মেডিটেশন বা যোগাভ্যাস এর উপকারিতা

 
মেডিটেশন বা যোগাভ্যাস

মেডিটেশন বা যোগাভ্যাস কেন গুরুত্বপূর্ণ

আধ্যাত্মিকতার প্রাথমিক ভিত্তি হলো এই বিশ্বাস যে, যদিও আমরা এ পৃথিবীতে বাস করছি, তবুও আমরা আসলে এখানকার নই। আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে হয়ে চলা অনেক সমস্যার মূল কারণ নিজেদের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে না পারা। 

 

আমরা মানুষ নামক সামান্য জীব নই যাদের কিছু চিন্ময় উপলব্ধি হয় মাত্র; আমরা এ মনুষ্য দেহে থাকা এক চিন্ময় সত্ত্বা। আমরা অনেক বই পড়তে পারি, অনেক প্রবচন শুতনে পারি; কিন্তু নিজে আধ্যাত্মিক সেবায় নিয়োজিত না হলে বিষয়টি তাত্ত্বিকভাবে অনুভব করা অসম্ভব। এই প্রক্রিয়াকে সংস্কৃতে বলা হয় সাধনা। 

 

আধ্যাত্মিক অনুশীলনের বিষয়টি বোঝার জন্য সরল পন্থা হলো পরম্পরার সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন। আমরা তিন ধরনের যোগসূত্র তৈরি করতে পারি: 

১. আমাদের বাইরের যোগসূত্র

২. ভেতরের যোগসূত্র 

৩. চিন্ময় যোগসূত্র । 

১. বাইরের যোগসূত্র 

আমাদের জীবনের বেশিরভাগ সময়ই আমরা বহির্জগতের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকি। উদাহরণস্বরূপ: আমাদের দৈনন্দিন কাজকর্ম, পারস্পরিক যোগাযোগ বা হতে পারে আমাদের আপনজনদের সঙ্গে সময় কাটানো ইত্যাদি।  

কাজগুলো গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু আমাদের অন্তর্জগতের সঙ্গে সম্পর্কহীন হলে এসবই অনর্থক হয়ে পড়ে, প্রাপ্ত জিনিসের হারিয়ে যাওয়ার ভয় হয়। তখন কেউ ভাবতে পারে- অন্যদের জীবন বুঝি বেশি সুন্দর ও স্বাধীন। এ ভাবনাই প্রমাণ করে যে আমরা আমাদের বর্হিজগৎকে ভুলক্রমে বেশি মূল্য দিয়ে ফেলছি। 

 

 ২. ভেতরের যোগসূত্র

আমাদের প্রত্যহিক জীবনের ফাঁকে আমরা অনেক সময় নিজেদের মাঝেই কিছুটা স্বস্তি খুঁজি। মানুষ জীবন সংগ্রামে ব্যস্ত, যারা পার্থিব জীবনের সঙ্গে সংগ্রামে জয়ী হবার চেষ্টায় রত আছেন, যারা নিজেদের অন্তর্জগৎ নিয়ে জানতে উন্মুখ। তাদের মধ্যে খুব কমসংখ্যক মানুষই সত্যানুসন্ধানী এবং তারাই ভেতরকার যোগসূত্র খোঁজার চেষ্টা করেন। 

 

৩. চিন্ময় যোগসূত্র 

যারা শুধু অন্তর্মুখী যোগ-ভ্রমনে থাকেন, তারা খুব শীঘ্রই দিগভ্রষ্ট হয়ে থাকেন অথবা নিজেদের অগ্রগতির ধীরতার কারণে হতাশ হয়ে পড়েন। তারা হয়তো ভাবতে পারেন যে তারা ৭০ নটিক্যাল মাইল গতিতে সমুদ্র ভ্রমন করছেন, কিন্তু বস্তুত তারা ছুটছেন লক্ষ্যহীন গন্তব্যের দিকে। 

চিন্ময় যোগসুত্রের অর্থ হলো ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক পুনঃস্থাপন করা। এটিই যোগের পরম লক্ষ্য। ভগবান এক, কিন্তু ভিন্ন ভিন্ন সংস্কৃতিতে তাকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে অনুভব ও উপস্থাপন করা হয়। তাই তোমরা ভগবান বা আমার ভগবান নয়, আমাদের সবার ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কস্থাপন করতে হবে। বিষয়টি যেন অনেকটা এক চন্দ্রে সমস্ত জগৎ আলোকিত হওয়ার মতো। 

 

বৈদ্যুতিক বাল্প যেমন বিদ্যুতের সংস্পর্শে আসা মাত্র আলোকিত হয়, ঠিক তেমনি আমরাও যদি ভগবানের সঙ্গে সম্পর্কিত হতে পারি, তবে আমরা তাঁর ভালোবাসা পেতে পারি এবং সেই ভালোবাসা অন্যদের মধ্যেও বিলিয়ে দিতে পারি। 

 

যেহেতু অনেক ধর্মমত আছে, তাই ভগবানের কাছে পৌছানো অনেক পন্থাও আছে- কোনোটি সরল, কোনোটি কঠিন। অনেকের মতো আমিও সরল কিন্তু আত্মপোলব্ধিপূর্ণ অর্থবহ প্রার্থনা করি। আত্মপোলব্ধির জন্য আমি আমার পছন্দ অনুযায়ী যোগাভ্যাস করি। 

 

অনেক ধরনের যোগাভ্যাসের পদ্ধতির মধ্যে আমি আমার পছন্দের মন্ত্রসহযোগে যোগাভ্যাস করি। এর অর্থ হলো, আমি প্রতিদিন কিছু সময়ের জন্য কিছু চিন্ময় শব্দ উচ্চারণের মাধ্যমে ইশ্বরের ধ্যান করি, যাতে আমি সকল উৎকন্ঠা থেকে মুক্ত থাকতে পারি। 

 

আধুনিক বিজ্ঞানও যোগ্যাভ্যাসের মাহাত্ম্যকে স্বীকৃতি দেয় যে, এটি আসলেই উৎকণ্ঠা থেকে মুক্তি দিয়ে জীবনে একটি লক্ষ্য স্থির করতে সাহায্য করে এবং আমাদের উদ্ভাবনী করে তোলে। যাহোক, প্রাচ্যের এ জ্ঞানমন্ডিত সাহিত্য নিঃসন্দেহে আমাদের গভীর আত্মদর্শন প্রদান করে। 

 

যোগ একটি বিমানের মতো- প্রথমে তা আপনাকে উঁচুতে ওঠাবে, তারপর আপনাকে নিয়ে দূরে কোথাও অদৃশ্য হয়ে যাবে। আমি বিষয়টিকে এভাবে তলনা করি কারণ, বিমান ভ্রমণের মতো যাত্রা শুরু করা মাত্রই যোগাভ্যাসের সময় আপনি একটি উন্নত স্থিতি লাভ করেন। আমাদের জীবনে দুঃখ কষ্ট, উৎকন্ঠার উপলব্ধি হয় এ কারণে যে, আমরা এ বিষয়গুলোকে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে পর্যবেক্ষণ করি না। যোগাভ্যাস আমাদের জীবনে দুঃখ-কষ্ট বা উৎকন্ঠাকে একটি উচ্চতর অবস্থান থেকে পর্যবেক্ষণ করতে সাহায্য করে, ফলে আমরা একটি উচ্চতর শান্তি ও সমাহিত অবস্থা লাভ করি। 

 

তাহলে, বিশেষত ভক্তিযোগের গভীরতম প্রায়োগিক দিকটি হলো তা আমাদের বহুদূরে নিয়ে যায়। আমাদের চরিত্র পরিবর্তনের মাধ্যমে আমাদের ভেতরকার সদগুণগুলো বিকশিত করে এবং আত্মপোলব্দি করতে সাহায্য করে। 

 

এর মাধ্যমে আমরা জীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্যে উন্নীত হতে পারি। কিন্তু এর জন্য সময়ের প্রয়োজন, আবার চরিত্রগত যে পার্থক্য হবে, তা-ও খুব সূক্ষ্ম উপলব্ধির বিষয়। 

 আকাশে উড্ডয়নরত বিমান দেখলে গতির অনুভূতি ঠিক ততটা হয় না যতটা এর আসল গতি। কিন্তু আট ঘন্টা এভাবে চললে আপনার অর্থেক পৃথিবী ঠিকই ঘোরা হয়ে যাবে। 

 

যোগাভ্যাস কঠিন হয়ে পড়ে আমাদের মনের কারণে। বলা হয়ে থাকে আমাদের মন অনেকটা চঞ্চল বানরের মতো; সর্বদা এক চিন্তা থেকে আরেক চিন্তায় অস্থির এক পরিভ্রমণে থাকে। আপনার নির্দেশে সহসাই সে শান্ত হয়ে যায় না; 

 

একে নিয়ন্ত্রণের প্রয়োজন হয়। তাই মন্ত্রসহযোগে ধ্যান বা যোগ এমন একটি শিল্প যা আমাদের অস্থির মনকে শান্ত করতে শেখায়। ধরুন, মুম্বাই শহরের ট্রেনগুলো সস্তা ভাড়ার বিপরীতে সারাদিন ছুটে চলছে। কিন্তু নির্দিষ্ট একটি ট্রেন লাইন, শিডিউল আর গন্তব্য একে একটি নিয়মতান্ত্রিকতার মধ্যে রাখে। 

 

অনুরূপভাবে, আমাদের মন যোগাভ্যাস ও ধ্যানের নিয়মতান্ত্রিকতা মধ্যে না থাকলে তার লক্ষ অর্জন করতে পারে না; কেবল বিক্ষিপ্তভাবে ছুটতে থাকে। মন একদিন খুব স্থির থাকবে, আবার একদিন একেবারেই নয়।  

মন্ত্রধ্যান বা যোগভ্যাসের ধারণাটি ভালোভাবে বুঝতেও অনেক সময় লাগতে পারে। অনেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং বিখ্যাত সেলিব্রেটি আছেন যারা নিয়মিত যোগ অনুশীলন করেনম কিন্তু সবার সেই সময় নাও থাকতে পারে। 

 

যাদের সময় কম তাদের জন্য মন্ত্রধ্যান বা যোগাভ্যাস খুব বেশি প্রয়োজন। এখন আমি প্রতিদিন দুই ঘন্টা করে যোগাভ্যাস করি। শুরুতে কিন্তু বিষয়টি এমন ছিল না; দশ মিনিটের মন্ত্রধ্যানই আমার জন্য কষ্টকর ছিল। 

 

প্রশ্ন হতে পারে- যোগাভ্যাসকারী সবাই কি নিজের মধ্যে কোনো পরিবর্তন লক্ষ্য করেন? অবশ্যই, সঠিকভাবে সঠিক গুরুর তত্ত্বাবধানে ভক্তিযোগ অনুশীলন শুরু করলে তার ফল দেখতে পরবর্তী জীবন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না। বরং দ্রুতেই কেউ এর ফল দেখতে পাবেন। তাছাড়া, যারা নিয়মিত মন্ত্রধ্যান করেন, তারা নিজের অজান্তেই গভীরভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের অভ্যাস গড়ে তোলেন, যা তাদের অন্যদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নেও সহায়তা করে। এটা সম্পর্ক উন্নয়নের পন্থা, 

 কারণ যোগাভ্যাস আমাদের দেখায়- আমরা কীভাবে অন্যদের সহযোগিতা পাই বা অন্যদের সাহায্য নিয়ে চলি। 

 

ঈশ্বরের সঙ্গে সম্পর্কিত হওয়ার অনেক পথ আছে, আমাদের ব্যক্তিগত পছন্দ থাকবেই, আর এটা অসাধারণ বিষয়। আমাদের এর মমার্থ উপলব্ধি করা উচিত গভীরভাবে। সবচেয়ে কার্যকর পন্থা হলো মন্ত্র যোগাভ্যাস যা আমার ক্ষেত্রে চমৎকার কাজ করেছে। 

 

এযুগের জন্য সবচেয়ে কার্যকরী মহামন্ত্র হলো- 

হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে 
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।।  
 
 আরও পড়ুন

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url