কলিযুগ পাবনাবতারী পরেমশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাব স্থান শ্রীনবদ্বীপ ধাম। শ্রীল ভক্তিবিনোদ ঠাকুর ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন, একসময় সমগ্র পৃথিবী থেকে ভক্তবৃন্দ এসে এই ধামে শ্রীকৃষ্ণসংকীর্তনে মত্ত হবেন।
ঠাকুর শ্রীভক্তিবিনোদের বাণী আজ সার্থক। বিশ্বজনীন ঐক্যের এক অনন্য তীর্থভূমি শ্রীনবদ্বীপ ধাম। ৫৩৭ বছর পূর্বে শ্রীচৈতন্যদেব আবির্ভূত হলেও শ্রীধামের মহিমা খুব কম লোকই জ্ঞাত ছিলেন।
কালক্রমে মহাপ্রভুর বাণীর সেবকগণের অন্যতম শ্রীল এ.সি. ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ তাঁর আবির্ভাবস্থলীর মহিমা বিশ্বব্যাপী প্রচার করেন। আজ নবদ্বীপধামের পবিত্র ধূলির স্পর্শ লাভের জন্য শেতাঙ্গ-কৃষ্ণাঙ্গ নির্বিশেষে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভক্তবৃন্দ সমবেত হচ্ছেন।
শুধু তাই নয় আধুনিক সভ্যতার চাকচিক্যময় জীবন পরিত্যাগ করে ধামবাসী হয়েছেন বিভিন্ন দেশের ভক্তবৃন্দ।
শ্রীনবদ্বীপ ধাম অভিন্ন বৃন্দাবন
আপন আপন ভাব অনুরূপ অনুভব অনুসারে যে পরম পুণ্যধামকে কেউবা গোলোক কেউবা শ্বেতদ্বীপ, কেউবা পরব্যোম প্রভৃতি আখ্যা দিলেও রসজ্ঞভক্তবৃন্দ যে পুণ্য ধামকে নববৃন্দাবন বলেই বর্ণনা করেন, সেই পরমানন্দময় শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর নিত্যলীলাস্থলী শ্রীধাম নবদ্বীপের জয় হোক।
নদীয়ার অবতার শ্রীমন্মহাপ্রভুর লীলাস্থলী শ্রীধাম নবদ্বীপ নিত্য চিন্ময় ধাম। শ্রীগৌরগোবিন্দ এই নিত্য ধামে তাঁর পার্ষদবৃন্দসহ নিত্য বিলাস করেন।
নবদ্বীপ ধামকে মহাজনগণ গুপ্তবৃন্দাবন আখ্যা দিয়েছেন। শ্রীমন্মহাপ্রভুর নবদ্বীপ লীলা গুপ্ত। শ্রীকৃষ্ণ শ্রীমতী রাধারাণীর ভাবকান্তি নিয়ে প্রেমনিধি শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভু সর্ব সম্পত্তি প্রেমধন ভুলোকে এনে কলিহত ত্রিতাপ দগ্ধ জীবকে বিতরণ করেছেন।
এজন্য পরম কল্যাণময় শ্রীনবদ্বীপ ধামের রস-মাধুর্য ও মহাত্ম অধিক। কলির কলুষিত ও পতিত জীবের পক্ষে এই পরম ধঅম নবদ্বীপ সর্বতোভাবে আশ্রয় করা অবশ্য কর্তব্য।
শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর লীলাস্থলী নবদ্বীপধাম সর্ব সম্পদযুক্ত, প্রেমানন্দ-বর্ধনকারী, ব্রহ্মাদি দেবগণের বন্দিত এবং নবধাভক্তি ভূষণে ভূষিত নিত্য চিন্ময় ধাম। ‘পদ্ধতি প্রদীপ’ এ আছে-
শ্রীনবদ্বীপানন্দ-বর্দ্ধনং সর্ব্ব সম্পদম্।
ব্রহ্মাদি বন্দিতং নিত্যং নবধাভক্তিভূষিতম্।।
নববৃন্দাবনাখ্য নবদ্বীপধাম ধ্যানগম্য এবং শিবশক্তি প্রভৃতির দ্বারা শোভাঢ্য। নয়টি দ্বীপ দ্বারা এই নিত্যধাম পরিবেষ্টিত। এই নয়টি দ্বীপ নবধাভক্তির আশ্রয়পীঠ। এই জন্যই এই নিত্যধামের নাম নবদ্বীপ।
নবদ্বীপের নয়টি দ্বীপ ও নবধাভক্তি
১. শ্রীঅন্তর্দ্বীপ (শ্রীমায়াপুর): আত্মনিবেদনাখ্য ভক্তিপীঠ।
২. শ্রীসীমন্তদ্বীপ (সিমুলিয়া): শ্রবণাখ্য ভক্তিপীঠ।
৩. শ্রীগোদ্রুমদ্বীপ (গাদিগাছা): কীর্তনাখ্য্য ভক্তিপীঠ।
৪. শ্রীমধ্যদ্বীপ (মাজদিয়া): স্মরণাখ্য ভক্তিপীঠ।
৫. শ্রীকোলদ্বীপ (বর্তমান শহর নবদ্বীপ): পাদসেবনাখ্য ভক্তিপীঠ।
৬. শ্রীঋতুদ্বীপ (রাতুপুর): অর্চনাখ্য ভক্তিপীঠ।
৭. শ্রীজহ্নুদ্বীপ (জান্নগর): বন্দনাখ্য ভক্তিপীঠ।
৮. শ্রীমোদদ্রুমদ্বীপ (মামগাছি): দাস্যসেবনাখ্য ভক্তিপীঠ।
৯. শ্রীরুদ্রদ্বীপ (রদ্রপাড়া): সখ্যাখ্য ভক্তিপীঠ।
শিব পার্বতীর সংবাদে শ্রীনবদ্বীপ ধাম মাহাত্ম্য
হে দেবী, নবদ্বীপ ধামে সাক্ষাৎ হরি শ্রীগৌরসুন্দর নিত্য বিরাজমান। গঙ্গার রমনীয় পূর্বতীরে-অন্তর্দ্বীপ, সীমন্তদ্বীপ, গোদ্রুমদ্বীপ ও মধ্যদ্বীপ নামে চারটি দ্বীপ এবং পশ্চিম তীরে কোলদ্বীপ, ঋতুদ্বীপ, জহ্নুদ্বীপ, মোদদ্রুমদ্বীপ ও রুদ্রদ্বীপ নামে পাঁচটি দ্বীপ আছে।
এখানে গঙ্গা, যমুনা, গোদাবরী, সরস্বতী, নর্মদা, সিন্ধু, কাবেরী, তাম্রপর্ণী, পয়স্বিনী, কৃতমালা, ভীমা, গোমতী, দূষদ্বতী প্রভৃতি পুণ্যসলিলা নদী যথাযথভাবে বিদ্যমান। এসমস্ত তীর্থ (নদী) দ্বারা নবদ্বীপ ধাম সর্বদা পরিবৃত। ভাগীরথী, অলকানন্দা, মন্দাকিনী ও ভোগবতী নামে গঙ্গার চারটি ধারাই এখানে বর্তমান।
এই নবদ্বীপ ক্ষেত্রের পরিধি চার যোজন (৩২ মাইল) পরিমতি। স্বর্গ মর্ত্য ও পাতালের সমস্ত তীর্থ নবদ্বীপে বিদ্যমান। এই পদ্ম আকৃতির নবদ্বীপক্ষেত্রে অন্তর্দ্বীপ হচ্ছে পদ্মের কর্ণিকা।
এই নবদ্বীপ মন্ডলের যেকোনো স্থানে সন্ন্যাসী কিংবা গৃহী যেকোনো ব্যক্তি নিরন্তর “হা গৌর, হা গৌর”- এরকম কীর্তন করলে নিখিল আনন্দ প্রাপ্ত হয়ে থাকে।
ভাগীরথীর পূর্বতটে গোকুল মহাবনস্বরূপ শ্রীমায়াপুর এবং পশ্চিম তটে বৃন্দাবন অবস্থিত। হে দেবী, ভূতলে এই যোগপীঠ ‘মায়াপুর’ নামে এবং তুমি ‘প্রৌঢ়ামায়া’ নামে বিখ্যাতা।
নবদ্বীপ মধ্যে মায়াপুর নামে স্থান।
যথা জম্মিলেন গৌরচন্দ্র ভগবান।।(ভক্তিরত্নাকর)
শ্রী অন্তর্দ্বীপ
শ্রীমায়াপুর, বল্লালদিঘি, বামনপুকুরের কিছু অংশ, শ্রীনাথপুর অন্তর্দ্বীপের অন্তর্গত।
বল্লাল দিঘিঃ
সত্যযুগে ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার পৃথু মহারাজ পৃথিবীর উচুনীচু-ভূমি সমতল করার জন্য লোক নিযুক্ত করেন। এই স্থানে লোকেরা মাটি খনন করলে চতুর্দিক থেকে এক দিব্য জ্যোতির্ময়ী প্রভা উত্থিত হয়।
লোকেরা রাজাকে সে কথা বললে সেই আশ্চর্য জ্যোতি অন্তর্হিত হলো। তখন রাজা ধ্যানযোগে জানলেন কলিযুগে শ্রীকৃষ্ণ শ্রীরাধার ভাবকান্তি অঙ্গীকার করে এই স্থানে অবতীর্ণ হবেন।
রাজা পৃথু এই স্থানের মাহত্ম্য গুপ্ত রাখার জন্য একটি মনোহর বিস্তৃত কুন্ড নির্মাণ করালেন। নাম পৃথুকুন্ড। কলক্রমে পৃথকুন্ড বিলুপ্ত হয়।
কলিযুগে বাংলায় রাজা বল্লাল সেনের পুত্র লক্ষণসেন নিজ পিতৃপুরুষের মঙ্গল কামনায় এই স্থানে পুনরায় দিঘি খনন করলেন। নাম হলো বল্লাল দিঘি। বর্তমানে বল্লালদিঘি ধানজমি রূপে দৃশ্যমান।
মুরারি গুপ্ত ভবনঃ
বল্লাল দিঘির পূর্বপাড়ে হনুমানের অবতার শ্রীমুরারি গুপ্ত বাস করতেন। বর্তমানে এখানে রামসীতার মন্দির বিদ্যমান।
শ্রীধর অঙ্গনঃ
শ্রীমায়াপুরের ঈশান প্রান্তে, রাজাপুর শ্রীজগন্নাথ মন্দিরের কাছে শ্রীধর ঠাকুরের বাস্তুভিটা। শ্রীধর ঠাকুর ছিলেন ব্রজলীলায় কুসুমাসব সখা। দরিদ্র সরল শ্রীধর ঠাকুর রোজ রোজ শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুকে কলা, মোচা, থোড়, লাউ দিতেন। তিনি গৃহে রোজ রাত্রে উচ্চকন্ঠে হরিনাম জপ করতেন।
শ্রীচন্দ্রশেখর ভবনঃ
চন্দ্রশেখর আচার্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মেসোমশাই। স্নেহময়ী মাসী সর্বজয়া দেবী। ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দে শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের শ্রীগুরুদেব শ্রীলভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী গোস্বামী ঠাকুর প্রভুপাদ এই স্থানেই ‘শ্রীচৈতন্য মঠ’ প্রতিষ্ঠা করেন।
মন্দির মধ্যে শ্রীশ্রীগৌর-গান্ধর্বিকাগিরিধারী বিরাজমান। মন্দিরের চতুর্দিকে সাত্বত পুরাণ-কথিত শুদ্ধ চার বৈষ্ণব সম্প্রদায়ের আচার্যগণের বিগ্রহ বিদ্যমান। শ্রীল ভক্তি সিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুর এখানেই শতকোটি নাম যজ্ঞ করেন। তাঁর গুরুদেব শ্রীল গৌরকিশোর দাস বাবাজির সমাধি, রাধাকুন্ড, শ্যামকুন্ড, গোবর্ধন, তমাল-কেলিকদম্ববৃক্ষ, তাঁর সমাধিমন্দির ও ভজনকুটির বিদ্যমান।
শ্রীঅদ্বৈত ভবনঃ
এখানে শ্রীল অদ্বৈত আচার্য প্রভু দুর্দশাগ্রস্ত কলিহত জীবের উদ্ধার সাধনের নিমিত্ত গঙ্গাজল ও তুলসী মঞ্জরি দিয়ে পাঞ্চরাত্রিক বিধান অনুসারে অর্চন করে শ্রীকৃষ্ণকে হুংকার দিয়ে আহবান করেন। তাঁর আহ্বানে মর্তে শ্রীগৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাব হলো।
শ্রীগদাধর অঙ্গনঃ
অদ্বৈত আচার্যের ভবনের কাছেই মাধব মিশ্র বাস করতেন। তাঁর পুত্র গদাধর ছিলেন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর বাল্যসাথী। গদাধর অত্যন্ত শান্ত প্রকৃতির ছেলে। একসময় শচীমাতা বলেছিলেন, “গদাধর, আমি নিমাইকে সামলাতে পারি না। তুমি বাবা ওর সঙ্গে সর্বদা থাকো।” এখানে গৌর-গদাধর বিগ্রহ বিরাজমান।
শ্রীবাস অঙ্গনঃ
প্রতিদিন শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও নিত্যানন্দ প্রভু এখানে ভক্তসঙ্গে সংকীর্তন করেন। নদীয়াশাসক চাঁদ কাজীর লোক এসে সংকীর্তন বন্ধ করার নির্দেশ জারি করে। ভক্তদের খোল তারা ভেঙ্গে দিয়েছিল; আর এরপরই সংকীর্তন আন্দোলন বিশেষভাবে শুরু হলো। শ্রীবাস ঠাকুরের বিষ্ণুর খাটে মহাপ্রভু উপবেশন করে ভক্তদের বরদান করতেন, নৈবদ্যগ্রহণ করতেন। মহাপ্রকাশ লীলা করতেন। এস্থান সংকীর্তন রাসস্থলীরূপে চিহ্নিত।
শ্রীজগন্নাথ মিশ্রভবন (যোগপীঠঃ
এটি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জন্মস্থান। ১৪০৭ শতাব্দে ফাল্গুনী পূর্ণিমায় শনিবার সন্ধ্যাকালে (১৪৮৬ খ্রি. ১৮ ফেব্রুয়ারি) চন্দ্রগ্রহণকালে অগণিত লোক গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে মহা হরিধ্বনি করছিলেন, সেই সময়ে শচীমাতার কোলে গৌরহরির জন্ম হয়।
মাধাই ঘাটঃ
মহাপ্রভু ঘাটের ষাট হাত উত্তরে এই ঘাট ছিল। ‘নবদ্বীপবাসীর চরণে আমি মহা অপরাধী’- এই দুঃখে মাধাই কাঁদতে থাকলে, তার অপরাধ মোচনের জন্য নিত্যানন্দ প্রভু প্রতিদিন তাকে স্বহস্তে গঙ্গার এই ঘাটটি পরিষ্কার করতে নির্দেশ দেন।
গঙ্গানগরঃ
এই স্থানে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বাল্যকালে গঙ্গাদাস পন্ডিতের গৃহে এসে ব্যাকরণ শাস্ত্র পড়াশোনা করতেন। বর্তমানে এ স্থান ধানচাষ এলাকা।
নন্দন আচার্য ভবনঃ
শ্রীনিত্যানন্দ প্রভু অবধূতরূপে নানাতীর্থ ভ্রমণের পর মায়াপুরে প্রথম এই স্থানে আসেন। এটি শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু ও শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর মায়াপুরে সর্বপ্রথম এবং বিগলিত প্রেমময় মিলন স্থান। এখানে বর্তমানে শ্রীশ্রীগৌর-নিতাই পূজা বিদ্যমান।
ইসকন শ্রীমায়াপুর চন্দ্রোদয় মন্দিরঃ
শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ এখানে আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন)-এর প্রধান কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এখানে আছে-শ্রীল প্রভুপাদের ভজন কুটির, শ্রীল প্রভুপাদের পুষ্পসমাধি মন্দির, শ্রীচন্দ্রোদয় মন্দির, বৈদিক তারামন্ডল মন্দির, শ্রীচৈতন্যমহাপ্রভুর জীবনী ও শিক্ষা সম্বন্ধীয় প্রদর্শনী, গুরুকুল, গোশালা, বৃহৎমৃদঙ্গ ভবন( দি ভক্তিবেদান্ত বুক ট্রাস্ট), সংকীর্তন ভবনম হরেকৃষ্ণ নামহট্রম অতিথি ভবন ও ধর্মশালা, মহাপ্রসাদ ভোজনালয় ইত্যাদি। এই মন্দিরে শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদের প্রতিষ্ঠিত অষ্টসখী পরিবৃত মনোহর শ্রী শ্রীরাধামাধব, শ্রীনৃসিংহদেব এবং শ্রীপঞ্চতত্ত্ব বিগ্রহ।
আরও পড়ুন: