পৌরাণিক বর্ণনায় পাতাললোকের বর্ণনা

 

শ্রীমদ্ভাগবতের বর্ণনা অনুযায়ী শুকদেব গোস্বামী মহারাজ রাজা পরীক্ষিতকে মহাবিশ্বের বিস্ময়কর স্তরসমূহ, গ্রহলোক এবং পাতাললোক সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। 

 

সূর্য, চন্দ্র ও রাহুর অবস্থান

শুকদেব গোস্বামী বলেন, সূর্যের দশ হাজার যোজন নীচে রাহু গ্রহ অবস্থান করছে, যার বিস্তার প্রায় ত্রিশ হাজার যোজন। সূর্যমণ্ডলের আয়তন দশ হাজার যোজন এবং চন্দ্রমণ্ডল বিশ হাজার যোজন বিস্তৃত। 

 

রাহু সূর্য ও চন্দ্র উভয়ের প্রতিই বৈরী এবং এজন্য প্রতিটি অমাবস্যা ও পূর্ণিমায় সে তাদের আচ্ছাদিত করার চেষ্টা করে। তবে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সুদর্শন চক্র সর্বদা সূর্য ও চন্দ্রকে রক্ষা করে। এভাবেই আমরা আজ যেটিকে সূর্যগ্রহণ বা চন্দ্রগ্রহণ বলি, সেটি রাহুর আক্রমণ হিসেবেই ব্যাখ্যা করা হয়েছে।

 

আকাশ, অন্তরীক্ষ ও পৃথিবীর সীমা

রাহুর নীচে অবস্থিত সিদ্ধলোক, চারণলোক এবং বিদ্যাধরলোক। এরও নীচে যক্ষ, রাক্ষস, পিশাচ, ভূত-প্রেতের আবাসস্থল অন্তরীক্ষ বিস্তৃত।   

যতদূর মেঘ ভেসে বেড়ায় এবং বায়ু প্রবাহিত হয়, ততদূর পর্যন্ত অন্তরীক্ষ প্রসারিত। অন্তরীক্ষের প্রায় একশো যোজন নীচে পৃথিবীর অবস্থান। পৃথিবীর সীমা পর্যন্ত বৃহৎ পাখিরা উড়তে সক্ষম।

 

সাতটি অধোলোক বা পাতাললোক

পৃথিবীর নীচে রয়েছে সাতটি অধোলোক বা পাতাললোক, যা প্রতি দশ হাজার যোজন অন্তরে বিস্তৃত। এগুলি হলো অতল, বিতল, সুতল, তলাতল, মহাতল, রসাতল এবং পাতাল বা নাগলোক। 

 প্রতিটি গ্রহলোকই আয়তনে ভূমণ্ডলের সমান এবং সেখানে অসুর, দানব, নাগ প্রভৃতি জীবেরা বাস করে।

 

বিলস্বর্গ – কৃত্রিম স্বর্গপুরী

অধোলোকের মধ্যে সর্বাধিক ঐশ্বর্যময় হলো বিলস্বর্গ। এখানে মহাশিল্পী ময় দানব অসংখ্য প্রাসাদ, সভাগৃহ, উদ্যান ও জলাশয় নির্মাণ করেছে। 

 মণিরত্নে অলঙ্কৃত প্রাসাদ, বিরাট বৃক্ষ, ফুল-ফল এবং পাখির কলতানে মুখর উদ্যান এই বিলস্বর্গকে অমরলোকের থেকেও শোভন করেছে। 

 এখানে সূর্যের আলো প্রবেশ করে না, তাই দিন-রাতের কোন বিভাজন নেই। নাগদের মাথার মণির প্রভায় অন্ধকার দূর হয়। এছাড়া এখানে বাসিন্দারা দিব্য ঔষধির প্রভাবে বার্ধক্যহীন ও রোগমুক্ত জীবনযাপন করে।

 

অতললোক – মায়ার রাজ্য

অতললোকে ময় দানবের পুত্র বল অসুর বাস করে, যে ছিয়ানব্বই প্রকার মায়া সৃষ্টি করেছে। এখানকার নারীরা মাদক পান করিয়ে পুরুষদের মোহগ্রস্ত করে কামভোগে লিপ্ত করে। এই কারণে অসংখ্য মানুষ নিজেদের ভগবান বলে মনে করে অহঙ্কারে মত্ত হয়।

 

বিতললোক – হাটকের স্বর্ণরাজ্য

বিতললোকে হাটকেশ্বর শিব ভবানীসহ অবস্থান করেন। তাঁদের বীর্য থেকে উৎপন্ন হাটক নদীর জলে বিশেষ প্রভাবে স্বর্ণের উৎপত্তি ঘটে। সেখানকার অসুররা এই সোনার অলঙ্কার পরে মহাসুখে বাস করে।

 

সুতললোক – মহাবলির রাজ্য

সুতললোকে বিরোচনের পুত্র মহাবলি মহারাজ বাস করেন। ভগবান শ্রীবিষ্ণু বামনরূপে এসে তাঁর কাছ থেকে তিন পা ভূমি ভিক্ষা করে ত্রিলোক দখল করেছিলেন। 

কিন্তু মহাবলির ভক্তির কারণে তিনি আবার ঐশ্বর্য ও ভগবানের বিশেষ কৃপা লাভ করেন। আজও ভগবান নারায়ণ গদা হাতে সুতললোকের দ্বারে অবস্থান করছেন। মহাবলি মহারাজের চরিত্র ভক্তির মহিমার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।

 

তলাতল – ময় দানবের অধিকার

তলাতল হলো ময় দানবের রাজ্য, যাকে মহাদেব শিব একসময় দগ্ধ করেছিলেন, পরে আবার তার অধিকার ফিরিয়ে দেন। তাই ময় দানব এখনও এই লোকের শাসক হিসেবে বিরাজমান।

 

মহাতল – সর্পলোকের ভয় ও ভোগ

মহাতলে কদ্রুর সন্তান বহুফণাধারী সর্পেরা যেমন তক্ষক, কালীয়, কুহক প্রভৃতি বাস করে। তারা সর্বদা গরুড়ের ভয়ে আতঙ্কিত থাকে, তবুও স্ত্রী-সন্তানসহ ভোগে লিপ্ত থাকে।

 

রসাতল – দৈত্যদের আবাস

রসাতলে দিতি ও দনুর পুত্র দৈত্যরা বসবাস করে। তারা শক্তিশালী ও নিষ্ঠুর স্বভাবের এবং দেবতাদের শত্রু। তবে তারা সর্বদা ভগবানের সুদর্শন চক্র দ্বারা পরাভূত হয়।

 

পাতাললোক – মহাসর্পের রাজ্য

সবচেয়ে নীচে রয়েছে পাতাল বা নাগলোক, যেখানে বাসুকির নেতৃত্বে অসংখ্য মহাসর্প বাস করে। তাদের কারও পাঁচটি, কারও শতাধিক এবং কারও হাজার ফণা রয়েছে। প্রতিটি ফণায় মণি জড়ানো থাকে, যার আলোতে ঘোর অন্ধকার বিদূরিত হয়।

 

মহাবলির ভক্তি ও শিক্ষণীয় বার্তা

শুকদেব গোস্বামী উপসংহারে জানান, মহাবলি মহারাজের জীবনী থেকে আমরা শিক্ষা পাই যে ভগবানের প্রতি শুদ্ধ প্রেম ও ভক্তিই সর্বোচ্চ সম্পদ। 

 

জড় ঐশ্বর্য, ভোগ বা মুক্তি— এগুলি ভক্তির প্রকৃত ফল নয়। ভগবদ্ভক্তির প্রকৃত ফল হচ্ছে ভগবানের প্রেম লাভ এবং তাঁর চরণে আত্মসমর্পণ। এই কারণেই মহাবলি ও প্রহ্লাদ মহারাজকে ভক্তির আদর্শ হিসেবে পূজিত করা হয়।

আরও পড়ুনঃ 

* মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ: কী কারণে হয়েছিল  

* নরোত্তম দাস ঠাকুর: বৈষ্ণব ভক্তির অমর স্তম্ভ 

Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url