মানসিক শান্তি পাওয়ার উপায়

 
মানসিক শান্তি পাওয়ার উপায়

 কি করলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়

অনেক দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মানুষ ভাবে- “আমি কীভাবে এ থেকে মুক্তি পাবো? আমি কিভাবে মানসিক শান্তি লাভ করব। আমি তো কষ্ট পেতে চাই না। 

 

আমি কষ্ট পাবার মতো তো কিছু করিনি। আমি কাউকে দুঃখও দিইনি। এজন্মের অথবা পূর্বজন্মের কৃতকর্মের ফলেই আমরা সুখ অথবা দুঃখ ভোগ করি। তাই, আমি অনৈতিক কিছু করিনি, আমি কোনো পাপকর্ম করিনি- এই ধারণাটিতেই ভুল রয়েছে। 

 

এরকম ভাবার কোনো কারণ-শাস্ত্রীয় জ্ঞানের অভাব। তাই আমাদের বর্তমান সমাজের বিরূপ পরিস্থিতি। কেউ কোনো নিয়ম মানতে চায় অন্যরা ভুল। কেউ কারো অনুশাসনে থাকতে চায় না। গাভীকে ঘাস খাওনানো জন্য যতক্ষণ দড়ি লাগিয়ে একটি গন্ডির মধ্যে রাখা হয়, কেবল ততক্ষণই সে ভালো থাকে, মালিকও তাতে খুশি থাকে। 

 

 কিন্তু যখনই সে এর বাইরে কিছু ভোগ করতে চায়, তখন সে অন্যের ক্ষতি করে। ফলে মালিক তার ওপর রুষ্ট হয় এবং তাকে শাস্তি দিয়ে থাকে। আমাদের অবস্খাও ঠিক একইরকম। শাস্তির পরিবর্তে আমরা কীভাবে শান্তি লাভ করতে পারি, এ প্রসঙ্গে একটি প্রবন্ধ কথোপকথনের মাধ্যমে উপস্থাপন করা হলো। 

 

ভদ্রলোকঃ আমাদের কেন এ অবস্থা? কেন আমাদের মনোভাব এমন? এর জন্য কে দায়ী? 

সাধুঃ এর জন্য আমরা নিজেরাই দায়ী। আমরা সবাই স্বাধীনভাবে চলতে চাই। আমরা ভুলে যাই আমাদের রাষ্ট্রের একটি সংবিধান আছে। এ সংবিধান আমরা নিজে যেমন মানতে চাইনা, তেমনি আমাদের আগামী প্রজন্মকেও শিক্ষা দিতে পারি না। 

 

যেমন- বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্ট লিপিবদ্ধ রয়েছে যে, ৪১।(১) আইন, জনশৃঙ্খলা ও নৈতিকতা-সাপেক্ষে 

(ক) প্রত্যেক নাগরিকের যেকোনো ধর্ম অবলম্বন, পালন বা প্রচারের অধিকার রয়েছে;

(খ) প্রত্যেক ধর্মীয় সম্প্রদায় ও উপ-সম্প্রদায়ের নিজস্ব ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের স্থাপন, রক্ষণ ও ব্যবস্থাপনার অধিকার রয়েছে। 

(২) কোনো শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে যোগদানকারী কোনো ব্যক্তির নিজস্ব ধর্ম-সংক্রান্ত না হলে তাঁকে কোনো ধর্মীয় শিক্ষাগ্রহণ কিংবা কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠান বা উপাসনায় অংশগ্রহণ বা যোগদান করতে হবে না। 

অর্থাৎ, প্রতিটি নাগরিকের নিজ নিজ ধর্ম পালনের স্বাধীনতা থাকবে এবং কাউকে জবরদস্তি করে কোনো ধর্ম পালনে বা পাঠদানে বাধ্য করা যাবে না। অথচ একদল কুচক্রী ও দুস্কৃতিকারী সাংবিধানিক আইন অমান্য করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর অমানবিক নির্যাতন চালায়। 

কিন্তু আমাদের উচিত রাষ্ট্রের আইন মেনে চলা। যদি কেউ তা অমান্য করে, সে যে-ই হোক- পরিণামে তাকে শাস্তি পেতে হয়। এমনকি অনেক সম্মাননীয় ব্যাক্তিকেও অন্যায়ের জন্য শাস্তি পেতে হয়। 

 

তেমনি আইন অমান্যকারীরা সরকার ও জনগণের হাত থেকে আপাত রেহােই পেলেও ভগবানের আইনে তাদের দন্ড অবশ্যম্ভাবী। ভগবানের সংবিধান না মানলে আমাদের জন্ম-জন্মান্তর ধরে শাস্তি পেতে হয়।  

 

ভদ্রলোকঃ এ অবস্থা নিরসনের উপায় কী? রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সংবিধান আছে, কিন্তু শ্রীকৃষ্ণের সংবিধান (আইন) কীরূপ তা যদি আমাকে বলতেন...। 

সাধুঃ এ অবস্থা নিরসনের উপায় রাষ্ট্রের আইন মানা এবং সামাজিকতা বজায় রেখে চলা। মানুষ সমস্যার সম্মুখীন হলে তার কর্তব্য সে বিষয়ে সম্পূর্ণভাবে অবগত ব্যক্তির শরণাগত হওয়া। আইনের সমস্যা সমাধানের জন্য মানুষ উকিলের কাছে যায়, স্বাস্থের সমস্যা সমাধানের জন্য মানুষ ডাক্তারের কাছে যায়। 

 

পারমার্থিক পরিস্থিতি সম্বন্ধে এই জগতে সকলেই বিভ্রান্ত। তাই মানুষের কর্তব্য সদগুরুর শরণাপন্ন হওয়া, যিনি যথার্থ জ্ঞান দান করতে পারেন। দেশের সংবিধান (আইন) হলো চুরি না করা, অন্যের সম্পদ দখল না করা, পরস্ত্রীকে মাতৃজ্ঞানে সম্মান করা, মাদক গ্রহণ না করা, 

 

নির্বিচারে কাউকে হত্যা না করা ইত্যাদি। এছাড়া রাস্তায়, অফিসে, কোর্ট-কাচারীতে বিভিন্ন নিয়মকানুন মানতে হয়। আমরা শাস্ত্রে (ভাগবত ১-১৭-৩৮) দেখতে পাই, যেখানে দ্যূতক্রীড়া, আসব পান, অবৈধ স্ত্রীসঙ্গ এবং প্রাণিহত্যা হয়, সেই স্থানে কলি অবস্থান করে। 

 

আর এসবের কারণে আমাদের সত্য, শৌচ, তপ, ও দয়া নষ্ট হয়। তাই ভগবানের সংবিধানে অর্থাৎ বৈদিক শাস্ত্রে আমাদের এসব এড়িয়ে চলতে বলা হয়েছে। আমরা দেখি, ফ্রিজ, টেলিভিশন, মোবাইল ফোন ইত্যাদি পণ্যক্রয় করলেতার সঙ্গে একটি ম্যানুয়াল দেয়া হয়। 

 

সেই ম্যানুয়ালের নির্দেশেই আমাদের তা ব্যবহার করতে হয়। এমনকি আমাদের অসুখ হলে সেক্ষেত্রেও ডাক্তারের নির্দেশ অনুসারে ঔষধ খেতে হয়। কারণ এ বিষয়ে ডাক্তারই ভালো জানেন। তাই আমাদের এই মনুষ্য শরীররূপ যন্ত্র চালানোর জন্য ভগবান আমাদের শাস্ত্ররূপে সংবিধান বা আইন দিয়েছেন। আমরা তা পেয়েছি গুরু-শিষ্য পরম্পরার মাধ্যমে। 

 

ভদ্রলোকঃ শ্রীকৃষ্ণ আমাদের মনুষ্য জীবন পরিচালনার জন্য যে সংবিধান (আইন) দিয়েছেন, সেই আইনগুলো কী কী? আর পরস্পরাই বা কী? 

 

সাধুঃ আমরা কোনোকিছু পেতে চাইলে তার জন্য আমাদের কারো না কারো সাহায্য প্রয়োজন হয়, আমরা তা একা একা পেতে পারি না। ভগবানের এই আইন আমরা কীভাবে পেলাম সে বিষয়ে শ্রীমদ্ভাবদগীতায় (৪.১-২) ভগবান বলেছেন- “আমি পূর্বে সূর্যদেব বিবস্বানকে এই অব্যয় নিষ্কাম কর্মসাধ্য জ্ঞানযোগ বলেছিলাম। 

 

সূর্য তা মানবজাতির জনক মনুকে বলেছিলেন এবং মনু তা ইক্ষাকুকে বলেছিলেন। এভাবেই পরম্পরার মাধ্যমে প্রাপ্ত এই পরম বিজ্ঞান রাজর্ষিরা লাভ করেছিলেন। কিন্তু কালের প্রভাবে পরম্পরা ছিন্ন হয়েছিল এবং তাই সেই যোগ নষ্টপ্রায় হয়েছে।” 

 

দ্বাপর যুগে ভগবান এই জ্ঞান অর্জুনকে প্রদান করেন কুরুক্ষেত্রে যুদ্ধের প্রাক্কালে। প্রকৃত শান্তির উৎস ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা; আর ধর্ম স্বয়ং ভগবান কর্তৃক প্রণীত (ধর্মস্তু সাক্ষাৎ ভগবৎ প্রণীতম্)। তাহলে এটি সহজে বোঝা যায়, ভগবান প্রদত্ত আইনই প্রকৃত শান্তির বার্তা বহন করতে পারে। 

 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত, বিভিন্ন উপনিষদ-পুরাণাদিতে ভগবান প্রদত্ত আইনগগুলো তুলে ধরা হয়েছে। ভগবান স্বয়ং শান্তির সূত্র প্রদান করেছেন শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায়-

ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোক মহেশ্বরম্। 
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি।। 

আমরা অসান্তির মূল কারণ ভগবানের প্রতি বিদ্বেষপরাষণ মনোভাব, বস্তুর প্রকৃত মালিককে ভুলে গিয়ে আমাদের জগতের বিষয়গুলো ভোগ করার প্রবল আকাঙ্খা এবং তা ভোগ করার ক্ষেত্রে বাধাসমূহ। 

 

তাই এ শ্লোকে বলা হচ্ছে- ভগবানকে সবকিছুর পরম ভোক্তা, পরম নিয়ন্তা এবং পরম সুহৃদরূপে জানার মাধ্যমে আমরা শান্তি লাভ করতে পারি। 

 

বিদ্বেষপরায়ণ মনোভাব হতে নিস্তারঃ  অশান্তির কিছু কারণ হলো মানুষের ধৈর্যের অভাব, ক্ষমা না করা, সহনশীলতার অভাব, আধিপত্য বিস্তার করার প্রবণতা ইত্যাদি। তাই, গীতায় ভগবান আমাদের ধৈর্যশীল হবার শিক্ষা দিচ্ছেন, “মাত্রা স্পর্শস্তু কৌন্তেয়...।।”


সমাজে একজনের অন্যায়ে অন্যজন ক্রোধান্বিত হয়ে যাচ্ছে, ক্ষমা না করে প্রতিহিংসাপরায়ণ হচ্ছে। কিন্তু যুগে যুগে আমরা দেখেছি, মহৎব্যক্তিরা ‘ক্ষমা’ নামক মহৎ গুণের দ্বারা ভূষিত হয়েছেন। সাধ্বী দ্রৌপদী তার পাঁচ পুত্রের হত্যাকারী অশ্বত্থামাকে পর্যন্ত ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। 


গীতায় ভগবান ক্ষমা করে অন্যের প্রতি নৃশংস হতে নিষেধ করেছেন। 

কামনা-বাসনা মনোভাব হতে নিস্তারঃ অনেকে কোনো কাজ অন্যায় জেনেও তা পরিত্যাগ করতে পারে না। েএর কারণ কী? গীতায় ভগবান বলেছেন, অন্তরের মধ্যে সুপ্তভাবে নিহিত কামনা-বাসনাই হলো এর মুখ্য কারণ-কাম এষ...বিদ্ধ্যেনমিহ বৈরিণম। শুধু তা-ই নয়, আমরা কীভাবে এই দুর্নিবার শুক্র হতে মুক্ত হতে পরি, তিনি এর সমাধান হিসেবে আমাদের প্রাথমিকভাবে জড় ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার উপদেশও প্রদান করেছেন। 


প্রকৃত সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠাঃ আমরা দেখি, পুঁজিবাদি সমাজে একদল স্বার্থন্বেষী ব্যক্তি বিপুল সম্পদে সম্পদশালী হয়ে ওঠে, আরেকদল অনাহারে দিন অতিবাহিত করে। তাই, সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করে সকলের সম-অধিকার প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস করা হচ্ছে, 


কিন্তু তা অপূর্ণ, কেননা তা আপাতদৃষ্টিতে সমবন্টন মনে হলেও তাতে স্বার্থন্বেষী বিষয়গুলো থেকেই যাচ্ছে, ফলস্বরূপ গৃহযুদ্ধাদি সমস্যা দেখা দিচ্ছে। সেজন্য চিরস্থায়ী সমাধান হিসেবে ভগবান বলেছেন, যার যতটুকু প্রয়োজন তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকা কর্তব্য। 


সন্তুষ্ট থাকার সহজ উপায় হিসেবে জগতের সমস্ত সম্পত্তির মালিক যে তিনি, তা অনুধাবন করার উপদেশ করেছেন।

 

আরও পড়ুন

* আত্মা ও দেহের পার্থক্য এবং এবং আমাদের দুঃখের প্রকৃত কি?
 
* সুখ অর্থে নয় সন্তুষ্টিতে

* মহাজন উপদেশ-শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ 

*মহাজন উপদেশ-শ্রী যমরাজ 

* জীবনে সাফল্য পেতে চান! তাহলে মেনে চলুন এই দশটি টিপস 

* চানক্য পন্ডিতের অমূল্য বাণী যা আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে  

* মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী  
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url