কংশের যজ্ঞস্থলে শ্রীকৃষ্ণের ধনুর্ভঙ্গ ও কুব্জার রূপান্তর: এক অপরূপ মথুরা লীলা
কুব্জা পরিচারিকার সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের প্রথম সাক্ষাৎ
মথুরা নগরে প্রবেশ করে শ্রীকৃষ্ণ ও শ্রীবলরাম দেখলেন—একজন কুব্জা যুবতী একটি থালায় চন্দন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। রসিকশেখর শ্রীকৃষ্ণ তাঁর স্বভাবসুলভ হাস্যরস নিয়ে বললেন— “ও দীর্ঘাঙ্গী সুন্দরী, তুমি কে? এই চন্দন কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
এটি আমাকে অর্পণ করলে তুমি ভাগ্যবতী হবে।” কুব্জা রমণীর হৃদয় কৃষ্ণকথায় গলে গেল। সে জানাল যে প্রতিদিন কংসকে চন্দন লেপন করে সে সেবা করে।
অসুরসেবা অর্থহীন—শ্রীকৃষ্ণের শিক্ষা
শ্রীকৃষ্ণ তাকে বোঝালেন—অসুরের সেবা কখনোই স্থায়ী কল্যাণ দেয় না।বরং ভগবৎসেবা হৃদয়কে পবিত্র করে, পাপমুক্ত করে এবং সৌভাগ্য আনয়ন করে। কুব্জা রমণী উপলব্ধি করল—এই দুই দিভ্য রূপবতীর সেবা করা কংসের সেবার চেয়ে শ্রেয়।
কুব্জার চন্দনলেপন ও শ্রীকৃষ্ণের সন্তুষ্টি
শ্রীকৃষ্ণ ও বলরামের অনিন্দ্য রূপ ও মধুর আচরণে মোহিত হয়ে কুব্জা ভক্তিভরে তাঁদের দেহে কোমল চন্দন লেপন করতে লাগল। চন্দনলেপনে তাদের আরও দ্যুতিময় লাগতে শুরু করল। ভক্তিভরে সেবা করার কারণে শ্রীকৃষ্ণ তাঁর মনে অত্যন্ত সন্তুষ্ট হলেন।
অলৌকিক রূপান্তর: কুব্জার সৌন্দর্য লাভ
ভক্তির প্রতিদানস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণ তাঁর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দিয়ে কুব্জার পায়ে চাপ দিলেন এবং চিবুক স্পর্শ করে তার দেহ সোজা করলেন।
মুহূর্তেই কুব্জা রমণী পরিণত হল—
মুহূর্তেই কুব্জা রমণী পরিণত হল—
• সুগঠিত
• সরল দেহী
• রমণীয় রূপলাবণ্যে ভাস্বর এক অপূর্ব সুন্দরী
এই লীলা প্রমাণ করে—ভগবৎসেবায় ভক্ত অচিরেই উন্নত পদ ও গুণলাভ করতে পারে।
ভক্তি থাকলেই ভগবান সন্তুষ্ট হন
শ্রীকৃষ্ণ কুব্জার রূপ দেখে নয়—তার সেবা ও ভক্তি দেখে সন্তুষ্ট হয়েছিলেন। এ কারণেই ভক্তি হল সর্বোচ্চ যোগ্যতা; আর ভগবৎসেবা মানুষকে মহান করে তোলে।
প্রেমাবেশে কুব্জার আমন্ত্রণ ও শ্রীকৃষ্ণের প্রতিশ্রুতি
নতুন রূপ পাওয়ার আনন্দে কুব্জা কিছুটা উচ্ছ্বসিত হয়ে শ্রীকৃষ্ণকে নিজের গৃহে আসার আমন্ত্রণ জানাল। শ্রীবলারামের সামনে এটি কিছুটা অপ্রস্তুত পরিস্থিতি সৃষ্টি করলেও শ্রীকৃষ্ণ হাসি দিয়ে বললেন—
“হে সুন্দরী, তোমার আমন্ত্রণে আমি সন্তুষ্ট। এখানে কাজ শেষ করে আমি অবশ্যই তোমার গৃহে আসব।” এভাবে তিনি তাকে আশ্বাস দিলেন।
মথুরাবাসীর উচ্ছ্বাস ও শ্রীকৃষ্ণ দর্শন
মথুরার মানুষ চন্দন, পুষ্প, তাম্বুল নিয়ে ছুটে এলেন দুই ভাইকে অভ্যর্থনা করতে। অনেক নারীরা তাঁদের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে আত্মবিস্মৃত হয়ে পড়লো। এ যেন দেবলোকের দুই দেবতা মানব রূপে মথুরায় আগমন করেছেন।
ধনুর্যজ্ঞ ও বিরাট ধনুকের পরিচয়
কংস এক বিশাল ধনুক স্থাপন করেছিল ধনুর্যজ্ঞের জন্য। ইন্দ্রধনুর মতো বিশাল সেই ধনুকের চারপাশে রক্ষীরা ছিল কড়া পাহারায়। শ্রীকৃষ্ণ ধনুক দেখার ইচ্ছা জানান এবং রক্ষীদের বাধা অগ্রাহ্য করে ধনুকের কাছে এগিয়ে যান।
শ্রীকৃষ্ণের ধনুর্ভঙ্গ: শক্তির মহাপ্রদর্শন
শ্রীকৃষ্ণ বাম হাতে ধনুক তুলে নিলেন, জ্যা স্থাপন করলেন এবং মুহূর্তেই— ক্ষুব্ধ হাতির মতো ইক্ষুদণ্ড ভাঙার মতো করে চূর্ণ করে ফেললেন ধনুকটি। এই শব্দে কংস ভয়ে কাঁপতে লাগল এবং বুঝল—অষ্টম সন্তান এসে গেছে।রক্ষী বাহিনীর আক্রমণ ও দুই ভাইয়ের পরাক্রম
রক্ষীরা চিৎকার করে অস্ত্র তুলে শ্রীকৃষ্ণকে আক্রমণ করল। শ্রীকৃষ্ণ ও বলরাম ধনুকের ভাঙা অংশকে অস্ত্র বানিয়ে তাদের দমন করলেন। কংস আরও সৈন্য পাঠালেও দুই ভাই তাদেরও পরাজিত করলেন।
মথুরা দর্শন ও শিবিরে প্রত্যাবর্তন
যুদ্ধ শেষে দুই ভাই মথুরার বিভিন্ন স্থান দর্শন করে সন্ধ্যায় শিবিরে ফিরে এলেন। সেবকরা তাঁদের স্নান করিয়ে দুধ ও আহার্য নিবেদন করল। শান্তিতে রাত্রি যাপন করলেন শ্রীকৃষ্ণ।
কংসের অশুভ লক্ষণ: আগত মৃত্যুর পূর্বাভাস
ধনুর্ভঙ্গ ও সৈন্য নিহতের খবর পেয়ে কংস রাতে ঘুমোতে পারল না। সে দেখল—• আয়নায় নিজের মাথা নেই
• আকাশে দ্বিগুণ সূর্য
• ছায়ায় ছিদ্র
• অশরীরী ভয়ের শব্দ
• স্বপ্নে নিজেকে বিষপান করতে দেখল সবই ছিল তার আসন্ন মৃত্যুর পূর্বলক্ষণ।
মল্লক্রীড়ার মহাসমারোহ
ভোর হতেই কংস মল্লক্রীড়ার বিশাল আয়োজন করল। রঙিন পতাকা, বাদ্যযন্ত্র, সুসজ্জিত আসন, রাজন্যবর্গদের উপস্থিতি—সব মিলিয়ে রাজসিক পরিবেশ। বিখ্যাত মল্লবীর—চাপুর, মুষ্টিক, শল, কূট, তোশল—মঞ্চে প্রবেশ করল।
বৃন্দাবনবাসীদের আগমন ও কংসের সম্মান
নন্দ মহারাজের নেতৃত্বে বৃন্দাবনবাসী গোপেরা রাজসভায় উপস্থিত হলেন। দুগ্ধজাত উপহার কংসকে দেওয়া হল। গোপদের বিশেষ সম্মানসূচক আসনে বসানো হলো। এভাবেই পরদিনের ভয়ঙ্কর মল্লক্রীড়ার মঞ্চ প্রস্তুত হল।
উপসংহার
এ অধ্যায়ে দেখা গেল—• ভক্তিভরে সেবা করলে ভগবান কৃপা করেন
• শ্রীকৃষ্ণের শক্তি ধনুর্ভঙ্গে প্রকাশ পেল
• কংসের হৃদয়ে মৃত্যুভয় ঘনীভূত হল
• মথুরাবাসীরা প্রথমবার দর্শন পেলেন পরম সুন্দর শ্রীকৃষ্ণকে
এই লীলাময় ঘটনার বিবরণ “লীলা পুরুষোত্তম শ্রীকৃষ্ণ” গ্রন্থের দ্বিচত্বারিংশতি অধ্যায়ের ভক্তিবেদান্ত তাৎপর্য।
