ব্রহ্মা কে-ব্রহ্মার উৎপত্তি কাহিনী
মহাজন উপদেশ- ব্রহ্মার উৎপত্তি
গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভিপদ্ম থেকে ব্রহ্মার উৎপত্তি বা জন্ম। শ্বেতবরাহ কল্পে ইনি জন্মগ্রহণ করেন। ব্রহ্মাই সৃষ্টির আদি জীব। পদ্ম-উপরি উপবিষ্ট ব্রহ্মার চারটি মস্তক। অনন্তকোটি ব্র্রহ্মান্ড রয়েছে। প্রতি ব্রহ্মান্ডেই ব্রহ্মা রয়েছেন। শাস্ত্রে বর্ণিত আছে, বিশমাথা, পঞ্চাশমাথা, শতমাথা, সহস্রমাথা, লক্ষ মাথা ব্রহ্মা রয়েছেন। ব্রহ্মান্ড সমূহও ছোট বড় আকৃতির। আমাদের ব্রহ্মান্ডটি সবচেয়ে ছোট। আমাদের ব্রহ্মার চারটি মস্তক।
সৃষ্টির সমস্ত জীব থেকে ব্রহ্মা বয়োবৃদ্ধও। প্রথমে তিনি চিন্তা করলেন, “আমি কোথা থেকে এলাম। কেউ তো কোথাও নেই, কেবল আমি একা।” ভাবলেন এই পদ্মের নাল বেয়ে নিচে নামবেন কিনা। শেষ পর্যন্ত তিনি ধ্যানস্থ হয়ে তাঁর সৃষ্টির উৎস সম্বন্ধে সন্ধিৎসু হলেন।
বহু বর্ষ পরে ভগবান শ্রীহরি দর্শন দান করলেন। ব্রহ্মা ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার। সৃষ্টিকার্যে তিনি নিয়োজিত। ব্রহ্মা নিজ অঙ্গ থেকে মুনি ঋষি এবং মরীচি প্রমুখ প্রজাপতির সৃষ্টি করলেন। তিনি তাঁদের কাউকে তপস্যা আচরণে নির্দেশ দিলেন, কাউকে বা সাংসারিক কর্মে নিয়োজিত করলেন।
তারপর ব্রহ্মা চিন্তা করলেন আর নিজের থেকে এভাবে সৃষ্টি না করে নারী-পুরুষের মাধ্যমে সংসার সৃষ্টি হোক। তাঁর সংকল্প অনুসারে মানস পুত্ররূপে মনুকে এবং মনুর অর্ধাঙ্গিনীরূপে শতরূপাকে সৃষ্টি করলেন। তাঁরা মিলিত হয়ে প্রিয়ব্রত ও উত্তানপাদ নামে দুই পুত্র এবং আকুতি, প্রসুতি ও দেবহুতি নামে তিন কন্যার জন্ম দেন। তাঁদেরকে উপযুক্ত পাত্র-পাত্রীর হাতে সমর্পন করা হয়। ক্রমে ক্রমে ব্রহ্মার দ্বারাই সৃষ্টিকার্য ব্যাপকভাবে পরিচালিত হতে লাগল।
সৃষ্টি করবার জন্যে ভগবান ব্রহ্মাকে রজোগুণ দিয়েছিলেন। রজোগুণের মধ্যে রয়েছে সংকল্প, আগ্রহ ও প্রচেষ্টা। চতুর্মুখ ব্রহ্মা। রজোগুণপ্রভাবে স্থাবর জঙ্গম খেচুর জলচর উভচর প্রাণী প্রজাতির সৃষ্টি করলেন। নয় লক্ষ রকমের জলজ প্রাণী, কুড়ি লক্ষ রকমের গাছপালা, এগারো লক্ষ রকমের কীটপতঙ্গ, দশ লক্ষ রকমের পাখী, ত্রিশ লক্ষ রকমের পশু এবং চার লক্ষ রকমের মানুষ প্রজাতি সৃষ্টি করলেন।
একদিন ব্রহ্মা অহংকার বশতঃ মনে করলেন ‘আমিই সবকিছু করেছি। আমিই সমগ্র মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। আমিই ব্রহ্মান্ডের মালিক।’
শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে দ্বারকাতে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীব্রহ্মান্ডকে আহ্বান করলেন। ব্রহ্মা এসে পৌছালে কৃষ্ণের দ্বারপালগণ জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কোন ব্রহ্মা।’ ব্রহ্মা তখন বিস্মিত হয়ে বললেন, চতুর্মুখ ব্রহ্মা। তারপর সভাকক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন বহু বহু ব্রহ্মান্ড থেকে আগত অসংখ্য ব্রহ্মা সেখানে উপস্থিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণতি নিবেদন করছেন। আমাদের চতুর্মুখ ব্রহ্মা নিজেকে সবচেয়ে ছোট বলে অনুভব। শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেক ব্রহ্মার সঙ্গে কুশলবার্তা জিঙ্গাসা করে একে একে তাঁদের বিদায় দিলেন। তখন চতুর্মুখ ব্রহ্মার বিষন্ন মুখ দর্শন করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে ব্রহ্মা, বলুন আপনার কি অভিপ্রায়?
ব্রহ্মা বললেন, আমি বড় অভিমানী, আমি মনে করেছি আমি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। কিন্তু সেই মোহ আমার দূর হয়েছে, আমার চেয়েও অসংখ্য কোটি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি রয়েছেন, তা আমি এখন বুঝতে পারলাম। আমার এই চৌদ্দভুবন বিশিষ্ট ব্রহ্মান্ড ছাড়া আরও অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ড রয়েছে- এবার আমার সেই বুদ্ধি জন্মেছে। হে ভগবান, এখন আমি বুঝেছি যে, আমিই সবার চেয়ে ক্ষুদ্র, আমার চিন্তাধারা অতি তুচ্ছ। আপনি দয়া করে আমার সমস্ত অভিমান ও অহংকার দূর করুন এবং আমাকে আপনার চরণে শুদ্ধভক্তি প্রদান করুন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে ব্রহ্মা, অভিমান অহংকার যাতে না হয় সেজন্য এখানে আপনাকে আহ্বান করেছি, এখন আপনার মঙ্গল হোক। তারপর ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণকে প্রণতি নিবেদন করে আপন স্থান সত্যলোকে গমন করলেন।
একসময় নারদমুনি মন্দাকিনীর তটে তপস্যা করছিলেন। কিন্তু তিনি দৈববাণী শুনতে পেলেন- “শ্রীহরি যদি আরাধিত না হন, তবে তপস্যার কি দরকার? শ্রীহরি যদি আরাধিত হন, তবে তপস্যারও কি দরকার? শ্রীহরি যদি আরাধিত হন, তবে তপস্যারও কি দরকার।”
বৈববাণী শুনে নারদ শ্রীহরিস্মরণ করছিলেন, তখন পিতৃদেব ব্রহ্মাকে দেখতে পেলেন। ব্রহ্মাকে প্রণতি নিবেদন করে জলপূর্ণ নয়নে নারদ বললেন, এই দৈববাণীর অর্থ কি?
ব্রহ্মা বললেন, হে বৎস! যদি কোনও ব্যক্তি ভক্তি সহকারে শ্রীহরির আরাধনা করেন, তবে সেই ব্যক্তির তীর্থভ্রমণ, তপস্যার প্রয়োজন নেই। ভারতবর্ষে কৃষ্ণমন্ত্র-উপাসক জীবন্মুক্ত ব্যক্তির পক্ষে তপস্যার প্রয়োজন নেই। হে নারদ, শ্রীকৃষ্ণনামমন্ত্র গ্রহণ মাত্রেই তাঁর বংশের শত পুরুষ ও বন্ধুবান্ধবেরাও অনায়াসে পবিত্র হয়। শ্রীকৃষ্ণসেবা থেকে অন্য কোন ধর্ম বড় নয়, অন্য কোন তপস্যা শ্রেয় নয়। কৃষ্ণসেবা পরায়ণ ব্যক্তিদের তপস্যার পরিশ্রম অনাবশ্যক। হে পুত্র, শ্রীকৃষ্ণমন্ত্রে ব্রতী ব্যক্তিই মহা পবিত্র। তাঁর তীর্থস্থান, তাঁর বেদ অধ্যয়ন বিড়ম্বনা মাত্র।
হে বৎস, আগুন পবিত্র, নির্মল জল পবিত্র করেন, আর এঁরাও সাদরে কৃষ্ণভক্ত ব্যক্তির স্পর্শ বাঞ্চা করেন। বসুন্ধরা হরিভক্তের পদধূলি দ্বারা তৎক্ষণাৎ পবিত্র হন। হে নারদ, জানবে যে, এই ব্রহ্মান্ডে শ্রীকৃষ্ণসেবক অপেক্ষা কোন বস্তু বা কোনও ব্যক্তি অধিক পবিত্র নয়।
যে ব্যক্তি প্রতিদিন শ্রীকৃষ্ণপূজা করে এবং শ্রীকৃষ্ণচরণামৃত ও মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে, সেই মহা পবিত্র। হে নারদ, কৃষ্ণভক্ত যে বংশে জন্মগ্রহণ করে সেই বংশ পবিত্র হয়। জগতে যে ব্যক্তি কৃষ্ণভজনা করে না, তার তপস্যা, তার কর্মপ্রচেষ্টা তার পরিশ্রম বৃথা। গঙ্গাজল যেমন মদের বান্ডকে পবিত্র করতে পারে না, সেরকম বৈদিক কর্মকান্ডীয় যজ্ঞ, উপবাস, তপস্যা, ব্রত, দান, শুভকর্ম- এ সবই অভক্ত ব্যক্তিকে পবিত্র করতে পারে না।
শ্রীকৃষ্ণে যে ভক্তি-পরায়ণ নয়, সেই ব্যক্তি যদি তীর্থে স্নান করতে যায় তবে তীর্থ বিচলিত হন। বসুন্ধরা অভক্তের ভারে দুঃখে কম্পিত হয়ে থাকেন।
হে বৎস, শ্রীকৃষ্ণের কথাই বেদশাস্ত্রের সারবস্তু। যে মহাত্মা স্বপ্নে ও জাগরণে শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করেন, তিনি নিষ্পাপ হয়ে জগৎকে পবিত্র করেন, ভগবানের সুদর্শন চক্র সেই মহাত্মাকে সুরক্ষিত করেন। শ্রীকৃষ্ণের নিরন্তর স্মরণকারী ভক্ত অপেক্ষা আত্মা, প্রাণ, দেহ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, আমি, শিব তাঁর কাছে কিছুই প্রিয় নয়। পরমপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভক্তগত প্রাণ এবং ভক্তগণ হচ্ছেন কৃষ্ণগত প্রাণ। ভক্ত শ্রীকৃষ্ণকে ধ্যান করেন, শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের ধ্যান করেন।
আরও পড়ুনঃ হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার নিয়ম
হে নারদ, যারা শ্রীকৃষ্ণসেবা পরায়ণ নয়, তাদের জ্ঞান, তাদের তপস্যা, তাদের ব্রত, তাদের নিয়ম, তাদের তীর্থ স্নান, তাদের পুণ্যকর্ম সমস্তই নিষ্ফল। যারা ব্রহ্মণ, অথচ কৃষ্ণভক্ত নয়, তারা ধর্মভ্রষ্ট পতিত জীব। কৃষ্ণভক্তিহীন ব্রহ্মাণ অপেক্ষা স্বধর্মাচারশীল চন্ডাল, ম্লেচ্ছ এমনকি কুকুর- শুকরেররাও ভালো। হে নারদ, ধর্মহীন ব্রাহ্মণেরা যা আহার্যরূপে গ্রহণ করা উচিত নয়, সেইগুলিও তারা ভক্ষণ করে। প্রতিদিন বিপরীত ধর্মাচার দ্বারা তারা পতিত হয়ে চন্ডাল অপেক্ষাও অধম হয়।
নারদমুনি প্রশ্ন করলেন, হে পিতা, ব্রহ্মাণদের স্বধর্ম কি? তাঁদের ভক্ষ্য বস্তু কি? ব্রহ্মা বললেন, হে পুত্র, ব্রহ্মণদের নিরন্তর কৃষ্ণসেবন করাই স্বর্ধম। এই জন্যই অন্যান্য লোকেরা ব্রহ্মণকে সশ্রদ্ধ সম্মাণ জ্ঞাপন করে থাকে, ব্রহ্মণের উচ্ছিষ্ট ও পদধৌত জল পান করে থাকে। ব্রাহ্মণরা প্রতিদিন শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ নিবেদন করেন এবং শ্রীকৃষ্ণ-প্রসাদই তাঁদের আহার্য বস্তু।
আরও পড়ুনঃ রথযাত্রা অনুষ্ঠান কি? রথযাত্রার ইতিহাস
নারদমুনি প্রশ্ন করলেন, হে পিতা, ব্রহ্মাণরা যদি প্রত্যহ কৃষ্ণপ্রসাদ না গ্রহণ করে অন্য কোন খাদ্য গ্রহণ করে, তবে দোষ কি? ব্রহ্মা বললেন, পন্ডিতেরা সেই খাদ্যকে অখাদ্য বলে বর্ণনা করেন। সেই অন্ন বিষ্ঠা সম, সেই পানীয় মুত্র সম হয়। কোল ভীল ম্লেচ্ছ চন্ডালেরা ভগবানকে অনিবেদিত অন্ন, রক্তমাংস জাতীয় অমেধ্য বস্তু ভক্ষণ করে থাকে, কিন্তু ব্রাহ্মণ যদি সেই বস্তু ভক্ষণ করে তবে চন্ডালাধম বলে গণ হয়।
হে নারদ, এখন আমি তোমাকে যে নির্দেশ দিতে ইচ্ছা করছি, তা হল এই, কৃষ্ণভক্ত শিবকে গুরুরূপে গ্রহণ করে অচিরেই কৃষ্ণদাস্য ভক্তি লাভ কর। তোমার এরকম নির্জনে বসে তপস্যা করার দরকার নেই। শ্রীকৃষ্ণভক্তিই দুঃখময় সংসার-সমুদ্র উত্তীর্ণ হবার নৌকা স্বরূপ। গুরুদেব সেখানে কর্ণধার স্বরূপ। হে নারদ, তুমি যে-দৈববাণী শুনেছিলে, দেবী সরস্বতীই তোমার উদ্দেশ্যে এই কথা বলে প্রস্থান করেছেন।
শ্রীব্রহ্মা যখন নারদকে এই সমস্ত কথা বলছিলেন, তখন ব্রহ্মার পুত্র সনৎকুমার বললেন, হে পিতা, আমি কোনও কথা বুঝতে পারিনি, দয়া করে আমাকে পুনরায় বলুন। শ্রীকৃষ্ণকে যে আরাধনা করেছে তার আর তপস্যা করা অনর্থক এবং যে শ্রীকৃষ্ণকে আরাধনা করেনি তারও তপস্যা ব্যর্থ হয়, যদি এই দুই জনই তপস্যারহিত হয়, তবে তপস্যার স্থান কি ধরনের লোকের প্রতি নির্দিষ্ট থাকল?
ব্রহ্মা বললেন, হে বুদ্ধিমান, তোমাকে পুত্ররূপে পেয়ে আমার জীবন ধন্য। ‘আরাধিত’ কথাটিতে আ অর্থ বিশেষরূপে ‘রাধিত’ শব্দটি প্রাপ্তবাচক হয়। অতএব যিনি শ্রীহরিকে প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁর তপস্যার প্রয়োজন নেই। কোনও মূঢ় ব্যক্তি, যখন শ্রীকৃষ্ণকে বিমুখ, তার তীর্থ, দান, তপস্যা, পুণ্য, ব্রত তাকে পবিত্র করতে পারে না।
সনৎকুমার জানতে চাইলেন, হে পিতা, কোন ধরনের ব্যক্তি তপস্যা করবে? ব্রহ্মা বললেন, যে ব্যক্তি মূঢ়তম, কিংবা, যে ব্যক্তি সর্বোৎকৃষ্ট ভক্তিলাভ করেছে, এই উভয় ব্যক্তিই সুখী। তাদের তপস্যা করার দরকার নেই। কিন্তু মধ্যম ব্যক্তিরা যারা গৃহস্থ সাধক, সংসারে ব্যাপৃত থেকে পূর্ব কর্মের ফলভোগে অনুরাগী হয়ে অভীস্পিত শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম পাওয়ার বাসনায় তারা তপস্যা করে।
সনৎকুমার প্রশ্ন করলেন, হে পিতা, তারা কিরকম তপস্যা করবে? ব্রহ্মা বললেন, শ্রীকৃষ্ণের সেবা, শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান, শ্রীকৃষ্ণের নাম জপ- কীর্তন, শ্রীকৃষ্ণের চরণামৃত ও মহাপ্রসাদ সেবন করািই সকলের বাঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
-হে পিতা, অধিকাংশ লোকেরই তা হলে শ্রীকৃষ্ণভক্তিমূলক তপস্যার প্রয়োজন আছে। তবুও আমার জানতে ইচ্ছা হয় যে, সংসারের সব লোক কৃষ্ণভজন করে না কেন?
আরও পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা, কৃষ্ণলীলা কাহিনী
- হে বৎস, যার বুদ্ধি পূর্বজন্মকৃত কর্মদোষে মন্দ হয়েছে এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে গুরুরূপে গ্রহণ করেছে, তারা তমোগুণের অধীন হয়ে থাকে। তার ফলে তারা ত্রিগেুণের অতীত ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না, এমনকি জানতেও আগ্রহ থাকে না। সংসারের সেই সব লোক তাই কৃষ্ণভজন করবে না।
-হে পিতা, তা হলে সংসারের সেই সব কৃষ্ণবিমুখ লোকদের কিভাবে সদগতি হবে?
-হে পুত্র, অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে, সাধুসঙ্গক্রমে কিংবা সৌভাগ্যক্রমে কেউ যদি অপ্রসাদভোজী না হয়ে কৃষ্ণপ্রসাদভোজী হয়, তা হলে, তার হৃদয়ে সমস্ত পাপ ক্ষয় হবে, সে দেহত্যাগের পর দিব্যরথে করে গোলোক কিংবা উৎকৃষ্ট কোনও গ্রহলোকে স্বেচ্ছামতো গমন করতে সমর্থ হবে।
একদিন ব্রহ্মা অহংকার বশতঃ মনে করলেন ‘আমিই সবকিছু করেছি। আমিই সমগ্র মহাবিশ্বের সৃষ্টিকর্তা। আমিই ব্রহ্মান্ডের মালিক।’
শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত আছে দ্বারকাতে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীব্রহ্মান্ডকে আহ্বান করলেন। ব্রহ্মা এসে পৌছালে কৃষ্ণের দ্বারপালগণ জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কোন ব্রহ্মা।’ ব্রহ্মা তখন বিস্মিত হয়ে বললেন, চতুর্মুখ ব্রহ্মা। তারপর সভাকক্ষে প্রবেশ করে দেখলেন বহু বহু ব্রহ্মান্ড থেকে আগত অসংখ্য ব্রহ্মা সেখানে উপস্থিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে প্রণতি নিবেদন করছেন। আমাদের চতুর্মুখ ব্রহ্মা নিজেকে সবচেয়ে ছোট বলে অনুভব। শ্রীকৃষ্ণ প্রত্যেক ব্রহ্মার সঙ্গে কুশলবার্তা জিঙ্গাসা করে একে একে তাঁদের বিদায় দিলেন। তখন চতুর্মুখ ব্রহ্মার বিষন্ন মুখ দর্শন করে শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে ব্রহ্মা, বলুন আপনার কি অভিপ্রায়?
ব্রহ্মা বললেন, আমি বড় অভিমানী, আমি মনে করেছি আমি সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি। কিন্তু সেই মোহ আমার দূর হয়েছে, আমার চেয়েও অসংখ্য কোটি শ্রেষ্ঠ ব্যক্তি রয়েছেন, তা আমি এখন বুঝতে পারলাম। আমার এই চৌদ্দভুবন বিশিষ্ট ব্রহ্মান্ড ছাড়া আরও অনন্তকোটি ব্রহ্মান্ড রয়েছে- এবার আমার সেই বুদ্ধি জন্মেছে। হে ভগবান, এখন আমি বুঝেছি যে, আমিই সবার চেয়ে ক্ষুদ্র, আমার চিন্তাধারা অতি তুচ্ছ। আপনি দয়া করে আমার সমস্ত অভিমান ও অহংকার দূর করুন এবং আমাকে আপনার চরণে শুদ্ধভক্তি প্রদান করুন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, হে ব্রহ্মা, অভিমান অহংকার যাতে না হয় সেজন্য এখানে আপনাকে আহ্বান করেছি, এখন আপনার মঙ্গল হোক। তারপর ব্রহ্মা শ্রীকৃষ্ণকে প্রণতি নিবেদন করে আপন স্থান সত্যলোকে গমন করলেন।
একসময় নারদমুনি মন্দাকিনীর তটে তপস্যা করছিলেন। কিন্তু তিনি দৈববাণী শুনতে পেলেন- “শ্রীহরি যদি আরাধিত না হন, তবে তপস্যার কি দরকার? শ্রীহরি যদি আরাধিত হন, তবে তপস্যারও কি দরকার? শ্রীহরি যদি আরাধিত হন, তবে তপস্যারও কি দরকার।”
বৈববাণী শুনে নারদ শ্রীহরিস্মরণ করছিলেন, তখন পিতৃদেব ব্রহ্মাকে দেখতে পেলেন। ব্রহ্মাকে প্রণতি নিবেদন করে জলপূর্ণ নয়নে নারদ বললেন, এই দৈববাণীর অর্থ কি?
ব্রহ্মা বললেন, হে বৎস! যদি কোনও ব্যক্তি ভক্তি সহকারে শ্রীহরির আরাধনা করেন, তবে সেই ব্যক্তির তীর্থভ্রমণ, তপস্যার প্রয়োজন নেই। ভারতবর্ষে কৃষ্ণমন্ত্র-উপাসক জীবন্মুক্ত ব্যক্তির পক্ষে তপস্যার প্রয়োজন নেই। হে নারদ, শ্রীকৃষ্ণনামমন্ত্র গ্রহণ মাত্রেই তাঁর বংশের শত পুরুষ ও বন্ধুবান্ধবেরাও অনায়াসে পবিত্র হয়। শ্রীকৃষ্ণসেবা থেকে অন্য কোন ধর্ম বড় নয়, অন্য কোন তপস্যা শ্রেয় নয়। কৃষ্ণসেবা পরায়ণ ব্যক্তিদের তপস্যার পরিশ্রম অনাবশ্যক। হে পুত্র, শ্রীকৃষ্ণমন্ত্রে ব্রতী ব্যক্তিই মহা পবিত্র। তাঁর তীর্থস্থান, তাঁর বেদ অধ্যয়ন বিড়ম্বনা মাত্র।
হে বৎস, আগুন পবিত্র, নির্মল জল পবিত্র করেন, আর এঁরাও সাদরে কৃষ্ণভক্ত ব্যক্তির স্পর্শ বাঞ্চা করেন। বসুন্ধরা হরিভক্তের পদধূলি দ্বারা তৎক্ষণাৎ পবিত্র হন। হে নারদ, জানবে যে, এই ব্রহ্মান্ডে শ্রীকৃষ্ণসেবক অপেক্ষা কোন বস্তু বা কোনও ব্যক্তি অধিক পবিত্র নয়।
যে ব্যক্তি প্রতিদিন শ্রীকৃষ্ণপূজা করে এবং শ্রীকৃষ্ণচরণামৃত ও মহাপ্রসাদ গ্রহণ করে, সেই মহা পবিত্র। হে নারদ, কৃষ্ণভক্ত যে বংশে জন্মগ্রহণ করে সেই বংশ পবিত্র হয়। জগতে যে ব্যক্তি কৃষ্ণভজনা করে না, তার তপস্যা, তার কর্মপ্রচেষ্টা তার পরিশ্রম বৃথা। গঙ্গাজল যেমন মদের বান্ডকে পবিত্র করতে পারে না, সেরকম বৈদিক কর্মকান্ডীয় যজ্ঞ, উপবাস, তপস্যা, ব্রত, দান, শুভকর্ম- এ সবই অভক্ত ব্যক্তিকে পবিত্র করতে পারে না।
শ্রীকৃষ্ণে যে ভক্তি-পরায়ণ নয়, সেই ব্যক্তি যদি তীর্থে স্নান করতে যায় তবে তীর্থ বিচলিত হন। বসুন্ধরা অভক্তের ভারে দুঃখে কম্পিত হয়ে থাকেন।
হে বৎস, শ্রীকৃষ্ণের কথাই বেদশাস্ত্রের সারবস্তু। যে মহাত্মা স্বপ্নে ও জাগরণে শ্রীকৃষ্ণের চিন্তা করেন, তিনি নিষ্পাপ হয়ে জগৎকে পবিত্র করেন, ভগবানের সুদর্শন চক্র সেই মহাত্মাকে সুরক্ষিত করেন। শ্রীকৃষ্ণের নিরন্তর স্মরণকারী ভক্ত অপেক্ষা আত্মা, প্রাণ, দেহ, লক্ষ্মী, সরস্বতী, আমি, শিব তাঁর কাছে কিছুই প্রিয় নয়। পরমপ্রভু শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন ভক্তগত প্রাণ এবং ভক্তগণ হচ্ছেন কৃষ্ণগত প্রাণ। ভক্ত শ্রীকৃষ্ণকে ধ্যান করেন, শ্রীকৃষ্ণ ভক্তের ধ্যান করেন।
আরও পড়ুনঃ হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার নিয়ম
হে নারদ, যারা শ্রীকৃষ্ণসেবা পরায়ণ নয়, তাদের জ্ঞান, তাদের তপস্যা, তাদের ব্রত, তাদের নিয়ম, তাদের তীর্থ স্নান, তাদের পুণ্যকর্ম সমস্তই নিষ্ফল। যারা ব্রহ্মণ, অথচ কৃষ্ণভক্ত নয়, তারা ধর্মভ্রষ্ট পতিত জীব। কৃষ্ণভক্তিহীন ব্রহ্মাণ অপেক্ষা স্বধর্মাচারশীল চন্ডাল, ম্লেচ্ছ এমনকি কুকুর- শুকরেররাও ভালো। হে নারদ, ধর্মহীন ব্রাহ্মণেরা যা আহার্যরূপে গ্রহণ করা উচিত নয়, সেইগুলিও তারা ভক্ষণ করে। প্রতিদিন বিপরীত ধর্মাচার দ্বারা তারা পতিত হয়ে চন্ডাল অপেক্ষাও অধম হয়।
নারদমুনি প্রশ্ন করলেন, হে পিতা, ব্রহ্মাণদের স্বধর্ম কি? তাঁদের ভক্ষ্য বস্তু কি? ব্রহ্মা বললেন, হে পুত্র, ব্রহ্মণদের নিরন্তর কৃষ্ণসেবন করাই স্বর্ধম। এই জন্যই অন্যান্য লোকেরা ব্রহ্মণকে সশ্রদ্ধ সম্মাণ জ্ঞাপন করে থাকে, ব্রহ্মণের উচ্ছিষ্ট ও পদধৌত জল পান করে থাকে। ব্রাহ্মণরা প্রতিদিন শ্রীকৃষ্ণকে ভোগ নিবেদন করেন এবং শ্রীকৃষ্ণ-প্রসাদই তাঁদের আহার্য বস্তু।
আরও পড়ুনঃ রথযাত্রা অনুষ্ঠান কি? রথযাত্রার ইতিহাস
নারদমুনি প্রশ্ন করলেন, হে পিতা, ব্রহ্মাণরা যদি প্রত্যহ কৃষ্ণপ্রসাদ না গ্রহণ করে অন্য কোন খাদ্য গ্রহণ করে, তবে দোষ কি? ব্রহ্মা বললেন, পন্ডিতেরা সেই খাদ্যকে অখাদ্য বলে বর্ণনা করেন। সেই অন্ন বিষ্ঠা সম, সেই পানীয় মুত্র সম হয়। কোল ভীল ম্লেচ্ছ চন্ডালেরা ভগবানকে অনিবেদিত অন্ন, রক্তমাংস জাতীয় অমেধ্য বস্তু ভক্ষণ করে থাকে, কিন্তু ব্রাহ্মণ যদি সেই বস্তু ভক্ষণ করে তবে চন্ডালাধম বলে গণ হয়।
হে নারদ, এখন আমি তোমাকে যে নির্দেশ দিতে ইচ্ছা করছি, তা হল এই, কৃষ্ণভক্ত শিবকে গুরুরূপে গ্রহণ করে অচিরেই কৃষ্ণদাস্য ভক্তি লাভ কর। তোমার এরকম নির্জনে বসে তপস্যা করার দরকার নেই। শ্রীকৃষ্ণভক্তিই দুঃখময় সংসার-সমুদ্র উত্তীর্ণ হবার নৌকা স্বরূপ। গুরুদেব সেখানে কর্ণধার স্বরূপ। হে নারদ, তুমি যে-দৈববাণী শুনেছিলে, দেবী সরস্বতীই তোমার উদ্দেশ্যে এই কথা বলে প্রস্থান করেছেন।
শ্রীব্রহ্মা যখন নারদকে এই সমস্ত কথা বলছিলেন, তখন ব্রহ্মার পুত্র সনৎকুমার বললেন, হে পিতা, আমি কোনও কথা বুঝতে পারিনি, দয়া করে আমাকে পুনরায় বলুন। শ্রীকৃষ্ণকে যে আরাধনা করেছে তার আর তপস্যা করা অনর্থক এবং যে শ্রীকৃষ্ণকে আরাধনা করেনি তারও তপস্যা ব্যর্থ হয়, যদি এই দুই জনই তপস্যারহিত হয়, তবে তপস্যার স্থান কি ধরনের লোকের প্রতি নির্দিষ্ট থাকল?
ব্রহ্মা বললেন, হে বুদ্ধিমান, তোমাকে পুত্ররূপে পেয়ে আমার জীবন ধন্য। ‘আরাধিত’ কথাটিতে আ অর্থ বিশেষরূপে ‘রাধিত’ শব্দটি প্রাপ্তবাচক হয়। অতএব যিনি শ্রীহরিকে প্রাপ্ত হয়েছেন, তাঁর তপস্যার প্রয়োজন নেই। কোনও মূঢ় ব্যক্তি, যখন শ্রীকৃষ্ণকে বিমুখ, তার তীর্থ, দান, তপস্যা, পুণ্য, ব্রত তাকে পবিত্র করতে পারে না।
সনৎকুমার জানতে চাইলেন, হে পিতা, কোন ধরনের ব্যক্তি তপস্যা করবে? ব্রহ্মা বললেন, যে ব্যক্তি মূঢ়তম, কিংবা, যে ব্যক্তি সর্বোৎকৃষ্ট ভক্তিলাভ করেছে, এই উভয় ব্যক্তিই সুখী। তাদের তপস্যা করার দরকার নেই। কিন্তু মধ্যম ব্যক্তিরা যারা গৃহস্থ সাধক, সংসারে ব্যাপৃত থেকে পূর্ব কর্মের ফলভোগে অনুরাগী হয়ে অভীস্পিত শ্রীকৃষ্ণের পাদপদ্ম পাওয়ার বাসনায় তারা তপস্যা করে।
সনৎকুমার প্রশ্ন করলেন, হে পিতা, তারা কিরকম তপস্যা করবে? ব্রহ্মা বললেন, শ্রীকৃষ্ণের সেবা, শ্রীকৃষ্ণের ধ্যান, শ্রীকৃষ্ণের নাম জপ- কীর্তন, শ্রীকৃষ্ণের চরণামৃত ও মহাপ্রসাদ সেবন করািই সকলের বাঞ্চিত শ্রেষ্ঠ ধর্ম।
-হে পিতা, অধিকাংশ লোকেরই তা হলে শ্রীকৃষ্ণভক্তিমূলক তপস্যার প্রয়োজন আছে। তবুও আমার জানতে ইচ্ছা হয় যে, সংসারের সব লোক কৃষ্ণভজন করে না কেন?
আরও পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা, কৃষ্ণলীলা কাহিনী
- হে বৎস, যার বুদ্ধি পূর্বজন্মকৃত কর্মদোষে মন্দ হয়েছে এবং অনুপযুক্ত ব্যক্তিকে গুরুরূপে গ্রহণ করেছে, তারা তমোগুণের অধীন হয়ে থাকে। তার ফলে তারা ত্রিগেুণের অতীত ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে জানতে পারে না, এমনকি জানতেও আগ্রহ থাকে না। সংসারের সেই সব লোক তাই কৃষ্ণভজন করবে না।
-হে পিতা, তা হলে সংসারের সেই সব কৃষ্ণবিমুখ লোকদের কিভাবে সদগতি হবে?
-হে পুত্র, অজ্ঞানে বা সজ্ঞানে, সাধুসঙ্গক্রমে কিংবা সৌভাগ্যক্রমে কেউ যদি অপ্রসাদভোজী না হয়ে কৃষ্ণপ্রসাদভোজী হয়, তা হলে, তার হৃদয়ে সমস্ত পাপ ক্ষয় হবে, সে দেহত্যাগের পর দিব্যরথে করে গোলোক কিংবা উৎকৃষ্ট কোনও গ্রহলোকে স্বেচ্ছামতো গমন করতে সমর্থ হবে।
আরও পড়ুন
* মহাজন উপদেশ-শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ
*মহাজন উপদেশ-শ্রী যমরাজ
* চানক্য পন্ডিতের অমূল্য বাণী যা আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে
* মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী
* চানক্য পন্ডিতের অমূল্য বাণী যা আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে
* মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী
জয় শ্রিহরি