কিভাবে প্রকৃত আনন্দ ও শান্তি লাভ করা যায়
কি করলে জীবনে প্রকৃত সুখ, শান্তি ও আনন্দ লাভ করা যায়
১৯৬৮ সালের সেপ্টেম্বরে, ওয়াশিংটনের সিয়াটেলে প্রদত্ত এক ভাষণে শ্রীল প্রভুপাদ আমরা কিভাবে জীবনে প্রকৃত শান্তি লাভ করতে পারি সেই সম্বন্ধে বলেন, “এই সভায় যারা উপস্থিত রয়েছেন তাদের মধ্যে এমন কেউ বলতে পারবেন যে, তিনি কারো না কারো বা কোনকিছুর সেবক নন? না কেননা আমাদের স্বাভাবিক, স্বভাবগত অবস্থাই হচ্ছে সেবা করা।”
তখন তিনি তাঁর অধিকাংশ শ্রোতাদের মধ্যে একটি নতুন ধারণা উপস্থাপন করেনঃ “যদি আপনারা শ্রীকৃষ্ণের সেবা করতে সম্মত হন, ক্রমে ক্রমে আপনারা উপলব্ধি করবেন যে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণও আপনাদের সেবা করছেন।” শ্রীল প্রভুপাদ ব্যাখ্যা করেন, কিভাবে কৃষ্ণকে সন্তুষ্ট করার মাধ্যমে আত্মা অসীম আনন্দ উপভোগ করতে পারে ।
এই জড় জগতে প্রত্যেকেই দুঃখ থেকে অব্যাহতি পাওয়ার এবং সুখ সন্ধান করার চেষ্টা করছে। আমাদের জড় অস্তিত্বের ফলে তিন রকমের দুঃখের উদ্ভব হয় আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক এবং আধিদৈবিক, আধ্যাত্মিক দুঃখগুলো হচ্ছে সেইগুলো যা দেহ ও মন দ্বারা উৎপন্ন হয়।
দৃষ্টাত্তস্বরূপ, যখন দেহের মধ্যে বিভিন্ন বিপাকক্রিয়ায় কোন গোলযোগ দেখা দেয়, আমরা তখন কষ্ট অনুভব করি, অথবা আমাদের জ্বর হয়। আর এক ধরনের আধ্যাত্মিক দুঃখ উৎপন্ন হয় মনের দ্বারা। মনে করুন, আমার অত্যস্ত প্রিয়জন এমন কাউকে আমি হারালাম। তখন আমার মন অত্যন্ত বিচলিত হবে। সেটিও দুঃখভোেগ। সুতরাং, দেহের রোগ এবং মানসিক কষ্টগুলো হচ্ছে আধ্যাত্মিক দুঃখ ।
এরপরে রয়েছে আধিভৌতিক দুঃখ, অন্যান্য জীবের থেকে উদ্ভূত দুঃখ । দৃষ্টাত্ত স্বরূপ, মানুষ প্রতিদিন লক্ষ লক্ষ হতভাগ্য পশুকে কসাইখানায় প্রেরণ করছে । পশুরা তাদের মনের ভাব ব্যক্ত করতে পারেনা, কিন্তু তারা তীব্র যন্ত্রণাভোগ করছে। আর আমরাও অন্যান্য জীবসত্তা থেকে বিভিন্ন দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে থাকি ।
অবশেষে, আধিদৈবিক দুঃখ, দেব-দেবতাদি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের থেকে যা উদ্ভূত হয়। যেমন, দুর্ভিক্ষ হতে পারে, ভূমিকম্প হতে পারে, বন্যা, মহামারী--কত রকমের দৈবদুর্বিপাক রয়েছে। এগুলো হচ্ছে আধিদৈবিক দুঃখ ।
সুতরাং, আমরা সর্বদা এক বা একাধিক এই সমস্ত দুঃখভোগ করে চলেছি। এই জড়া প্রকৃতিকে এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে আমরা দুঃখ ভোগ করতে বাধ্য হই; এটি ভগবানের আইন। আর আমরা এসব দুঃখ-দুর্দশা থেকে কেবল অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করছি কেবল কিছু জোড়াতালিমূলক প্রতিকারের সাহায্যে।
প্রত্যেকেই দুঃখ-দুর্দশা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার চেষ্টা করছে সেটি একটি ঘটনা। অস্তিত্বের জন্য সংগ্রাম, সমগ্র জীবন সংগ্রাম পরিচালিত হয় এই লক্ষ্যে দুঃখভোগ থেকে অব্যাহতি লাভ বিভিন্ন ধরনের প্রতিকার রয়েছে যা আমরা দুঃখ-দুর্দশা থেকে অব্যাহতি পাওয়ার জন্য প্রয়োগ করার চেষ্টা করি।
আধুনিক বিজ্ঞানীরা হয়তো কোন প্রতিকার দিয়েছেন, দার্শনিকেরা কোন প্রতিকারের প্রস্তাব করেছেন, নাস্তিকেরা কিছু প্রস্তাব করেছেন, আস্তিকেরা হয়তো কিছু প্রস্তাব করেছে, সকামকর্মীরা এরকম কিছু প্রস্তাব করেছে । কত রকমের পরিকল্পনা রয়েছে। কিন্তু কৃষ্ণভাবনামৃত দর্শন অনুসারে, আপনি আপনার সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে চিরতরে মুক্ত হতে পারেন যদি আপনি কেবল আপনার চেতনাকে কৃষ্ণচেতনায় পরিবর্তন করেন। ব্যস্, আর কিছু নয় ৷
আমাদের সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার উদ্ভবের কারণ হচ্ছে অজ্ঞতা। আমরা ভুলে গেছি যে, আমরা হচ্ছি শ্রীকৃষ্ণের নিত্য দাস । একটি সুন্দর বাংলা পদ্যে এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করা
কৃষ্ণ-বহির্মুখ হইয়া ভোগ বাঞ্ছা করে ।
নিকটস্থ মায়া তারে জাপটিয়া ধরে ॥
যখনই আমাদের আদি অকৃত্রিম কৃষ্ণচেতনা জড় জাগতিক ভোগ-কামনার দ্বারা কলুষিত হয়ে পড়ে——যখনই আমরা এই ধারণার দ্বারা আবিষ্ট হই যে, আমি জড় সম্পদের উপরে প্রভুত্ব করতে চাই—তখনই আমাদের সমস্যার সূত্রপাত হয়। তৎক্ষণাৎ আমরা মায়াগ্রস্ত হয়ে পড়ি।
এই জড় জগতে প্রত্যেকেই চিন্তা করছে, “আমি আমার সাধ্যমতো এই জড় জগতকে ভোগ করতে পারি।” এই জগতের একটি ক্ষুদ্র পিপীলিকা থেকে উচ্চতম জীবসত্তা ব্রহ্মা পর্যন্ত প্রত্যেকেই একজন প্রভু হওয়ার চেষ্টা করছে । আপনাদের দেশে বহু রাজনীতিবিদ দেশের প্রেসিডেন্ট হওয়ার জন্য প্রচার করছেন। কেন? তারা প্রভু হতে চায়। এটিই মায়ার অলীকতা ।
কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনে আমাদের মানসিকতা ঠিক বিপরীত। আমরা শ্রীকৃষ্ণের দাসের দাসের দাসানুদাস হওয়ার চেষ্টা করছি (গোপীভর্তুঃ পদকমলয়োর্দাসদাসানুদাসঃ) । একজন প্রভু হওয়ার চেষ্টা করার পরিবর্তে, আমরা শ্রীকৃষ্ণের দাস, সেবক হওয়ার চেষ্টা করছি ।
এখন, মানুষ বলতে পারে যে, এটি একটি দাসসুলভ মানসিকতা “কেন আমি একজন দাস হতে যাব? আমি একজন প্রভু হব।” কিন্তু তারা জানে না যে, এই চেতনা-“আমি প্রভু হব"--এটিই তাদের সমস্ত দুঃখের মূল কারণ। এটি উপলব্ধি করতে হবে। এই জগতের প্রভু হওয়ার নামে, আমরা কার্যতঃ আমাদের ইন্দ্রিয়ের দাসে পরিণত হচ্ছি।
আমরা সেবা না করে থাকতে পারি না। এই সভায় আমরা যারা বসে আছি। প্রত্যেকেই এক একজন সেবক। এই সমস্ত ছেলে-মেয়েরা যারা কৃষ্ণভাবনামৃত গ্রহণ করেছে তারা শ্রীকৃষ্ণের সেবক হতে সম্মত হয়েছে। সুতরাং, তাদের সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। কিন্তু অন্যেরা ভাবছেন, “কেন আমি ভগবানের একজন সেবক হব?
বরং প্রভু হব।” প্রকৃতপক্ষে, কেউই প্রভু হতে পারে না। আর কেউ যদি প্রভু হতে চেষ্টা করে, সে কেবল তার ইন্দ্রিয়েরই সেবকে পরিণত হয় । আর কিছুই সে তার কামের দাস হয়, সে তার লোভের দাস হয়, সে তার ক্রোধের দাস হয়। সে অনেক কিছুরই দাস হয়ে পড়ে ।
অপেক্ষাকৃত উন্নত স্তরে, কেউ হয়ত মানবজাতির সেবক হয়, কেউ হয়ত সমাজের সেবক হয়, কেউ তার দেশের সেবক হয়। কিন্তু এদের সকলেরই প্রকৃত মতলব হচ্ছে প্রভু হওয়া। সেটি হচ্ছে রোগ। রাষ্ট্রপতির পদপ্রার্থীরা তাদের নিজের নিজের ইস্তাহার প্রেরণ করছে“আমি খুব সুন্দরভাবে দেশের সেবা করব। অনুগ্রহ করে আমাকে আপনাদের ভোটটি দিন ।” কিন্তু তা প্রকৃত পরিকল্পনা হচ্ছে না কোনভাবে এই দেশের প্রভু হওয়া, সেটিই হচ্ছে মায়া ।
সুতরাং, এই গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক তত্ত্বটি আমাদের উপলব্ধি করতে হবে। স্বরূপতঃ আমরা দাস। কেউ বলতে পারে না, “আমি মুক্ত; আমি প্রভু ।” যদি কেউ এভাবে চিন্তা করে তাহলে সে মোহগ্রস্ত। এই সভায় যারা উপস্থিত রয়েছেন তাদের মধ্যে এমন কেউ বলতে পারেন যিনি কারো না কারো কিংবা কোনকিছুর সেবক নন? না, কেননা আমাদের স্বরূপগত বৃত্তিই হচ্ছে সেবা করা।
আমরা শ্রীকৃষ্ণের সেবা করতে পারি, অথবা আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের সেবা করতে পারি কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে এই যে, আমাদের ইন্দ্রিয়ের সেবা করার মাধ্যমে আমরা কেবল আমাদের দুঃখ ভোগ করার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে থাকি। কিছুক্ষণের জন্য কোন মাদক গ্রহণ করে আপনি আপনার দুঃখ-জ্বালাকে ভুলে থাকতে পারেন ।
আর নেশার প্রভাবে আচ্ছন্ন হয়ে আপনি ভাবতে পারেন আপনি আর কারো সেবক নন, আপনি মুক্ত স্বাধীন। কিন্তু এই ধারণাটি কাল্পনিক, কৃত্রিম । যখনই মাদকের প্রভাব কেটে যায়, আপনি তখন আবিষ্কার করেন যে, আপনি একজন সেবক।
অতএব, আমরা সেবা করতে বাধ্য হই, কিন্তু আমরা সেবা করতে চাই না। তাহলে সমাধান কোথায়? কৃষ্ণভাবনামৃত । আপনি যদি শ্রীকৃষ্ণের সেবক হন, আপনার প্রভু হওয়ার অভিলাষ তৎক্ষণাৎ চরিতার্থ হয়ে যায়। দৃষ্টান্তস্বরূপ, এখানে আমরা শ্রীকৃষ্ণ ও অর্জুনের চিত্র দেখতে পাচ্ছি (শ্রীল প্রভুপাদ কুরুক্ষেত্রের কৃষ্ণ অর্জুনের একটি চিত্রের দিকে নির্দেশ করেন) ।
শ্রীকৃষ্ণ পরমেশ্বর ভগবান; আর অর্জুন হচ্ছেন একজন মানুষ। কিন্তু অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে বন্ধু হিসাবে ভালবাসেন, আর অর্জুনেরই বন্ধুসুলভ ভালবাসার প্রত্যুত্তরে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর রথের সারথি হয়েছেন,
তাঁর সেবক হয়েছেন । ঠিক তেমনি, আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে আমাদের দিব্য চিন্ময় সম্বন্ধের স্তরে আবার অধিষ্ঠিত হই, আমাদের প্রভুত্ব করার আকাঙ্ক্ষা পরিপূর্ণ হবে। আপনি যদি শ্রীকৃষ্ণকে সেবা করতে সম্মত হন, ধীরে ধীরে আপনি দেখবেন যে, শ্রীকৃষ্ণও আপনার সেবা করছেন। এটি একটি উপলব্ধির প্রশ্ন ।
অতএব, আপনি যদি এই জড় জগতের সেবা থেকে, আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহের সেবা থেকে অব্যাহতি পেতে চান, তাহলে আমাদের অবশ্যই আমাদের সেবাভাবকে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি নিবদ্ধ করতে হবে। এটি হচ্ছে কৃষ্ণভাবনামৃত । ইন্দ্রিয়ের সেবা সম্বন্ধে শ্রীল রূপ গোস্বামী একটি সুন্দর শ্লোক তাঁর ভক্তিরসামৃতসিন্ধু গ্রন্থে উদ্ধৃত করেছেন কামাদীনাং কতি ন কতিধা পালিতা দুর্নিদেশা।
এখানে একজন ভক্ত শ্রীকৃষ্ণকে বলছেন যে, তিনি দীর্ঘকাল ধরে তার ইন্দ্রিয়গুলোর সেবা করছেন (কামাদীনাং কতি ন কতিধা)। কাম অর্থ যৌনতৃপ্তির বাসনা। তিনি বলছেন, “আমার কামাদির নির্দেশে আমি এমনসব কাজ করেছি যা আমার করা উচিত নয়।" কেউ যখন একজন দাস হয়, সে তখন এমনসব কাজ করতে বাধ্য হয়, যা সে করতে চায় না। সে করতে বাধ্য হয়। অতএব, এখানে এই ভক্ত স্বীকার করছেন যে, তার কাম প্রবৃত্তির তাড়নায় তিনি পাপময় কর্ম করছেন।
তখন কেউ হয়ত এই ভক্তকে বলতে পারেনঃ “ঠিক আছে, আপনি আপনার ইন্দ্রিয়ের সেবা করেছেন। কিন্তু এখন আপনি তাদের সেবা করার কাজ সমাপ্ত করেছেন। এখন তো সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে।” কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে এই যে, তেষাং জাতা ময়ি ন করুণা ন ত্রপা নোপশাস্তিঃ। ভক্তটি বলেন, “আমি কত যত্নসহকারে আমার ইন্দ্রিয়গুলোর সেবা করেছি, কিন্তু আমি দেখতে পাচ্ছি যে, তারা এখনও সন্তুষ্ট হয়নি।
সেটিই হচ্ছে আমার অসুবিধা। আমার ইন্দ্রিয়গুলো তৃপ্ত নয় । আমি পরিতৃপ্ত নই, আর আমাকে এখন অব্যাহতি দেওয়ার জন্য, তাদের সেবা থেকে আমাকে অবসর দেওয়ার জন্য আমার ইন্দ্রিয়গুলো আমার প্রতি যথেষ্ট সদয় নয়। এই হচ্ছে আমার অবস্থা। আমি আশা করেছিলাম যে, বহু বছর ধরে আমার সেবার দ্বারা আমার ইন্দ্রিয়গুলোকে আমি সন্তুষ্ট করতে পারব, তারা একদিন তৃপ্ত হবে।
কিন্তু না, তারা আদৌ তৃপ্ত নয়। তারা এখনও আমাকে নির্দেশ দিয়ে চলেছে।” এখানে আমি আমার একজন ছাত্র আমাকে যা বলেছিল তা প্রকাশ করতে পারি, মা এখন বৃদ্ধা, কিন্তু তিনি বিবাহ করতে যাচ্ছেন। আর অন্য আরেকজন অভিযোগ করে জানালো যে, তার ঠাকুরমাও বিবাহ করেছেন। দেখুন : পঞ্চাশ বছরের বৃদ্ধা, সত্তর বছরের বৃদ্ধা, তবুও ইন্দ্রিয়গুলো এত প্রবল যে তারা আদেশ দিয়ে চলেছে, “হ্যা, তোমাকে অবশ্যই বিবাহ করতে হবে।”
ইন্দ্রিয়গুলো কত প্রবল, উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। কেবল যুবকেরাই তাদের ইন্দ্রিয়ের সেবক নয়। কেউ পঁচাত্তর বছরের বৃদ্ধ হতে পারে, আশি বছরের বৃদ্ধ হতে পারে, অথবা এমনকি মৃত্যুর দুয়ারে উপনীত হতে পারে--তবুও সে তার ইন্দ্রিয়গুলোর সেবক।
ইন্দ্রিয়গুলোকে কখনও তৃপ্ত করা যায় না। সুতরাং, এই হচ্ছে জড়জাগতিক পরিস্থিতি। আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের দাস, আর আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোর এভাবে এত সেবা করা সত্ত্বেও আমরা পরিতৃপ্ত নই। আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোও পরিতৃপ্ত নয়, তারা আমাদের প্রতি সদয় নয়।
সুতরাং ফল কেবল বিশৃঙ্খলা! সর্বোত্তম পথ হচ্ছে, সেজন্য, শ্রীকৃষ্ণের একজন সেবক হওয়া। ভগবদ্গীতায় (১৮/৬৬) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন,
সর্বধর্মান্ পরিত্যজ্য মামেকং শরণং ব্রজ ।
অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ॥
আপনি কত জন্ম ধরে আপনার ইন্দ্রিয়ের সেবা করেছেন, জীবনের পর জীবন, ৮৪,০০,০০০ প্রজাতির জীব দেহে। পাখিরা তাদের ইন্দ্রিয়ের সেবা করছে, পশুরা তাদের ইন্দ্রিয়ের সেবা করছে, মানুষ, দেবতা--এই জড় জগতের প্রত্যেকেই ইন্দ্রিয়জ সুখ ভোগ করতে চেষ্টা করছে । “সুতরাং”, শ্রীকৃষ্ণ বলেন, “কেবল আমার শরণাগত হও। আমার সেবা করতে সম্মত হও, আমি তোমার দায়িত্ব গ্রহণ করব। তুমি তখন তোমার ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব করা থেকে মুক্ত হবে।”
ইন্দ্রিয়গুলোর আদেশে তাড়িত হয়ে, আমরা জন্ম জন্ম ধরে পাপকর্ম করে চলেছি। সেজন্য আমরা বিভিন্ন ধরনের দেহের মধ্যে রয়েছি। মনে করবেন না যে, আপনাদের প্রত্যেকেই একই স্তরে রয়েছেন। না একজনের কার্যকলাপ অনুসারে, সে একটি নির্দিষ্ট ধরনের দেহ লাভ করে থাকে।
আর এই সমস্ত বিভিন্ন ধরনের দেহগুলো তাকে বিভিন্ন মাত্রার ইন্দ্রিয়তৃপ্তির সুযোগ দান করে। একটি শূকরের জীবনেও ইন্দ্রিয়তৃপ্তি রয়েছে, কিন্তু সেটি নিম্ন স্তরের। শূকর এতই ইন্দ্রিয়পরায়ণ যে, সে তার মা, বোন কিংবা তার কন্যার সঙ্গেও যৌন সংসর্গ করতে দ্বিধা করে না। এমনকি মানব সমাজে এমন কিছু মানুষ আছে যারা তাদের মা কিংবা বোনের সঙ্গে যৌন সম্বন্ধ স্থাপনে দ্বিধা করে না।
ইন্দ্রিয়গুলো এত শক্তিশালী সুতরাং, আমাদের উপলব্ধি করতে চেষ্টা করা উচিত যে, আমাদের সমস্ত দুঃখের কারণ হচ্ছে ইন্দ্রিয়গুলোর আদেশে সেবা করা। যে ত্রিবিধ দুঃখ--আমরা ভোগ করছি, যে সমস্ত দুঃখ থেকে আমরা মুক্ত হওয়ার চেষ্টা করছি--এগুলো সবই এই ইন্দ্রিয়সুখ লালসার, ইন্দ্রিয়ের আজ্ঞা পালনের ফলে।
কিন্তু আমরা যদি শ্রীকৃষ্ণের সেবার প্রতি আকৃষ্ট হই, আমাদেরকে আর ইন্দ্রিয়ের আদেশ পালনে বাধ্য হতে হবে না। শ্রীকৃষ্ণের একটি নাম হচ্ছে মদনমোহন, “যিনি মদন বা কামদেবকে মোহিত করেন।” আপনি যদি আপনার প্রেমকে আপনার ইন্দ্রিয়গুলো থেকে শ্রীকৃষ্ণে স্থানান্তরিত করেন, তাহলে আপনি সমস্ত রকমের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হবেন।
অতএব, প্রভু হওয়ার এই প্রচেষ্টা--“আমি যা কিছু দেখছি সবকিছুর সম্রাট” --I am the monarch of all I survey এই দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করতে হবে । আমাদের প্রত্যেকেই স্বরূপতঃ একজন সেবক। এখন আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়ের সেবক হওয়ার চেষ্টা করছি, কিন্তু আমাদের উচিত এই সেবাবৃত্তি শ্রীকৃষ্ণের অভিমুখে পরিচালিত করা।
আর আপনি যখন শ্রীকৃষ্ণের সেবা করবেন, যতই আপনি ঐকান্তিক থাকবেন, শ্রীকৃষ্ণ ধীরে ধীরে নিজেকে আপনার নিকট প্রকাশ করবেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ ও আপনার মধ্যে সেবার আদান-প্রদান অপূর্ব সুন্দর হয়ে উঠবে। আপনি তাকে আপনার একজন বন্ধু হিসাবে অথবা একজন প্রভু হিসাবে, কিংবা একজন প্রেমিক হিসাবে--ভালবাসতে পারেন--শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসার কত উপায় রয়েছে।
সুতরাং, আপনার উচিত শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসার চেষ্ট করা, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন আপনি কত পরিতৃপ্ত। পূর্ণরূপে পরিতৃপ্ত হওয়ার আর কোন রাস্তা নেই । প্রচুর পরিমাণে অর্থ উপার্জন আপনাকে কখনই পরিতৃপ্তি দান করতে পারবে না। একসময় কোলকাতায় আমি একজন ভদ্রলোককে জানতাম, যিনি মাসে ছয় হাজার ডলার উপার্জন করতেন। কিন্তু তিনি আত্মহত্যা করেছিলেন । কেন? তার সেই অর্থ তাকে তৃপ্তি দিতে পারেনি । তিনি অন্যকিছু পাওয়ার চেষ্টা করেছিলেন ।
অতএব, আপনাদের সবার কাছে আমার বিনীত অনুরোধ এই যে, আপনারা জীবনের এই পরম আশীর্বাদ, কৃষ্ণভাবনামৃত উপলব্ধি করার চেষ্টা করুন। শুধু কেবল হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ-কীর্তনের মাধ্যমে আপনারা ক্রমশঃ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি এক অপ্রাকৃত প্রেমভাব বিকশিত করতে পারবেন। যখনই আপনি শ্রীকৃষ্ণকে ভালবাসতে শুরু করবেন, আপনার সমস্ত সমস্যা দূরীভূত হয়ে যাবে এবং আপনি পূর্ণ পরিতৃপ্তি ও সস্তোষ লাভ করবেন।
আপনাদের অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনাদের কি কোন প্রশ্ন আছে?
প্রশ্নঃ যখন আমরা জড়াশক্তিকে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করি, তখন কি ঘটে? সেটি কি তখন চিন্ময় হয়ে উঠে?
শ্রীল প্রভুপাদঃ যখন কোন তামার তার বিদ্যুতের সংস্পর্শে আসে তখন সেটি আর তামার তার নয়; সেটি বিদ্যুৎ । একইভাবে, যখন আপনি আপনার শক্তিকে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োগ করবেন, সেটি আর তখন জড় নয়, সেটি চিন্ময় শক্তি। সুতরাং, যখনই আপনি নিজেকে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করেন, তখনই আপনি জড়া শক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হয়ে যান । ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ সেটি বলেছেন (১৪/২৬) ৪
মাং চ যোহব্যভিচারেণ ভক্তিযোগেন সেবতে।
স গুণান্ সমতীত্যৈতান্ ব্ৰহ্মভূয়ায় কল্পতে ॥
“যিনি ঐকান্তিক ভক্তি সহকারে আমার সেবা করেন, এবং যিনি কোন অবস্থাতেই অধঃপতিত হন না, তিনি প্রকৃতির সমস্ত গুণ অতিক্রম করে ব্রহ্মভূত অবস্থায় উন্নীত হয়েছেন।"
• সেজন্য, যখন আপনি আপনার শক্তিকে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় প্রয়োগ করেন, তখন ভাববেন না যে, সেটি জড় থাকে। শ্রীকৃষ্ণের সেবায় ব্যবহৃত সবকিছুই চিন্ময়। উদাহরণস্বরূপ, প্রতিদিন আমরা ফলপ্রসাদ বিতরণ করি। এখন, কেউ প্রশ্ন করতে পরে, এই ফলটির সাথে অন্য সাধারণ একটি ফলের পার্থক্য কোথায়? অন্য যেকোন ফলের মতো এটিকেও বাজার থেকে কিনে আনা হয়েছে।
আমরাও বাড়িতে ফল খেয়ে থাকি ৷ পার্থক্য কোথায়? না, পার্থক্য রয়েছে। যেহেতু আমরা ফলটি শ্রীকৃষ্ণকে নিবেদন করি, তৎক্ষণাৎ সেটি চিন্ময় হয়ে উঠে। তার ফলে কি লাভ হয়? আপনি কেবল কৃষ্ণপ্রসাদ ভোজন করতে থাকুন, তাহলে আপনি দেখতে পাবেন কিভাবে কৃষ্ণভাবনায় আপনি অগ্রসর হচ্ছেন, উন্নতি করছেন।
আরেকটি দৃষ্টাত্ত দেওয়া যেতে পারে। আপনি যদি অনেক পরিমাণ দুধ একসঙ্গে খেয়ে নেন, তাহলে আপনার পাকস্থলীতে কিছু গোলযোগ দেখা দিতে পারে। আপনি যদি তখন চিকিৎসকের কাছে যান (অত্ততঃপক্ষে আপনি যদি একজন আয়ুর্বেদিক কবিরাজের কাছে যান), তিনি আপনাকে দই থেকে তৈরি করা একটি কবিরাজি ঔষধ দেবেন।
আর সেই একটু ঔষুধ সংযুক্ত দই আপনার রোগকে আরোগ্য করবে। এখন, এই দুই দুধের পরিবর্তিত রূপ বা বিকার ছাড়া কিছু নয়। অতএব, আপনার রোগ সৃষ্টি হয়েছিল দুধ থেকে, আর সেই একই দুধের দ্বারা আপনি রোগমুক্ত হলেন । কেমনভাবে? তার কারণ আপনি একজন যোগ্য চিকিৎসকের ঔষধ গ্রহণ করছেন।
ঠিক তেমনই, আপনি যদি একজন যথার্থ সদ্গুরুর তত্ত্বাবধানে জড়া শক্তিকে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করেন, সেই একই জড়াশক্তি যা আপনার বন্ধনের কারণ ছিল, সেটিই আপনাকে সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার অতীত অপ্রাকৃত স্তরে, চিন্ময় স্তরে নিয়ে আসবে।
প্রশ্নঃ আপনি কিভাবে সবকিছুকে এত সহজবোধ্য করে তোলেন?
শ্রীল প্রভুপাদঃ তার কারণ সমগ্র দর্শনটি এত সরল ভগবান মহান,আপনি মহান নন। কখনও এমন দাবি করবেন না যে, আপনি ভগবান। কখনও এমন বলবেন না যে, ভগবান নেই। ভগবান অনন্ত, আর আপনি অতি ক্ষুদ্র। তখন আপনার অবস্থানটি কি?
আপনাকে ভগবানের, শ্রীকৃষ্ণের সেবা করতে হবে। আপনি সেবক । এটি একটি সরল সত্য । ভগবানের প্রতি বিদ্রোহী দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে মায়া, বিভ্রান্তি । যে ঘোষণা করছে যে সে নিজে একজন ভগবান, আপনিও ভগবান, অথবা ভগবান নেই, ভগবান মৃত--সে মায়ার দ্বারা মোহিত।
কোন মানুষকে যখন ভূতে পায়, তখন সমস্ত ধরনের অর্থহীন প্রলাপ বকতে থাকে ৷ ঠিক তেমনিভাবে, যখন কোন মানুষ মায়াচ্ছন্ন হয়, সে বলে, “ভগবান মৃত , আমি ভগবান। কেন তুমি ভগবানের অনুসন্ধান করছ? রাস্তায় কত ভগবান ঘুরে বেড়াচ্ছে।” বিকৃতমস্তিষ্ক যেসব মানুষ এই ধরনের কথাবার্তা বলে তারা সাবই ভূতগ্রস্ত,
অতএব, আপনাকে তাদের রোগ আরোগ্য করতে হবে এই চিন্ময় শব্দতরঙ্গ হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনের দ্বারা । এটি আরোগ্য লাভের ঔষধ । কেবল তাদের শ্রবণ করতে দাও, তাহলে ধীরে ধীরে তারা রোগ মুক্ত হবে। যখন একজন মানুষ গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন থাকে, আপনি তার কানের কাছে গিয়ে জোরে ডাকতে পারেন, তাহলে সে জেগে উঠবে ।
এভাবে এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র নিদ্রিত মানুষকে জাগিয়ে তুলতে পারে। বেদে বলা হয়েছে, উত্তিষ্ঠত জাগ্রত প্রাপ্য বরান্ নিবোধতঃ “হে মানবগণ, জেগে ওঠ! আর নিদ্রিত থেকো না। তুমি মানব শরীরে থাকার সুযোগ লাভ করেছ । এটির সদ্ব্যবহার কর। মায়ার কবল থেকে নিজেকে মুক্ত কর।” এই হচ্ছে বেদের ঘোষণা । সুতরাং, হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করতে থাকুন। আপনার দেশবাসীকে মায়া নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলুন এবং তাদেরকে দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে সাহায্য করুন।
আরও পড়ুন
* সৃষ্টিকর্তা আছেন তাঁর প্রমাণ কি?
* কৃষ্ণ ভক্তি অনুশীলনের পন্থা ও ভক্তির অঙ্গগুলি-ভক্তি-রসামৃতসিন্ধু
* মৃত্যুর পর আত্মা কোথায় যায়, জন্মান্তরবাদ