যমরাজের কাহিনী, যমরাজ কে?

জম রাজের কাহিনী

মহাজন উপদেশ-শ্রীযমরাজ

সমস্ত জীবের ধর্ম-অধর্মের বিচারক যমরাজ। তিনি সূর্যদেবের পুত্র। তিনি নরকলোকের অধিপতি। পৃথিবী থেকে ৭ লক্ষ ৯২ হাজার মাইল নীচে নরক নামক গ্রহলোক অবস্থিত। নরক গ্রহের সংযমনী নামক যমপুরী রয়েছে। যমরাজের প্রধান হিসাবরক্ষকের নাম চিত্রগুপ্ত। মাত্র কয়েক মিনিটের মধ্যেই যমরাজের দূতেরা পৃথিবীতে ত্যক্তদেহ পাপাত্মাদের যমপুরীতে টেনে নিয়ে যায়। 

প্রাচীনকালে কানপুরের কাছে কনৌজ নামক স্থানে অজামিল নাকম এক ব্যক্তি দেহত্যাগ করলে যমদূতেরা তাকে পাশবদ্ধ করে নিয়ে যেতে উদ্যত হল। চারজন বিষ্ণুদূত এসে তাদের তীব্রভাবে বাধা প্রদান করেন। পাপাচারী অজামিলকে যমের বিধানে শাস্তি প্রদানের জন্য যমদূতেরা নিয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু সমস্ত পাপ ক্ষমা করে দিয়ে বিষ্ণুদূতেরা যমদূতদের বিতাড়িত করেছিলেন। যমদূতদের কাছে তা এক বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছিল। তাই বিষ্ণুদূতদের দ্বারা পরাভূত হয়ে যমদূতেরা সংযমনীপুরীর অধীশ্বর যমরাজের কাছে গিয়ে প্রশ্ন করেছিল-

হে প্রভূ, এই জগতের শাসনকর্তা কয়জন? বিচারকর্তা কয়জন? বিচারকর্তা কয়জন? যদি বহুজন থাকে, তবে তাদের পরস্পরের বিরোধী অভিমত থাকতে পারে। ফলে, কে দেন্ডনীয় হবে, কে পুরস্কৃত হবে, তা তো বোঝা দায় হবে। প্রীল প্রভুপাদ উল্লেখ করেছিলেন, বিচারক এবং তাঁদের বিচার অবশ্যই নির্ভুল ও বিরোধ-বর্জিত হওয়া কর্তব্য। প্রকৃতপক্ষে, অজামিলের ব্যাপারে যমরাজের অবস্থা বেশ অপ্রতিত ছিল, কারণ যমদুতদের অজামিলকে গ্রেপ্তার করার প্রচেষ্টা ন্যায়সঙ্গত ছিল, কিন্তু বিষ্ণুদূতেরা তাদের নিরস্ত করেন। এই অবস্থায় যমরাজ যদিও বিষ্ণুদূত ও যমদূত উভয়ের দ্বারাই অভিযুক্ত হয়েছেন, তবুও তাঁর বিচার সম্পূর্ণরূপে ক্রুটিহীন, কারণ তিনি ভগবানের প্রতিনিধিত্ব করছেন। (ইউকিপিডিয়া)


যমদূতেরা যমরাজকে বলছিল, আমরা জানতাম, আপনি সর্বোচ্চ বিচারক, সমস্ত দেবতাও আপনার অধীন। সমস্ত জীবের আপনি অধীশ্বর। আপনিই সমস্ত মানুষের পাপ-পুণ্যের একমাত্র বিচারকর্তা। কিন্তু এখন আপনার বিহিত দন্ড আর কার্যকরী হচ্ছে না। চারজন সিদ্ধপুরুষ আপনার আদেশ সংঘন করছেন। আমরা আপনার আদেশে পাপী অজামিলকে পাশবদ্ধ করে নিয়ে আসছিলাম অমনি সেই অদ্ভুত দর্শন সিদ্ধপুরুষেরা তার পাশবন্ধন ছেদন করে তাকে মুক্ত করে দিয়েছেন। আরও অজামিলকে তারা আশ্বাস দিয়েছেন যে, ‘ভয় করো না।’ হে প্রভু! তারা কে? দয়া করে তাদের পরিচিতি বলুন।

যমরাজ তাঁর দূতদের বলতে লাগলেন, যদিও তোমরা আমাকেই সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে কর, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আমারও উর্ব্ধে পরমনিয়ন্তা রয়েছেন। স্বর্গরাজ ইন্দ্র থেকে শুরু করে সমস্ত দেবতা, এমনকি এই ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি স্থিতি ও বিনাশের যাঁরা অধ্যক্ষ সেই ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিব যাঁর অংশ তিনি হলেন পরমেশ্বর ভগবান। পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন স্বয়ং সম্পূর্ণ ও স্বাধীন। তিনিই সকলের অধীশ্বর। তোমরা যাদেরকে দর্শন করে এসেছ, তারাও দুর্লভ দর্শন। বিষ্ণু আমার নিয়ন্তা। বিষ্ণুদুতেরাও আমার ঊর্ধ্বে। তাই বিষ্ণুদুতেরা যাদের রক্ষা করেন, তোমরা তাদেরকে স্পর্শও করতে পারো না।

দূত- বিষ্ণুদূতেরা কাদেরকে রক্ষা করেন?
যমরাজ- যারা ভগবদভক্তি অনুশীলন করে।
দূত-অজামিল তো অভক্ত, পাপাচারী?
যমরাজ-অজামিল মরণকালে ‘নারায়ণ’ এই ভগবানের নাম কীর্তন করেছে। মরণকালে ভগবানের নাম স্মরণ করতে পারলে তাকে তোমরা আর নরকে আনতে পারবে না। তাকে বিষ্ণুদূতেরা বৈকুন্ঠে নিয়ে যাবে।
দূত- মনুষ্য সমাজের প্রকৃত ধর্ম কি?
যমরাজ- পরমেশ্বর ভগবানের দিব্য নাম কীর্তন থেকে শুরু হয় যে ভক্তিযোগ, তা-ই মানব-সমাজে জীবের পরম ধর্ম।

হে ভৃত্যগণ, ভগবানের পবিত্র নামের মাহাত্ম্য দেখো। মহাপাপী অজামিল তার পুত্রকে সম্বোধন করে, অজ্ঞাতসারে, এই নাম গ্রহণ করার ফলে নারায়ণ-স্মৃতির উদয় হয়। তৎক্ষণাৎ সে মৃত্যুপাশ থেকে মুক্ত হয়।

তোমরা জানবে যে, ভগবানের নাম, গুণ এবং কর্মের কীর্তনের ফলে জড়জাগতিক বিষয়ী লোকের নাম গুণ ও কর্মের কথা করে থাকে। কিন্তু ভগবানের নাম গুণ কীর্তন হল পাপমোচনের জন্য একমাত্র উপদিষ্ট পন্থা। নিরপরাধে কেউ যদি ভগবানের নাম উচ্চারণ করে, তা হলে সেই উচ্চারণ অশুদ্ধ হলেও সে ভববন্ধন থেকে মুক্ত হবে। অজামিল পাপী হলেও মৃত্যুকালে তার পুত্রকে ‘নারায়ণ’ বলে সম্বোধন করে, সেই নাম উচ্চারণের ফলে, পূর্ণরূপে মুক্ত হতে পেরেছে।


আরও পড়ুনঃ হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার নিয়ম

হে ভৃত্যগণ, ভগবানের মায়াতে মোহিত হওয়ার ফলে যাজ্ঞবল্ক্য, জেমিনি প্রমুখ ধর্মশাস্ত্র প্রণেতাগণ ভাগবত ধর্মের রহস্য জানতে পারেননি। দ্বাদশ মহাজন ধর্মের প্রকৃত তত্ত্ব জানেন- (১) ব্রহ্মা, (২) নারদ, (৩) শিব, (৪) চতুস্কুমার, (৫) দেবহুতি পুত্র কপিল, (৬) স্বায়ম্ভুব মনু, (৭) প্রহ্লাদ মহারাজ, (৮) রাজর্ষি জনক, (৯) গঙ্গাপুত্র ভীষ্ম, (১০) দৈতরাজ বলি, (১১) শুকদেব গোস্বামী এবং (১২) আমি যম।


আসল ধর্ম হচ্ছে ভাগবত ধর্ম। এটা যে জানে না, সে ভগবদভক্তি অনুষ্ঠান বা হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনের দিব্য মহিমা বুঝবে না। ভাগবত ধর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞ মুনিঋষিরা বিশেষত যজুর্বেদ, সামবেদ ও ঋকবেদে বর্ণিত কর্মকান্ডীয় অনুষ্ঠানের প্রতি আকৃষ্ট। তাই তাদের বুদ্ধি জড়ীভূত হয়ে অনিত্য ফল লাভের জন্য কর্ম অনুষ্ঠানের উপকরণ সংগ্রহেই ব্যক্ত। তারা হরিনাম সংকীর্তন আন্দোলনের প্রতি আকৃষ্ট হওয়ার পরিবর্তে ধন-অর্থ-কাম ও মোক্ষের প্রতিই আগ্রহশীল।

অতএব, যারা বুদ্ধিমান মানুষ, তারা এই সমস্ত বিষয় বিবেচনা করে সর্বান্তঃকরণে সমস্ত মঙ্গলময় গুণের আকর সর্বান্তর্যামী ভগবানের পবিত্র নামকীর্তন রূপ ভগবদ্ভক্তির পন্থা অবলম্বন করে। এই পন্থা দ্বারা তাদের সমস্ত সমস্যার সমাধান বিবেচনা করে। এই ধরনের ব্যক্তিরা আমার দন্ডার্হ নয়। সাধারণতঃ তারা কোন পাপকর্ম করে না। কিন্তু কেউ যদি ভ্রম, প্রমাদ বা মোহবশত কখনও কোনও পাপ করে, তবুও সে নিরন্তর হরিনাম কীর্তন করার ফলে সেই পাপ থেকে রক্ষা পেয়ে যায়।

হে দূতগণ, তোমরা কখনও ভগবানের ভক্তদের কাছে যাবে না। কারণ তাঁরা সর্বতোভাবে ভগবানের পাদপদ্মে শরণাগত। পৃথিবীতে যে মানুষেরা ভক্ত, তাঁদের গুণগাথা স্বর্গের দেবতারা, সিদ্ধরা গান করেন। তোমরা কখনও তাঁদের কাছে যাবে না।

হে দূতগণ, ভক্তরা জড়সুখ ভোগের প্রতি আসক্ত নয়, তাঁরা সর্বদা ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের মধু পান করেন। যে ব্যক্তিরা সেই ভক্তদের সঙ্গ করে না, কৃষ্ণপাদপদ্ম- অমৃত পানে যার কোনও ইচ্ছা নেই, যারা কেবলমাত্র মৈথুন সুখ উপভোগের জন্য গৃহস্থ জীবনের প্রতি আসক্ত, সেই সমস্ত ব্যক্তিদেরকে আমার কাছে দন্ডভোগের জন্য নিয়ে এসো।

হে ভৃত্যগণ, সেই সমস্ত পাপীদেরকে আমার কাছে নিয়ে আসবে, (১) যাদের জিহ্বা শ্রীকৃষ্ণের নাম, গুণ ইত্যাদি কীর্তন করে না। (২) যাদের চিত্ত শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্ম স্মরণ করে না। (৩) যাদের মস্তক একবারও শ্রীকৃষ্ণের চরণকমলে প্রণত হয় না। (৪) যারা বৈষ্ণবব্রত অনুষ্ঠান করে না।


শ্রীল প্রভুপাদ বলেছেন, যদিও যমরাজ অপরাধের অতীত, তবুও তাঁর অনুমতিক্রমে তাঁর সেবকেরা অজামিলকে গ্রেপ্তার করতে গিয়েছিল, যার ফলে এক মহা অপরাধ হয়েছিল। ন্যায়-শাস্ত্র অনুসারে ভৃত্য যদি কোন ভুল করে তা হলে তার প্রভুকে সেই জন্য দায়ী হতে হয়। যমরাজ সেই নীতি অনুসারে নিজেকে অপরাধী বলে মনে করে, ভৃত্যগণ সহ কৃতাঞ্জলিপুটে তিনি ভগবান শ্রীহরির কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছিলেন।


আরও পড়ুনঃ  হিন্দু ধর্মে স্বর্গ ও নরক, নরক কত প্রকার ও কি কি?

যমরাজ বলেছিলেন, হে পুরাণপুরুষ, দয়া করে আপনি আমাদের ক্ষমা করুন। অজ্ঞানতাবশত আমরা অজামিলকে আপনার ভৃত্য বলে চিনতে পারিনি এবং তার ফলে আমরা অবশ্যই এক মহা অপরাধ করেছি। তাআ আমরা আপনার কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করছি। হে ভগবান, যেহেতু আপনি সমস্ত সদগুণ-সমন্বিত, তাই দয়া করে আমাদের ক্ষমা করুন। আমরা আপনাকে আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url