প্রযুক্তি ও বেকারত্ব
বর্তমান সময়ে বেকারত্বের কারণ প্রযুক্তি
ভক্তঃ সাম্প্রতিক এক বক্তৃতায় ভারতীয় এক রাজনীতিবিদ্ বলেছেন যে, ভরতবর্ষের আশি শতাংশ মানুষ গ্রামে বাস করেন। তার প্রস্তাব কৃষিক্ষেত্রে প্রযুক্তির প্রয়োগ করা উচিত।
মানুষ হাতে করে গম কাটার পরিবর্তে তাদের যান্ত্রিক প্রযুক্তির ব্যবহার করা উচিত এবং বলদ দ্বারা লাঙ্গল দেওয়ার পরিবর্তে ট্রাক্টর ব্যবহার করা উচিত।
শ্রীল প্রভুপাদঃ ভারতবর্ষে ইতিমধ্যেই বহু বেকার মানুষ বর্তমান। সুতরাং অধিক যান্ত্রিক প্রিযুক্তি প্রয়োগের প্রস্তাব খুব একটা ভাল নয়। একশত সেবকের কাজ মাত্র একটি মানুষ দ্বারা যন্ত্র সম্পাদন করতে পারে।
সেখানে কি অধিক বেকার মানুষ রাখা উচিত? কেন একশো মানুষকে একজনের পরিবর্তে নিয়োজিত করা হবে না? এখনো এই পশ্চিমা দেশেও বহু বেকারত্ব।
কারণ তোমরা এই পশ্চিমা দেশগুলিতে সমস্ত কাজই যন্ত্র দ্বারা সাধিত হয়। তুমি অনেক হিপি তৈরী করছো, অবসাদগ্রস্থ যুবক, যাদের কোন কাজ নেই। এটি একটি অন্য প্রকারের বেকারত্ব।
তাই বহু বিষয়ে যন্ত্র বেকারত্ব সৃষ্টি করে। প্রত্যেকের চাকরী থাকা উচিত। অন্যত্থায় সেখানে সমস্যা হবে। ‘অলস মস্তিস্ক শয়তানের কারখানা।’ যেখানে বহু মানুষ কর্মহীন, কেন আমরা সেখানে যান্ত্রিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করে আরও অধিক বেকারত্ব সৃষ্টি করবো?
সর্বোত্তম নীতি হচ্ছে কাউকে বেকার না রাখা, প্রত্যেকেরই ব্যস্ত থাকা উচিত।
ভক্তঃ কিন্তু কেউ কেউ তর্ক করতে পারে, “প্রযুক্তি আমাদের সময় সাপেক্ষ পরিশ্রম থেকে মুক্তি প্রদান করছে।”
শ্রীল প্রভুপাদঃ কিসের জন্য মুক্তি? মদ্যপান এবং অনৈতিক কাজ করার জন্য? এই রকম মুক্তির কি অর্থ হয়? যদি তুমি মানুষদেরকে কৃষ্ণভাবনামৃত অনুশীলনের জন্য মুক্ত কর তাহলে অন্য কথা।
অবশ্য যদি কেউ আমাদের কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলনে যোগদান করে সে তখন পরিপূর্ণ ভাবে নিযুক্ত হয়ে পড়বে। এই আন্দোলনের অর্থ এই নয় যে, খাও এবং ঘুমাও। এর অর্থ হচ্ছে শ্রীকৃষ্ণের জন্য কর্ম কর।
সুতরাং এখানে কৃষ্ণভাবনামৃতই হোক আর বাহির সমাজেই হোক নীতি এই হওয়া উচিত প্রত্যেকেই যেন কর্মরত এবং ব্যস্ত থাকে। একমাত্র তখনই একটি সুষ্ঠু সভ্যতা পাওয়া যাবে।
বৈদিক সভ্যতায় সমাজ প্রধানের এটাই কর্তব্য ছিল যে, প্রতিটি মানুষ কর্মে রত আছে কিনা তা দেখা, একজন ব্রাহ্মণ হিসাবে হোক একজন ক্ষত্রিয় হিসাবে হোক, একজন বৈশ্য হিসাবে হোক।
প্রত্যেকের কর্ম আবশ্যিক, একমাত্র তখনই সেখানে শান্তি বিরাজ করবে। বর্তমান অবস্থাতে আমরা দেখতে পাই, বহুল প্রযুক্তির ব্যবহারের জন্য বহু বেকারত্ব এবং অলস মানুষের সংখ্যা অধিক। হিপীরা অলস, ব্যাস। তারা কোন কিছু করতে চায় না।
ভক্ত: অন্য আর এক বিতর্ক হতে পারে যে, প্রযুক্তির সাহায্যে আমরা অনেক ভাল কাজ করতে পরি, অনেক দক্ষতার সঙ্গে করতে পারি এবং যারা কাজ কর তাদের প্রমোদও বৃদ্ধি পায়।
শ্রীল প্রভুপাদঃ কর্ম দক্ষতার সঙ্গে অধিক মানুষের কর্ম করাও শ্রেয়। ভগবদ্গীতায় (১৮/৪৮) শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন-
সহজং কর্ম কৌন্তেয়
সদোষমপি ন ত্যজেৎ।
সর্বারম্ভা হি দোষেণ
ধূমেনাগ্নিরিবাবৃতাঃ।।
অনুবাদঃ ‘হে কৌন্তেয়, সহজাত কর্ম দোষযুক্ত হলেও ত্যাগ করা উচিত নয়। যেহেতু অগ্নি ধূমের দ্বারা আবৃত থাকে, তেমনই সমস্ত কর্মই দোষের দ্বারা আবৃত থাকে।
হিন্দিতে একটি প্রবাদ আছে, বেকারী সে বেগারী আচ্ছা হ্যায়।’ বেকার অর্থাৎ ‘চাকরী ছাড়া’ এবং বেগার অর্থাৎ, বেতন ছাড়া কর্ম করা।
ভারতবর্ষে আমরা অনেক গ্রামবাসীকে দেখেছি, তারা আসে এবং দোকান মালিক অথবা কোন অদ্রলোককে বলে, ‘অনুগ্রহ করে আমাকে কাজ দিন আমি কোন বেতন চাই না।
যদি আপনি মনে করেন তাহলে কিছু খাদ্যবস্তু দিতে পারেন। অন্যথা আমি তাও চাই না।’ সুতরাং কোন ভদ্রলোক যদি আপনি তার জায়গাতে কাজ করেন সে আপনাকে কি কোন খাদ্যদ্রব্য দেবে না?
তৎক্ষণাৎ সেই কর্মীটি কিছু পেশা পেল সঙ্গে খাদ্য এবং বাসস্থান। তারপর সে যখন কাজ করতে শুরু করে এবং সেই ভদ্রলোক যদি দেখেন যে, সেই ব্যক্তিটি যদি সুন্দরভাবে কাজ করছে,
তিনি তখন বলবেন ‘আচ্ছা ঠিক আছে কিছু বেতন নাও। সুতরাং কাজ না করে অলস বসে থাকার চেয়ে বিনা বেতনে চাকরী করাও ভাল।
এটি একটি ভয়ঙ্কর অবস্থা। কিন্তু এই বর্তমান সভ্যতারয় অত্যাধিক যন্ত্র ব্যবহারের ফলে প্রচুর বেকার লোকের সৃষ্টি হয়েছে এবং অনেক অলসও। এটি ভাল নয়।
ভক্তঃ অনেক মানুষই বলবে যে, এই ধারণাটি অতি সেকেলে। তারা প্রযুক্তিকেই ভালো বলবে। এমনকি এটি যদি অধিক মাত্রাতে বেকার তৈরী করে তাও, কারণ তারা এটিকে মজুরীগিরি করা থেকে মুক্তির পথ হিসাবে দেখে এবং এটিকে তারা দুরদর্শন, সিনেমা, গাড়ী ভ্রমণ ইত্যাদি উপভোগ করার স্বাধীনতা বলে মনে করে।
শ্রীল প্রভুপাদঃ প্রযুক্তি স্বাধীনতা নয়। বস্তুতপক্ষে এটি নরকে যাওয়ার মুক্ত পথ। এটি স্বাধীনতা নয়। প্রত্যেকেই তার সক্ষমতা অনুযায়ী কর্মে লিপ্ত থাকা উচিত। যদি তোমার মেধা থাকে তাহলে তুমি একজন ব্রহ্মণের কর্ম করতে পার।- শাস্ত্র অধ্যয়ন, পুস্তক রচনা এবং অন্যকে শিক্ষা দান।
এটি ব্রাহ্মণের কর্ম। তোমাকে তোমার জীবিকা সম্বন্ধে চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। সমাজ তা সরবরাহ করবে। বৈদিক সভ্যতায় ব্রাহ্মণরা বেতনের জন্য কাজ করতেন না।
তাঁরা বেদ অধ্যয়ন করতেন এবং অন্যকে শিক্ষা দান করতে ব্যস্ত থাকতেন এবং সমাজ তাদের খাদ্যের যোগান দিত। ক্ষত্রিয়দের জন্য, সমাজের অন্যান্য সকলের সুরক্ষা প্রদান করা তার কাজ।
বিপদ থাকতে পারে, আক্রমণ থাকতে পারে এবং ক্ষত্রিয়দের সেই সকল বিপদ থেকে মানুষকে সুরক্ষা দেওয়া কর্তব্য।
তার জন্য তারা কর আরোপ করতে পারে। তারপর যারা ক্ষত্রিয়দের তুলনায় কম বুদ্ধিমান তারা হলো বৈশ্য, বণিক, সম্প্রদায়, যারা খাদ্য উৎপাদন করে এবং গোপালন করে। এই জিনিসগুলির প্রয়োজন আছে।
তার পরের জন্য হচ্ছে শূদ্র। তারা এই তিন উচ্চ শ্রেণীকে সাহায্য করে। এতি হচ্ছে সমাজের প্রকৃতিক বিভাগ এবং খুব ভাল। করাণ শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং এটি সৃষ্টি করেছেন। প্রত্যেকেই কর্মরত। মেধা শ্রেণী কর্মে রত, কর্মী শ্রেণী কর্মে রত এবং বাকীরা শূদ্র তারাও কর্মে রত, সেখানেই লড়াই করার জন্য কোন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজন নেই।
বৈদিক সময়ে এরকম কোন কর্মকান্ড ছিল না। রাজা ছিলেন পরিদর্শক, তিনি দেখতেন যে, প্রত্যেকে তার নির্ধারিত কর্মে রত আছে কিনা। সুতরাং মানুষের কাছে মিথ্যার রাজনৈতিক দল গঠন, বিশেষ প্রদর্শন এবং একে অপরের সঙ্গে লড়াই করার মতো কোন সময় থাকত না।
কিন্তু সমস্ত কিছুর শুরুতে এটা বুঝতে হবে, আমি এই দেহ নই’ এবং শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় বারা বারা এই বিজ্ঞানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
আরও পড়ুনঃ
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?
* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়
* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য)