বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য)
বিষ্ণুর অবতার
ব্রহ্মা বললেন—“যখন অনন্ত শক্তিশালী ভগবান গর্ভ সমুদ্রে নিমজ্জিত পৃথিবীকে উদ্ধার করার জন্য লীলাচ্ছলে বরাহ রূপ ধারণ করেছিলেন, তখন আদি দৈত্য (হিরণ্যাক্ষ) সেখানে এসে উপস্থিত হয়েছিল এবং ভগবান তাকে তাঁর দত্ত দ্বারা বিদীর্ণ করেছিলেন।
সর্বপ্রথমে প্রজাপতি রুচির পত্নী আকুতির গর্ভে সুযজ্ঞ নামে পুত্র উৎপন্ন হয়েছিল। তারপর সুযজ্ঞ তাঁর পত্নী দক্ষিণার গর্ভে সুযম প্রমুখ দেবতাদের উৎপাদন করেছিলেন।
সুষম ইন্দ্রদেবরূপে ত্রিলোকের (ঊর্ধ্ব, অধো এবং মধ্যবর্তী) মহান দুঃখভার হরণ করেছিলেন। ব্রহ্মাণ্ডের দুঃখভার হরণ করেছিলেন বলে মানব জাতির পিতা স্বায়ম্ভূব মনু তাঁকে হরি নামে অভিহিত করেছিলেন।
ভগবান তারপর কপিলদের রূপে প্রজাপতি কর্দম এবং তাঁর পত্নী দেবহূতির পুত্ররূপে নয়জন রমণীসহ (ভগ্নী) অবতরণ করেছিলেন। তিনি তাঁর মাতাকে আত্মজ্ঞান দান করেছিলেন, যার ফলে তিনি এই জন্মেই প্রকৃতির গুণরূপ পক্ষ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিধৌত হয়ে কপিলদেবের প্রদর্শিত পন্থায় মুক্তি লাভ করেছিলেন।
অত্রি ঋষি সন্তান কামনা করে ভগবানের আরাধনা করেছিলেন, এবং ভগবান তার প্রতি প্রসন্ন হয়ে তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, 'আমি আমাকে তোমার পুত্ররূপে দান করলাম।' তার ফলে ভগবানের নাম দত্তাত্রেয় হয়েছিল।
তার শ্রীপাদপদ্মের পরাগ দ্বারা পবিত্র হয়ে যদু, হৈহয় আদি নৃপতিগণ ঐহিক ও পারলৌকিক ঐশ্বর্য লাভ করেছিলেন। বিভিন্ন লোক সৃষ্টি করার বাসনা করে আমি তপস্যা করেছিলাম, এবং আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান তখন চতুঃসন রূপে (সনক, সনৎকুমার, সনন্দন এবং সনাতন) আবির্ভূত হয়েছিলেন।
পূর্বকল্পে প্রলয়ে আত্মতত্ত্ব বিনষ্ট হয়েছিল, কিন্তু চতুঃসনেরা তা এত সুন্দরভাবে বর্ণনা করেছিলেন যে মুনিগণ তা তৎক্ষণাৎ স্পষ্টভাবে দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। তপশ্চর্যা এবং কৃচ্ছ্রসাধনের নিজস্ব পন্থা প্রদর্শনের জন্য তিনি ধর্মের পত্নী এবং দক্ষের কন্যা মূর্তির গর্ভে নর এবং নারায়ণ এই দ্বিবিধ স্বরূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
কামদেবের সঙ্গিনী অপ্সরাগণ তাঁর তপস্যা ভঙ্গ করতে এসে যখন দেখল যে তাদের মতো বহু সুন্দরীগণ তাঁর দেহ থেকে নির্গত হচ্ছে, তখন তারা বিফল মনোরথ হয়েছিল। শিবের মতো মহাবলবান ব্যক্তিরা তাঁদের রোষযুক্ত দৃষ্টির দ্বারা কামকে দগ্ধ করতে পারেন, কিন্তু তাঁদের নিজেদের ক্রোধের প্রভাব থেকে মুক্ত হতে পারেন না।
কিন্তু ক্রোধের অতীত ভগবানের অমল অন্তঃকরণে কখনো প্রবেশ করতে পারে না, অতএব তাঁর মনে কিভাবে কাম আশ্রয় গ্রহণ করবে?”
“রাজার সমক্ষে ধ্রুব বিমাতার বাক্যবাণে জর্জরিত হয়ে অপমানিত বোধ করেছিলেন, এবং বালক হওয়া সত্ত্বেও কঠোর তপস্যা করার জন্য বনে গমন করেছিলেন। ভগবান তখন ধ্রুবের প্রতি প্রসন্ন হয়ে তাঁকে ধ্রুবলোক প্রদান করেন, উপরিস্থিত এবং অবাঞ্ছিত মহর্ষিগণ যাঁর স্তব করে থাকেন।
মহারাজ বেন উৎপথগামী হয়েছিল এবং তখন ব্রাহ্মণদের বজ্র-কঠোর শাপবাক্যে তার পৌরুষ ও ঐশ্বর্য দগ্ধ হয়। সে নরকে পতিত হতে থাকলে ব্রাহ্মণদের প্রার্থনায় এবং তাকে পরিত্রাণ করার জন্য ভগবান পৃথু অবতারে তার পুত্রত্ব স্বীকার করেন এবং সর্বপ্রকার শস্য পৃথিবী থেকে দোহন করেন।
মহারাজ নাভি এবং তাঁর পত্নী সুদেবীর পুত্ররূপে ভগবান আবির্ভূত হয়ে ঋষভদের নামে পরিচিত লাভ করেন। ই তিনি মনের সাম্যভাব লাভের জন্য জড়-যোগ অনুশীলন ন করেছিলেন। এই অবস্থাকে পারমহংসপদ বা মুক্তির চরম ।
সিদ্ধ অবস্থা বলে মনে করা হয়, যে স্তরে জীব তার স্বরূপে অবস্থিত হয়ে পূর্ণরূপে প্রশান্ত চিত্ত হয়। ভগবান আমার (ব্রহ্মার) অনুষ্ঠিত যজ্ঞে হয়গ্রীব অবতার রূপে প্রকট হয়েছিলেন। তিনি সাক্ষাৎ যজ্ঞ এবং তাঁর অঙ্গকান্তি সুবর্ণস্বরূপ।
তিনি সাক্ষাৎ বেদ এবং সমস্ত দেবতাদের : পরমাত্মা। যখন তিনি শ্বাস গ্রহণ করেছিলেন, তখন তাঁর নাসারন্ধ্র থেকে সমস্ত মধুর বৈদিক স্তোত্র ধ্বনিত হয়েছিল।”
“কল্পান্তে সত্যব্রত নামক ভাবী বৈবস্বত মনু দেখতে পাবেন যে মৎস্যাবতাররূপে ভগবান পৃথিবী পর্যন্ত সর্বপ্রকার জীবাত্মাদের আশ্রয়। কেননা কল্পান্তে প্রলয় বারির ভয়ে ভীত হয়ে বেদ-সমূহ আমার (ব্রহ্মার) মুখ থেকে নির্গত হয়, এবং ভগবান তখন সেই বিশাল জলরাশি দর্শন করে উৎফুল্ল হন এবং বেদ-সমূহকে রক্ষা করেন।
আদিদের ভগবান কূর্মরূপ ধারণ করে। অমৃতলাভের জন্য ক্ষীর-সমুদ্র মন্থনকারী দেবতা ও দানবদের মন্থনদণ্ডস্বরূপ মন্দর পর্বত পৃষ্ঠে ধারণ করেছিলেন। সেই পর্বতের ঘূর্ণনের ফলে অর্ধনিদ্রিত অবস্থায় ভগবান কয়ন সুখ অনুভব করেছিলেন।
পরমেশ্বর ভগবান দেবতাদের মহাভয় দূর করার জন্য ভয়ঙ্কর ভ্রূকুটি, দন্ত ও ভীষণ বদনযুক্ত নৃসিংহরূপ ধারণপূর্বক গদা হস্তে আক্রমণকারী দৈত্যরাজকে (হিরণ্যকশিপুকে) তাঁর উরুদেশে স্থাপন করে নখ দ্বারা তার বক্ষঃস্থল বিদীর্ণ করেছিলেন।
অধিক বলশালী কুমীর যখন জলের মধ্যে যূথপতি গজরাজের পদ ধারণ করে, তখন সেই গজরাজ অত্যন্ত কাতর হয়ে তার শুণ্ডের দ্বারা একটি পদ্ম ধারণ করে ভগবানকে সম্বোধন করে বলেছিল, 'হে আদি পুরুষ, আপনি সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডের পতি।
হে পরিত্রাণকারী, আপনি তীর্থক্ষেত্রের মতো বিখ্যাত। আপনার দিব্য নাম স্মরণ করা মাত্রই সকলে পবিত্র হয়, তাই আপনার নাম কীর্তনীয়।' চক্রপাণি শ্রীহরি সেই শরণার্থী গজরাজের আর্তনাদ শ্রবণ করে পক্ষী রাজা গরুড়ের পৃষ্ঠে আরোহণপূর্বক তাঁর চক্রের দ্বারা কুমীরের বদন দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন এবং কৃপাপূর্বক গজরাজের শুঁড় ধরে তাকে কুমীরের মুখ থেকে উদ্ধার করেছিলেন।"
“গুণাতীত ভগবান অদিতি-পুত্র আদিত্যদের মধ্যে বয়সে সর্বকনিষ্ঠ হলেও গুণে সর্বপেক্ষা শ্রেষ্ঠা ছিলেন। সেই যজ্ঞাধিষ্ঠাতা ভগবান বিষ্ণু পানিক্ষেপের বারা ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত লোক অতিক্রম করেন। ত্রিপাদ ভূমি ভিক্ষা করার ছলে তিনি বামনরূপে বলি মহারাজের অধিকৃত সমগ্র ভূবন অধিগ্রহণ করেছিলেন।
তিনি ভিক্ষার ছলে তা গ্রহণ করেছিলেন, কেননা নিগ্রহ এবং অনুগ্রহ করতে সমর্থ জনেরা সব কিছু করতে পারলেও ব্যতিরেকে সৎপথচারী ব্যক্তিকে ঐশ্বর্য করা তাদেরও কর্তব্য নয়। বলি মহারাজ, যিনি তাঁর মস্তকে ভগবানের পদধৌত জল ধারণ করেছিলেন, তাঁর গুরুর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি তাঁর প্রতিশ্রুতি ব্যতীত অন্য আর কিছু চিন্তা করেননি। ভগবানের তৃতীয় চরণ রাখবার জন্য তিনি তাঁর দেহ নিবেদন করেছিলেন।
এই প্রকার ব্যক্তির কাছে হারিাজাও মূল্যহীন, যা তিনি স্বীয় বলের দ্বারা অধিকার করেছিলেন “হে নারদ! সেই ভগবান হংসাবতারে তোমার ঐকান্তিক ভক্তিতে পরিতুষ্ট হয়ে তোমাকে পরিপূর্ণভাবে ভক্তিযোগ এবং ভগবত্তত্ত্ববিজ্ঞান বিশ্লেষণ করেছিলেন। বাসুদেবের ঐকান্তিক ভক্তরাই কেবল সেই অন হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।
মন্বন্তর অবতারে ভগবান মনুর বংশধররূপে তাঁর সুদর্শন চক্রের দ্বারা দুষ্কৃতকারী রাজাদের দমন করেন। সর্বাবস্থায় অপ্রতিহতভাবে তাঁর রাজ্য শাসনের মহিমা এবং তাঁর কীর্তি ত্রিভুবনেরও ঊর্ধ্বে, ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চলোক সত্যলোকেও বিস্তার লাভ করেছিল।
ভগবান ধন্বন্তরিরূপে অবতীর্ণ হয়ে নিরন্তর রুগ্ন জীবদের তাঁর স্বীয় কীর্তির দ্বারা অচিরেই রোগ নিরাময় করেন এবং তার প্রভাবেই দেবতারা দীর্ঘ জীবন লাভ করেন। এইভাবে পরমেশ্বর ভগবান নিরন্তর মহিমান্বিত হন। পূর্বে দৈত্যদের দ্বারা যে যজ্ঞভাগ অবরুদ্ধ হয়েছিল, তাও তিনি উদ্ধার করেন।
তিনি এই ব্রহ্মাণ্ডে আয়ুর বিষয়ক বেদ বা চিকিৎসা শাস্ত্র প্রবর্তন করেন। যখন ক্ষত্রিয় নামধারী শাসকেরা পরম সত্যের পথ থেকে ভ্রষ্ট হয়ে নরক যন্ত্রণা ভোগের অভিলাষী হয়েছিল, তখন পরশুরামরূপে অবতীর্ণ হয়ে ভগবান পৃথিবীর কণ্টকস্বরূপ সেই সমস্ত রাজাদের উচ্ছেদ করেছিলেন। এইভাবে তিনি তাঁর তীক্ষ্ণধার কুঠারের দ্বারা একুশবার ক্ষত্রিয়দের বিনাশ সাধন করেছিলেন।”
"এই ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত জীবের প্রতি অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে ভগবান তাঁর অংশসহ মহারাজ ইক্ষাকুর বংশে অন্তরঙ্গা শক্তি সীতাদেবীর পতিরূপে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর পিতা মহারাজ দশরথের আজ্ঞানুসারে তিনি তাঁর পত্নী এবং কনিষ্ঠ ভ্রাতাসহ বনে গমন করেছিলেন এবং দীর্ঘকাল সেখানে বসবাস করেছিলেন।
অত্যন্ত শক্তিশালী দশমুণ্ড রাবণ তাঁর প্রতি মহা অপরাধ করেছিল এবং তার ফলে চরমে সে বিনাশপ্রাপ্ত হয়েছিল। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীরামচন্দ্র, তাঁর প্রিয়তমা সীতার বিরহে ব্যথিত হয়ে (ত্রিপুর দগ্ধ করতে ইচ্ছুক) মহাদেবের মতো ক্রোধে আরক্তিম নয়নে রাবণের নগরী লঙ্কার প্রতি দৃষ্টিপাত করেছিলেন।
তখন সমুদ্র ভয়ে কম্পমান হয়ে তাঁকে পথ প্রদান করেছিলেন, কেননা তাঁর আত্মীয়-স্বজন, জলচর মকর, সর্প, কুমীর প্রভৃতি ভগবানের ক্রোধাগ্নির তাপে দগ্ধ হচ্ছিল।
রাবণ যখন যুদ্ধ করছিল তখন তার বক্ষঃস্থলের সঙ্গে সংঘর্ষ হওয়ার ফলে দেবরাজ ইন্দ্রের বাহন ঐরাবত হস্তীর দন্তরাজি ভগ্ন হয়েছিল এবং তাদের ভগ্ন অংশসমূহ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হওয়ায় দিকসমূহ আলোকিত হয়েছিল, রাবণ তখন তার শক্তির গর্বে গর্বিত হয়ে উভয় পক্ষের সৈন্যদের মধ্যে অট্টহাস্য করতে করতে বিচরণ করেছিল।
কিন্তু শ্রীরামচন্দ্র সেই পরস্ত্রী হরণকারী রাবণের সেই হাস্যকে তাঁর ধনুকের টঙ্কার মাত্রই প্রাণের সঙ্গে বিনাশ করেছিলেন।”
"পৃথিবী যখন অসুররূপ নৃপতিদের সৈন্যসমূহের দ্বারা ভারাক্রান্ত হয়েছিল, তখন সে ভার অপনোদনের জন্য ভগবান তাঁর অংশসহ আবির্ভূত হন। সুন্দর কৃষ্ণবর্ণ কেশদামসহ ভগবান তাঁর আদিরূপে আবির্ভূত হয়ে অলৌকিক কার্যকলাপ সম্পাদন করার মাধ্যমে তাঁর অপ্রাকৃত মহিমা বিস্তার করেন।
তাঁর মহিমা কেউই যথাযথভাবে অনুমান করতে পারে না। শ্রীকৃষ্ণ যে পরমেশ্বর ভগবান সে সম্বন্ধে কোন সন্দেহ নেই। মাতৃক্রোড়স্থিত ক্ষুদ্র শিশুরূপে বিশাল শরীরা পুতনা রাক্ষসীর প্রাণবধ, তিনমাসের শিশু অবস্থায় পদাঘাতে শকট ভঞ্জন,
হামাগুড়ি দিয়ে গমনপূর্বক গগনস্পর্শী অতি উচ্চ অর্জুনবৃক্ষযুগলের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে তাদের উৎপাটন, এই সমস্ত কার্য স্বয়ং ভগবান ছাড়া আর কার পক্ষে সম্ভব? যখন গোপ বালকেরা এবং তাদের পশুরা যমুনার বিষাক্ত জল পান করেছিল, ভগবান (তাঁর বাল্য অবস্থায়) তাঁর কৃপাপূর্ণ দৃষ্টিপাতের দ্বারা তাদের পুনরুজ্জীবিত করেছিলেন।
যমুনার জলকে বিশুদ্ধ করার জন্য তাতে ঝাঁপ দিয়ে তিনি খেলার ছলে বিষের তরঙ্গ উদ্গীরণকারী কালীয় নাগকে দণ্ড দান করেছিলেন। পরমেশ্বর ভগবান ব্যতীত কে এইপ্রকার অসম্ভব কার্য সম্পাদন করতে পারে?
কালীয় নাগকে দণ্ড দান করার পর সেই রাত্রেই যখন ব্রজবাসীরা নিশ্চিন্তে নিদ্রা মগ্ন ছিলেন, তখন শুষ্ক পাতা থেকে বনে দাবানল প্রজ্বলিত হওয়ার জন্য ব্রজবাসীদের জীবন সংশয় হয়ে উঠলে ভগবান বলদেবসহ কেবলমাত্র তাঁর চক্ষু নিমীলন করার মাধ্যমে তাঁদের রক্ষা করেছিলেন। এমনই অলৌকিক ভগবানে.. কার্যকলাপ।”
“গোপরমণী (শ্রীকৃষ্ণের মাতা যশোদা) যখন প্রচুর রজ্জুর দ্বারা শ্রীকৃষ্ণকে বন্ধন করার জন্য চেষ্টা করতে লাগলেন, তাঁকে বন্ধন করার পক্ষে সে সমস্ত রজ্জুই অপর্যাপ্ত বলে প্রতিভাত হয়েছিল। অবশেষে হতাশ হয়ে সেই প্রয়াস ত্যাগ করলে শ্রীকৃষ্ণ ধীরে ধীরে জ্বগুন করার ছলে তাঁর মুখ ব্যাদন করেছিলেন;
তখন তাঁর মা তাঁর মুখের ভিতর সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড দর্শন করে মনে মনে আশঙ্কিত হয়ে উঠলেও তাঁর পুত্রের যোগমায়ার প্রভাবে তিনি ভিন্নভাবে আশ্বস্ত হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পিতা নন্দ মহারাজকে বরুণপাশের ভয় থেকে রক্ষা করেছিলেন,
এবং ময়দানবের পুত্র যখন গোপবালকদের পর্বতের গুহায় আটক করে রেখেছিল, তখন তিনি তাদের রক্ষা করেছিলেন। ব্রজবাসীরা যখন সারাদিন কঠোর পরিশ্রম করার ফলে রাত্রে গভীর নিদ্রায় মগ্ন হতেন, তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁদের চিজ্জগতের সর্বোচ্চ লোকে উন্নীত করে পুরষ্কৃত করতেন।
এই সমস্ত কার্যকলাপ অপ্রাকৃত এবং তা নিঃসন্দেহে শ্রীকৃষ্ণের ভগবত্তা প্রমাণ করে। বৃন্দাবনের গোপেরা যখন শ্রীকৃষ্ণের নির্দেশে ইন্দ্রের যজ্ঞ বন্ধ করে দিয়েছিলেন, তখন সাতদিন ধরে নিরস্তর মুষলধারায় বৃষ্টি হতে থাকলে বৃন্দাবন ভেসে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিল।
ব্রজবাসীদের প্রতি তাঁর অহৈতুকী কৃপার প্রভাবে শ্রীকৃষ্ণ তখন সাত বছর বয়স্ক বালক হওয়া সত্ত্বেও ব্ৰজ পশুদের রক্ষা করার জন্য গোবর্ধন পর্বতকে সাত দিন একটি ছাতার মতো এক হাতে ধারণ করেছিলেন।
ভগবান যখন শুভ্র চন্দ্রকিরণে উদ্ভাসিত নিশিতে বৃন্দাবনের বনে মধুর সঙ্গীতের দ্বারা ব্রজবধূদের কামপীড়া উদ্দীপিত করে রাসনৃত্য করতে উন্মুখ হবেন, তখন ধনাঢ্য কুবেরের অনুচর শব্ঙ্খচূড় নামক দৈত্য সেই ব্রজরমণীদের হরণ করবে এবং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তখন তার ধড় থেকে মস্তকটি ছেদন করবেন।
প্রলম্ব, ধেনুক, বক, কেশী, অরিষ্ট, চাপুর, মুষ্টিক, কুবলয়াপীড় হস্তী, কংস, যবন, নরকাসুর এবং পৌণ্ড্রকের মতো অসুরেরা তথা শাল্বের মতো মহারথী, দ্বিবিদ বানর এবং কবল, দম্ভবক্র, সপ্তবৃষ, শম্বর, বিদুরথ এবং রুক্মি প্রমুখ প্রসিদ্ধ রাজাগণ, এবং কাম্বোজ, মৎস্য, কুরু, সৃঞ্জয় এবং কেকয় প্রমুখ মহান যোদ্ধাগণ সাক্ষাৎ শ্রীহরির সঙ্গে অথবা বলদেব, অর্জুন, ভীম ইত্যাদি নামে তাঁরই সঙ্গে প্রচণ্ড যুদ্ধ করবে।
এইভাবে নিহত হওয়ার ফলে এই সমস্ত অসুরেরা নির্বিশেষ ব্রহ্মজ্যোতি প্রাপ্ত হবে অথবা বৈকুণ্ঠলোকে ভগবানের স্বীয় ধাম প্রাপ্ত হবে।
কালক্রমে মানুষেরা যখন সঙ্কুচিত বুদ্ধি এবং অল্প আয়ুসম্পন্ন হবে, তখন তাদের পক্ষে বৈদিক জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করা কঠিন হবে বলে বিবেচনা করে ভগবান সত্যবতীর পুত্র (ব্যাসদেব) রূপে আবির্ভূত হয়ে যুগের পরিস্থিতি অনুসারে কোয়েলী কল্পবৃক্ষকে বিভিন্ন শাখায় বিভক্ত করবেন।
নাস্তিক অসুরেরা বৈদিক বিজ্ঞানে অত্যন্ত দক্ষ হয়ে, মহাবিজ্ঞানী ময়দানব কর্তৃক নির্মিত মহাকাশযানে চড়ে গগনমার্গে অদৃশ্যভাবে বিচরণ করবে, তখন তাদের মোহাচ্ছন্ন করার জন্য অত্যন্ত আকর্ষণীয় বুদ্ধ রূপে আবির্ভূত হয়ে তিনি উপধর্ম প্রচার করবেন।”
“তারপর কলিযুগের শেষে, যখন তথাকথিত সধু এবং উচ্চতর তিন বর্ণের সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিদের গৃহেও ভগবানের কথা আলোচনা হবে না এবং যখন রাষ্ট্রের শাসন-ব্যবস্থা জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত শূদ্র অথবা তার থেকেও নিকৃষ্ট স্তরের মানুষদের হাতে ন্যস্ত হবে,
এবং যখন স্বাহা, স্বধা, বষট্ ইত্যাদি বৈদিক মন্ত্র আর শোনা যাবে না, তখন ভগবান পরম দণ্ডদাতারূপে আবির্ভূত হবেন। সৃষ্টির প্রারম্ভে তপস্যা, আমি (ব্রহ্মা) এবং প্রজাপতিগণ তারপর স্থিতি সময়ে জীবিষ্ণু, নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা সমন্বিত দেবতাগণ এবং বিভিন্ন লোকের রাজাগণ, এবং সংহারকালে অধর্ম, রুদ্র, এবং ক্রোধী নাস্তিক ইত্যাদি এরা সকলেই বহু শক্তিধারী ভগবানের শক্তির বিভিন্ন প্রতিনিধি।
শ্রীবিষ্ণুর পরাক্রম কে সম্পূর্ণরূপে বর্ণনা করতে পারে? কোন বৈজ্ঞানিক ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত পরমাণু গণনা করে থাকতে পারে, কিন্তু তার পক্ষেও বিষ্ণুর বীর্য গণনা করা সম্ভব নয়। কেননা তিনি তাঁর ত্রিবিক্রম অবতারে এই ব্রহ্মাণ্ডের সর্বোচ্চ লোক সত্যলোকেরও ঊর্ধ্বে প্রকৃতির তিন গুণের সাম্য অবস্থা পর্যন্ত তাঁর পদ-বিক্ষেপ করেছিলেন, এবং তার ফলে সমস্ত ব্রহ্মাণ্ড কম্পমান হয়েছিল।
আমি বা তোমার অগ্রজ মুনিগণও সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবানকে পূর্ণরূপে জানতে পারি না, সুতরাং আমাদের পরে যাদের জন্ম হয়েছে তারা কিভাবে তাঁকে জানবে? ভগবানের প্রথম অবতার শেষ সহস্র বদনে তাঁর গুণাবলী নিরন্তর গান করেও এখনও পর্যন্ত তার সীমা পাননি।
যাঁরা নিষ্কপটে পরমেশ্বর ভগবানের শরণাগত হয়েছেন, তাঁরা ভগবানের বিশেষ কৃপার প্রভাবে দুস্তর ভব-সমুদ্র উত্তীর্ণ হতে পারেন এবং ভগবানকে জানতে পারেন। কিন্তু যারা কুকুর শৃগালের ভক্ষ্য এই জড় দেহটির প্রতি আসক্ত, তারা কখনোই তা পারে না।"
“হে নারদ, যদিও ভগবানের শক্তি অজ্ঞেয় এবং অপরিমেয়, তথাপি তাঁর শরণাগত হওয়ার ফলে আমরা জানি কিভাবে তিনি তাঁর যোগমায়ার দ্বারা কার্য করেন। এইভাবে ভগবানের শক্তি তুমি, ভগবান শিব, দৈত্যশ্রেষ্ঠ প্রহ্লাদ, স্বায়ত্ত্বর মনু, তাঁর পত্নী শতরূপা, মনু-সন্তান প্রিয়ব্রত,
উত্তানপাদ, আকৃতি, দেবহূতি, প্রসুতি, প্রাচীনবার্হ, ঋভু, বেনের পিতা অঙ্গ, মহারাজ ধ্রুব, ইক্ষ্বাকু, ঐল, মুচকুন্দ, মহারাজ জনক, গাধি, রঘু, অম্বরীষ, সগর, গয়, নাহ, মান্ধাতা, অলক, শতধনু, অনু, রস্তিদেব, ভীষ্ম, বলি, অমূৰ্ত্তরয়, দিলীপ, সৌভরি, উতঙ্ক, শিবি, দেবল,
পিঙ্গলাদ, সারস্বত, উদ্ভব, পরাশর, ডুরিবেশ, বিভীষণ, হনুমান, শুকদেব গোস্বামী, অর্জুন, অরিটসেন, বিদুর, শ্রুতদেব ইত্যাদি ব্যক্তিরা অবগত আছেন।
শুদ্ধ ভক্তের শরণাগত হওয়ার ফলে এবং ভক্তি যোগে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার ফলে স্ত্রী, শূদ্র, হণ, শবর আদি পাপজীবীরাও এমনকি পশু-পাখিরা পর্যন্ত ভগবত্তত্ত্ব বিজ্ঞান অবগত হয়ে মায়ার মোহময় বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে।
ব্রহ্ম-উপলব্ধি শোকরহিত অসীম আনন্দে পূর্ণ। তা অবশ্যই পরম পুরুষ ভগবানের পরম পদ। তিনি নিত্য ক্ষোভরহিত এবং অভয়। তিনি জড় পদার্থের বিপরীত পূর্ণ চেতনায়। নির্মল এবং ভেদরহিত তিনি সমস্ত কারণ এবং কার্যের পরম কারণ।
তাঁর সকাম কর্মের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের প্রয়োজন হয় না, এবং মায়া তাঁর সামনে অবস্থান করতে পারে না। এইপ্রকার অপ্রাকৃত অবস্থায়, জ্ঞানী অথবা যোগীদের মতো, কৃত্রিমভাবে মনকে সংযত করার, মনোধর্মপ্রসূত জল্পনা কল্পনা করার অথবা ধ্যান করার প্রয়োজন হয় না,
ঠিক যেমন বর্ষার নিয়ন্ত্রণকারী দেবরাজ ইন্দ্রকে জল পাওয়ার জন্য কূপ খনন করার কষ্ট করতে হয় না। যা কিছু মঙ্গলময় সে সবেরই পরম প্রভু হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, কেননা জড় অথবা চিন্ময় অস্তিত্বে জীবের সমস্ত কার্যের ফল তিনিই প্রদান করেন।
তাই তিনি হচ্ছেন পরম উপকারী। প্রতিটি জীবই জন্মরহিত, তাই দেহের অভ্যন্তরে বিরাজমান বায়ুর মতো আত্মার বা জীবের অস্তিত্ব জড় দেহের বিনাশের পরেও বর্তমান থাকে।”
“হে পুত্র, আমি তোমাকে সংক্ষেপে পরমেশ্বর ভগবানের তত্ত্ব বর্ণনা করলাম, যিনি হচ্ছেন এই প্রকাশিত জগতের স্রষ্টা। সেই পরমেশ্বর ভগবান হরি বিনা এই ব্যক্ত এবং অব্যক্ত জগতের আর অন্য কোন কারণ নেই।
হে নারদ, এই ভগবত্তত্ত্ব-বিজ্ঞান, শ্রীমদ্ভাগবত পরমেশ্বর ভগবান সংক্ষেপে আমাকে বলেছিলেন। এই ভগবত্তত্ত্ব বিজ্ঞান হচ্ছে তাঁর বিভিন্ন শক্তির সমন্বয়ের বর্ণনা। তুমি এই বিজ্ঞান সম্প্রসারিত কর। নিষ্ঠা সহকারে এই ভগবত্তত্ত্ব তুমি বর্ণনা কর যাতে মানুষ সমস্ত জীবের পরমাত্মা এবং সমস্ত শক্তির পরম উৎস, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির প্রতি অপ্রাকৃত ভক্তি লাভ করতে পারে।
ভগবানের বিভিন্ন শক্তির সঙ্গে সম্পর্কিত ভগবানের কার্যকলাপ, তাঁর শিক্ষা অনুসারে কীর্তন, অভিনন্দন এবং শ্রবণ করা উচিত। নিয়মিত ভাবে ভক্তি ও শ্রদ্ধা সহকারে তা করা হলে জীব কখনোই মায়ার দ্বারা মোহিত হবে না।”
আরও পড়ুনঃ
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?
* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়