জটায়ু পরাজয়েও বিজয়ী-বাংলা রামায়ন- bangla ramayan katha
বাংলা রামায়ন কথা-জটায়ু পরাজয়েও বিজয়ী-Bangla ramayon kotha
কেউই পরাজয় পছন্দ করে না। যখন আমরা নিজেদেরকে হারতে দেখি তখন আমরা কোন শক্তিশালী ব্যক্তির সঙ্গ করতে চেষ্টা করি বিজয়ী হওয়ার জন্য। যখন মানুষ ভগবানের পূজা করতে শুরু করে, তখন তারা মনে করে যে, ভগবান তাকে যুদ্ধে জয় জয়লাভ করতে সাহায্য করবে এবং এই পৃথিবীর বিভিন্ন শাস্ত্র সেইসব ঘটনার ব্যাখ্যা করেছে যে, ভক্তরা কিভাবে ভগবানের কৃপাতে সমস্ত কঠিন প্রতিকূলতাকে জয় করেছে।
তথাপি, এমনও শাস্ত্রীয় ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যেখানে ভক্তরাও পরাজিত হয়েছে। কেমনভাবে সেই ব্যাখ্যাকে বুঝতে হবে? আমাদের ধারণাকে জড় জগতের উর্ধ্বে আধ্যাত্মিক জগতে নিয়ে যেতে হবে। এই সমস্ত ঘটনা আমাদেরকে স্বীকার করতে বাধ্য করে যে, ভগবান প্রদত্ত সুরক্ষা কিভাবে আমাদের অস্তিত্বকে জড়বাস্তবের উর্ধ্বে গিয়েও সুরক্ষিত করে। যদি আমরা এই স্তরে মনে করি যে, ভগবান সর্বদাই সাফল্য প্রদান করবেন, তাহলে আমাদের বিশ্বাসে ধ্বাক্কা লাগতে পারে, এমনকি জড় জাগতিক ঘাত প্রতিঘাতের দ্বারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা আধ্যাত্মিক জগতের অনেক মূল্যবান ভগবৎ কৃপা থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করব।
যদিও রামচন্দ্র এবং লক্ষণ অনেক দূরে থাকার জন্য শুনতে পাননি কিন্তু কেউ একজন শুনেছিল এবং সক্রিয় হয়েছিল। সীতামতা দেখলেন যে, জটায়ু একটি গাছ থেকে উড়ে আসছিল। এই বৃদ্ধ পক্ষীটি মহারাজ দশরথের মিত্র ছিল। সীতামাতার স্বর্গীয় শ্বশুর মহাশয়ের সময় সে দন্তক নামক অরণ্যে বাস করত। যখন রামচন্দ্র, সীতামাতা এবং লক্ষ্মণ সেখানে এসেছিলেন তখন জটায়ু তাঁদেরকে স্বাগতম করেন। সে তাদেরকে আশ্বস্তও করেছিল যে, এই দৈত্য দানব পূর্ণ অরণ্যে সে সীতামাতার সুরক্ষায় সাহায্য করবে।
সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে জটায়ু সীতামাতাকে উদ্ধার করার জন্য রাবণের সাথে যুদ্ধ শুরু করল। একজন বীর যোদ্ধার পত্নী হওয়ার সুবাদে সীতামাতা বুঝতে পারলেন যে, এই বৃদ্ধ পক্ষীটি কোন ভাবেই ঐ শক্তিশালী দৈত্যের সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে উঠতে পারবে না। তাই তিনি তাকে চিৎকার করে বললেন যে, রামচন্দ্রকে তাঁর অপহরণের সংবাদ দিতে এবং সাবধানও করলেন এই আশঙ্কায় যে, এখানে হস্তক্ষেপ করলে রাবণ তাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু জটায়ুর পক্ষে সীতামাতার এই সাবধান বাণী মানা অসম্ভব ছিল।
সে ভাবল যে, সীতামাতার অপরণকে বন্ধ করার জন্য যদি কিছু না করে তাহলে তার বেচেঁ থেকে কি লাভ। দৃঢ় চিত্তে সে রাবণের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে তার এই একজন বিবাহিতা স্ত্রীলোককে অপরণের অনৈতিক কাজের জন্য তিরস্কার করতে লাগল। প্রত্যাশিত ভাবেই, এই নৈতিক কথোপকথন ঐ নীচ দানবকে নিবারিত করতে পারল না। সে রাবণের বাহুতে নখ দিয়ে বিদ্ধ করল, তার চুল তার চঞ্চু দিয়ে টেনে চার পাশে ঘোরাতে লাগল। রাবণ প্রচন্ড ক্রোধে চিৎকার করতে লাগল এই ভেবে যে, একটা নগণ্য পক্ষী তাকে টানা হ্যাঁচড়া করছে, তাও আবার একজন স্ত্রীলোকের
সামনে যাকে কিনা সে তার নতুন পাটরাণী করার জন্য প্রভাবিত করতে চাইছে। রাবণ সত্ত্বর বুঝতে পারল যে, জটায়ু একজন সাধারণ শিকারী নয়। সে একজন শক্তিশালী যোদ্ধা। জটায়ুর পরিকল্পনা সে রাবণকে আক্রমণ করে হত্যা করবে। তাই সে বলপূর্বক রাবণের অশ্বচালিত রথকে লক্ষ্য করে ধ্বংশ করার চেষ্টা করল। সে তার চঞ্চুর একটি আঘাতেই রথচারীকে ফেলে দিল এবং পুনঃ পুনঃ আঘাতে রথটিকে খন্ড বিখন্ড করে ফেলল। ইত্যবসরে রাবণ তার বৃহদাকার তীর ধনুক নিয়ে জটায়ুকে প্রত্যাঘাত করতে শুরু করল। যেহেতু তার রথটি খন্ড বিখন্ড হয়ে গিয়েছিল তাই রাবণ মাটিতে নেমে আসতে বাধ্য হয়ে ছিল।
মাটি থেকেই সে জটায়ুর প্রতি এত শর নিক্ষেপ করেছিল যে, সেগুলি জটায়ুকে পক্ষীর বাসার মতো আচ্ছন্ন করেছিল। যদিও জটায়ু আহত হয়েছিল কিন্তু আক্রমণ স্তিমিত করেনি। কিছু শর উপেক্ষা করে কিছু শরকে সহ্য করে জটায়ু তার তীক্ষ্ম নখ দিয়ে রাবণকে আঘাত করতে লাগল এবং অত্যন্ত বিষ্ময়কর ক্ষমতার দ্বারা সে রাবণের একটি হাত কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। কিন্তু তাকে নিরুৎসাহ করে আবার রাবণের হাত পুনঃ নির্মাণ হয়ে গেল। রাবণের প্রতি ব্রহ্মার বর ছিল যে, রাবণের শরীরের যে খন্ডই ছেদন হোক না কেন তা তৎক্ষনাৎ পুনর্গঠিত হবে।
তাই জটায়ু যতবার রাবণের অঙ্গ খন্ড-বিখন্ড করল তা তঃক্ষণাৎ আবার পুনর্গঠিত হয়ে গেল। কিছু সময় পরে জটায়ু ক্লান্ত হতে লাগল এবং তার ক্ষিপ্রতা কমে আসতে লাগল। রাবণ এই অবস্থা অনুধাবন করতে পেরে যাতে ঐ পক্ষী তার কাছ থেকে পলায়ন করতে না পারে সে বিদ্যুৎ গতিতে তার তরবারির আঘাতে তার একটি ডানা কেটে ফেলল এবং মুহূর্তের মধ্যে অন্য ডানাটিও কেটে ফেলল। রক্তাক্ত অবস্থায় জটায়ু মাটিতে পতিত হল। অসহায় অবস্থায় কান্না করতে করতে সীতা এই ভয়ানক যুদ্ধ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থাতেও জটায়ুর দিকে ধাবিত হলেন তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য কিন্তু জয়োল্লাসে রাবণ তার চুলের মুঠি ধরে হিঁচড়ে নিয়ে আসল এবং তার মায়াশক্তির দ্বারা আকাশ দিয়ে উড়ে গেল জটায়ুকে প্রচন্ড কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়ে।
তিনি সম্মুখে কিছু একটি পড়ে থাকতে দেখলেন। রামচন্দ্র ভাবলেন এটি সীতা অপহরণকারী কোন পক্ষীরূপ মায়াবী দানব এবং তিনি তাঁর তীর ধনুক দিয়ে তাকে বধ করতে উদ্যত হলেন। জটায়ু এমনভাবে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছিল যে, শ্রীরামচন্দ্র তাকে চিনতে পারে নি। জটায়ুর কাছে এটি ভক্তি এবং বিশ্বাসের অনেক বড় পরীক্ষা ছিল। কেননা, যখন সে দেখল যে রামচন্দ্র তাঁর তীর তার দিকে লক্ষ্য করছে তার প্রাণ নেওয়ার জন্য যে কিনা তার প্রাণ উৎসর্গ করেছে সীতামাতার প্রাণ রক্ষা করার জন্য! তবুও মনে প্রাণে বিশ্বাসের সহিত সে শ্রীরামচন্দ্রের নাম জপ করতে থাকল।
রামচন্দ্র সেই মৃদু জপ শুনতে পেলেন। কৌতুহলবশতঃ তিনি তাঁর ধনুকটিকে নিচে রেখে সতর্কতার সহিত দেখতে লাগলেন, যখন তিনি পক্ষীটিকে জটায়ু বলে চিনতে পারলেন, তখন তিনি সম্মুখ দিকে ধাবিত হলেন এবং তাকে আলিঙ্গণ করলেন। জটায়ু তার শেষ জীবনীশক্তিটুকু দিয়ে যা ঘটেছিল তা বর্ণনা করলেন এবং সীতামাতর অপহরণের সংবাদ রামচন্দ্রকে দেওয়ার শেষ সেবাটুকু করে চিরকালের জন্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
গভীর শোকে রামচন্দ্র স্বয়ং জটায়ুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করলেন-ভগবানের এই অভূতপূর্ব লীলা সমাজ সংস্কারকেও প্রতিষ্ঠা করল এবং জটায়ুর জীবন সর্বোত্তম সাফল্যের প্রতিষ্ঠা পেল। আধ্যাত্মিক জ্ঞান আমাদেরকে এটা বুঝতে সাহায্য করে যে, আমরা হচ্ছি অবিনাশী আত্মা যা জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে নিত্য মুক্তির দিকে যাত্রা করে।
আমরা প্রত্যেকেই পার্থিব অস্তিত্ব রক্ষায় মায়ার সঙ্গে লড়াই করছি যা আমাদেরকে সাময়িক সুখের প্রতি প্রলুব্ধ করে এবং নিত্য সুখ থেকে বঞ্চিত করে। এই যুদ্ধে এটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ভগবানকে স্মরণ করার সাফল্য অর্জন করতেই হবে কারণ কোন মতেই চিরকাল কেন, দীর্ঘকাল ধরেও ছেষ্টা করে মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব নয়।
শ্রীমদ্ভগবতদীতায় (৮/৫-৬) বলেছেন. “মৃত্যুকালে যে, যেভাবে স্মরণ করে তার পরবর্তী জীবনও সেই রকম হয়। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে দেহত্যাগ করলে তৎক্ষণাৎ ভগবৎধামে প্রবেশ করা যায়। যদিও জটায়ু রাবণের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, তথাপি সে ভগবান রামচন্দ্রের পরম সান্নিধ্যে মৃত্যুলাভ করার পরম সুযোগ লাভে সফল হয়েছিল এবং গভীরভাবে তাঁর স্মরণে অভিনিবিষ্ট হয়েছিল। সে পক্ষী যোনিতেও এইরকম গৌরবময় সাফল্য অর্জন করেছিল।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বৈদিক পরম্পরায় শকুনকে অজ্ঞানের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু জটায়ু, পক্ষীদেহ হওয়া সত্ত্বেও রামচন্দ্রের সান্নিধ্যে দার নশ্বরদেহ ত্যাগ করার পরম সৌভাগ্য অর্জন করেছিল এবং তাঁর পরম আশ্রয়ও প্রাপ্ত হয়েছিল। এখানেই জটায়ুর সৌভাগ্যের শেষ হয়নি। তার মৃত্যু হওয়ার পর, শ্রীরামচন্দ্র তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন এইভাবে যেমনভাবে এক পুত্র তাঁর পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। জটায়ু রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু সে পার্থিব মায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। সে পরাজয়েও বিজয়ী হয়েছিল।
তথাপি, এমনও শাস্ত্রীয় ঘটনার ব্যাখ্যা পাওয়া যায় যেখানে ভক্তরাও পরাজিত হয়েছে। কেমনভাবে সেই ব্যাখ্যাকে বুঝতে হবে? আমাদের ধারণাকে জড় জগতের উর্ধ্বে আধ্যাত্মিক জগতে নিয়ে যেতে হবে। এই সমস্ত ঘটনা আমাদেরকে স্বীকার করতে বাধ্য করে যে, ভগবান প্রদত্ত সুরক্ষা কিভাবে আমাদের অস্তিত্বকে জড়বাস্তবের উর্ধ্বে গিয়েও সুরক্ষিত করে। যদি আমরা এই স্তরে মনে করি যে, ভগবান সর্বদাই সাফল্য প্রদান করবেন, তাহলে আমাদের বিশ্বাসে ধ্বাক্কা লাগতে পারে, এমনকি জড় জাগতিক ঘাত প্রতিঘাতের দ্বারা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যেতে পারে। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে, আমরা আধ্যাত্মিক জগতের অনেক মূল্যবান ভগবৎ কৃপা থেকে আমাদেরকে বঞ্চিত করব।
মৃত্যুমুখে পতিত হয়েও সংকল্পে অটুট( বাংলা রামায়ন)
কিভাবে আধ্যাত্মিক দর্শন জড় জাগতিক ঘাত প্রতিঘাতের ধারণাকে বদলে দেয় এটা বোঝার জন্য আমাদের রামায়ণের জটায়ুর ঘটনার প্রতি দৃষ্টিপাত করতে হবে। সে রাবণকে সীতামাতার অপহরণ থেকে বিরত করার জন্য কিভাবে আত্মবলিদান দিয়েছিল এটি সুবিদিত। সেই লোভী দানব সীতামাতার সুরক্ষাগুলিকে বিফল করে তাঁকে অপহরণ করার ষড়যন্ত্র করেছিল। সে সীতামাতাকে আকাশ পথে তার পুষ্পক বিমানে নিয়ে যাচ্ছিল, সীতামাতা উন্মত্তভাবে সাহায্যের জন্য চিৎকার করছিলেন।
যদিও রামচন্দ্র এবং লক্ষণ অনেক দূরে থাকার জন্য শুনতে পাননি কিন্তু কেউ একজন শুনেছিল এবং সক্রিয় হয়েছিল। সীতামতা দেখলেন যে, জটায়ু একটি গাছ থেকে উড়ে আসছিল। এই বৃদ্ধ পক্ষীটি মহারাজ দশরথের মিত্র ছিল। সীতামাতার স্বর্গীয় শ্বশুর মহাশয়ের সময় সে দন্তক নামক অরণ্যে বাস করত। যখন রামচন্দ্র, সীতামাতা এবং লক্ষ্মণ সেখানে এসেছিলেন তখন জটায়ু তাঁদেরকে স্বাগতম করেন। সে তাদেরকে আশ্বস্তও করেছিল যে, এই দৈত্য দানব পূর্ণ অরণ্যে সে সীতামাতার সুরক্ষায় সাহায্য করবে।
সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে জটায়ু সীতামাতাকে উদ্ধার করার জন্য রাবণের সাথে যুদ্ধ শুরু করল। একজন বীর যোদ্ধার পত্নী হওয়ার সুবাদে সীতামাতা বুঝতে পারলেন যে, এই বৃদ্ধ পক্ষীটি কোন ভাবেই ঐ শক্তিশালী দৈত্যের সঙ্গে লড়াইয়ে পেরে উঠতে পারবে না। তাই তিনি তাকে চিৎকার করে বললেন যে, রামচন্দ্রকে তাঁর অপহরণের সংবাদ দিতে এবং সাবধানও করলেন এই আশঙ্কায় যে, এখানে হস্তক্ষেপ করলে রাবণ তাকে মেরে ফেলবে। কিন্তু জটায়ুর পক্ষে সীতামাতার এই সাবধান বাণী মানা অসম্ভব ছিল।
সে ভাবল যে, সীতামাতার অপরণকে বন্ধ করার জন্য যদি কিছু না করে তাহলে তার বেচেঁ থেকে কি লাভ। দৃঢ় চিত্তে সে রাবণের পাশ দিয়ে উড়ে গিয়ে তার এই একজন বিবাহিতা স্ত্রীলোককে অপরণের অনৈতিক কাজের জন্য তিরস্কার করতে লাগল। প্রত্যাশিত ভাবেই, এই নৈতিক কথোপকথন ঐ নীচ দানবকে নিবারিত করতে পারল না। সে রাবণের বাহুতে নখ দিয়ে বিদ্ধ করল, তার চুল তার চঞ্চু দিয়ে টেনে চার পাশে ঘোরাতে লাগল। রাবণ প্রচন্ড ক্রোধে চিৎকার করতে লাগল এই ভেবে যে, একটা নগণ্য পক্ষী তাকে টানা হ্যাঁচড়া করছে, তাও আবার একজন স্ত্রীলোকের
সামনে যাকে কিনা সে তার নতুন পাটরাণী করার জন্য প্রভাবিত করতে চাইছে। রাবণ সত্ত্বর বুঝতে পারল যে, জটায়ু একজন সাধারণ শিকারী নয়। সে একজন শক্তিশালী যোদ্ধা। জটায়ুর পরিকল্পনা সে রাবণকে আক্রমণ করে হত্যা করবে। তাই সে বলপূর্বক রাবণের অশ্বচালিত রথকে লক্ষ্য করে ধ্বংশ করার চেষ্টা করল। সে তার চঞ্চুর একটি আঘাতেই রথচারীকে ফেলে দিল এবং পুনঃ পুনঃ আঘাতে রথটিকে খন্ড বিখন্ড করে ফেলল। ইত্যবসরে রাবণ তার বৃহদাকার তীর ধনুক নিয়ে জটায়ুকে প্রত্যাঘাত করতে শুরু করল। যেহেতু তার রথটি খন্ড বিখন্ড হয়ে গিয়েছিল তাই রাবণ মাটিতে নেমে আসতে বাধ্য হয়ে ছিল।
মাটি থেকেই সে জটায়ুর প্রতি এত শর নিক্ষেপ করেছিল যে, সেগুলি জটায়ুকে পক্ষীর বাসার মতো আচ্ছন্ন করেছিল। যদিও জটায়ু আহত হয়েছিল কিন্তু আক্রমণ স্তিমিত করেনি। কিছু শর উপেক্ষা করে কিছু শরকে সহ্য করে জটায়ু তার তীক্ষ্ম নখ দিয়ে রাবণকে আঘাত করতে লাগল এবং অত্যন্ত বিষ্ময়কর ক্ষমতার দ্বারা সে রাবণের একটি হাত কেটে বিচ্ছিন্ন করে ফেলল। কিন্তু তাকে নিরুৎসাহ করে আবার রাবণের হাত পুনঃ নির্মাণ হয়ে গেল। রাবণের প্রতি ব্রহ্মার বর ছিল যে, রাবণের শরীরের যে খন্ডই ছেদন হোক না কেন তা তৎক্ষনাৎ পুনর্গঠিত হবে।
তাই জটায়ু যতবার রাবণের অঙ্গ খন্ড-বিখন্ড করল তা তঃক্ষণাৎ আবার পুনর্গঠিত হয়ে গেল। কিছু সময় পরে জটায়ু ক্লান্ত হতে লাগল এবং তার ক্ষিপ্রতা কমে আসতে লাগল। রাবণ এই অবস্থা অনুধাবন করতে পেরে যাতে ঐ পক্ষী তার কাছ থেকে পলায়ন করতে না পারে সে বিদ্যুৎ গতিতে তার তরবারির আঘাতে তার একটি ডানা কেটে ফেলল এবং মুহূর্তের মধ্যে অন্য ডানাটিও কেটে ফেলল। রক্তাক্ত অবস্থায় জটায়ু মাটিতে পতিত হল। অসহায় অবস্থায় কান্না করতে করতে সীতা এই ভয়ানক যুদ্ধ ভীত সন্ত্রস্ত অবস্থাতেও জটায়ুর দিকে ধাবিত হলেন তাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য কিন্তু জয়োল্লাসে রাবণ তার চুলের মুঠি ধরে হিঁচড়ে নিয়ে আসল এবং তার মায়াশক্তির দ্বারা আকাশ দিয়ে উড়ে গেল জটায়ুকে প্রচন্ড কষ্ট এবং যন্ত্রণার মধ্যে ফেলে দিয়ে।
জীবনের শেষ নিঃশ্বাস দিয়ে শেষ সেবা (বাংলা রামায়ন)
যদিও জটায়ু মৃতবৎ আঘাত প্রাপ্ত হয়েছিল তথাপি সে প্রাণবায়ু রক্ষা করেছিল। সীতামাতা তাকে তাঁর অপহরণের সংনবাদ শ্রীরামচন্দ্রকে দিতে বলেছিল। তীব্র যন্ত্রণা সত্ত্বেও জটায়ু অপেক্ষা করেছিল এবং শ্রীরামচন্দ্রের নাম ধরে চিৎকার করছিল এবং ভগবানের পবিত্র নাম জপের মাধ্যমে সান্ত্বনা খুঁজছিল। এর মধ্যে রামচন্দ্র রামচন্দ্র এবং লক্ষ্মণ পাগলের মতো সীতামাতার খোঁজ করছিলেন। কিছু সময়ের মধ্যে তিনি জঙ্গলে এলেন এলেন এই ভেবে যে, এটি কোন প্রাণঘাতী যুদ্ধের মল্লভূমি হবে।
তিনি সম্মুখে কিছু একটি পড়ে থাকতে দেখলেন। রামচন্দ্র ভাবলেন এটি সীতা অপহরণকারী কোন পক্ষীরূপ মায়াবী দানব এবং তিনি তাঁর তীর ধনুক দিয়ে তাকে বধ করতে উদ্যত হলেন। জটায়ু এমনভাবে ছিন্ন ভিন্ন হয়েছিল যে, শ্রীরামচন্দ্র তাকে চিনতে পারে নি। জটায়ুর কাছে এটি ভক্তি এবং বিশ্বাসের অনেক বড় পরীক্ষা ছিল। কেননা, যখন সে দেখল যে রামচন্দ্র তাঁর তীর তার দিকে লক্ষ্য করছে তার প্রাণ নেওয়ার জন্য যে কিনা তার প্রাণ উৎসর্গ করেছে সীতামাতার প্রাণ রক্ষা করার জন্য! তবুও মনে প্রাণে বিশ্বাসের সহিত সে শ্রীরামচন্দ্রের নাম জপ করতে থাকল।
রামচন্দ্র সেই মৃদু জপ শুনতে পেলেন। কৌতুহলবশতঃ তিনি তাঁর ধনুকটিকে নিচে রেখে সতর্কতার সহিত দেখতে লাগলেন, যখন তিনি পক্ষীটিকে জটায়ু বলে চিনতে পারলেন, তখন তিনি সম্মুখ দিকে ধাবিত হলেন এবং তাকে আলিঙ্গণ করলেন। জটায়ু তার শেষ জীবনীশক্তিটুকু দিয়ে যা ঘটেছিল তা বর্ণনা করলেন এবং সীতামাতর অপহরণের সংবাদ রামচন্দ্রকে দেওয়ার শেষ সেবাটুকু করে চিরকালের জন্য মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন।
গভীর শোকে রামচন্দ্র স্বয়ং জটায়ুর শেষকৃত্য সম্পন্ন করলেন-ভগবানের এই অভূতপূর্ব লীলা সমাজ সংস্কারকেও প্রতিষ্ঠা করল এবং জটায়ুর জীবন সর্বোত্তম সাফল্যের প্রতিষ্ঠা পেল। আধ্যাত্মিক জ্ঞান আমাদেরকে এটা বুঝতে সাহায্য করে যে, আমরা হচ্ছি অবিনাশী আত্মা যা জন্ম থেকে জন্মান্তর ধরে নিত্য মুক্তির দিকে যাত্রা করে।
আমরা প্রত্যেকেই পার্থিব অস্তিত্ব রক্ষায় মায়ার সঙ্গে লড়াই করছি যা আমাদেরকে সাময়িক সুখের প্রতি প্রলুব্ধ করে এবং নিত্য সুখ থেকে বঞ্চিত করে। এই যুদ্ধে এটা অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল যে, ভগবানকে স্মরণ করার সাফল্য অর্জন করতেই হবে কারণ কোন মতেই চিরকাল কেন, দীর্ঘকাল ধরেও ছেষ্টা করে মৃত্যুকে এড়ানো সম্ভব নয়।
শ্রীমদ্ভগবতদীতায় (৮/৫-৬) বলেছেন. “মৃত্যুকালে যে, যেভাবে স্মরণ করে তার পরবর্তী জীবনও সেই রকম হয়। কৃষ্ণভাবনায় ভাবিত হয়ে দেহত্যাগ করলে তৎক্ষণাৎ ভগবৎধামে প্রবেশ করা যায়। যদিও জটায়ু রাবণের সহিত যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, তথাপি সে ভগবান রামচন্দ্রের পরম সান্নিধ্যে মৃত্যুলাভ করার পরম সুযোগ লাভে সফল হয়েছিল এবং গভীরভাবে তাঁর স্মরণে অভিনিবিষ্ট হয়েছিল। সে পক্ষী যোনিতেও এইরকম গৌরবময় সাফল্য অর্জন করেছিল।
এটা খুব গুরুত্বপূর্ণ, কারণ বৈদিক পরম্পরায় শকুনকে অজ্ঞানের প্রতীক হিসেবে গণ্য করা হয়। কিন্তু জটায়ু, পক্ষীদেহ হওয়া সত্ত্বেও রামচন্দ্রের সান্নিধ্যে দার নশ্বরদেহ ত্যাগ করার পরম সৌভাগ্য অর্জন করেছিল এবং তাঁর পরম আশ্রয়ও প্রাপ্ত হয়েছিল। এখানেই জটায়ুর সৌভাগ্যের শেষ হয়নি। তার মৃত্যু হওয়ার পর, শ্রীরামচন্দ্র তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন এইভাবে যেমনভাবে এক পুত্র তাঁর পিতার পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে। জটায়ু রাবণের সঙ্গে যুদ্ধে পরাজিত হয়েছিল, কিন্তু সে পার্থিব মায়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করেছি। সে পরাজয়েও বিজয়ী হয়েছিল।