ভগবানের মোহিনী মূর্তিরূপে অবতার

 

অমৃত পান করা নিয়ে অসুরদের মধ্যে কোলাহল  

শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন-"তারপর অসুরেরা পরস্পরের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন হয়েছিল। তারা পরস্পরের প্রতি সৌহার্দ্য পরিত্যাগ করে অমৃতভাণ্ড ছিনিয়ে নিয়েছিল এবং নিক্ষেপ করেছিল। 

 

তখন তারা দেখল যে, এক পরমা সুন্দরী যুবতী তাদের দিকে আসছে। সেই পরমা সুন্দরী যুবতীকে দর্শন করে অসুরেরা বলেছিল, "আহা এর সৌন্দর্য কি অপূর্ব, এর অঙ্গকান্তি কি অদ্ভুত, এর যৌবন কি অনির্বচনীয় সৌন্দর্যমণ্ডিত।” 

 

মোহীনির প্রতি অসুরদের আকর্ষণ 

এই কথা বলতে বলতে তারা তাঁকে উপভোগ করার বাসনায় কামার্ত হয়ে, তাঁর প্রতি দ্রুতবেগে ধাবিত হয়েছিল এবং তাঁকে নানা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করতে শুরু করেছিল। হে সুন্দরী! হে পদ্মপলাশ- লোচনে! তুমি কে? তুমি কোথা থেকে এসেছ?

কি উদ্দেশ্যে তুমি এখানে এসেছ? তুমি কার? হে অপূর্বসুন্দর উরুশালিনী, তোমাকে দর্শন করা মাত্র আমাদের মন বিক্ষুব্ধ হচ্ছে। মানুষদের কি কথা, দেবতা, দানব, সিদ্ধ, গন্ধর্ব, চারণ এবং লোকপাল প্রজাপতিরাও তোমাকে স্পর্শ করেনি। 

 

এমন নয় যে আমরা তোমার পরিচয় জানি না। হে সুন্দর ভ্রূশালিনী, বিধাতা নিশ্চয়ই কৃপা পরবশ হয়ে আমাদের ইন্দ্রিয় ও মনের প্রীতি উৎপাদনের জন্য তোমাকে প্রেরণ করেছেন। তাই নয় কি? 

 

হে সুমধ্যমে, হে সুন্দরী, আমরা একটি বস্তু অর্থাৎ অমৃতভাণ্ড নিয়ে পরস্পরের প্রতি শত্রু ভাবাপন্ন হয়েছি। আমরা এক কুলে জন্মগ্রহণ করা সত্ত্বেও পরস্পর বিবাদ করে শত্রু হয়ে পড়েছি। 

 

তুমি কৃপা করে আমাদের এই বিবাদের সমাধান কর। দেবতা এবং দানব আমরা সকলেই প্রজাপতি কশ্যপের সন্তান এবং তার ফলে আমরা ভ্রাতারূপে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু এখন আমরা পরস্পরের সঙ্গে বিবাদ করে নিজেদের পৌরুষ প্রদর্শন করছি। 

 

তাই আমরা তোমাকে অনুরোধ করছি, আমাদের মধ্যে এই অমৃত সমানভাবে বিতরণ করে তুমি আমাদের এই বিবাদের মীমাংসা করে দাও।"

 

অসুরদের প্রতি মোহিনীর কথা

"এইভাবে দৈত্যদের দ্বারা অভ্যর্থিত হয়ে মায়া রচিত মোহিনীমূর্তি ধারণকারী ভগবান হাস্য সহকারে মনোহর কটাক্ষে তাদের প্রতি দৃষ্টিপাত করে বলতে লাগলেন।" মোহিনীমূর্তিরূপী ভগবান অসুরদের বললেন-"হে কশ্যপ-তনয়গণ, আমি একটি বেশ্যা। 

 

 

আপনারা আমাকে এইভাবে বিশ্বাস করছেন কেন? বিজ্ঞ ব্যক্তি কখনও রমণীকে বিশ্বাস করেন না। হে অসুরগণ, বানর, শৃগাল এবং কুকুরদের যৌন সম্পর্কের যেমন কোন স্থিরতা নেই এবং তারা প্রতিদিন নতুন নতুন সঙ্গিনীর অন্বেষণ করে, স্বেচ্ছাচারিণী স্ত্রীলোকেরাও তেমন। 

 

 

এই প্রকার স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুত্ব কখনও স্থায়ী হয় না। সেটিই পণ্ডিতদের মত।" শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন-

 

 

মোহিনী দেবীর হাতে অমৃত কলস অর্পন।  

 

"মোহিনীমূর্তির এই প্রকার পরিহাস বাক্য শ্রবণ করে সমস্ত অসুরেরা আশ্বস্ত হয়েছিল এবং গম্ভীরভাবে হেসে তারা সেই অমৃতভাণ্ড তাঁর হাতে সমর্পণ করেছিল। তারপর ভগবান সেই অমৃতভাণ্ড গ্রহণ করে, ঈষৎ হেসে মধুর বচনে বললেন-

 

 

'হে অসুরগণ, আমি অমৃত বিভাগের ব্যাপারে ভাল-মন্দ যা করি না কেন, যদি তোমরা তা অঙ্গীকার কর, তা হলে আমি এই অমৃত তোমাদের মধ্যে ভাগ করে দিতে পারি।' অসুর-নায়কেরা বিচক্ষণ ছিল না। 

 

 

তাই মোহিনীমূর্তির সেই মধুর বাক্য শ্রবণ করে, 'হ্যাঁ, তুমি যা বলেছ তাই ঠিক', এই বলে তারা তাঁর বাক্যে তৎক্ষণাৎ সম্মত হয়েছিল। দেবতা এবং অসুরেরা উপবাস করে স্নান করেছিল এবং তারপর ঘৃত দ্বারা অগ্নিতে আহুতি নিবেদন করে গাভী, ব্রাহ্মণ এবং অন্যান্য বর্ণের সদস্যদের অর্থাৎ ক্ষত্রিয়, বৈশ্য এবং শূদ্রদের যথাযোগ্য উপহার প্রদান করেছিলেন। 

 

 

তারপর ব্রাহ্মণদের নির্দেশ অনুসারে দেবতা এবং অসুরেরা শুভ কর্ম অনুষ্ঠান করেছিলেন। তারপর তাঁদের নিজের নিজের রুচি অনুসারে তাঁরা নতুন বস্ত্র পরিধানপূর্বক অলঙ্কারের দ্বারা বিভূষিত হয়ে পূর্বাভিমুখে কুশাসনে উপবিষ্ট হয়েছিলেন।"

 

 

"হে রাজন, ফুলের মালা, দীপ আদির দ্বারা সুশোভিত এবং ধূপের সৌরভে আমোদিত সভাগৃহে দেবতা এবং দানবেরা পূর্বমুখী হয়ে উপবেশন করেছিলেন। তখন অত্যন্ত সুন্দর বসনে আবৃত, গুরু নিতম্বের ভারে মন্থর গতি, মদবিহ্বল নয়না, কুম্ভসদৃশ স্তন এবং হাতির শুঁড়ের মতো সুডৌল উরু সমন্বিতা মোহিনী অমৃতকলস হস্তে সেই স্থানে উপস্থিত হয়েছিলেন। 

 

 

তাঁর অত্যন্ত সুন্দর নাক, কপোল এবং স্বর্ণকুগুলে শোভিত কর্ণ তাঁর মুখমণ্ডলকে এক অপূর্ব সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত করেছিল। তাঁর চলার সময় তাঁর স্তন থেকে শাড়ির প্রান্তভাগ ঈষৎ খসে পড়েছিল। 

 

 

দেবতা এবং দানবেরা তাঁকে দর্শন করে তাঁর ঈষৎ হাস্যযুক্ত দৃষ্টিপাতে সম্পূর্ণরূপে মুগ্ধ হয়েছিলেন। অসুরেরা স্বভাবতই সর্পের মতো ক্রুর। তাদের অমৃত দান করা সর্পকে দুগ্ধদান করার মতোই অন্যায্য বলে বিবেচনা করে অচ্যুত ভগবান অসুরদের অমৃতের ভাগ প্রদান করলেন না। 

 

মোহিনী দেবী নিজ হাতে অমৃত বিতরণ 

 

মোহিনীমূর্তিরূপী জগৎপতি ভগবান দেবতা এবং দানবদের স্থিতি অনুসারে তাঁদের ভিন্ন ভিন্ন পঙ্ক্তিতে উপবেশন করিয়েছিলেন। ভগবান অমৃতকলস হাতে নিয়ে প্রথম অসুরদের কাছে গিয়েছিলেন এবং মধুর বাক্যের দ্বারা তাদের প্রসন্নতা বিধান করে অমৃত থেকে বঞ্চনা করেছিলেন। 

 

 

তারপর তিনি দূরে উপবিষ্ট দেবতাদের অমৃত পান করিয়ে জরা, বার্ধক্য এবং মৃত্যু থেকে মুক্ত করেছিলেন।"

 


"হে রাজন, অসুরেরা প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, সেই রমণী ন্যায় অন্যায় যা-ই করুক না কেন, তাই তারা অনুমোদন করবে। সেই প্রতিজ্ঞা রক্ষা করার জন্য, তাদের সাম্যভাব প্রদর্শন করার জন্য এবং একজন স্ত্রীলোকের সঙ্গে বিবাদ করা গর্হিত বলে, তারা নীরব ছিল। 

 

 

অসুরেরা মোহিনীমূর্তির প্রতি প্রণয়াসক্ত হয়েছিল এবং তাঁর প্রতি তাদের এক প্রকার বিশ্বাস উৎপন্ন হয়েছিল। তাই তাদের ভয় ছিল যাতে সেই সম্পর্ক নষ্ট হয়ে না যায়। সেইজন্য তারা তাঁর বাক্যে শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শন করে তাঁকে কিছু বলেনি। 

 

 

রাহু দেবতাদের মধ্যে ছদ্ধ্যবেশে অবস্থান 

 

চন্দ্র ও সূর্যকে গ্রাস করে যে রাহু, সে দেবতাদের বেশ ধারণ করে নিজের পরিচয় গোপন রেখে দেবতাদের পঙ্ক্তিতে প্রবেশ করেছিল এবং সকলের অলক্ষ্যে এমন কি ভগবানেরও অলক্ষ্যে অমৃত পান করেছিল। 

 

 

কিন্তু চন্দ্র এবং সূর্য রাহুর প্রতি তাঁদের স্থায়ী শত্রুতাবশত তা বুঝতে পেরেছিলেন। তার ফলে রাহুর এই প্রতারণা ধরা পড়ে গিয়েছিল। ভগবান শ্রীহরি তাঁর ক্ষুরধার চক্রের দ্বারা তৎক্ষণাৎ রাহুর মস্তক ছেদন করেছিলেন। 

 

 

রাহুর মস্তক যখন তার দেহ থেকে ছিন্ন হয়েছিল, তখন সে অমৃত গলাধঃকরণ করতে না পারার ফলে, তার দেহ অমৃতের স্পর্শ লাভ করতে পারেনি এবং তার ফলে তা অমৃতত্ব লাভ করেনি। 

 

 

রাহুর মস্তক অমৃতের স্পর্শ লাভ করার ফলে অমর হয়েছিল। তাই ব্রহ্মা রাহুর মস্তককে একটি গ্রহরূপে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। রাহু যেহেতু চন্দ্র এবং সূর্যের চিরশত্রু, তাই সে অমাবস্যা এবং পূর্ণিমা তিথিতে চন্দ্র এবং সূর্যের প্রতি ধাবিত হয়।"

 

 

মোহিনী রূপ থেকে বিষ্ণমূর্তি ধারণ 

 

"দেবতাদের অমৃত পান সমাপ্ত হলে, ত্রিভুবনের পরম সুহৃদ এবং শুভাকাঙক্ষী ভগবান অসুরশ্রেষ্ঠদের সমক্ষেই তাঁর স্বরূপ প্রকাশ করেছিলেন। যদিও দেবতা এবং অসুরদের উভয়ের ক্ষেত্রেই স্থান, কাল, কারণ, উদ্দেশ্য, কার্যকলাপ এবং মতাদর্শ একই ছিল, তবুও দেবতা এবং অসুরদের মধ্যে ফলপ্রাপ্তি ভিন্ন হয়েছিল। 

 

 

দেবতারা সর্বদা ভগবানের পাদপদ্মরেণুর আশ্রয় গ্রহণ করেছিলেন বলে, তাঁরা অনায়াসে অমৃতরূপ ফল লাভ করেছিলেন; কিন্তু অসুরেরা ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ না করায়, তাদের ঈপ্সিত ফল লাভ করতে পারেনি। 

 

 

মানব-সমাজে বাক্য, মন এবং কর্মের দ্বারা ধন এবং প্রাণ রক্ষা করার জন্য নানা রকম কার্যকলাপ অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু সেই সবই অনুষ্ঠিত হয় নিজের অথবা দেহ সম্পর্কিত বিস্তৃত ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য। এই সমস্ত কার্যকলাপ ভগবদ্ভক্তি থেকে ভিন্ন হওয়ার ফলে ব্যর্থ হয়। 

 

কিন্তু সেই কার্যকলাপই যখন ভগবানের প্রসন্নতা বিধানের জন্য অনুষ্ঠিত হয়, তখন তার লাভজনক ফল সকলেই ভোগ করে, ঠিক যেমন গাছের গোড়ায় জল দিলে সমস্ত গাছটিতেই জল দেওয়া হয়।"

 

আরও পড়ুনঃ- 


*  ক্ষীর সমুদ্র মন্থন কাহীনি



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url