শুকদেব গোস্বামীকে মহারাজ পরীক্ষিতের প্রশ্ন-অমল পুরান শ্রীমদ্ভাগবত

মহারাজ পরীক্ষিতের প্রশ্ন

 মহারাজ পরীক্ষিতের প্রশ্ন

 

মহারাজ পরীক্ষিৎ শুকদেব গোস্বামীকে জিজ্ঞাসা করলেন—“হে ব্রাহ্মণ, ব্রহ্মা কর্তৃক উপদিষ্ট হয়ে দেবতার ন্যায় দর্শন বিশিষ্ট শ্রীনারদমুনি কেমনভাবে এবং কাদের কাছে প্রাকৃত গুণরহিত শ্রীভগবানের অপ্রাকৃত গুণাবলী বর্ণনা করেছিলেন?”


রাজা বললেন “আমি অপূর্ব শক্তিমান শ্রীহরির কথা শ্রবণ করতে ইচ্ছুক, যা সমস্ত লোকের সমস্ত জীবের পক্ষে কল্যাণকর।” “হে মহাভাগ্যবান শুকদেব গোস্বামী, দয়া করে আপনি শ্রীমদ্ভাগবতের কথা বর্ণনা করতে থাকুন যাতে আমি জড় গুণ থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে আমার মনকে পরমাত্মায়, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণে নিবেশিত করে আমার কলেবর পরিত্যাগ করতে পারি। 

 

যাঁরা নিয়মিতভাবে শ্রদ্ধাপূর্বক শ্রীমদ্ভাগবত শ্রবণ করেন, তাঁদের হৃদয়ে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অচিরেই প্রকাশিত হন। পরমাত্মা, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শব্দরূপী অবতার (অর্থাৎ শ্রীমদ্ভাগবত) স্বরূপ সিদ্ধ ভক্তের হৃদয়ে প্রবেশ করে ভাবরূপ কমলাসনে অধিষ্ঠিত হয় এবং কাম, ক্রোধ, লোভ আদি জড়জাগতিক আসক্তি প্রসূত সমস্ত মলিনতাকে বিদূরিত করে, ঠিক যেমন শরৎ ঋতুর আগমনে কদমাক্ত জলাশয়ের মলিনতা সম্পূর্ণভাবে বিনষ্ট হয়ে যায়। 

 

ভগবদ্ভক্তির প্রভাবে যাঁর হৃদয় নির্মল হয়েছে, ভগবানের সেই ভক্ত কখনোই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় পরিত্যাগ করেন না। কেননা সেখানে তিনি পরম তৃপ্তি লাভ করেন, ঠিক যেমন দীর্ঘ ক্লেশকর পথ ভ্রমণের পর গৃহে প্রত্যাবর্তন করে পথিক  সম্পূর্ণরূপে তৃপ্ত হয়।”


“হে বিদ্বান ব্রাহ্মণ! চিন্ময় আত্মা জড় দেহ থেকে ভিন্ন। জীব কি কোন কারণের বশবর্তী হয়ে নাকি ঘটনাচক্রে আকস্মিক দেহ প্রাপ্ত হয়? আপনি তা জানেন, তাই আপনি দয়া করে আমাকে তা বলুন। 

 

যাঁর উদর থেকে পদ্ম নাল প্রাদুর্ভূত হয়েছে সেই পরমেশ্বর ভগবান যদি তাঁর ক্ষমতা এবং পরিমিত অনুসারে বিরাট শরীরযুক্ত হন, তাহলে তাঁর সেই শরীর এবং সাধারণ জীবের শরীরের মধ্যে পার্থক্য কোথায়? 

 

যার জন্ম কোন জড় উৎস থেকে হয়নি, পক্ষান্তরে ভগবানের নাভি থেকে উদ্ভূত কমল থেকে হয়েছে এবং সেই সূত্রে যিনি জন্মরহিত, সেই ব্রহ্মা জগতের সমস্ত প্রাণীসমূহের স্রষ্টা। ভগবানের কৃপায় সেই ব্রহ্মা তাঁকে দর্শন করতে সক্ষম হয়েছিল।

 

 কৃপা করে আপনি সেই পরমেশ্বর ভগবানের কথা বলুন যিনি পরমাত্মারূপে সকলের হৃদয়ে বিরাজ করেন এবং যিনি সমস্ত শক্তির ঈশ্বর হলেও বহিরঙ্গা মায়াশক্তি যাঁকে স্পর্শ করতে পারে না।”


“হে বিদ্বান ব্রাহ্মণ, পূর্বে বিশ্লেষণ করা হয়েছে যে ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত গ্রহলোক তাদের পালকগণসহ বিরাট পুরুষের বিরাট শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে অবস্থিত। আমি এও শুনেছি যে বিভিন্ন ভুবন হচ্ছে বিরাট পুরুষের বিরাট শরীর। কিন্তু তাদের প্রকৃত স্থিতি কি? দয়া করে আপনি কি তা বিশ্লেষণ করবেন? 

 

দয়া করে আপনি সৃষ্টি এবং প্রলয়ের অন্তর্বর্তী কাল (কক্স), গৌণ সৃষ্টি (বিকল্প) এবং অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ শব্দের দ্বারা সূচিত কালের প্রকৃতি সম্বন্ধে বিশ্লেষণ করুন। দেবতা, মানুষ ইত্যাদি নামে পরিচিত বিভিন্ন গ্রহলোকের বিভিন্ন জীবের আয়ুর কাল এবং পরিমিতি সম্বন্ধেও বিশ্লেষণ করুন।”


“হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! দয়া করে আপনি কালের ক্ষুদ্র এবং বৃহৎ পরিমিতির কারণ এবং কর্ম অনুসারে কালের কিভাবে সূচনা হয়, তা বর্ণনা করুন। কিভাবে বিভিন্ন গুণ থেকে উৎপন্ন ফলের এবং জীবের বাসনা অনুসারে জীব দেবতা থেকে অত্যন্ত নগণ্য প্রাণী পর্যন্ত উন্নীত হয়। 

 

অথবা অধঃপতিত হয়, সেই সম্বন্ধেও আপনি দয়া করে বিশ্লেষণ করুন।” “হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ! দয়া করে আপনি বর্ণনা করুন ভূমি, পাতাল, দিক, আকাশ, গ্রহ, নক্ষত্র, পর্বত, নদী, সমুদ্র, দ্বীপ, এবং সেই সমস্ত স্থানে যে সমস্ত প্রাণীরা বাস করে তাদের উৎপত্তি কিভাবে হয়। 

 

বাহ্য ও অভ্যন্তর ভেদে এই ব্রহ্মাণ্ডের পরিমাণ, মহাত্মাদের চরিত্র এবং যে যে লক্ষণ ও স্বভাব অনুসারে বর্ণ ও আশ্রমধর্ম নির্দিষ্ট হয়, তাও কৃপা করে বলুন। বিভিন্ন যুগ, তাদের পরিণাম, যুগধর্মসমূহ এবং পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির যুগাবতারদের অতি আশ্চর্য কার্যকলাপ আপনি রূপা করে বর্ণনা করুন। 

 

কৃপা করে এও বলুন যে মানব সমাজের সাধারণ ধর্ম কি. ধর্ম অনুষ্ঠানের বিশেষ কর্তব্য কি, বর্ণাশ্রম ধর্ম কি, রাজর্ষিদের ধর্ম কি এবং বিপদাপন্ন মানুষদের ধর্ম কি। সৃষ্টির তত্ত্বসমূহ এবং তাদের সংখ্যা, তাদের কারণ এবং তাদের লক্ষণ, ভগবদ্ভক্তির পন্থা এবং অষ্টাঙ্গ যোগের বিধিও আপনি দয়া করে বর্ণনা করুন। 

 

মহান যোগীদের ঐশ্বর্য কি এবং তাঁদের চরম উপলব্ধি কি? সিদ্ধ যোগী কিভাবে তাঁর সূক্ষ্ম শরীর থেকে মুক্ত হন? ইতিহাস পুরাণ আনি শাখা সমন্বিত বৈদিক শাস্ত্রসমূহের প্রকৃত জ্ঞান কি? 

 

দয়া করে আপনি বলুন জীবের উৎপত্তি কিভাবে হয়, কিভাবে তাদের পালন হয় এবং কিভাবে তাদের সংহার হয়। ভগবদ্ভক্তির অনুকূল ও প্রতিকূল বিষয় কি কি। বৈদিক বিধি এবং বেদের অনুগামী শাস্ত্রসমূহের নির্দেশ কি, এবং ধর্ম, অর্থ এবং কাম এই ত্রিবর্গের সাধনের বিধি কি? 

 

দয়া করে আপনি বিশ্লেষণ করুন ভগবানের শরীরে লীনপ্রাপ্ত জীবাদির সৃষ্টি হয় কিভাবে, পাষণ্ডীদের উৎপত্তি হয় কিভাবে, এবং জীবের বন্ধন এবং মোক্ষের কারণ কি এবং তার স্বরূপে সে কিভাবে অবস্থান করে।  

 

স্বতন্ত্র পরমেশ্বর ভগবান তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তির দ্বারা তাঁর লীলা আস্বাদন করেন, এবং প্রলয়ের সময় তিনি সে সমস্ত তাঁর বহিরঙ্গা শক্তিতে পরিত্যাগ করেন, এবং তিনি কেবল সাক্ষীরূপে অবস্থান করেন। 

 

পরমেশ্বর ভগবানের প্রতিনিধি হে মহামুনি, আমি প্রথম থেকে আপনার কাছে যে সমস্ত প্রশ্ন করেছি এবং যে সমস্ত বিষয় প্রশ্ন করতে পারিনি, কৃপাপূর্বক আপনি যথাযথভাবে সে সমস্ত বিষয়ে বর্ণনা করুন। 

 

যেহেতু আমি আপনার শরণাগত, আপনি আমাকে সে সম্বন্ধে পূর্ণজ্ঞান প্রদান করুন। হে মহর্ষি! আত্মযোনি ব্রহ্মার মতো আপনিই একমাত্র এই জিজ্ঞাসিত বিষয় সমূহের তত্ত্ববেত্তা। 

 

এই জগতে অন্যান্য সকলে পূর্ববর্তী জ্ঞানীগণের আচরিত বিষয়েরই অনুসরণ করেন। হে ব্রাহ্মণ! যেহেতু আমি আপনার বাণী-সমুদ্র থেকে প্রবাহিত অচ্যুত পরমেশ্বর ভগবানের কথামৃত পান করেছি, তাই আমি অনশনজনিত কোন ক্লান্তি অনুভব করছি না।"


সুত গোস্বামী বললেন— “মহারাজ পরীক্ষিৎ কর্তৃক এইভাবে ভক্তসহ শ্রীকৃষ্ণের কথা বলতে আমন্ত্রিত হয়ে শুকদেব গোস্বামী অত্যন্ত আনন্দিত হলেন। মহারাজ পরীক্ষিতের প্রশ্নের উত্তরে তিনি সৃষ্টির প্রারম্ভে সর্বপ্রথম কল্পে ভগবান ব্রহ্মাকে যে বেদগর্ভ ভাগবত নামক পুরাণ বলেছিলেন, 

 

তা বলতে করলেন। মহারাজ পরীক্ষিৎ ছিলেন পাণ্ডুবংশের শ্রেষ্ঠ উত্তরাধিকারী এবং তাই তিনি উপযুক্ত ব্যক্তির কাছে উপযুক্ত প্রশ্ন করতে সক্ষম হয়েছিলেন। শুকদেব গোস্বামীও মহারাজ পরীক্ষিতের সেই সমস্ত প্রশ্নের উত্তর প্রদান করার জন্য নিজেকে প্রস্তুত করলেন।"

 

আরও পড়ুনঃ

 

* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব

 

* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা 

 

* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন 

 

* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার

* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?

* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়

* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য) 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url