সর্ব চিত্ত আকর্ষক ভগবান শ্রীকৃষ্ণ
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সকলের মনকে আকর্ষন করে
“একজন পুরুষ স্ত্রীলোকের দ্বারা আকৃষ্ট হয়, স্ত্রী পুরুষের দ্বারা আকৃষ্ট হয়, আর যখন তারা মিলিত হয়ে যৌন সম্ভোগে লিপ্ত হয়, তখন এই জড়জগতের প্রতি তাদের আসক্তি খুবই বৰ্দ্ধিত হতে থাকে।
কিন্তু এই জড় জগতের চাকচিক্যের দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে পড়া আমাদের কাজ নয়; আমাদের প্রয়োজনটি হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা আকৃষ্ট হওয়া। আর আমরা যখন শ্রীকৃষ্ণের অনবদ্য সৌন্দর্যের দ্বারা আকৃষ্ট হই, আমরা তখন এই জড় জগতের মিথ্যা সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলি ।”
এই জড় জগতে প্রত্যেকেই যৌনসঙ্গের দ্বারা আকৃষ্ট হয়। সেটি একটি বাস্তব সত্য। শ্রীমদ্ভাগবতে যেমন বলা হয়েছে, যন্মৈথুনাদি গৃহমেধি সুখং হি তুচ্ছম্ঃ “এই সুখ--পারিবারিক জীবনের তথাকথিত সুখের সূত্রপাত হয় মৈথুন বা যৌন সংসর্গের মাধ্যমে ।”
সাধারণতঃ একজন পুরুষ তার যৌন আবেগ পরিতৃপ্ত করার জন্য বিবাহ করে। তারপর সে সস্তানের জন্ম দেয়। তারপর যখন ছেলেমেয়েরা বড় হয়, তখন কন্যা সন্তান একটি যুবককে বিবাহ করে, পুত্র-সন্তান একটি তরুণীকে বিবাহ করে একই উদ্দেশ্যেমৈথুন।
তারপর নাতি-নাতনী এভাবে শ্রী ঐশ্বর্য প্রজেন্সবঃ রূপে জড় জাগতিক সুখ প্রসারিত হয়। শ্রী শব্দের অর্থ “সৌন্দর্য", ঐশ্বর্য শব্দের অর্থ "ধন-সম্পদ", এবং প্রজা শব্দের অর্থ “সস্তান সন্ততি" ।
মানুষ মনে করে যে, তারা যদি একটি সুন্দরী স্ত্রী, একটি ভাল ব্যাংক ব্যালেন্স, সুন্দর পুত্র-কন্যা, পুত্রবধূ ইত্যাদি পায় তাহলে তারা পূর্ণ সুখী হবে, সফল হবে। যদি কারো পরিবারে সুন্দরী রমণী, ধন-সম্পত্তি ও অনেক সন্তানাদি থাকে তাহলে সেই পরিবারের গৃহকর্তাকে সবচেয়ে সফল, সুখী ব্যক্তি বলে মনে করা হয়
এই সাফল্য আসলে কী? শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, এই সাফল্য যৌন সংসর্গের বিস্তার মাত্র আর কিছুই নয়। আমরা এটিকে বিভিন্নভাবে মার্জিত করতে পারি, কিন্তু সেই একই যৌনসুখ শূকরদের মধ্যেও রয়েছে শূকর সারাদিন এখানে সেখানে খেয়ে বেড়ায়, সবসময় সন্ধান করে- “বিষ্ঠা কোথায়? বিষ্ঠা কোথায়?”আর তারপর কোনরকম বাছ-বিচার না করে মৈথুনে লিপ্ত হয়। একটি শূকর কার সঙ্গে যৌন সংসর্গ করছে--তার মা, বোন, কন্যার সাথে কিনা--সে বিষয়ে কোন বাছ বিচার করে না।
সুতরাং, শাস্ত্রে বলা হয়েছে যে, আমরা এই জড়জগতে আবদ্ধ কেবল যৌনতৃপ্তির জন্য। অন্য কথায়, আমরা কামদেবের স্বীকার। কামদেব, বা মদন হচ্ছে কামের দেবতা । কেউ যদি কামদেবের দ্বারা মোহিত না হয় তাহলে সে যৌন জীবনে আনন্দ পেতে পারে না।
আর শ্রীকৃষ্ণের অনেক নামের একটি হচ্ছে মদনমোহন, “যিনি কামদেবকে পরাভূত করেন, মোহিত করেন ।” অন্য কথায়, যে ব্যক্তি শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হয় সে কাম সম্ভোগের মাধ্যমে অর্জিত আনন্দের কথা ভুলে যায়। কৃষ্ণভাবনায় অগ্রগতির এটি একটি পরীক্ষা ।
মদন শব্দটির আরেকটি অর্থ হচ্ছে “মদান্বিত করা বা উন্মুক্ত করা।” প্রত্যেকেই যৌন লালসার প্রবেগের দ্বারা উন্মত্ত শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, পুংসঃ স্ত্রীয়া মিথুনী ভাবমেতং তয়োর্মিথো হৃদয় গ্রন্থিমাহুঃ “এই সমগ্র জড় জগতটি চলছে পুরুষ ও স্ত্রীর পারস্পরিক আকর্ষণ বা মিথুনীভাবের জন্য।”
একজন পুরুষ একজন স্ত্রীলোকের দ্বারা আকৃষ্ট হয়, একজন স্ত্রীলোক একজন পুরুষের দ্বারা আকৃষ্ট হয়, আর যখন তারা পরস্পর মিলিত হয়ে যৌনজীবন শুরু করে এই জড় জগতের প্রতি আকর্ষণ উত্তরোত্তর বৰ্দ্ধিত হতে থাকে। বিবাহের পর, ওই পুরুষ ও স্ত্রী একটি সুন্দর আবাস-গৃহ, এবং একটি চাকরি বা কিছু কৃষিকাজের জন্য জমির সন্ধান করে, কেননা খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটাতে তাদের অর্থ উপার্জনের প্রয়োজন হয়।
তারপর আসে সুত (সন্তান-সন্ততি), আপ্ত (বন্ধু-বান্ধব ও আত্মীয়-স্বজন) এবং বিত্তৈঃ (ধনসম্পত্তি)। এভাবে জড় জগতের প্রতি আকর্ষণ তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে। আর এর সবকিছুর সূত্রপাত হয় মদনের প্রতি, যৌনসুখের প্রতি আকর্ষণবশতঃ ।
কিন্তু এই জড় জগতের চাকচিক্যের দ্বারা আকৃষ্ট হওয়াটি আমাদের কর্ম নয়; আমাদের কাজ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া। আর যখন আমরা শ্রীকৃষ্ণের অনুপম সৌন্দর্যের প্রতি আকৃষ্ট হই, তখন আমরা এই জড় জগতের মিথ্যা সৌন্দর্যের প্রতি আমাদের আকর্ষণ হারিয়ে ফেলি ।
শ্রীযামুনাচার্য বলেন,
যদবধি মম চেতঃ কৃষ্ণপদারবিন্দে নব-নব-রস ধামন্যুদ্যতং রম্ভমাসীৎ। তদবধি বত নারী সঙ্গমে স্মর্যমানে ভবতি মুখ-বিকারঃ সুষ্ঠু নিষ্ঠীবনং চ ॥
“যেদিন থেকে আমার মন শ্রীকৃষ্ণের প্রতি দিব্য ভক্তিমূলক সেবায় নিযুক্ত হয়েছে এবং এর মধ্যে নব নব রস আস্বাদন করতে শুরু করেছে, সেদিন থেকে যখনই আমি জঘন্য যৌনসুখের কথা ভাবি, তখনই বিরক্তিতে আমার মুখ বিকৃত হয় এবং সেই জঘন্য চিন্তার উদ্দেশ্যে আমি থুথু ফেলি ।”
সুতরাং, শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন মদনমোহন, মদন বা কামদেবকে তিনি পরাভূত করেন । মদন সকলকে আকর্ষণ করেন, কিন্তু কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের দ্বারা আকৃষ্ট হয়, মদন পরাভূত হয়। আর যখনই মদন পরাভূত হয়, আমরা তখন এই জড় জগতকে জয় করতে পারি। তা নাহলে এটি অত্যন্ত কঠিন। শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় (৭/১৪) বলেছেন,
দৈবী হোষা গুণময়ী মম মায়া দুরত্যয়া।
মামেব যে প্রপদ্যস্তে মায়ামেতাং তরস্তি তে ॥
এই জড় জগত অতিক্রম করা অত্যন্ত কঠিন, দুরতিক্রম, কিন্তু কেউ যদি শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হয় এবং তাঁর চরণ-কমলযুগল দৃঢ়ভাবে ধারণ করে আশ্রয় করে—-“কৃষ্ণ, আমাকে রক্ষা কর!”--তাহলে শ্রীকৃষ্ণ প্রতিশ্রুতি দেন, “হ্যা, আমি তোমাকে রক্ষা করব।
ভীত হয়ো না, আমি তোমাকে রক্ষা করব।” কৌন্তেয় প্রতিজানীহি ন মে ভক্তঃ প্রণশ্যতি, “প্রিয় অর্জুন, তুমি জগতে ঘোষণা করতে পার যে, আমার যে ভক্তের আমার সেবা করা ছাড়া অন্য কোন অভিলাষ নেই, আমি আমার সেই ভক্তকে রক্ষা করব।"
দুর্ভাগ্যবশতঃ মানুষ জানে না যে, আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের চরণপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করা। এছাড়া আমাদের অন্য কোন কাজ নেই। অন্য যেকোন কাজ আমরা যা করতে পারি তা কেবল আমাদেরকে এই জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ করে। মানব জীবনের উদ্দশ্য হচ্ছে এই জড় জগতের কবল থেকে নিষ্ক্রান্ত হওয়া।
কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতে যেমন বলা হয়েছে, ন তে বিদুঃ স্বার্থগতিং হি বিষ্ণুম্ “মানুষ জানে না যে, তাদের জীবনের পরম উদ্দশ্য হচ্ছে বিষ্ণু বা কৃষ্ণকে উপলব্ধি করা।”
সেজন্য, এই যুগে মানুষকে কৃষ্ণভাবনায় আকৃষ্ট করা অত্যন্ত কঠিন। তবুও শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু আমাদের আদেশ দিয়েছেন এই জ্ঞান সারা পৃথিবীতে বিতরণ করার জন্য। সুতরাং, আমরা চেষ্টা করি। এমনকি যদি মানুষ আমাদের শিক্ষা নির্দেশ গ্রহণ না-ও করে, সেটি আমাদের অযোগ্যতা নয়। আমাদের একমাত্র যোগ্যতা হচ্ছে কেবল আমাদের সাধ্যমতো চেষ্টা করা।
মায়া অত্যন্ত শক্তিশালী। সেজন্য মায়ার কবল থেকে বদ্ধজীবকে বের করে আনা খুব একটি সহজ কিছু নয়। আমার গুরু মহারাজের সারা ভারতে অনেক মন্দির ছিল, কিন্তু তবুও তিনি বলতেন, “যদি এই সমস্ত মন্দিরগুলো বিক্রি করে আমি এমনকি একজন মানুষকে কৃষ্ণভাবনাময় করতে পারতাম তাহলে আমার উদ্দেশ্য সফল হত।" তিনি এরকম কথা বলতেন।
বড় বড় ইমারত নির্মাণ করা আমাদের উদ্দেশ্য নয়। যদিও কৃষ্ণচেতনা বিস্তারের এবং মানুষকে আশ্রয় দেওয়ার জন্য কখনও কখনও তার প্রয়োজন হতে পারে। কিন্তু আমাদের প্রধান কাজ হচ্ছে বদ্ধজীবের মুখকে শ্রীকৃষ্ণের দিকে ঘুরিয়ে দেওয়া। সেটিই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য।
সেজন্য ভক্তিবিনোদ ঠাকুর এবং অন্যান্য বৈষ্ণবগণ আমাদের সাবধান করেছেন যে, বড় বড় মন্দির নির্মাণের ক্ষেত্রে আমরা যেন সতর্ক থাকি, কেননা আমাদের মনোযোগ বিক্ষিপ্ত হয়ে জড় জাগতিক জিনিসের প্রতি ধাবিত হতে পারে। অন্যকথায়, আমরা শ্রীকৃষ্ণকে বিস্তৃত হতে পারি।
অবশ্য, পরমে কোনকিছুই জড় নয়। কোনকিছুকে জড় বলে চিন্তা করা হচ্ছে কেবল একটি মোহময় ভ্রাপ্তি। প্রকৃতপক্ষে, চিৎ পদার্থ ছাড়া অন্যকিছুই নেই । কোনকিছু জড় হবে কিভাবে? পরমেশ্বর ভগবান হচ্ছেন পরম চেতন, এবং যেহেতু সবকিছুই তাঁর থেকে আসছে, আমরা যাকে জড়াশক্তি বলি সেটিও তাঁর কাছ থেকে আসছে এবং সেজন্য সেটি পরম চিন্ময়।
কিন্তু সমস্যাটি হচ্ছে এই যে, জড়জগত হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের অপরা শক্তি, তার ফলে এখানে শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা সবসময় রয়েছে। মানুষ কত রকমের কার্যকলাপে নিযুক্ত--এই পাশ্চাত্য দেশগুলোকে আমরা সেটি অত্যন্ত স্পষ্টভাবে লক্ষ্য করতে পারি--আর মানুষ কতরকমের আধুনিক সুযোগ-সুবিধা উদ্ভাবন করে চলেছে, কিন্তু ফলটি হচ্ছে এই যে, তারা শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে যাচ্ছে। সেটিই জড়--এই কৃষ্ণবিস্মৃতি, শ্রীকৃষ্ণকে ভুলে যাওয়া ।
প্রকৃতপক্ষে, শ্রীকৃষ্ণ এবং তাঁর শক্তিরাজি ব্যতীত কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই । নারদমুনি যেমন বলেন, ইদং হি বিশ্বং ভগবান্ ইবেতরঃ “এই বিশ্ব হচ্ছেন কৃষ্ণ, ভগবান।” কিন্তু যারা অজ্ঞানতায় আচ্ছন্ন তাদের কাছে এটি ভগবান থেকে ভিন্নরূপে প্রতীয়মান হয়।
একজন ভগবদ্ভক্তের কাছে, একজন শুদ্ধ ভক্তের কাছে জড় ও চিন্ময়ের পার্থক্যের কোন ধারণা নেই, কেননা তিনি শ্রীকৃষ্ণকে সর্বত্র দর্শন করেন। যখন তিনি এমন কিছু দেখেন আমরা যাকে জড় বলি, তিনি সেটিকে শ্রীকৃষ্ণের শক্তির একটি পরিণামরূপে দর্শন করেন (পরিণামবাদ)। শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু নিচের এই দৃষ্টান্তটি দিয়েছেনঃ
স্থাবর জঙ্গম দেখে, না দেখে তার মূর্তি।
সর্বত্র হয় নিজ ইষ্টদেব স্ফূর্তি ॥
একজন শুদ্ধ ভক্ত একটি গাছ দেখতে পারেন, কিন্তু তিনি গাছটিকে ভুলে যান এবং শ্রীকৃষ্ণের শক্তিকে দর্শন করতে থাকেন। আর যখনই তিনি শ্রীকৃষ্ণের শক্তিকে দর্শন করেন তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই দর্শন করেন। সেজন্য, বৃক্ষটিকে দর্শনের পরিবর্তে তিনি শ্রীকৃষ্ণকেই দর্শন করেন ।
অপর একটি দৃষ্টান্ত হচ্ছে সূর্য এবং সূর্যলোক। যখনই আপনি সূর্যালোক দর্শন করেন, তৎক্ষণাৎ সূর্যের কথা চিন্তা করেন । তাই নয় কি? সকাল হলে, আপনি যখন আপনার জানালার মধ্য দিয়ে উজ্জ্বল সূর্যালোক দেখেন, আপনি তৎক্ষণাৎ সূর্যকে স্মরণ করেন ।
আপনি নিঃসংশয় হন যে, সূর্য উদিত হয়েছে, কেননা আপনি জানেন যে, সূর্য ব্যতীত সূর্যালোক থাকতে পারে না। একইভাবে, যখনই আমরা কোনকিছু দেখব, আমরা তৎক্ষণাৎ সেই বিশেষ বস্তুটির সঙ্গে সম্পর্কিত করে শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করব, শ্রীকৃষ্ণের কথা ভাবব, কেননা সেই বস্তুটি শ্রীকৃষ্ণেরই শক্তির একটি অভিব্যক্তি, প্রকাশ।
আর যেহেতু শক্তি শক্তিমান থেকে ভিন্ন নয়, আর যারা শ্রীকৃষ্ণের শক্তিরাজিসহ শ্রীকৃষ্ণকে উপলব্ধি করেন, তারা শ্রীকৃষ্ণ ব্যতীত আর অন্যকিছু দর্শন করেন না। সেজন্য তাদের কাছে জড় জগত বলে কিছু নেই। একজন উন্নত ভক্তের নিকট, সবকিছুই চিন্ময় (সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম)।
সুতরাং, সর্বত্র কৃষ্ণদর্শনের জন্য আমাদের চোখকে প্রশিক্ষিত করে তুলতে হবে। আর সেই প্রশিক্ষণ শ্রীকৃষ্ণের প্রতি ভক্তিযুক্ত সেবানুশীলন, যা পবিত্র হওয়ার, অন্তরের নির্মলতা লাভের পন্থা।
সর্বোপাধি বিনিমুক্তং তৎ-পরতুেন নির্মলম্ ।
হৃষিকেন হৃষিকেশ সেবনং ভক্তিরুচ্যতে ॥
যখনই আমরা কৃষ্ণভাবনাময় হই, আমরা আমাদের সমস্ত মিথ্যা জড় উপাধিগুলো বর্জন করি, এবং আমাদের দেখা, স্পর্শ করা, ঘ্রাণ গ্রহণ এবং এরকম সমস্ত কার্যকলাপ শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত হওয়ার দ্বারা নির্মল হয়ে উঠে, পবিত্র হয়ে উঠে, তখন আমরা অবিলম্বে সর্বত্র কৃষ্ণদর্শন করতে পারি।
যতক্ষণ আমাদের দর্শনের ইন্দ্রিয় চোখ দুটি শুদ্ধ না হয় ততক্ষণ আমরা শ্রীকৃষ্ণকে দর্শন করতে পারি না, কিন্তু যখনই ভগবদ্ভক্তিযুক্ত সেবানুশীলনের দ্বারা সেগুলো নির্মল, পবিত্র হয়, তখন আমরা শ্রীকৃষ্ণ ছাড়া অন্য কোন কিছুকেই দেখি না।
অতএব, কামদেব হচ্ছে মায়াময়, জড়াশক্তির অনুচরদের মধ্যে একজন অনুচর, কিন্তু আমরা যদি পূর্ণরূপে কৃষ্ণভাবনাময় হই, মদনদেব তাঁর শরগুলো দিয়ে আমাদের হৃদয়কে আর বিদ্ধ করতে পারে না। সেটি আর সম্ভব নয়। একটি সুন্দর দৃষ্টাস্ত হচ্ছে হরিদাস ঠাকুর; হরিদাস ঠাকুর যখন যুবক ছিলেন, সুন্দর পোশাকে সজ্জিত হয়ে পতিতা বেশ্যা গভীর রাত্রিতে তাঁর কাছে আসে এবং তাঁর সঙ্গে মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করে।
হরিদাস ঠাকুর বলেন, “হ্যা, এখানে বসো। আমি তোমার অভিলাষ পূর্ণ করব, কিন্তু তার আগে আমাকে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ সমাপন করতে দাও।” দেখুন! তখন গভীর রাত আর তাঁর নির্জন ভজন কুটিরে হরিদাস ঠাকুরের সামনে একজন সুন্দরী যুবতী এসে তাঁর সঙ্গে যৌন মিলনের প্রস্তাব করছে।
কিন্তু তবুও হরিদাস ঠাকুর ছিলেন অবিচল, তিনি কেবল জপ করছিলেন হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে । কিন্তু তিনি কখনই তাঁর জপ সমাপ্ত করেননি, সেজন্য সেই পতিতার পরিকল্পনাটি সফল হতে পারেনি।
সুতরাং, আমরা যখন পূর্ণরূপে কৃষ্ণচেতনায় নিমগ্ন থাকি, মদনদেব তার কামশক্তি আমাদের হৃদয়কে বিদ্ধ করতে পারে না। একজন ভক্তের সামনে হাজার হাজার সুন্দরী রমণী থাকতে পারে, কিন্তু তারা তাকে বিচলিত করতে পারে না।
তিনি তাদেরকে শ্রীকৃষ্ণের শক্তিরূপে দর্শন করেন। তিনি চিন্তা করেন, “এরা সকলেই শ্রীকৃষ্ণের; এরা সকলেই শ্রীকৃষ্ণের উপভোগ্য।” একজন ভক্তের কর্তব্য হচ্ছে সমস্ত সুন্দরী রমণীকে শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করতে চেষ্টা করা, তাদের উপভোগ করতে চেষ্টা করা নয়।
একজন ভক্ত কামশরে বিদ্ধ হন না, কারণ তিনি সবকিছুকেই শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সমন্বিতরূপে দর্শন করেন । সেটিই প্রকৃত বৈরাগ্য। তিনি কোন তার নিজের ইন্দ্রিয়তৃপ্তির জন্য গ্রহণ করেন না, বরং সবকিছুকে এবং প্রত্যেককে তিনি শ্রীকৃষ্ণের সেবায় নিয়োজিত করেন। এটিই কৃষ্ণভক্তির পন্থা।
আরও পড়ুন
* সৃষ্টিকর্তা আছেন তাঁর প্রমাণ কি?
* মৃত্যুর পর আত্মা কোথায় যায়, জন্মান্তরবাদ
হরে কৃষ্ণ