পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
কলি ও পরিক্ষীৎ মহারাজের কথপোকথন
সূত গোস্বামী বললেন—“সেখানে উপস্থিত হয়ে মহারাজ পরীক্ষিৎ দেখলেন যে, এক শূদ্র রাজবেশ ধারণ করে একটি দণ্ডের দ্বারা অনাথবৎ একটি গাভী ও বৃষকে প্রহার করছে। বৃষটি শ্বেতপদ্মের মতো শুভ্রবর্ণ।
শূদ্রের প্রহারে সে এমনি ভয়ভীত হয়ে পড়েছিল যে, মূত্র ত্যাগ করে কম্পিত হচ্ছিল এবং এক পায়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
গাভীটি ধর্মস্রাবী হওয়ার ফলে অত্যন্ত শুভদা হলেও তিনি যেন দীনা এবং বৎসহীনা। শূদ্রটি তাঁর পদে আঘাত করছিল। তাই তাঁর নয়ন অশ্রুসিক্ত এবং তিনি অত্যন্ত কৃশা হয়ে তৃণ ভক্ষণ করবার জন্য আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করছিলেন।"
সুবর্ণখচিত রথে আরূঢ় হয়ে, ধনুর্বাণে সুসজ্জিত মহারাজ পরীক্ষিৎ সেই শূদ্রকে বজ্রগম্ভীর স্বরে জিজ্ঞাসা করলেন—“তুই কে? বলবান হওয়া সত্ত্বেও তুই এই পৃথিবীতে আমার আশ্রিত অসহায়দের হত্যা করতে সাহস করছিস?
তুই নটের মতো রাজবেশ ধারণ করেছিস্ বটে, কিন্তু তোর কার্যকলাপ ক্ষত্রিয় নীতির বিরোধী। শ্রীকৃষ্ণ গাণ্ডীবধারী অর্জুনসহ দুরে প্রস্থান করেছেন বলে তুই কি নির্জনে নিরপরাধ প্রাণীকে বধ করতে সাহস করছিস্? তার ফলে তোর যে অপরাধ হয়েছে, তাতে তুই বধের উপযুক্ত।”
মহারাজ পরীক্ষিৎ তখন বৃষটিকে জিজ্ঞাসা করলেন—“আপনি কে? আপনি কি মৃণালশুভ্র কোন বৃষ, না কোনও দেবতা? আপনি তিনটি চরণ হারিয়েছেন এবং মাত্র এক পদে নির্ভর করে বিচরণ করছেন।
আপনি কি কোনও দেবতা বৃষরূপ ধারণ করে আমাদের ছলনা। করছেন? কৌরবশ্রেষ্ঠ বীরদের ভুজ বলে সুরক্ষিত কোনও রাজ্যে এই প্রথম আপনাকে অশ্রুজলে অনুতপ্ত হতে দেখলাম।
এখনও পর্যন্ত এই পৃথিবীতে রাজকীয় অবহেলার ফলে কারও অশ্রুপাত হতে দেখা যায়নি। হে সুরভীনন্দন, আপনার আর শোক করার প্রয়োজন নেই। নিম্নশ্রেণীর শূদ্রটিকে ভয় পাওয়ারও দরকার নেই।
আর, হে গোমাতা। আপনিও আর রোদন করবেন না। দুষ্টদের শাসনকর্তা আমি জীবিত থাকতে আপনার মঙ্গলই হবে। হে সাধ্বি, যে রাজার রাজ্যে প্রজারা অসৎ ব্যক্তিদের দ্বারা সন্ত্রস্ত হয়, সেই দুরাচার নরপতির যশ, পরমায়ু সৌভাগ্য ও পরলোকে উৎকৃষ্ট পুনর্জন্মাদি সবই নাশ প্রাপ্ত হয়।
উৎপীড়িতদের দুঃখ-দুর্দশা দূর করা অবশ্যই রাজার পরম ধর্ম, তাই আমি অতীব জঘন্য এই মানুষটির প্রাণ অবশ্যই সংহার করব, কারণ সে অন্যান্য প্রাণীদের প্রতি হিংস্র হয়ে উঠেছে।”
তিনি (মহারাজ পরীক্ষিৎ) সেই বৃষটিকে পুনরায় জিজ্ঞাসা করলেন—“হে সুরভীনন্দন, কে আপনার তিনটি পা ছেদন করেছে? পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনুবর্তী রাজাদের রাজ্যে আপনার মতো দুঃখ ত আর কারও হয়নি?”
“হে বৃষ, আপনি নিরপরাধ এবং সম্পূর্ণ সাধু প্রকৃতির; তাই আপনার সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল হোক। দয়া করে আপনি আমাকে বলুন কোন্ দুষ্টজনে আপনার অঙ্গ ছেদন করেছে, যার ফলে পৃথাপুত্রদের যশ ও কীর্তি কলুষিত হচ্ছে?
যারা নিরপরাধ জীবের কষ্টের কারণ, এই জগতের সর্বত্রই আমি তাদের কাছে ভয়ের কারণ। দুর্বৃত্তদের দমনের মাধ্যমে স্বাভাবিকভাবে যে কেউই সাধুগণের কল্যাণ সাধন করেন। যে দুর্বৃত্ত নিরপরাধ জীবের প্রতি হিংসা করে অপরাধী হয়েছে, সে যদি স্বর্গের বর্ম-অলংকৃত সাক্ষাদ্ দেবতাও হয়, তবু আমি তার বাহু ছেদ করে ফেলব।
যারা শাস্ত্রের অনুশাসন অনুসারে নিজ নিজ ধর্ম পালন করেন, তাঁদের পালন করা এবং যখন জরুরী অবস্থা থাকে না, তখনও যারা শাস্ত্রবিধি উল্লঙ্ঘন করে আপৎশূন্য স্বাভাবিক কালেও বিপথগামী হয়, তাদের যথাশাস্ত্র তিরস্কার করাই শাসনকারী রাজার পরম ধর্ম।”
ধর্মরাজ বললেন—“যে পাণ্ডবদের ভক্তিভাবময় গুণবৈশিষ্ট্যাদিতে বিমুগ্ধ হয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পর্যন্ত দৌত্যাদি কর্তব্যকর্ম পালন করেছিলেন, আপনি সেই পাণ্ডবদেরই বংশধরের মতো উপযুক্ত কথাই বলেছেন।
হে নরশ্রেষ্ঠ, কোন্ বিশেষ দুরাচারী যে আমাদের দুঃখ দুর্দশা ঘটিয়েছে, তা নির্ণয় করা খুবই কঠিন, কারণ বহু মতাবলম্বী দার্শনিকদের বিভিন্ন সব অভিমতের দ্বারা আমরা বিমুগ্ধ হয়ে গেছি। কিছু দার্শনিক যাঁরা সব রকমের দ্বৈতভাব অস্বীকার করেন,
তাঁরা প্রচার করেন যে, জীব নিজেই নিজের সুখ-দুঃখের জন্য দায়ী। অন্যেরা বলে যে, অতিমানবীয় শক্তিই সুখ-দুঃখের জন্য দায়ী।
আবার অন্যেরা বলে যে, কর্মই সুখ-দুঃখের কর্তা; তেমনি আবার জড়বাদীরা বলে যে, স্বভাব বা প্রকৃতি আমাদের সুখ-দুঃখের পরম কারণ।
কিছু মনীষী আছেন, যাঁরা বিশ্বাস করেন যে, যুক্তি বিচারের সাহায্যে দুঃখ শোকের কারণ নির্ণয় করতে কেউ পারে না, বা কল্পনার সাহায্যেও তা জানতে পারে না, অথবা ভাষায় প্রকাশ করতেও পারে না। হে রাজর্ষি, আপনার নিজের মনীষার সাহায্যে এই সকল বিষয়ে চিন্তা করে আপনি নিজেই বিচার করুন।”
সূত গোস্বামী বললেন—“হে দ্বিজশ্রেষ্ঠ, এইভাবে মহারাজ পরীক্ষিৎ ধর্মরাজের কথা শ্রবণ করে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট হলেন এবং নির্ভুল ও বিগতমোহ হয়ে তিনি তার উত্তর দিলেন।”
মহারাজ পরীক্ষিৎ বললেন—“হে বৃষরূপধারী ধর্মজ্ঞ। ধর্ম শাস্ত্রে বলা হয় যে, অধার্মিক বা পাপাচারীর যে স্থান লাভ হয়, অধর্ম নির্দেশকেরও সেই স্থান লাভ হয়ে থাকে।
সেই জন্য আপনার অনিষ্টকারীকে জেনেও আপনি তার পরিচয় দিচ্ছেন না, সুতরাং নিশ্চয়ই আপনি সাক্ষাৎ ধর্ম বৃষরূপ ধারণ করেছেন মাত্র।
এইভাবে দৈবী মায়ার গতি নিশ্চয় জীবেদের মন এবং বাক্যের অগোচর, এতে কোনও সন্দেহ নেই। সত্যযুগে তপস্যা, শৌচ, দয়া ও সত্য রূপ তোমার চারটি পা প্রতিষ্ঠিত ছিল। কিন্তু এখন আমি দেখছি যে, অহঙ্কার, স্ত্রীসঙ্গ এবং নেশাজনিত মত্ততা রূপে বর্ধমান অধর্মের প্রভাবে তোমার তিনটি পা ভগ্ন হয়েছে।
এখন আপনি সত্যরূপ একটি মাত্র পায়ের উপর ভর করে কোন মতে দাঁড়িয়ে আছেন। কিন্তু এই অধর্মরূপী কলি ক্রমশ প্রবঞ্চনার দ্বারা সংবর্ধিত হয়ে আপনার ঐ পদটিও ধ্বংস করার চেষ্টা করছে।
পরমেশ্বর ভগবান এবং অন্যেরা অবশ্যই পৃথিবীর ভার হরণ করেছিলেন। তিনি যখন এখানে অবতরণ করেন, তখন তাঁর মঙ্গলময় পদচিহ্নের প্রভাবে সর্বতোভাবে পৃথিবীর মঙ্গল সাধিত হয়েছিল।
দুর্ভাগ্যবশত পরমেশ্বর ভগবান কর্তৃক পরিত্যক্তা হয়ে সাধ্বী ধরিত্রী, ‘আমাকে ব্রাহ্মণ বিদ্বেষী শূদ্রেরা রাজা হয়ে ভোগ করবে'—এই বলে শোক করতে করতে অশ্রু ত্যাগ করছিলেন।
এইভাবে মহারথী (সহস্র শত্রুর সঙ্গে এককভাবে সংগ্রাম করতে সক্ষম) পরীক্ষিৎ, ধর্ম এবং পৃথিবীকে সান্ত্বনা দান করে, অধর্মের কারণ স্বরূপ কলিকে সংহার করার জন্য তীক্ষ্ণ খড়গ গ্রহণ করলেন।
কলি যখন দেখলেন যে, রাজা তাকে বধ করতে উদ্যত, তখন ভয়ে বিহ্বল হয়ে সে তার রাজবেশ পরিত্যাগ করে তাঁর পদতলে অবনতমস্তকে নিপতিত হয়ে আত্মসমর্পণ করল।
দীনবৎসল, শরণাগত পালক, যশস্বী মহাবীর মহারাজ পরীক্ষিৎ তাকে চরণতলে নিপতিত দেখে কৃপাবশত তাকে বধ করলেন না এবং যেন ঈষৎ হাস্য করতে করতে বলতে লাগলেন, 'আমরা অর্জুনের যশের উত্তরাধিকারী;
তাই তুমি যখন কৃতাঞ্জলিপুটে আমার শরণাগত হয়েছ, তখন আমি তোমাকে বধ করব না, কিন্তু তুমি আমার রাজ্যের কোন স্থানে থাকতে পারবে না, কেননা তুমি অধর্মের প্রধান সহচর।
কলি বা অধর্মকে যদি রাজা বা রাষ্ট্রনেতারূপে আচরণ করতে দেওয়া হয়, তা হলে অবশ্যই লোভ, মিথ্যা, চৌর্য, অসভ্যতা, বিশ্বাসঘাতকতা, দুর্ভাগ্য, কপটতা, কলহ ও দত্ত প্রভৃতি অধর্মসমূহ প্রবলভাবে বৃদ্ধি পাবে।
অতএব, হে অধর্মবন্ধু! পরমেশ্বর ভগবানের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য যেখানে সত্য ও ধর্মের ভিত্তিতে যজ্ঞ বিস্তারনিপুণ যাজ্ঞিকেরা যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেন, সেই ব্রহ্মাবর্ত প্রদেশে তোমার থাকা উচিত নয়।
যজ্ঞে যদিও কখনও কখনও কোন দেবতা পূজিত হন, তথাপি সেই পূজার মাধ্যমে পরমেশ্বর ভগবানেরই পূজা হয়ে থাকে, কারণ তিনি স্থাবর ও জঙ্গম সকলেরই আত্মা এবং তিনি বায়ুর মতো সকলেরই অন্তরে ও বাইরে অবস্থিত। সেই ভগবান শ্রীহরি যজ্ঞের দ্বারা সন্তুষ্ট হয়ে যাজ্ঞিকদের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গল সাধন করেন।' "
শ্রীসূত গোস্বামী বললেন—“এইভাবে মহারাজ পরীক্ষিৎ কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে কলি ভয়ে কাঁপতে লাগল। তরবারি হস্তে তাকে বধ করতে উদ্যত পরীক্ষিৎ মহারাজকে তখন তার কাছে যমরাজের মতো মনে হয়েছিল।
তখন সে মহারাজ পরীক্ষিতকে বলতে লাগল, ‘হে পৃথিবীর একমাত্র সম্রাট, আপনার আজ্ঞানুসারে আমি যেখানে বাস করব বলে মনস্থ করছি, সেখানে আমি ধনুর্বাণসহ আপনাকে দেখতে পাচ্ছি।
অতএব, হে ধার্মিক-শ্রেষ্ঠ, আপনি এমন কোন স্থান নির্দেশ করুন, যেখানে আমি স্থিরচিত্তে আপনার আজ্ঞা পালন করতে পারি।'
সৃত গোস্বামী বললেন—“কলির এই আবেদন শ্রবণ করে মহারাজ পরীক্ষিৎ তাকে যেখানে দ্যুত ক্রীড়া, আসব পান, অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ এবং পশু হত্যা হয়, সেই সেই স্থানে থাকবার অনুমতি দিলেন।
কলি (উক্ত চতুর্বিধ স্থান পাওয়া সত্ত্বেও) পুনরায় স্থান প্রার্থনা করলে মহারাজ পরীক্ষিৎ তাকে সুবর্ণে বসবাসের অনুমতি প্রদান করলেন।
কেননা যেখানেই সুবর্ণ সেখানেই মিথ্যা, মত্ততা, কাম এবং হিংসা বর্তমান। অধর্মাশ্রয় কলি, উত্তরানন্দন পরীক্ষিতের আজ্ঞা শিরোধার্য করে তাঁর দেওয়া সেই পাঁচটি স্থানে বাস করতে লাগল।
অতএব যে মানুষ মঙ্গলময় প্রগতি আকাঙ্ক্ষা করেন, বিশেষ করে রাজা, লোকনেতা, ধর্মনেতা, ব্রাহ্মণ এবং সন্ন্যাসী—তাঁদের পক্ষে, ঐ সমস্ত অধর্ম আচরণে লিপ্ত হওয়া কখনো উচিত নয়।
তারপর মহারাজ পরীক্ষিৎ বৃষরূপ ধর্মের তপঃ, শৌচ এবং দয়ারূপ তিনটি ভগ্ন চরণ পুনঃ প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন এবং তাঁর আশ্বাসপূর্ণ কার্যকলাপেরমাধ্যমে পৃথিবীর প্রভূত উন্নতি সাধন করেছিলেন।
মহা সৌভাগ্যশালী সম্রাট মহারাজ পরীক্ষিৎ বনগমনে অভিলাষী পিতামহ মহারাজ যুধিষ্ঠির কর্তৃক অর্পিত রাজোপযুক্ত সিংহাসনে সেই সময় উপবিষ্ট হলেন।
এখন সেই রাজর্ষি, মহাভাগ, চক্রবর্তী, মহাযশা, পরীক্ষিৎ কৌরব রাজলক্ষ্মীর দ্বারা মহিমান্বিত হয়ে হস্তিনাপুরে অবস্থান করছেন। অভিমন্যু-পুত্র মহারাজ পরীক্ষিৎ এতই মহৎ গুণসম্পন্ন যে, তাঁর দ্বারা এই পৃথিবী শাসিত হয়েছে বলেই আপনাদের পক্ষে এই প্রকার যজ্ঞ করা সম্ভব হয়েছে।”
আরও পড়ুনঃ