লক্ষ্মী দেবী: ধন, সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের প্রতিমা – সম্পূর্ণ বর্ণনা

 

লক্ষ্মী দেবী: ধন, সমৃদ্ধি ও সৌন্দর্যের প্রতিমা – সম্পূর্ণ বর্ণনা

লক্ষ্মী দেবী হলেন হিন্দুধর্মে ধন, সম্পদ, আধ্যাত্মিক উন্নতি, সৌভাগ্য ও সৌন্দর্যের দেবী। তিনি বিষ্ণুর পত্নী এবং পার্বতী ও সরস্বতীর সাথে ত্রিদেবীর একজন। জৈন ধর্মেও লক্ষ্মীর মূর্তি দেখা যায়।


লক্ষ্মী দেবীর বাহন হল পেঁচা। তিনি ছয়টি বিশেষ গুণের দেবী এবং বিষ্ণুর শক্তির উৎস। মনে করা হয়, মহাবিশ্বের সৃষ্টি, রক্ষা ও রূপান্তরে তিনি বিষ্ণুকে সাহায্য করেন। যখন বিষ্ণু পৃথিবীতে অবতার রূপে আসেন, তখন লক্ষ্মীও তাঁর সঙ্গী হন।


হিন্দুরা সাধারণত প্রতি বৃহস্পতিবার লক্ষ্মী পূজা করেন। তবে নবরাত্রি, দীপাবলি ও কোজাগরী পূর্ণিমার সময় তাঁর বিশেষ পূজা হয়। কোজাগরী পূর্ণিমাতে যে লক্ষ্মী পূজা অনুষ্ঠিত হয়, তা কোজাগরী লক্ষ্মী পূজা নামে পরিচিত।


বৈদিক যুগে লক্ষ্মী সরাসরি আবির্ভূত না হলেও, 'শ্রী' শব্দটি - যা মঙ্গল, গৌরব ও উচ্চ পদ বোঝাত - পরবর্তী বৈদিক সাহিত্যে দেবী শ্রী-লক্ষ্মীরূপে যুক্ত হয়। বিষ্ণুকেন্দ্রিক সম্প্রদায়ে তিনি সর্বোচ্চ দেবী এবং শ্রী বৈষ্ণবধর্মের একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। এই বিশ্বাসে, লক্ষ্মীর প্রতি ভক্তি বিষ্ণুর কাছে পৌঁছানোর একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।


পৌরাণিক বিশ্বাস অনুসারে, দেবী লক্ষ্মীর আটটি প্রধান রূপ রয়েছে, যাদের 'অষ্টলক্ষ্মী' বলা হয়। এই রূপগুলি জীবনের বিভিন্ন দিক যেমন - সম্পদ, প্রাচুর্য, শস্য, সাহস, সন্তান, জ্ঞান, ক্ষমতা ও বিজয় - এর প্রতিনিধিত্ব করে।


লক্ষ্মী দেবীর মূর্তিতে সাধারণত তাঁকে পদ্মের উপর উপবিষ্ট বা দণ্ডায়মান অবস্থায় দেখা যায়। তাঁর হাতে পদ্ম থাকে, যা পবিত্রতা, সৌন্দর্য ও আধ্যাত্মিকতার প্রতীক। কখনও কখনও তাঁর পাশে দুটি হাতি দেখা যায়, যা কর্ম, শক্তি ও প্রাচুর্যের প্রতীক।


লক্ষ্মী দেবীর পূজা বাঙালি হিন্দুদের ঘরে একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসব। এই দিনে, ভক্তরা দেবীর আশীর্বাদ লাভের জন্য উপবাস রাখেন, মন্ত্র পাঠ করেন এবং বিভিন্ন ধরনের নৈবেদ্য নিবেদন করেন।

 

লক্ষী দেবীর কাহিনী

লক্ষ্মী দেবী হিন্দুধর্মে ধন, সম্পদ, প্রাচুর্য, ভাগ্য এবং সৌন্দর্যের দেবী। তিনি বিষ্ণুর স্ত্রী এবং তাঁর সঙ্গিনী শক্তি। লক্ষ্মী দেবীর বিভিন্ন কাহিনী প্রচলিত আছে, যার মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাহিনী নিচে দেওয়া হলো:

 

সমুদ্র মন্থনের কাহিনী:

পুরাণ অনুসারে, এক সময় দেবতারা এবং অসুররা সম্মিলিতভাবে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন অমৃতের জন্য। এই মন্থনের সময় সমুদ্র থেকে বহু মূল্যবান রত্নের সাথে দেবী লক্ষ্মীও উত্থিত হন। তিনি সৌন্দর্যের প্রতিমূর্তি এবং ঐশ্বর্যের প্রতীক রূপে আবির্ভূত হন। বিষ্ণু তাঁকে পত্নী রূপে গ্রহণ করেন। এই কাহিনীতে লক্ষ্মীর আবির্ভাবকে অত্যন্ত শুভ এবং তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করা হয়।

 

কৃষক ও দেবীর কাহিনী:

একটি জনপ্রিয় লোককাহিনী অনুসারে, এক দরিদ্র ও ধার্মিক কৃষক প্রতিদিন দেবী লক্ষ্মীর পূজা করত। দেবী তার ভক্তিতে প্রসন্ন হয়ে একদিন এক বৃদ্ধার বেশে তার কাছে আসেন এবং তাকে একটি সোনার থালা দান করেন। কিন্তু কৃষক থালাটি বিক্রি করে দিতে চাইলে দেবী তাকে থালার পরিবর্তে কিছু শস্য রাখতে বলেন। কৃষকের বিশ্বাসে অভাব ছিল বলে সে সামান্য শস্য নেয়। পরে যখন সে সেই শস্য দেখে, তখন তা সোনায় পরিণত হয়। কিন্তু তার অল্প বিশ্বাস এবং লোভের কারণে সে প্রচুর সম্পদ লাভ করতে পারেনি। এই কাহিনীটি বিশ্বাস ও সন্তুষ্টির গুরুত্ব তুলে ধরে।

কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার কাহিনী:

কোজাগরী পূর্ণিমা রাতে দেবী লক্ষ্মী মর্ত্যে নেমে আসেন এবং জিজ্ঞাসা করেন, "কে জেগে আছ?" যে ব্যক্তি সেই রাতে জেগে থেকে তাঁর পূজা করে, দেবী তার প্রতি প্রসন্ন হন এবং তাকে ধন-সম্পদ দান করেন। এই বিশ্বাস থেকেই কোজাগরী লক্ষ্মী পূজার প্রথা প্রচলিত হয়েছে।


লক্ষ্মী দেবীর এই কাহিনীগুলো থেকে আমরা সম্পদ, সমৃদ্ধি, বিশ্বাস, ভক্তি এবং সন্তুষ্টির গুরুত্ব সম্পর্কে জানতে পারি। দেবী লক্ষ্মী শুধু ধনসম্পদের দেবী নন, তিনি ধার্মিকতা ও কল্যাণেরও প্রতীক।

 

লক্ষী নারায়ণের সন্তান

লক্ষ্মী নারায়ণ, হিন্দুধর্মে বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর সম্মিলিত রূপকে বোঝায়। বিভিন্ন শাস্ত্রে তাঁদের সন্তানদের বিষয়ে বিভিন্ন মত প্রচলিত আছে।
কিছু পুরাণ অনুযায়ী, লক্ষ্মী ও নারায়ণের দুই পুত্র সন্তান রয়েছে:


  •  বল (Bala): এর অর্থ শক্তি বা সামর্থ্য।
  •  উৎসাহ (Utsaha): এর অর্থ উদ্যম বা উৎসাহ।


এছাড়াও, বিভিন্ন আঞ্চলিক বিশ্বাস ও ভিন্ন ভিন্ন শাস্ত্রে লক্ষ্মী ও নারায়ণের অন্যান্য সন্তানদের কথাও উল্লেখ পাওয়া যায়। যেমন:


  •  কিছু স্থানে মনে করা হয় কামদেব তাঁদের পুত্র।
  •  দক্ষিণ ভারতে অমৃতবল্লী ও সুন্দরবল্লীকে তাঁদের কন্যা রূপে গণ্য করা হয়।
  •  শ্রী সূক্তে আনন্দ, চিক্লীত,  শ্রীপ্রদ ও ইন্দিরা নামক ঋষিদের লক্ষ্মীর পুত্র বলা হয়েছে।


তবে সাধারণভাবে, বিষ্ণু ও লক্ষ্মীর সরাসরি সন্তান নেই বলেই মনে করা হয়। তাঁদের সম্মিলিত রূপ, লক্ষ্মী নারায়ণ স্বয়ং পূর্ণ ব্রহ্মাণ্ডের পিতামাতা রূপে পূজিত হন। তাঁদের বিভিন্ন অবতার (যেমন রাম-সীতা, কৃষ্ণ-রুক্মিণী) থেকে বংশ পরম্পরা বিস্তার লাভ করেছে বলে বিশ্বাস করা হয়।


লক্ষী পূজার মন্ত্র পাঠ

লক্ষ্মী পূজার বিভিন্ন মন্ত্র রয়েছে। এখানে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্র এবং তাদের অর্থ দেওয়া হলো:


১. প্রণাম মন্ত্র:

ওঁ বিশ্বরূপস্য ভার্যাসি পদ্মে পদ্মালয়ে শুভে । 
সর্ব্বতঃ পাহি মাং দেবী মহালক্ষ্মী নমহস্তুতে ।।

অর্থ: হে বিশ্বরূপের পত্নী, পদ্মবনে নিবাসকারিণী, কল্যাণী দেবী, তোমাকে প্রণাম করি। তুমি আমাকে সর্বতোভাবে রক্ষা করো। হে মহালক্ষ্মী, তোমাকে নমস্কার।


২. পুষ্পাঞ্জলি মন্ত্র:

নমস্তে সর্বদেবানাং বরদাসি হরিপ্রিয়ে । 
যা গতিস্ত্বৎ প্রপন্নানাং সা মে ভূয়াত্ত্বদর্চনাৎ ।। 
এষ সচন্দনগন্ধপুষ্প বিল্বপত্রাঞ্জলি শ্রীং লক্ষ্মীদেব্যৈ নমঃ ।।


অর্থ: হে সকল দেবতাদের বরদানকারিণী, বিষ্ণুপ্রিয়ে, তোমাকে প্রণাম করি। যারা তোমার শরণাগত, তাদের যে গতি হয়, তোমার পূজার ফলে আমারও যেন সেই গতি হয়। এই চন্দন, গন্ধ, পুষ্প ও বিল্বপত্র অঞ্জলি শ্রী লক্ষ্মী দেবীর উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি।


৩. ধ্যান মন্ত্র:

ওঁ পাশাক্ষমালিকাম্ভোজ-সৃণিভির্ষাম্য-সৌম্যয়োঃ । 
পদ্মাসনাস্থাং ধ্যায়েচ্চ শ্রিয়ং ত্রৈলোক্যমাতরম্ ।। 
গৌরবর্ণাং সুরুপাঞ্চ সর্বালঙ্কার-ভূষিতাম্  । 
রৌক্মপদ্ম-ব্যগ্রকরাং বরদাং দক্ষিণেন তু ।।   


 অর্থ: যাঁর বাম হস্তে পাশ ও অক্ষমালা, দক্ষিণ হস্তে পদ্ম ও অঙ্কুশ শোভিত; যিনি পদ্মাসনে উপবিষ্টা এবং ত্রিলোকের মাতা; যিনি গৌরবর্ণা, সুন্দরী এবং সর্বপ্রকার অলংকারে ভূষিতা; যাঁর হস্তে স্বর্ণপদ্ম এবং দক্ষিণ হস্ত বরদ মুদ্রা ধারণ করে আছে, সেই শ্রীদেবীকে ধ্যান করি।


৪. বীজ মন্ত্র:

ওঁ শ্রীং হ্রীং ক্লীং শ্রীং লক্ষ্মী মামাগৃহস্থিরো ভব ।

৫. গায়ত্রী মন্ত্র:

ওঁ মহালক্ষ্ম্যৈ বিদ্মহে বিষ্ণুপত্নৈ ধীমহি তন্নো লক্ষ্মী প্রচোদয়াৎ ।।

৬. লক্ষ্মী স্তোত্রম্:

ত্রৈলোক্য-পূজিতে দেবি কমলে বিষ্ণুবল্লভে । 
যথা ত্বং সুস্থিরা কৃষ্ণে তথা ভব ময়ি স্থিরা ।।
ঈশ্বরী কমলা লক্ষ্মীশ্চলা ভূতিহরিপ্রিয়া । 
পদ্মা পদ্মালয়া সম্পৎ প্রদায়িনী ।।


অর্থ: হে ত্রিলোকে পূজিতা দেবী, কমলাসনা, বিষ্ণুর প্রিয়তমা, যেমন তুমি কৃষ্ণের কাছে স্থির, তেমনই আমার কাছেও স্থির হও। ঈশ্বরী, কমলা, লক্ষ্মী, চঞ্চলা, ঐশ্বর্য্য, হরির প্রিয়া, পদ্মবাসিনী, পদ্মালয়া, সম্পদদায়িনী।

উপসংহারঃ

পরিশেষে বলা যায়, দেবী লক্ষ্মী শুধু ধনসম্পদের প্রতিমাই নন, তিনি সমৃদ্ধি, সৌন্দর্য এবং শুভশক্তিরও প্রতীক। তাঁর শান্ত ও সৌম্য মূর্তি আমাদের মনে আশার সঞ্চার করে, জীবনে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার প্রেরণা যোগায়। বিভিন্ন রূপে ও নামে পূজিত হলেও, প্রতিটি রূপেই তিনি কল্যাণময়ী ও ভক্তবৎসল।

লক্ষ্মী পূজা শুধু একটি আচার অনুষ্ঠান নয়, এটি জীবনে প্রাচুর্য, শান্তি ও মঙ্গল কামনার একটি আন্তরিক প্রচেষ্টা। দেবীর আশীর্বাদ লাভের জন্য আমাদের উচিত সততা, পরিশ্রম ও ন্যায়পরায়ণতার পথে চলা। আসুন, আমরা সকলে মিলে দেবী লক্ষ্মীর মহিমা উপলব্ধি করি এবং আমাদের জীবনকে তাঁর আশীর্বাদে পূর্ণ করে তুলি। তাঁর কৃপা সর্বদা আমাদের উপর বর্ষিত হোক – এই কামনাই করি।

জয় মা লক্ষ্মী!

 আরও পড়ুনঃ 

দুর্গা দেবীর প্রণাম মন্ত্র ও তার আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য

* দুর্গাপূজার কাহিনী, মা দুর্গা আসলে কে?  


 
🙏আপনি আমাদের তথ্যগুলি আরও যেসব মাধ্যমে পাবেন।🙏

👉WhatsApp চ্যানেল ফলো করে রাখুন – এখানে ক্লিক করুন।

👉Telegram চ্যানেল ফলো করে রাখুন – এখানে ক্লিক করুন।
 
👉Facebook পেজ ফলো করে রাখুন – এখানে ক্লিক করুন।

👉X (twitter) পেজ ফলো করে রাখুন – এখানে ক্লিক করুন।


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url