বৃন্দাবনের বাইরে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিলাস
বৃন্দাবনের বাইরে ভগবানের শ্রীকৃষ্ণের লীলাবিলাস
শ্রী উদ্ধব বললেন—“তারপর শ্রীকৃষ্ণ বলদেবসহ মথুরাপুরীতে গিয়ে তাঁদের পিতামাতার আনন্দবিধানের জন্য জনসাধারণের নেতা কংসকে তার সিংহাসন থেকে টেনে এনে মহাবলে তাকে ভূমিতে ফেলে হত্যা করেছিলেন।
তাঁর গুরু সান্দীপনি মুনির কাছে থেকে কেবল একবার মাত্র শ্রবণ করে তিনি বিভিন্ন শাখা সমেত সমগ্র বেদ হৃদয়ঙ্গম করেছিলেন এবং তাঁর গুরুদেবের প্রার্থনা অনুসারে তাঁর পুত্রকে যমলোক থেকে ফিরিয়ে এনে তাঁকে উপহার দিয়েছিলেন।
রাজা ভীষ্মকের কন্যা রুক্মিণীর সৌন্দর্য ও সৌভাগ্যে আকৃষ্ট হয়ে বহু রাজা এবং রাজপুত্র তাঁকে বিবাহ করার জন্য স্বয়ংবর সভায় উপস্থিত হয়েছিলেন।
কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ সেই সমস্ত রাজাদের মস্তকে পদক্ষেপ করে, গরুড় যেভাবে অমৃত কলস নিয়ে গিয়েছিল, ঠিক সেইভাবে রুক্মিণীকে হরণ করেছিলেন।
অবিদ্ধনাসা সাতটি বৃষকে দমন করে তিনি রাজকুমারী নাগ্নজিতীকে স্বয়ংবরে বিবাহ করেছিলেন। যদিও ভগবান কন্যারত্নটিকে জয় করেছিলেন, তবুও সেই রাজকন্যার পাণিগ্রহণে অভিলাষী তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীরা তাঁর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিলেন এবং তার ফলে তাঁদের মধ্যে সংগ্রাম হয়েছিল।
অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত ভগবান তাঁদের সকলকে হত্যা করেছিলেন অথবা আহত করেছিলেন, কিন্তু তিনি নিজে অক্ষত ছিলেন। সাধারণ মানুষ যেভাবে পত্নীর প্রীতিসাধন করে, তেমনই তাঁর পত্নীকে সন্তুষ্ট করার জন্য শ্রীকৃষ্ণ স্বর্গ থেকে পারিজাত বৃক্ষ হরণ করে নিয়ে এসেছিলেন।
স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র তার পত্নীর প্ররোচনায় (স্ত্রৈণ হওয়ার ফলে), ভগবানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তার সমগ্র সামরিক শক্তিসহ তাঁর পিছু পিছু ধাবিত হয়েছিল।
ধরিত্রীর পুত্র নরকাসুর সমগ্র গগনমণ্ডল তার শরীরের দ্বারা গ্রাস করতে চেয়েছিল এবং সেই জন্য যুদ্ধে ভগবান তাকে হত্যা করেন। তার মাতা তখন ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, তার ফলে নরকাসুরের রাজ্য তিনি তার পুত্রকে ফিরিয়ে দেন এবং তারপর তিনি সেই অসুরের অন্তঃপুরে প্রবেশ করেছিলেন।
নরকাসুর কর্তৃক অপহৃতা রাজকন্যারা আর্তবন্ধু শ্রীহরিকে দর্শন করে, তৎক্ষণাৎ উঠে দাঁড়িয়ে অত্যন্ত আনন্দ, লজ্জা ও অনুরাগযুক্ত দৃষ্টির দ্বারা তাকে পতিরূপে গ্রহণ করেছিলেন।
শ্রীকৃষ্ণ তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির প্রভাবে নানা গৃহে অবস্থিত সেই সমস্ত রাজকন্যাদের অনুরূপ ভিন্ন ভিন্ন প্রকার রূপ ধারণ করে, একইসময়ে শাস্ত্র বিধিমতে তাদের বিবাহ করেছিলেন।
তাঁর অপ্রাকৃত রূপে নিজেকে বিস্তার করার জন্য ভগবান তাঁদের প্রত্যেকের গর্ভে ঠিক তাঁর নিজের মতো গুণসম্পন্ন দশ-দশটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন।
কালযবন, মগধরাজ জরাসন্ধ এবং শাল্ব সসৈন্যে মথুরাপুরী অবরোধ করেছিল, তখন ভগবান তাঁর ভক্তদের তেজ প্রদর্শন করার জন্য তাদের বধ করেননি। শম্বর, দ্বিবিদ, বাণ, মুর, ববল ও দন্তবক্র আদি বহু অসুরদের কয়েকজনকে তিনি নিজে বধ করেন এবং অন্যদের শ্রীবলদেব ইত্যাদির দ্বারা বধ করিয়েছিলেন।”
“হে বিদুর! তারপর কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে আপনার ভ্রাতুষ্পুত্রদের পক্ষপাতী হয়ে আগত সেই সমস্ত রাজাদেরও ভগবান বিনাশ করেছিলেন।
সেই সমস্ত রাজারা এত শক্তিশালী ছিল যে, যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের পদক্ষেপে পৃথিবী কম্পিত হয়েছিল। কর্ণ, দুঃশাসন ও সৌবনের কুমন্ত্রণায় দুর্যোধন হতশ্রী এবং হতায়ু হয়েছিল। তার অনুচরকাসহ সে যখন ভগ্ন শুরু হয়ে ভূমিতে লুটাচ্ছিল, শ্রীকৃষ্ণ সেইভাবে তাকে দর্শন করে আনন্দিত হননি।”
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের পর ভগবান বলেছিলেন— 'দ্রোণ, ভীষ্ম, অর্জুন এবং ভীমের সহায়তায় অষ্টাদশ অক্ষৌহিণীযুক্ত পৃথিবীর বিশাল ভার হরণ হয়েছে, কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার থেকে উৎপন্ন যদুবংশের মহাভার এখনও বর্তমান, যা পৃথিবীর পক্ষে অত্যন্ত দুর্বিষহ হতে পারে।
যখন সেই যাদবেরা মধুপানে উন্মত্ত হয়ে আরও লোচনে পরস্পরের সঙ্গে কলহে প্রবৃত্ত হবে, তখন সেই বিবাদই তাদের বিনাশের কারণ হবে, অন্য আর কোন উপায়ে তা সম্ভব নয়।
আমার অন্তর্ধানের পর তা ঘটবে।' ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এইভাবে মনে মনে চিন্তা, করে, ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে তাঁর রাজ্যে স্থাপন করে এবং সাধুদের বর্ম প্রদর্শন করে সুহৃৎদের আনন্দবিধান করেছিলেন।
পুরুবংশধরের যে ভ্রূণটি মহাবীর অভিমন্যু কর্তৃক তাঁর পত্নী উত্তরার গর্ভে সংস্থাপিত হয়েছিল, তা দ্রোণপুত্র অশ্বত্থামার ব্রহ্মাস্ত্রে দগ্ধ হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে ভগবান তা পুনরায় রক্ষা করেছিলেন।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠিরকে দিয়ে তিনটি অশ্বমেধ যজ্ঞ সম্পাদন করিয়েছিলেন এবং মহারাজ যুধিষ্ঠিরও সর্বদা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুবর্তী হয়ে, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতাদের সহায়তায় পৃথিবী পালন করে, আনন্দে কালযাপন করেছিলেন।
বিশ্ব অন্তর্যামী ভগবানও দ্বারকাপুরীতে অবস্থান করে বৈদিক সিদ্ধান্ত অনুসারে জীবনযাপন করে আনন্দ আস্বাদন করেছিলেন। তিনি সাংখ্য দর্শনের নির্দেশ অনুসারে জ্ঞান এবং বৈরাগ্যে অবস্থিত ছিলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্নিগ্ধ সহাস্য অবলোকন, অমৃততুল্য মধুর বাক্য, নির্দোষ চরিত্রসহ লক্ষ্মীদেবীর নিবাসস্থলস্বরূপ তাঁর অপ্রাকৃত শ্রীবিগ্রহে সেখানে বিরাজমান ছিলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই পৃথিবীতে এবং অন্যান্য লোকে (উচ্চতর দিব্যলোকে) বিশেষ করে যাদবদের সঙ্গে তাঁর লীলাসমূহ উপভোগ করেছিলেন। রাত্রে অবসর সময়ে তিনি তাঁর পত্নীদের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ দাম্পত্য প্রেম উপভোগ করেছিলেন।
এইভাবে ভগবান বহু বছর গৃহস্থ জীবনে প্রবৃত্ত ছিলেন, তারপর প্রপঞ্চে প্রকটিত গৃহস্থসুলভ ক্ষণভঙ্গুর কামভোগের জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করার বাসনা তাঁর পূর্ণরূপে প্রকাশিত হয়েছিল।”
“প্রত্যেক জীব দৈব কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত এবং তার ফলে তার ইন্দ্রিয় সুখভোগও সেই দৈবের অধীন । তাই ভক্তিযোগে ভগবানের সেবা করার মাধ্যমে যাঁরা ভগবানের ভক্ত হতে পেরেছেন, তাঁরা ছাড়া অন্য কারো পক্ষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের কার্যকলাপে শ্রদ্ধা বা প্রীতি স্থাপন করা সম্ভব নয়।
এক সময় যদু ও ভোজবংশীয় রাজকুমারেরা খেলা করতে করতে মুনিদের ক্রোধ উৎপাদন করেছিলেন এবং তার ফলে, ভগবানের ইচ্ছা অনুসারে, সেই মুনিগণ তাঁদের অভিশাপ দিয়েছিলেন।
তার কয়েক মাস পর, শ্রীকৃষ্ণ কর্তৃক বিমোহিত হয়ে, দেবতাদের অবতার বৃষ্ণি, ভোজ এবং অন্ধকবংশীয়েরা মহা আনন্দে তাঁদের রথে চড়ে প্রভাস । তীর্থে গিয়েছিলেন।
কিন্তু যাঁরা ছিলেন ভগবানের নিত্য ভক্ত, তাঁরা দ্বারকাতেই ছিলেন। সেখানে গিয়ে তাঁরা সকলে স্নান করেছিলেন এবং সেই তীর্থের জল দিয়ে পূর্বপুরুষ, দেবতা ও ঋষিদের সন্তুষ্টিবিধানের জন্য তর্পণ করেছিলেন।
তারপর তাঁরা রাজকীয়ভাবে ব্রাহ্মণদের বহু গাভীদান করেছিলেন। ব্রাহ্মণদের কেবল সুপুষ্ট গাভীই দান করা হয়নি, তাঁদের স্বর্ণমুদ্রা, রজত, শয্যা, বস্ত্র, মৃগচর্ম, কম্বল, রথ, হাতি, ঘোড়া, কন্যা এবং জীবিকানির্বাহের জন্য পর্যাপ্ত ভূমিও দান করা হয়েছিল।
তারপর তাঁরা সেই সমস্ত ব্রাহ্মণদের ভগবানকে নিবেদিত অত্যন্ত সুস্বাদু খাদ্যদ্রব্য নিবেদন করে, মস্তক দ্বারা ভূমি স্পর্শ করে, তাঁদের প্রণাম করেছিলেন। সেই সমস্ত যাদবেরা গাভী এবং ব্রাহ্মণদের রক্ষা করার মাধ্যমে পরিপূর্ণ আদর্শ জীবন যাপন করেছিলেন।”
আরও পড়ুনঃ
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?
* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়
* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য)