শ্রীমদ্ভাগবত-১ম-স্কন্ধ-১০ম-অধ্যায়-Srimad-bhagavad-bangla

 
radha krishna photo

ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দ্বারকা যাত্রা (Srimad-bhagavad-bangla)-শ্রীমদ্ভাগবত 

 
 
সিতাতপত্রং জাগ্রাহ মুক্তাদমবিভূষিতম্।।
রত্নদন্ডং গুড়াকেশঃ প্রিয়ঃ প্রিয়তমস্য হ।।-(শ্রীমদ্ভাগবত-১-১০-১৭)
অনুবাদঃ সেই সময়ে পরমেশ্বর ভগবানের অন্তরঙ্গ সখা মহাযোদ্ধা এবং জিতনিদ্র অর্জুন প্রিয়তম পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের মস্তকে মুক্তামালামন্ডিত ও রত্ননির্মিত দন্ডযুক্ত শ্বেতছত্র ধারণ করলেন।
তাৎপর্যঃ প্রাচুর্যপূর্ণ রাজসিক উৎসবগুলিতে সোনা, রত্ন, মুক্তা এবং মূল্যবান পাথর ব্যবহার করা হতো। সে সবই হচ্ছে প্রকৃতির দান এবং মানুষ যখন প্রয়োজনের নামে অবাঞ্ছিত বস্তু উৎপাদনে তাদের মূল্যবান সময়ের অপচয় করে না, তখন ভগবানের আদেশে পর্বত, সমুদ্র ইত্যাদি সেগুলো উৎপাদন করে। কলকারখানার মাধ্যমে তথাকথিত উন্নতির দ্বারা তারা এখন সোনা, রূপা পিতল, তামা ইত্যাদি ধাতুর পরিবর্তে কৃত্রিম পদার্থের তৈরি বাসন ব্যবহার করছে। তারামাখনের পরিবর্তে মার্গারিন ব্যবহার করছে, শহরের এক-চতুর্থাংশ মানুষ আশ্রয়বিহীন হয়ে জীবনযাপন করছে। 

উদ্ভবঃ সাত্যকিশ্চৈব ব্যজনে পরমাদ্ভুতে।।
বিকীর্যমাণঃ কুসুমৈ রেজে মধুপতিঃ পথি।।১৮।। 
অনুবাদঃ উদ্ভব ও সাত্যকি অতি চমকপ্রদ চামর দ্বারা পরমেশ্বর ভগবান কুসুমাকীর্ণ আসনে উপবিষ্ট হয়ে পথ চলতে  চলতে তাঁদের নির্দেশ দিতে লাগলেন। 

অশ্রুয়ন্তাশিষঃ সত্যাস্তত্র তত্র দ্বিজেরিতাঃ।।
নানুরূপানুপাশ্চ নির্গুণস্য গুণাত্মনঃ।।১৯।।
অনুবাদঃ ব্রাহ্মণগণ কর্তৃক উচ্চারিত আশীর্বাদ-ধ্বনি সর্বত্র শোনা যেতে লাগল। ত্রিগুণাতীত পরমানন্দস্বরূপ শ্রীকৃষ্ণেরপ্রতি এই প্রকার আশীর্বাদ যদিও অনুপযুক্ত, কিন্তু নররূপে লীলা অভিনয়কারী ভগবানের প্রতি ব্রাহ্মণদের এ আশীর্বাদ উপযুক্তই হয়েছিল।


তাৎপর্যঃ স্থানে স্থানে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের উদ্দেশ্যে আশীর্বাদসূচক বৈদিক মন্ত্র উচ্চারিত হচ্ছিল। একদিক দিয়েএই আশীর্বাদ উপযুক্ত ছিল, কেননা ভগবান মহারাজ যুধিষ্ঠিরের জ্ঞাতিভ্রাতা (মামাতো ভাই) রূপে একজন সাধারাণমানুষের মতো লীলাবিলাস করছিলেন। কিন্তু আরেক দিক দিয়ে সেটি অনুপযুক্ত ছিল, কেননা ভগবান হচ্ছেন পরমেশ্বরএবং কোনোরকম জড়জাগতিক সম্পর্কের সঙ্গে তাঁর কোনো সম্পর্ক নেই। তিনি নির্গুণ,

অর্থাৎ তার মধ্যে কোনোজড়জাগতিক গুণ নেই। কিন্তু তিনি চিন্ময় গুণে পূর্ণ। চিজ্জগতে কোনো বিরুদ্ধ ভাব নেই, কিন্তু এ আপেক্ষিক জগতে সবকিছুরই বিপরীত ভাব রয়েছে। আপেক্ষিক জগতে সাদা হচ্ছে কালো ধারণার বিপরীত, কিন্তু চিজ্জগতে সাদা এবংকালোর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই।
 



তাই পরম পুরুষের উদ্দেশ্য বিদ্বান ব্রাহ্মণেরা যে আশীর্বাণী উচ্চারণ করছিলেনতা বিসদৃশ বলে মনে হচ্ছিল, কিন্তু যখন পরম পুরুষের উদ্দেশ্যে তার প্রয়োগ হয়, তখন তা সমস্ত বিরোধ থেকে মুক্তহয়ে চিন্ময়ত্বে পর্যবসিত হয়। একটি উদাহরণের দ্বারা এ ধারণাটি আরো স্পষ্ট করা যায়। কখনো কখনো শ্রীকৃষ্ণকেচোর বলা হয়।

 তাঁর শুদ্ধ ভক্তদের কাছে তিনি একজন মাখন চোররূপে অত্যন্ত প্রসিদ্ধ। তাঁর বাল্যলীলায় তিনি বৃন্দাবনের প্রতিবেশীদের গৃহ থেকে মাখন চুরি করতেন।
 
 
তখন থেকে তিনি একজন চোর বলে প্রসিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও, তিনি সেই চোররূপেই পূজিত হন; কিন্তু জড়জগতে কখনো কোনো চোরের প্রশংসা করা হয় না, পক্ষান্তরে তাকে দন্ড দেওয়া হয়। যেহেতু তিনি পরমেশ্বর ভগবান, তাঁর বেলায় সবকিছুই প্রযোজ্য এবং সমস্ত বিরুদ্ধ ভাব সত্ত্বেও তিনি পরমেশ্বর ভগবান।

অন্যোন্যমাসীৎসংজল্প উত্তমশ্লোকচেতসাম্। 
কৌরবেন্দ্রপুরস্ত্রীণাং সর্বশ্রুতিমনোহরঃ।।২০।।
অনুবাদঃ উত্তম শ্লোকের দ্বারা বন্দিত ভগবানের অপ্রাকৃত গুণাবলির চিন্তায় মগ্ন হয়ে কুরু-কুলরমণীরা পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণের কথা আলোচনা করতে লাগলেন। তাঁদের এ আলোচনা বৈদিক মন্ত্রের চেয়েও অধিক আকর্ষণীয় হয়েছিল।
তাৎপর্যঃ শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের লক্ষ্য হচ্ছে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ। প্রকৃতপক্ষে বেদ, রামায়ণ, মহাভারত আদি শাস্ত্রে ভগবানের মহিমা বর্ণিত হয়েছে। তাই করুবংশীয় রাজাদের রাজধানীর প্রাসাদের ছাদে কুলরমণীরা ভগবানের সম্বন্ধে যে আলোচনা করছিলেন তা বৈদিক মন্ত্রের থেকেও শ্রুতিমধুর ছিল।

ভগবানের মহিমা কীর্তন করে যা কিছুই গাওয়া হয়, সে সবই শ্রুতিমন্ত্র। গৌড়ীয় সম্প্রদায়ের একজন আচার্য নরোত্তম দাস ঠাকুর সরল বাংলা ভাষায় যে সমস্ত সঙ্গীত রচনা করেছেন, সে সম্বন্ধে সেই সম্প্রদায়ের আরেকজন আচার্য শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর বলেছেন যে, সেগুলো হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ, কোন ভাষায় রচিত তা দিয়ে কিছু যায় আসে না।

 ভগবানের কার্যকলাপের চিন্তায় মগ্ন সেই সমস্ত পুরনারীরা ভগবানের কৃপায় বৈদিক বাণীর চেতনায় বিকশিত হয়েছিলেন। তাই যদিও সেই রমণীরা সংস্কৃত ভাষায় অথবা অন্যান্য দিক দিয়ে মহাপন্ডিত ছিলেন না, তবুও তাঁরা যেসমস্ত কথা বলেছিলেন, তা ছিল বৈদিক মন্ত্রের থেকেও অধিক আকর্ষণীয়। উপনিষদের মন্ত্র কখনো কখনো পরোক্ষভাবে ভগবানকে ইঙ্গিত করে, কিন্তু সেই রমণীরা প্রত্যক্ষভাবে ভগবানের কথা আলোচনা করছিলেন এবং তাই তা অধিক হৃদয়গ্রাহী ছিল অভিজ্ঞ ব্রাহ্মণদের আশীর্বাণী থেকেও সেই সমস্ত রমণীদের আলোচনা অধিক মহত্ত্বপূর্ণ ছিল।

স বৈ কিলায়ং পুরুষঃ পুরাতনো
য এক আসীদবিশেষ আত্মনি। 
অগ্রে গুণেভ্যো জগদাত্মনীশ্বরে
নিমীলিতাত্মন্নিমি সুপ্তশক্তিষু।।২১।।.
অনুবাদঃ তাঁরা বলেছিলেন-ইনিই সেই আদি পুরুষোত্তম ভগবান, যাঁর কথা আমরা স্মরণ করে থাকি। প্রকৃতির গুণসমূহ সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে তিনিই কেবলমাত্র বিরাজমান ছিলেন এবং যেহেতু তিনিই পরমেশ্বর ভগবান, তাই কেবলমাত্র তাঁরই মধ্যে নিশাকালে নিদ্রা যাওয়ার মতো সমস্ত জীব শক্তিরহিত হয়ে লীন হয়ে যায়।

তাৎপর্যঃ নিখিল সৃষ্টিতে দুই প্রকার প্রলয় হয়। ৪৩২,০০,০০,০০০ সৌরবৎসরের পর কোনো বিশেষ ব্রহ্মান্ডের নিয়ন্তা ব্রহ্মা যখন নিদ্রা যান, তখণ এক প্রকার প্রলয় হয়। আর ব্রহ্মার শতবর্ষ পূর্ণ হলে, তাঁর জীবনের অন্তে সমগ্র ব্রহ্মান্ডের পূর্ণ প্রলয় হয়। আমাদের গণনায় ব্রহ্মার শত বর্ষ হচ্ছে ৮৬৪,০০,০০,০০০⤩৩০⤩১২⤩১০০ সৌর বৎসর। উভয়  প্রলয়ের সময়েই মহত্তত্ত্ব নামক জড়া শক্তি এবং জীব-তত্ত্ব নামক তটস্থা শক্তি পরমেশ্বর ভগবানের অঙ্গে লীন হয়ে যায়।

 পুনরায় জড় জগৎ সৃষ্টি হওয়া পর্যন্ত জীবেরা ভগবানের শরীরে সুপ্ত অবস্থায় থাকে। এভাবে জড় জগতের সৃষ্টি, স্থিতি এবং প্রলয় কার্য চলতে থাকে। ভগবানের দ্বারা সক্রিয় হওয়ার পর প্রকৃতি তিনটি গুণের প্রতিক্রিয়ার প্রভাবে ক্রিয়াশীল হয় এবং তাই এখানে বলা হয়েছে যে, প্রকৃতির গুণ সক্রিয় হওয়ার পূর্বে ভগবান শ্রীবিষ্ণুই কেবল সৃষ্টির পূর্বে ছিলেন এবং তখন ব্রহ্মা, শিব এবং অন্যান্য দেবতারা ছিলেন না।

 বিষ্ণু বলতে এখানে কারণ সমুদ্রে শায়িত মহাবিষ্ণুকে বোঝানো হয়েছে। তাঁর নিঃশ্বাসের ফলে বীজরূপে সমস্ত ব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি হয় এবং ধীরে ধীরে তা অসংখ্য গ্রহরূপে বিরাটরূপ ধারণ করেন। অশ্বথ বৃক্ষের বীজ থেকে যেমন অসংখ্য বৃক্ষের বিকাশ হয়, ঠিক তেমনই ব্রহ্মান্ডের বীজ থেকে বিশাল ব্রহ্মান্ড বিকশিত হয়। এই মহাবিষ্ণু হচ্ছেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অংশ, যাঁর সম্বন্ধে বর্ণনা করে ব্রহ্ম-সংহিতায় বলা হয়েছে যে- “আমি আদি পুরুষ গোবিন্দকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি, যাঁর অংশ হচ্ছেন মহাবিষ্ণু।

যাঁর অপ্রাকৃত শরীরের রোমকূপ থেকে সমস্ত ব্রহ্মান্ডের উৎপত্তি হয় এবং সেই ব্রহ্মান্ডের পরিচালক ব্রহ্মাগণ কেবল তাঁর নিঃশ্বাসের কাল অবধি জীবিত থাকেন।”(ব্রহ্ম-সংহিতা৫/৫৮) এভাবে গোবিন্দ বা কৃষ্ণ হচ্ছেন মহাবিষ্ণুরও কারণস্বরূপ। সেই বৈদিক তত্ত্ব আলোচনারত সমস্ত কুলরমণীরা অবশ্যই মহাজনদের কাছ থেকে সে কথা শুনেছিলেন। মহাজনদের কাছ থেকে শ্রবণ করাই হচ্ছে চিন্ময় বিষয়ে যথাযথভাবে অবগত হওয়ার একমাত্র উপায়।

আরও পড়ুনঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত 
 
 এর কোন বিকল্প নেই।  ব্রহ্মার শতবর্ষের সমাপ্তিতে জীবেরা আপনা থেকেই মহাবিষ্ণুর শরীরে লীন হয়ে যায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে জীবেরা তাদের সত্তা হারিয়ে ফেলে। তাদের সত্তা বর্তমান থাকে এবং ভগবানের ইচ্ছায় যখন আবার সৃষ্টি হয়, তখন সমস্ত সুপ্ত নিষ্ক্রিয় জীবেরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের পূর্ব জীবনের কার্যকলাপ অনুসারে পুনরায় সক্রিয় হওয়ার জন্য ছাড়া পায়।


একে বলা হয় সুপ্তোত্থিত ন্যায়, অর্থাৎ ঘুম থেকে জেগে ওঠে পুনরায় তাদের স্ব-স্বকর্তব্যকর্মে নিযুক্ত হয়। মানুষ যখন রাত্রি-বেলায় নিদ্রা যায়, তখন সে ভুলে যায় সে কে, তার কর্তব্য কী; কিন্তু ঘুম থেকে জেগে ওঠার পরই তার মনে পড়ে যায় তাকে কী করতে হবে এবং এভাবে সে তার কার্যকলাপে লিপ্ত হয়। জীবেরাও প্রলয়ের সময় মহাবিষ্ণুর শরীরে লীন হয়ে যায়, কিন্তু অন্য আরেকটি সৃষ্টিতে জেগে ওঠা মাত্রই তারা তাদের অসমাপ্ত কার্য শুরু করে। সে কথাও শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় (৮/১৮/২০) প্রতিপন্ন হয়েছে। সৃজনাত্মক শক্তি সক্রিয় হওয়ার পূর্বে ভগবান বর্তমান ছিলেন। ভগবান জড়া প্রকৃতি থেকে উৎপন্ন হননি। তাঁর শরীর পূর্ণরূপে চিন্ময় এবং তাঁর শরীর ও তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সৃষ্টির পূর্বে ভগবান তাঁর এক এবং অদ্বিতীয় পরম ধামে ছিলেন। 

আরও পড়ুন.

 
* কেমন সেই চিন্ময় জগৎ/বৈকুণ্ঠলোক-শ্রীমদ্ভাগবত
 
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url