মহাভারতের বংশ তালিকা- শ্রীকৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব


শ্রীকৃষ্ণ-দ্বৈপায়ন ব্যাসদেব


মহাভারতের রচয়িতা মহাকবি শ্রীকৃষ্ণ। তাঁর দেহের বর্ণ ছিল কৃষ্ণ। সেজন্য তাঁর নাম শ্রীকৃষ্ণ। তিনি ছিলেন মহর্ষি। ইনি তপস্যাবলে বেদ-চতুষ্টয়ের বিভাগ করেন বলে তাঁকে বলা হয় বেদব্যাস বা ব্যাস। 

 

যমুনার তীরে তাঁর জন্ম বলে তাঁকে বলা হয় ‘দ্বৈপায়ন’। তাঁর তপস্যার স্থান ছিল বদরিকাশ্রম। সেজন্য তাঁকে বলা হয় ‘বাদরায়ণ”।

 

মহর্ষি পরাশর এঁর পিতা দাশরাজার পালিতা কন্যা সত্যবতী এঁর মা। সত্যবতী নৌকা নিয়ে যমুনা নদীতে খেয়ানীর কাজ করতেন। মহর্ষি পরাশর খেয়াঘাটে সত্যবতীকে দেখেই মুগ্ধ হন, তখনই তাঁকে পাবার জন্য কন্যাকে আবেদন করলে সত্যবতী লোকলোচনের মধ্যে তাঁকে তুষ্ট করতে অপারগ হলেন। 

 

মহর্ষি তপোবলে তৎক্ষণাৎ গাঢ় কুয়াশার সৃষ্টি করে স্থানটিকে অন্ধকারে পরিণত করেন। এই ধরনের আশ্চর্য শক্তি দেখে বিস্মিতা ও লজ্জিতা সত্যবতী তাঁকে বললেন—ভগবান, আমি কুমারী। আমার অবস্থা আপনি চিন্তা করুন। পরাশর প্রীত হয়ে বললেন—আমার ইচ্ছা পূর্ণ করলে তোমার কোন ক্ষতি হবে না। 

 

তুমি কুমারীই থাকবে, যদি অন্য বর চাও, প্রার্থনা কর। সত্যবতীর দেহে মাছের গন্ধ অনুভূত হতো, সেজন্য তাঁকে লোকে ‘মৎস্যগন্ধা’ বলে ডাকত। মহর্ষির বরে তাঁর দেহের গন্ধ বদলে গেল। তিনি এক সুগন্ধময় দেহ পেলেন। সেজন্য তাঁর নাম হলো গন্ধবতী। 

 

বহুদূর থেকে তাঁর গন্ধ মানুষ পেত। সত্যবতী সদ্য গর্ভধারণ করে পুত্র প্রসব করলেন। (আদি ৬৩।৮৪) এই শিশু জন্মের পরমুহূর্তেই জননীর অনুমতি নিয়ে তপস্যার উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। ইনিই বেদব্যাস।


বেদব্যাস নিজের জীবন ইতিহাস সরল ভাষায় অকপটে প্রকাশ করেছেন। তাঁর অনন্যসাধারণ সত্যবাদিতা আমাদের মুগ্ধ করে। তপস্যায় যাবার সময় জননীকে বলেন যে, তাঁকে স্মরণ করলেই তিনি জননীর নিকট উপস্থিত হবেন।


ব্যাসদেবের একমাত্র পুত্র শুকদেব। তিনি জন্মসিদ্ধ, জিতেন্দ্রিয় ও নির্বিকারচিত্ত মহাপুরুষ। বেদব্যাস তাঁর বদরিকাশ্রমে সুমন্ত, জৈমিনী, পৈল, বৈশম্পায়ন ও পুত্র শুকদেব—এই পাঁচজন শিষ্যকে বেদচতুষ্টয় ও মহাভারত সম্বন্ধে উপদেশ দেন।

 

 তারপর লোমহর্ষণ মুনিকে ইনি ইতিহাস ও পুরাণ পাঠের শিষ্য হিসাবে গণ্য করেন। ব্যাসদেবের মুখে শাস্ত্র শুনে তাঁর রোমাদি হর্ষিত হয়েছিল, সেজন্য তাঁর নাম হয় সৌতি তাঁর সুযোগ্য পুত্র। এই সৌতিই নৈমিষারণ্যে মহাভারত বলেন।


মহর্ষি বেদব্যাস অষ্টাদশ পুরাণ ও মহাভারত রচনা করেন। বেদান্ত দর্শন ও ভাগবত তাঁরই রচিত। অতএব তাঁর প্রতিভাদীপ্ত প্রজ্ঞা, মহাকাব্য রচনা করার অনন্যসাধারণ অক্ষয়কীর্তি আমাদের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করে। 

 

আবার এই মহাতপস্বী, ত্রিকালজ্ঞ মহর্ষি জননী সত্যবতীর অনুরোধে বিচিত্রবীর্যের পত্নী অম্বিকা, অম্বালিকা ও একজন দাসীর গর্ভে তিন পুত্রের জন্মদাতা। তাদের নাম ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডু ও বিদুর। সে-যুগে নিয়োগ প্রথা ছিল। 

 

তাঁর যৌবনের একটি আলেখ্য পাই মহাভারতে। (আদি ১০৬।৫) তার দেহের রং ছিল গাঢ় কৃষ্ণবর্ণ, মাথায় ছিল পিঙ্গল বর্ণের জটা, নেত্রদ্বয় অতি উজ্জ্বল এবং মুখে ছিল পিঙ্গলবর্ণের দাড়ি। 

 

এই অদ্ভুত চেহারা দেখেই অম্বিকা চোখ বন্ধ করেন বলে। ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন। অম্বালিকা অত্যন্ত ভয় পেয়ে পাণ্ডুবর্ণ হয়ে যান, সেজন্য তাঁর পুত্র পাণ্ডুত্ব (অর্থাৎ ফেকাসে, শুক্ল পীতবর্ণ) প্রাপ্ত হন।


আশ্চর্য এই মহর্ষি জন্মের পরে তপস্যায় চলে গেলেন। আবার তপস্বীর প্রাণটি ছিল কোমল, মায়ের আজ্ঞাবহ। প্রয়োজনবোধে শুধু স্মরণ করলেই তিনি আসতেন। এ এক অলৌকিক ক্ষমতা তাঁর ছিল। শুধু মা কেন, অন্য কোন ব্যক্তির ইচ্ছাও এইভাবে পূর্ণ হতো। 

 

যুধিষ্ঠিরের বিপদেও বনবাসকালে অনেকবার যোগবলে তাঁদের অবস্থা জানতে পেরে তাঁদের নিকট উপস্থিত হয়ে সৎ উপদেশ দিয়েছেন। দুর্যোধনের জীবনেও তাঁর আবির্ভাব ঘটেছে অনেকবার। দুর্যোধনকে কুপথে যেতে নিষেধ করেছেন।

 

গৃহযুদ্ধ যাতে না হয় তার জন্য ধৃতরাষ্ট্রকে বহু সৎ উপদেশ দিয়েছেন। লোকালয়ের বাইরে তাঁর অবস্থান ছিল। তিনি সংসার বিরাগী তপস্বী। অথচ সংসারের প্রয়োজনে সর্বদাই তিনি উপস্থিত।


সঞ্জয়কে দিব্যচক্ষু দান, ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী ও যুধিষ্ঠিরকে সময়োচিত উপদেশ দান, এবং যুধিষ্ঠিরকে প্রায়শ্চিত্তস্বরূপ অশ্বমেধযজ্ঞ করার জন্য উৎসাহদান প্রভৃতি কাজে তাঁর চরিত্রের কিছুটা পরিচয় পাওয়া যায়। তাঁরই কৃপায় ধৃতরাষ্ট্র, গান্ধারী, কুন্তী প্রভৃতি মৃত আত্মীয়দের দর্শনলাভ করেন।


তাঁর চরিত্রে পাই নিরাসক্ত জীবনের ছবি। সংসার বিরাগী তপস্বী। কর্মকোলাহলের বাইরে বদরিকাশ্রমে তাঁর বাস। অথচ কুরু-পাণ্ডবদের মঙ্গলচিন্তা করেন। বিপদে হাজির হন, উপদেশ ও নির্দেশ দিয়ে প্রস্থান করেন। কত বিপদে তিনি এসেছেন। 

 

ধ্যানে ভেসে উঠত তাঁর পবিত্র মনে দুর্দিনের, অমঙ্গলের ইঙ্গিত। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর মা সত্যবতীকে বলেন তীর্থে যেতে, কারণ ভয়ঙ্কর দুর্দিন সামনে। গান্ধারীর নিকটে এসে তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন ভ্রূণকে সন্তানে পরিণত করার আশ্বাস দিয়ে। পাণ্ডবদের প্রতি তাঁর স্নেহ ছিল অধিক। 

 

(আদি, ১৫০।৯) সেজন্য তাঁদের বিপদে তিনি বহুবার উপস্থিত হয়ে আশ্বাস ও নির্দেশ দেন। যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য অনেকবার ধৃতরাষ্ট্রকে উপদেশ দেন। এমন কি যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্তেও ধৃতরাষ্ট্রকে ঐ কথা বলেন। 

 

নির্বিকার চিত্তে জনকল্যাণে রত তাঁর মহান জীবন। পক্ষপাতহীন তাঁর কর্ম। অযাচিতভাবে অক্লান্ত কর্ম করেছেন জনকল্যাণে। তাঁর শান্তজীবনে কোন উগ্রতা ছিল না। সংসারের কুটিল পরিবেশে, যুদ্ধের পৈশাচিক পরিস্থিতিতে তিনি শান্ত, উদ্বেগহীন, নিরাসক্ত।ব্যাসদেবের কবি প্রতিভা, যোগদৃষ্টি এবং ইতিহাস বর্ণনায় নিরাসক্তি মহাভারতে দেখা যায়। 

 

দুর্যোধন ও কর্ণের জীবনালেখ্য বর্ণনা করেছেন নিবিড় মমতায়। যুদ্ধের শেষে ধর্মরাজের মনে বৈরাগ্য, ক্ষমা আর মনুষ্যত্বের মহিমা প্রকাশ পেয়েছে। ধর্মরাজের মহাপ্রস্থানের চিত্র জগতের সাহিত্যে বা কাব্যে এক অনবদ্য সমাপ্তি। 

 

সকল কলুষ কালিমার স্পর্শ থেকে পূর্ণভাবে মুক্ত হয়ে, সকল বেদনা, দুর্বলতা ও শোক থেকে মুক্তিলাভ করে মৃত্যুর শেষে অমৃতলোকে ধর্মরাজের নিঃশঙ্ক অপ্রতিহত যাত্রা—এই মহাপ্রস্থান। ভারতের ধ্যান, ধারণা, ধর্ম, নীতি, তপস্যা, জীবনলক্ষ্য প্রভৃতির সমন্বয়ে একটি আদর্শ জীবনের পূর্ণ আলেখ্য পাওয়া যায় মহাভারতে। এজন্যই মহাভারত ভারতের এত প্রিয় গ্রন্থ।

 

 সৌতি সেজন্য বলেছেন, “ইহার তুল্য পবিত্র ইতিহাস আর নেই।” (স্বর্গারোহণ পর্ব, পঞ্চম অধ্যায়) মহাভারত সমস্ত ইতিহাসের মধ্যে প্রধান। নিজেই বলেছেন, “মহাভারতে যা নেই, তা অন্য কোথাও নেই।” (আদি ২।৩৯০)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url