সফলতার জন্য কি প্রয়োজন- ভাগ্য নাকি প্রচেষ্টা?

 আমাদের সমাজে আমরা এমন অনেকজনকে দেখতে পাই, যারা ভাগ্যকে মোটেই বিশ্বাস করে না, বরং তারা মনে করতে সক্ষম। আবার অন্যদিকে, অনেকে এও মেন করে যে, মানুষ সবসময় ভাগ্যের দোহাই দেয় এবং তারা বলে যে “সব ভাগ্যের লিখন, আমাদের কী করার আছে?” 

সফলতার জন্য কি প্রয়োজন

 

এই দুই প্রকারের ব্যক্তিদের মধ্যেই কিছু ক্রূটি আমরা দেখতে পাই। প্রথম জন নিজেকে একমাত্র কর্তা মনে করে অহংকারী হয়ে ওঠে।, আর দ্বিতীয় জন সবকিছুকে অদৃষ্টের ওপর ছেরে দিয়ে অলসতার পরিচয় দেয়। 

এজন্য এ দুইটি বিষয়ের সমস্বয়ের আবশ্যকতা হেতু এই প্রবন্ধের অনুপ্রেরণা। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃ্ষ্ণ একটি কার্য সম্পাদনের পেছনে পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছেন। 

অধিষ্ঠানং তথা কর্তা করণং চ পৃথগবিধম্।
বিবিধাশ্চ পৃথক্ চেষ্টা দৈবং দৈবং চৈবাত্র পঞ্চমম্।।(গীতা:১৮.১৪)  

“অধিষ্ঠান অর্থাৎ দেহ, কর্তা অর্থাৎ উপাধি বা ব্যক্তি, নানা প্রকার করণ যার মাধ্যমে কর্ম সম্পাদিত হয় অর্থাৎ  ইন্দ্রিয়সমূহ, বিবিধ প্রচেষ্টা ও দৈব অর্থাৎ পরমাত্মা-এই পাঁচটি হচ্ছে কারণ।” 

এই পাঁচটি কারণের যেকোনো একটিরও অনুপস্থিতি হেতু কর্ম সম্পাদন সম্ভব হয় না। জীবের পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে ভগবান কর্তৃক অনুমোদিত বা নির্ধারিত ফলই দৈব বা ভাগ্য।  

এই দৈব ও প্রচেষ্টা ব্যতীত অন্য তিনটি কারণ বুঝতে আমাদের খুব একটা অসুবিধা হয় না, কারণ দৈব ও প্রচেষ্টার পারস্পরিক ক্রিয়া কীভাবে কর্মে সফলতা পেতে প্রভাব ফেলে তা নির্ধারণ করাটা কঠিন। আর তাই-এখানে বিশ্লেষণ করা হলো। 

“একবার না পারিলে দেখ শতবার”- এ ধরনের বিবৃতি হতে মনে হয় যে, দৈব ব্যতিরেকে শুধু প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা কর্মে সাফল্য লাভ করতে পারি। 

কিন্তু শ্রীমদ্ভাগবতে বর্ণিত চিত্রকেতু মহারাজ, রাজা অঙ্গের মতো বেশকিছু চরিত্র হতে, এমনকি আমাদের ব্যবহারিক জীবনের ঘটনাবলি হতে দেখতে পাই যে, কখনো কখনো শত প্রচেষ্টা সত্ত্বেও দৈবের কারণে কর্মে সফলতা আসে না। 

মহারাজ চিত্রকেতু একটি পুত্র সন্তান লাভের জন্য বহু পত্নী গ্রহণ করলেও পূর্বকৃত কর্মফলের কারণে তিনি তাতে সফল হননি। নারদ মুনির বিশেষ কৃপায় তিনি একটি পত্রসন্তান লাভ করলেও কিছুকালের মধ্যেই সে মারা যায়। 

ধ্রুব মহারাজের বংশধর মহারাজ অঙ্গের পূর্বকৃত পাপকর্ম হেতু পুত্র সন্তান না থাকার করণে তার অনুষ্ঠিত অশ্বমেধ যজ্ঞে নিবেদিত ভোগ্য দেবতারা গ্রহণ করেননি। 

অন্যদিকে, শ্রীমদ্ভাগবতে (১.৫.১৮) বলা হয়েছে “তল্লভ্যতে দুঃখবদন্যতঃ সুখং কালেন সর্বত্র গভীররংহসা”- অর্থাৎ “ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে যে জড় সুখ, তা কালের প্রভাবে আপনা থেকেই লাভ হয়, ঠিক যেমন আকাঙ্ক্ষা না করলেও কালক্রমে আমরা দুঃখভোগ করে থাকি।” 

এই উক্তির সমর্থনে আমরা দেখি যে, পর্যাপ্ত প্রচেষ্টা ছাড়াই  দৈব আমাদের অধিক সুখ কিংবা দুঃখ প্রদান করে- লটারিতে পুরষ্কার লাভ, ধনী পরিবারে জন্মগ্রহণ কিংবা পঙ্গু হয়ে জন্ম ইত্যাদি উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। 

আবার, স্থান, কাল ও সময়ের প্রভেদে শাস্ত্র অনুসারে কৃত প্রচেষ্টার সফলতা তো হয় না, বরং বিপরীত ফল গ্রহণের চিত্রও দেখা যায়। শ্রীমদ্ভাগবতের ৯ম স্কন্ধে বর্ণিত মহারাজ নৃগ ব্রাহ্মণদের অসংখ্য গাভী দান করছিলেন। একবার তিনি এক ব্রাহ্মণকে অজান্তে অন্যজনকে দানকৃত গাভী পুনরায় দান করেছিলেন, এতে তিনি সেই ব্রাহ্মণ কর্তৃক অভিশপ্ত হয়ে পরবর্তী জন্মে গিরগিটি হয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। সুতরাং, দৈব ও প্রচেষ্টার সমন্বয় বেশ জটিল। 

দৈব ও প্রচেষ্টার মধ্যে পারস্পরিক কম্পর্ক

জীব প্রকৃতির দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়ে কর্ম করে (গীতা ৩.২৭)। তাহলে আমরা কি শুধুই পুতুল, যা সুতারূপী প্রকৃতি দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, নাকি আমাদের কোনোকিছু করার স্বাধীনতা রয়েছে? এই দৈব ও প্রচেষ্টার মধ্যে প্রকৃতপক্ষে পারস্পরিক সম্পর্ক কেমন? 

তাহলে কোনো একটি কর্ম সম্পাদনের ব্যাপারে জীবেরকি কোনো ভূমিকা নেই? আছে, জীব বাসনাকারী কর্তা। দৈব আমাদের ভবিষ্যৎ কর্মের মঞ্চ স্থাপন করে, যেমনটি দড়িতে বাঁধা গাভী ততদূর পর্যন্ত নড়াচড়া করতে পারে, যতদূর পর্যন্ত দড়িটি লম্বা। 

আবার, আমাদের বর্তমান প্রচেষ্টা ভবিষ্যৎ দৈবকে নির্ধারণ করে। কেননা আমাদের পূর্ববর্তী কর্ম অনুসারে স্মৃতি, বিস্মৃতি হয়, যা আমাদের বর্তমান বাসনা, আকাঙ্ক্ষারূপে প্রকাশ পায়। 

পূর্বজীবনে রজোগুণে আবদ্ধ ব্যক্তি পূর্বের বাসনাকে চরিতার্থ করার জন্য কর্মমুখী শরীর গ্রহণপূর্বক যদি কর্মে লিপ্ত হয়, তা তাকে পরবর্তী জন্মে আরা বেশি কর্মপরায়ণ দেহ প্রদান করে অথবা কর্মমূখী শরীর পেয়েও সে যদি সত্ত্বগুণজাত কর্মে কোনোভাবে যুক্ত হয়, তবে পরবর্তীকালে উচ্চকূলে জন্মগ্রহণ করে জীবনকে আরো উন্নত করার সুযোগ পায়। 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url