ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের আবির্ভাব ও চতুর্দশী ব্রত মাহাত্ম্য-Sri Narasimha Mahatto
ভগবান শ্রীনৃসিংহদেবের আবির্ভাব-নৃসিংহ চতুর্দশী ব্রত মাহাত্ম্য
দৈত-বালকেরা সবাই প্রহ্লাদের উপদেশ নিষ্ঠার সঙ্গে গ্রহণ করেছিল। তারা তাদের শিক্ষক ষন্ড ও অকর্মের বৈষয়িক উপদেশ গ্রহণ করল না। অসুর বালকেরা কৃষ্ণভক্তিতে নিষ্ঠাপরায়ণ হয়ে যাচ্ছে দেখে ষন্ড ও অকর্ম ভয়ভীত হয়ে রাজা হিরণ্যকশিপুর কাছে সমস্ত পরিস্থিতি জানালো। অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে হিরণ্যকশিপু প্রহ্লাদকে বলল, হে মন্দবুদ্ধি, তুই আমার শাসন লংঘন করেছিস, তুই একটা জেদী, মুর্খ। আজই তোকে যমালয় পাঠাবো। তুই জানিস, আমি ক্রুদ্ধ হলে সমগ্র ত্রিভুবন কাঁপে, আর তুই কার বলে ভয়শূন্য হয়ে আমার নির্দেশ অতিক্রম করছিস্!
প্রহ্লাদ বললেন, হে পিতৃদেব, দয়া করে আপনি আপনার আসুরিক প্রবৃত্তি পরিত্যাগ করুন। আপনি বলের কথা জিজ্ঞেস করছেন, পরমেশ্বর শ্রীহরিই সমস্ত বলের উৎস। আপনার বলও তাঁর কাছ থেকে আসছে। ইন্দ্রিয়ের বল, মনের বল, দেহের বল সব তিনিই। আপনার বিপথগামী মন ছাড়া আপনার এই জগতে কোন শত্রু নেই। আপনি আমাকে অনর্থক শত্রু মনে করছেন। আপনার শরীরের ছয় রিপুর আপনি দাসত্ব করছেন, অথচ আপনি গর্বভরে মনে করছেন যে-আপনি ত্রিভুবনের সমস্ত শত্রুকে জয় করেছেন। এসব আপনার নিদারুণ অজ্ঞতা।
হিরণ্যকশিপু বলল, ওরে হতভাগা মুর্খ প্রহ্লাদ, তুই নিজেকে অতি বুদ্ধিমান বলে মনে করছিস্, এর মানে হল আমার হাতে তোর মরবার ইচ্ছা হয়েছে। এক্ষুনি তোর মস্তক বিচ্ছিন্ন করব, তোর পরম আরাধ্য ভগবান এসে তোকে রক্ষা করুক। আমি দেখতে চাই। নেশাগ্রস্ত উন্মত্তের মতো হয়ে ক্রোধান্ধ হিরণ্যকশিপু খড়গ তুলে তিরষ্কার করছিল। হিরণ্যকশিপু বলল,
তুই যে সবসময় বলিস্ যে তোর কোন জগদীশ্বর আছে, সে নাকি সবার উর্ধ্বে। সে নাকি সবার নিয়ন্তা এবং সর্বব্যাপ্ত। তবে বল, সে জগদীশ্বর কোথায়, সে যদি সর্বত্রই থাকে, তাহলে আমার সামনের এই স্তম্ভটাতে কি সে আছে? ধুপধাপ শব্দে পাদাচারণ করে হিরণ্যকশিপু চীৎকার করে রাজসিংহাসনের সম্মুখভাগে একটি স্তম্ভে সজোরে মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগল। সেই সময় স্তম্ভ থেকে এক ভয়ংকর ধ্বনি উত্থিত হল। সেই ধ্বনিতে যেন ব্রহ্মান্ড কম্পিত হয়েছিল। বহু দেবতা মনে করেছিলেন, হায় এই আমাদের গ্রহলোকটি বুঝি নষ্ট হয়ে গেল। সেই অদ্ভুত প্রচন্ড ধ্বনি কেউ কখনও পূর্বে শুনেনি। অসুরেরা ভয়ে ভীত হয়েছিল। দেখা গেল, স্তম্ভ ভেঙ্গে তার ভেতর থেকে এক অদ্ভুত রূপ আবির্ভূত হলেন। সেই রূপটি না মানুষের, না সিংহের।
তুই যে সবসময় বলিস্ যে তোর কোন জগদীশ্বর আছে, সে নাকি সবার উর্ধ্বে। সে নাকি সবার নিয়ন্তা এবং সর্বব্যাপ্ত। তবে বল, সে জগদীশ্বর কোথায়, সে যদি সর্বত্রই থাকে, তাহলে আমার সামনের এই স্তম্ভটাতে কি সে আছে? ধুপধাপ শব্দে পাদাচারণ করে হিরণ্যকশিপু চীৎকার করে রাজসিংহাসনের সম্মুখভাগে একটি স্তম্ভে সজোরে মুষ্ট্যাঘাত করতে লাগল। সেই সময় স্তম্ভ থেকে এক ভয়ংকর ধ্বনি উত্থিত হল। সেই ধ্বনিতে যেন ব্রহ্মান্ড কম্পিত হয়েছিল। বহু দেবতা মনে করেছিলেন, হায় এই আমাদের গ্রহলোকটি বুঝি নষ্ট হয়ে গেল। সেই অদ্ভুত প্রচন্ড ধ্বনি কেউ কখনও পূর্বে শুনেনি। অসুরেরা ভয়ে ভীত হয়েছিল। দেখা গেল, স্তম্ভ ভেঙ্গে তার ভেতর থেকে এক অদ্ভুত রূপ আবির্ভূত হলেন। সেই রূপটি না মানুষের, না সিংহের।
ভক্ত প্রহ্লাদ মনে করেছিলেন, ভগবানকে আমি দর্শন করলেও পিতা হিরণ্যকশিপু না দশৃন করতে পারেন, আবার স্বতন্ত্র ভগবানও স্তম্ভ থেকে আবির্ভূত হতে পারেন কিংবা না হতেও পারেন। পিতা আমাকে যদি বধ করে, করতেও পারে, সেটিই ভগবানের ইচ্ছা হতেও পারে কিংবা না হতেও পারে। কিন্তু আমি স্থিরভাবেই জানি একমাত্র রক্ষাকর্তা পরমনিয়নন্তা হচ্ছেন শ্রীহরি। তাঁর ইচ্ছা বিনা কোনও অবস্থাতেই কেউ আমার শরীর নষ্ট করতে পারবে না।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ সেই পরিস্থিতিতে ভক্তের বাক্যের সত্যতা প্রমাণ করবার জন্য স্তম্ভ থেকে প্রকাশিত হলেন। শ্রীহরি আশ্বাস দিলেন প্রহ্লাদকে “ভয় করো না, আমি উপস্থিত আছি।” অসুর হিরণ্যকশিপু তাঁকে দেখে বিস্ময়ান্বিত হয়ে চিন্তা করল, এ আবার কোন ধরনের জীব! রূপটি বিশাল ভয়ংকর ক্রোধান্বিত রূপ। দুটি চোখ তাঁর স্বর্ণের মতো উজ্জ্বল। উজ্জ্বল কেশররাশি তাঁর ভয়ংকর মুখমন্ডলকে বিস্তার করেছে। বড় বড় ভয়ানক দন্তসারি। জিহ্বাপি ক্ষুরধার খরগের মতো চঞ্চল। উন্নত দুই কর্ণ নিশ্চল। মূখ এবং নাসিকা বিবর পর্বতের গুহার মতো। চোয়াল ভয়ংকরভাবে বিস্তীর্ণ। তাঁর অসংখ্য বাহু। সেই বাহুসমূহ যেন সেনাবাহিনীর মতো চতুর্দিকে বিস্তৃত। বাহুসমূহে শঙ্খ, চক্র, গদা, পদ্ম এবং অন্যান্য অস্ত্রাদি ধারণ করে রয়েছেন। তিনি এভাবে দৈত্য দানব এবং নাস্তিকদের বিনাশ করবার জন্য উদ্যত হয়েছেন। আর তিনি ভীষণ গর্জন করছিলেন।
শ্রীনৃসিংহ চতুর্দশী ব্রত মাহাত্ম্য
বৃহন্নারসিংহ পুরাণে ভগবান শ্রীনৃসিংহদেব ভক্ত প্রহ্লাদকে বললেন-
বর্ষে বর্ষে তু কর্তব্যং মম সন্তুষ্টি কারণম্।
মহা গুহ্যমিদং শ্রেষ্ঠং মানবৈর্ভবভীরুভিঃ ॥
অর্থাৎঃ “প্রতি বছর আমার সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে
চতুর্দশী ব্রত কর্তব্য। জন্ম-মৃত্যুময় সংসার ভয়ে ভীত মানুষ এই পরম গোপনীয় ও
শ্রেষ্ঠ ব্রত পালন করবে।”
বৈশাখ মাসের শুক্লা চতুর্দশীতে
শ্রীনৃসিংহদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন, তাই এই তিথিতে ব্রতপালনপূর্বক তাঁর পূজা ও
উৎসব করতে হয়। শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, আমার ব্রতদিন জেনেও যে ব্যক্তি লঙ্ঘন
করে, চন্দ্র-সূর্য যতদিন থাকবে ততদিন নরক যাতনা ভোগ করবে। যদিও আমার ভক্তরা
এই ব্রত করে থাকে তবুও প্রত্যেকের এই ব্রতে অধিকার আছে।
প্রহ্লাদ বললেন, হে ভগবান্, হে নৃসিংহরূপ, হে সকল দেবগণের আরাধ্য প্রভু আপনাকে প্রণাম জানাই। আমি জিজ্ঞাসা করছি, হে প্রভু, তোমার প্রতি আমার ভক্তি কিরূপে উৎপন্ন হল? কিরূপে আমি তোমার প্রিয় ভক্ত হলাম? শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, হে বুদ্ধিমান একান্ত মনে শোনো। প্রাচীনকল্পে তুমি ব্রাহ্মণ ছিলে, কিন্তু বেদপাঠ করনি। তোমার নাম ছিল বসুদেব এবং তুমি ছিলে বেশ্যাসক্ত। তোমার কোন সুকর্ম ছিল না, কেবল একটি মাত্র আমার ব্রত করেছিলে। সেই ব্রত প্রভাবে তোমার এরকম আমার প্রতি ভক্তি হয়েছে।
প্রহ্লাদ বললেন, হে নৃসিংহ, হে অচ্যুত, হে প্রভু, আমি কার পুত্র হয়ে কি করতাম? বেশ্যাসক্ত অবস্থায় কিভাবে তোমার ব্রত করলাম? দয়া করে বলুন। শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, পুরাকালে অবন্তীপুরে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিল। তার নাম ছিল বসুশর্মা। ধর্মপরায়ণ ও বৈদিক ক্রিয়া অনুষ্ঠানে তৎপর। তাঁর ভার্যা জগৎপ্রসিদ্ধা সুশীলা পতিব্রতা সদাচারিণী। তাদের পাঁচ পুত্র ছিল। চারজন ছিল সদাচারী, বিদ্বান, পিতৃভক্ত। কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্রটি ছিল অসদাচারী, সর্বদা বেশ্যাসক্ত, সুরাপায়ী। সেই কনিষ্ঠ পুত্রটি ছিলে তুমি।
নিত্য বেশ্যাগৃহেই তুমি বসবাস করতে। এক বনমধ্যে তুমি ও সেই তোমার বান্ধবী বেড়াতে গিয়েছিলে। তোমরা মনে করেছিলে দিনটা বেশ ভালোই কাটবে। কিন্তু তোমাদের নিজেদের মধ্যে চরিত্র বিষয়ে বিশেষ রকমে কলহ বেধে যায়। তোমাদের মধ্যে মনোমালিন্যের কারণে মৌনভাবে তোমরা আলাদাভাবে একটি স্থানে এসে বসেছিলে। সেখানে তুমি অতি পুরানো ধ্বংসাবশেষ গৃহ নিদর্শন স্বরূপ কিছু ইট পাথর দেখেছিলে।
সেই নির্জন স্থানে আলাদাভাবে উপবেশন করে তোমরা দুইজন ক্রন্দন করছিলে আপন আপনভাবে। সারাদিন তোমরা অনাহারী ছিলে, এমনকি জল পর্যন্ত পান করনি। সারারাতও তোমরা জাগরিত ছিলে। ক্লান্ত শরীরে দুঃখিত অন্তরে মনোমালিন্য ভাবে তুমি সেখানে শুয়ে পড়ে প্রার্থনা করছিলে, “হে ভগবান, হে শ্রীহরি, এই জগতের কত লোক সুন্দর! আমার মা-বাবা কত সুন্দর ধর্মপ্রাণ। আমার ভাইয়েরা কত সুন্দর। তারা নিষ্ঠাবান, চরিত্রবান। কিন্তু আমি অধঃপতিত। আমি মহা মন্দমতি। আমি চরিত্রহীন। পথের পাগলের চেয়েও অধম।
হে ভগবান, ভালো লোকেরা তোমার শরণাগত। আমি মূর্খ কারও শরণাগত নই। আমি অতি নিঃসঙ্গ। আমি বড় অসহায় অবস্থায় তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, হে ভগবান, আমাকে বিশুদ্ধ জীবন দান কর।”এভাবে তুমি ক্রন্দন করেছিলে। আর তোমার বান্ধবী, সেও একান্ত মনে প্রার্থনা করছিল, “ হে ভগবান, আমি সমাজের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য স্তরের জীব। সভ্য সমাজ থেকে আমি বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন।
এই জগতে অনেক নিষ্ঠাবতী সাধ্বী সুন্দরী নারী রয়েছে। এই জগতে অনেক নিষ্ঠাবতী সাধ্বী সুন্দরী নারী রয়েছে। আর, আমি মহাপাপী গণিকাবৃত্তি করেই জীবন নষ্ট করেছি। প্রতিদিনই কেবল পাপের বোঝা বাড়িয়েছি। নরকযাতনা কতই না এই পোড়া কপালে অপেক্ষা করছে। ভদ্র সমাজে কেউ কোনওদিন আমাকে তাকাতেও চায় না। আমিও এই জগতের কোনও পথ খুঁজে পাই না। হে পরম করুণাময় ভগবান, যদি তোমার অহৈতুকী কৃপাদৃষ্টি আমার প্রতি থাকে তবে দয়া করে আমার এই জীবন পরিবর্তন করে দাও!”
শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, হে প্রহ্লাদ, সেই স্থানটি ছিল আমার প্রাচীন মন্দির। সেই দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্লা চতুর্দশী আমার আবির্ভাবের দিন। তোমরা উপবাসী ছিলে, রাত্রি জাগরণ করছিলে, জীবনের কল্যাণ প্রার্থনা করছিলে। অর্থাৎ অজ্ঞাতসারেই তোমরা আমার পরম-মঙ্গলময় চতুর্দশী ব্রত পালন করেছিলে। সেই ব্রত প্রভাবে তুমি এ জন্মে আমার প্রিয় ভক্তরূপে জন্মগ্রহণ করেছ। আর সেই বেশ্যাও স্বর্গলোকে অপ্সরা জীবন লাভ করে ত্রিভুবনে সুখচারিণী হয়েছে। হে প্রহ্লাদ আমার ব্রতের প্রভাব শোনো। সৃষ্টিশক্তি লাভের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মা আমার এই চতুর্দশী ব্রত পালন করেছিলেন।
ত্রিপুরাসুরকে বধের উদ্দেশ্যে মহাদেব এই ব্রত করেছিলেন, স্বর্গসুখ লাভের জন্যই দেবতারা আগের জন্মে আমার ব্রত করেছিলেন। বেশ্যাও এই ব্রত প্রভাবে ত্রিলোকে সুখচারিণী হয়েছে। যে সমস্ত মানুষ আমার এই ব্রতশ্রেষ্ঠ পালন করবে, শতকোটি কল্পেও তাদের সংসারে পুনরাগমন নেই। আমার ব্রত প্রভাবে অপুত্রক ভক্তপুত্র লাভ করে, দরিদ্র ধনশালী হয়, তেজস্কামী তেজঃলাভ করে, রাজ্যকামী রাজ্য পায়, আয়ুষ্কামী দীর্ঘায়ু লাভ করে। স্ত্রীলোকেরা আমার এই চতুর্দশী ব্রত পালন করলে ভাগ্যবতী হয়, এই ব্রত সৎপুত্রপ্রদ, অবৈধব্যকর ও পুত্রশোক বিনাশন, দিব্য সুখপ্রদ। স্ত্রী-পুরুষ যারা এই উত্তম ব্রত পালন করে, তাদের আমি সুখ ও ভুক্তি-মুক্তি ফল দান করি। হে প্রহ্লাদ, দুরাত্মাদের আমার ব্রত পালনে মতি হয় না। পাপকর্মেই সর্বদা তাদের মতি।
প্রহ্লাদ বললেন, হে ভগবান্, হে নৃসিংহরূপ, হে সকল দেবগণের আরাধ্য প্রভু আপনাকে প্রণাম জানাই। আমি জিজ্ঞাসা করছি, হে প্রভু, তোমার প্রতি আমার ভক্তি কিরূপে উৎপন্ন হল? কিরূপে আমি তোমার প্রিয় ভক্ত হলাম? শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, হে বুদ্ধিমান একান্ত মনে শোনো। প্রাচীনকল্পে তুমি ব্রাহ্মণ ছিলে, কিন্তু বেদপাঠ করনি। তোমার নাম ছিল বসুদেব এবং তুমি ছিলে বেশ্যাসক্ত। তোমার কোন সুকর্ম ছিল না, কেবল একটি মাত্র আমার ব্রত করেছিলে। সেই ব্রত প্রভাবে তোমার এরকম আমার প্রতি ভক্তি হয়েছে।
প্রহ্লাদ বললেন, হে নৃসিংহ, হে অচ্যুত, হে প্রভু, আমি কার পুত্র হয়ে কি করতাম? বেশ্যাসক্ত অবস্থায় কিভাবে তোমার ব্রত করলাম? দয়া করে বলুন। শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, পুরাকালে অবন্তীপুরে এক বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণ ছিল। তার নাম ছিল বসুশর্মা। ধর্মপরায়ণ ও বৈদিক ক্রিয়া অনুষ্ঠানে তৎপর। তাঁর ভার্যা জগৎপ্রসিদ্ধা সুশীলা পতিব্রতা সদাচারিণী। তাদের পাঁচ পুত্র ছিল। চারজন ছিল সদাচারী, বিদ্বান, পিতৃভক্ত। কিন্তু কনিষ্ঠ পুত্রটি ছিল অসদাচারী, সর্বদা বেশ্যাসক্ত, সুরাপায়ী। সেই কনিষ্ঠ পুত্রটি ছিলে তুমি।
নিত্য বেশ্যাগৃহেই তুমি বসবাস করতে। এক বনমধ্যে তুমি ও সেই তোমার বান্ধবী বেড়াতে গিয়েছিলে। তোমরা মনে করেছিলে দিনটা বেশ ভালোই কাটবে। কিন্তু তোমাদের নিজেদের মধ্যে চরিত্র বিষয়ে বিশেষ রকমে কলহ বেধে যায়। তোমাদের মধ্যে মনোমালিন্যের কারণে মৌনভাবে তোমরা আলাদাভাবে একটি স্থানে এসে বসেছিলে। সেখানে তুমি অতি পুরানো ধ্বংসাবশেষ গৃহ নিদর্শন স্বরূপ কিছু ইট পাথর দেখেছিলে।
সেই নির্জন স্থানে আলাদাভাবে উপবেশন করে তোমরা দুইজন ক্রন্দন করছিলে আপন আপনভাবে। সারাদিন তোমরা অনাহারী ছিলে, এমনকি জল পর্যন্ত পান করনি। সারারাতও তোমরা জাগরিত ছিলে। ক্লান্ত শরীরে দুঃখিত অন্তরে মনোমালিন্য ভাবে তুমি সেখানে শুয়ে পড়ে প্রার্থনা করছিলে, “হে ভগবান, হে শ্রীহরি, এই জগতের কত লোক সুন্দর! আমার মা-বাবা কত সুন্দর ধর্মপ্রাণ। আমার ভাইয়েরা কত সুন্দর। তারা নিষ্ঠাবান, চরিত্রবান। কিন্তু আমি অধঃপতিত। আমি মহা মন্দমতি। আমি চরিত্রহীন। পথের পাগলের চেয়েও অধম।
হে ভগবান, ভালো লোকেরা তোমার শরণাগত। আমি মূর্খ কারও শরণাগত নই। আমি অতি নিঃসঙ্গ। আমি বড় অসহায় অবস্থায় তোমার কাছে প্রার্থনা করছি, হে ভগবান, আমাকে বিশুদ্ধ জীবন দান কর।”এভাবে তুমি ক্রন্দন করেছিলে। আর তোমার বান্ধবী, সেও একান্ত মনে প্রার্থনা করছিল, “ হে ভগবান, আমি সমাজের মধ্যে সবচেয়ে জঘন্য স্তরের জীব। সভ্য সমাজ থেকে আমি বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন।
এই জগতে অনেক নিষ্ঠাবতী সাধ্বী সুন্দরী নারী রয়েছে। এই জগতে অনেক নিষ্ঠাবতী সাধ্বী সুন্দরী নারী রয়েছে। আর, আমি মহাপাপী গণিকাবৃত্তি করেই জীবন নষ্ট করেছি। প্রতিদিনই কেবল পাপের বোঝা বাড়িয়েছি। নরকযাতনা কতই না এই পোড়া কপালে অপেক্ষা করছে। ভদ্র সমাজে কেউ কোনওদিন আমাকে তাকাতেও চায় না। আমিও এই জগতের কোনও পথ খুঁজে পাই না। হে পরম করুণাময় ভগবান, যদি তোমার অহৈতুকী কৃপাদৃষ্টি আমার প্রতি থাকে তবে দয়া করে আমার এই জীবন পরিবর্তন করে দাও!”
শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, হে প্রহ্লাদ, সেই স্থানটি ছিল আমার প্রাচীন মন্দির। সেই দিনটি ছিল বৈশাখ মাসের শুক্লা চতুর্দশী আমার আবির্ভাবের দিন। তোমরা উপবাসী ছিলে, রাত্রি জাগরণ করছিলে, জীবনের কল্যাণ প্রার্থনা করছিলে। অর্থাৎ অজ্ঞাতসারেই তোমরা আমার পরম-মঙ্গলময় চতুর্দশী ব্রত পালন করেছিলে। সেই ব্রত প্রভাবে তুমি এ জন্মে আমার প্রিয় ভক্তরূপে জন্মগ্রহণ করেছ। আর সেই বেশ্যাও স্বর্গলোকে অপ্সরা জীবন লাভ করে ত্রিভুবনে সুখচারিণী হয়েছে। হে প্রহ্লাদ আমার ব্রতের প্রভাব শোনো। সৃষ্টিশক্তি লাভের উদ্দেশ্যে ব্রহ্মা আমার এই চতুর্দশী ব্রত পালন করেছিলেন।
ত্রিপুরাসুরকে বধের উদ্দেশ্যে মহাদেব এই ব্রত করেছিলেন, স্বর্গসুখ লাভের জন্যই দেবতারা আগের জন্মে আমার ব্রত করেছিলেন। বেশ্যাও এই ব্রত প্রভাবে ত্রিলোকে সুখচারিণী হয়েছে। যে সমস্ত মানুষ আমার এই ব্রতশ্রেষ্ঠ পালন করবে, শতকোটি কল্পেও তাদের সংসারে পুনরাগমন নেই। আমার ব্রত প্রভাবে অপুত্রক ভক্তপুত্র লাভ করে, দরিদ্র ধনশালী হয়, তেজস্কামী তেজঃলাভ করে, রাজ্যকামী রাজ্য পায়, আয়ুষ্কামী দীর্ঘায়ু লাভ করে। স্ত্রীলোকেরা আমার এই চতুর্দশী ব্রত পালন করলে ভাগ্যবতী হয়, এই ব্রত সৎপুত্রপ্রদ, অবৈধব্যকর ও পুত্রশোক বিনাশন, দিব্য সুখপ্রদ। স্ত্রী-পুরুষ যারা এই উত্তম ব্রত পালন করে, তাদের আমি সুখ ও ভুক্তি-মুক্তি ফল দান করি। হে প্রহ্লাদ, দুরাত্মাদের আমার ব্রত পালনে মতি হয় না। পাপকর্মেই সর্বদা তাদের মতি।
শ্রীনৃসিংহ চতুর্দশী ব্রত পালনের নিয়ম কি?
শ্রীনৃসিংহদেব বললেন, বৈশাখী শুক্লা
চতুর্দশী ব্রত পালনকারীরা পাপাচারীদের সঙ্গে কথা বলবে না, মিথ্যা আলাপ
বর্জন করবে, স্ত্রীসম্ভাষণ বর্জন করবে, দ্যূতক্রীড়া ত্যাগ করে আমার
রূপগুণলীলার কথা স্মরণ করবে। দুপুরে পবিত্র জলে স্নান করবে। তারপর ঘরে এসে
গোময় দিয়ে মণ্ডপ লেপন করে অষ্টদলপদ্ম রচনা করবে। সেই পদ্মের উপর রত্নযুক্ত
তামার কলসী বসাতে হবে। তার উপর চালভর্তি একটি পাত্র রাখতে হবে। চাউলের উপর
লক্ষ্মীসহ নৃসিংহদেবকে স্থাপন করতে হবে।
কিংবা মণ্ডপে পবিত্রফুল সাজিয়ে তার উপর পঞ্চামৃতে লক্ষ্মীনৃসিংহকে স্নান করিয়ে পূজা আরম্ভ করতে হবে। আগে প্রহ্লাদের পূজা তারপর লক্ষ্মীনৃসিংহের পূজা। এই অভিষেক ও পূজা আরতি সন্ধ্যাকালে সম্পন্ন করতে হয়। নৃত্য গীত বাদ্য ও হরিনাম সংকীর্তন, নৃসিংহস্তুতি, নৃসিংহলীলা পাঠ কীর্তন পূর্বক রাত্রি জাগরণ এবং পরদিন সকালে স্নান সেরে যত্নসহ পূজা ও সকলের মঙ্গল প্রার্থনা করতে হয়। তারপর ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দান ও প্রসাদ সেবন করতে হয়। অপারগ লোকেরা কমপক্ষে সন্ধ্যার পর অনুকল্প প্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন। রাত দশটা পর্যন্ত জেগে থাকেন। পরদিন মঙ্গল আরতিতে নৃসিংহস্তব করতে থাকেন।
* ভীষ্মপঞ্চক ব্রত কী, কখন ও কীভাবে করবেন?
* তুলসী মাহাত্ম-বৃক্ষ হয়েও তুলসী কেন পূজনীয়া?
*শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সকল অধ্যায় সমূহ
কিংবা মণ্ডপে পবিত্রফুল সাজিয়ে তার উপর পঞ্চামৃতে লক্ষ্মীনৃসিংহকে স্নান করিয়ে পূজা আরম্ভ করতে হবে। আগে প্রহ্লাদের পূজা তারপর লক্ষ্মীনৃসিংহের পূজা। এই অভিষেক ও পূজা আরতি সন্ধ্যাকালে সম্পন্ন করতে হয়। নৃত্য গীত বাদ্য ও হরিনাম সংকীর্তন, নৃসিংহস্তুতি, নৃসিংহলীলা পাঠ কীর্তন পূর্বক রাত্রি জাগরণ এবং পরদিন সকালে স্নান সেরে যত্নসহ পূজা ও সকলের মঙ্গল প্রার্থনা করতে হয়। তারপর ব্রাহ্মণকে দক্ষিণা দান ও প্রসাদ সেবন করতে হয়। অপারগ লোকেরা কমপক্ষে সন্ধ্যার পর অনুকল্প প্রসাদ গ্রহণ করে থাকেন। রাত দশটা পর্যন্ত জেগে থাকেন। পরদিন মঙ্গল আরতিতে নৃসিংহস্তব করতে থাকেন।
আরও পড়ুন
* একাদশী কী? কিভাবে একাদশীর আবির্ভাব হলো* ভীষ্মপঞ্চক ব্রত কী, কখন ও কীভাবে করবেন?
* তুলসী মাহাত্ম-বৃক্ষ হয়েও তুলসী কেন পূজনীয়া?
*শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সকল অধ্যায় সমূহ