হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপের মাধ্যমে ধ্যান - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

শনিবার, ১৩ নভেম্বর, ২০২১

হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপের মাধ্যমে ধ্যান

হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপের মাধ্যমে ধ্যান

অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গের মাধ্যমে ধ্যান

১৯৬৯ সালের গ্রীষ্মকালে বোস্টনের নর্থইষ্টার্ণ ইউনিভার্সিটিতে ভাষণ দান কালে শ্রীল প্রভুপাদ একটি ধ্যানপন্থা সকলের কাছে তুলে ধরেন, যেটি অসাধারণ শক্তির জন্য প্রসিদ্ধ এবং বস্তুতঃ যেটি প্রায় যেকোন স্থানে বা যেকোন সময়ে অনুশীলন করা যায়। 

 

“আপনারা যদি এই সরল পন্থাটি গ্রহণ করেন," তিনি বলেন, “হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে মহামন্ত্র কীর্তনের পন্থা, তাহলে আপনারা অবিলম্বে অপ্রাকৃত স্তরে উন্নীত হবেন।” তিনি আরও বলেন, “আপনি যখন জনবহুল রাস্তার উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন তখন অন্য কোন ধরনের ধ্যান সম্ভব নয়--কিন্তু এটি সম্ভব।”


প্রিয় ছাত্র-ছাত্রীগণ, এই আলোচনা সভায় যোগদানের জন্য আমি আপনাদের অনেক ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমরা এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন প্রসারিত করছি কেননা সমগ্র বিশ্বে এই চেতনা বিস্তারের এক বিরাট প্রয়োজন রয়েছে। আর পন্থাটি খুবই সহজ--সেটিই হচ্ছে সুবিধা।


প্রথমতঃ, এই অপ্রাকৃত স্তর কি আমাদের তা অবশ্যই বুঝতে চেষ্টা করতে হবে। এখন আমাদের এই বর্তমান অবস্থায়, আমরা বিভিন্ন স্তরে স্থিত। সুতরাং, সর্বপ্রথম আমাদেরকে এই অপ্রাকৃত স্তরে আসতে হবে, আর এই অপ্রাকৃত স্তরে অধিষ্ঠিত হলেই কেবল অপ্রাকৃত ধ্যানের স্তরে আসা যায়। 


ভগবদ্গীতার তৃতীয় অধ্যায়ে আপনারা বদ্ধ জীবের চেতনার বিভিন্ন স্তরের ব্যাখ্যা পাবেন। প্রথম স্তর হচ্ছে দেহগত না, দেহাত্মবোধ (ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুঃ)। এই জড় জগতের প্রত্যেকেই দেহাত্ম-চেতনায় আবিষ্ট। কেউ ভাবছে, “আমি একজন ভারতীয় ।” আপনারা ভাবছেন, “আমি একজন আমেরিকান।" কেউ ভাবছে, “আমি রাশিয়ান।” কেউ হয়তো অন্য আর কিছু ভাবছে। সুতরাং প্রত্যেকেই ভাবছে, “আমিই শরীর ।”


বদ্ধজীবনে দেহগত চেতনার স্তরকে বলা হয় ইন্দ্রিয়জ স্তর, কেননা যতক্ষণ আমরা দেহাত্মবোধে আচ্ছন্ন থাকি, ততক্ষণ আমরা মনে করি যে, সুখ মানে ইন্দ্রিয়তৃপ্তি। আর কিছুই নয়। বর্তমানে এই দেহাত্ম-চেতনা অত্যন্ত প্রবল--কেবল বর্তমানেই নয়, এই জড় জগতের সৃষ্টির সময় থেকেই এমন চলছে। এই জড় জগতের বদ্ধ জীবের এটিই হচ্ছে রোগ; “আমি হচ্ছি এই দেহ।”

 

শ্রীমদ্ভাগবতে বলা হয়েছে, যস্যাত্ম-বুদ্ধিঃ কুণপে ত্রি-ধাতুকে।

আমরা এই শরীর, এমন চিন্তা করার অর্থ হচ্ছে আমরা নিজেদেরকে এক ব্যাগ চামড়া ও হাড় বলে মনে করি। এই দেহটি চামড়া, হাড়, রক্ত, মূত্র, বিষ্ঠা এবং এই ধরনের আরও সুন্দর জিনিসের একটি থলি । সুতরাং, যখন আমরা চিন্তা করি, “আমি এই শরীর," আমরা প্রকৃতপক্ষে ভাবছি, “আমি একথলি হাড়, চামড়া এবং বিষ্ঠা ও মূত্র। 

 

এটিই হচ্ছে আমার সৌন্দর্য; সেটিই আমার সবকিছু। অতএব, এই দেহগত চেতনা, দেহাত্মবোধ খুব একটি বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক নয়, এবং এই দেহটির অবস্থার উন্নতি সাধন আত্ম-উপলব্ধির যথার্থ উপায় নয়।


যারা দেহগত চেতনায় অত্যন্ত আবিষ্ট, তাদেরকে ধ্যানযোগ অনুশীলনের নির্দেশ দেওয়া হয় । শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাতে এটি আলোচিত হয়েছে। ষষ্ঠ অধ্যায়ের ১৩, ১৪ শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ ব্যাখ্যা করেছেন, “শরীর, মস্তক ও গ্রীবাকে সরল রেখে, অন্যদিকে দৃষ্টিনিক্ষেপ না করে নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশাত্তাত্মা, ভয়শূন্য ও ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরূপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যানপূর্বক যোগ অভ্যাস করবেন।”


কিভাবে এই ধ্যানযোগ অনুশীলন করতে হবে, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তার প্রারম্ভিক নির্দেশাবলী দিয়েছেন। যোগীকে ইন্দ্রিয়সম্ভোগ নিয়ন্ত্রিত করতে হবে, বিশেষতঃ কাম। যোগীকে একটি নির্জন পবিত্র স্থানের সন্ধান করতে হবে, এবং সেখানে একাকী ধ্যানে বসতে হবে। 

 

এই যোগ-পন্থা এইরকম স্থানে, জনাকীর্ণ এইরকম বড় শহরে অনুশীলন করা যায় না। যোগাভ্যাসকারীকে অবশ্যই একটি জনশূন্য স্থানে যেতে হবে, এবং একাকী ধ্যান অভ্যাস করতে হবে। আর আপনি যখন যত্নসহকারে আপনি আপনার জায়গা নির্বাচন করেছেন, তখন আপনার পরবর্তী কাজ হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট ভঙ্গিমায় উপবেশন করা, বসা। 

 

আরো কত নিয়মবিধি রয়েছে। অবশ্য ওই সমস্ত * কয়েক মিনিটের মধ্যে ব্যাখ্যা করা যায় না। আপনারা যদি এই বিষয়ে আগ্রহ থাকে হবে আপনারা ভগবদ্গীতার ধ্যানযোগ নামক অধ্যায়ে এর একটি পূর্ণ বিবরণ পাবেন।


অতএব, এই দেহগত চেতনার স্তর হতে অপ্রাকৃত, চিন্ময় স্তরে উন্নীত হতে হবে । কোন প্রকৃত আত্মোপলব্ধির এটিই হচ্ছে লক্ষ্য। আমি এই বলে শুরু করেছিলাম যে, প্রথমতঃ আমরা সবাই ভাবছি যে, আমরাই শরীর । ইন্দ্রিয়াণি পরাণ্যাহুঃ । তারপর, যিনি এই দেহাত্মবোধ অতিক্রম করেন, তিনি মনোগত স্তরে উপনীত হন। 

 

ইন্দ্রিয়েভ্যঃ পরং মনঃ। মনঃ শব্দটির অর্থ হচ্ছে মন। বস্তুতঃ বিশ্বের সমস্ত মানুষই দেহগত চেতনায় আচ্ছন্ন, কেবল কিছু মানুষ রয়েছে যারা মনোগত চেতনার স্তরে অধিষ্ঠিত । তারা ভাবছে যে, তারা হচ্ছে মন। আরো কিছু কমসংখ্যক বৌদ্ধিক স্তরে অবস্থিত মনসস্তু পরাবুদ্ধিঃ।

 

আর আপনি যখন এই বৌদ্ধিক স্তর অতিক্রম করেন, তখন আপনি পারমার্থিক স্তরে, চিন্ময় স্তরে উপনীত হন। এটিই হচ্ছে প্রাথমিক উপলব্ধি যা প্রয়োজন।


অপ্রাকৃত ধ্যান অনুশীলনের পূর্বে আপনাকে অবশ্যই অপ্রাকৃত স্তরে পৌছাতে হবে। সেই অপ্রাকৃত স্তরকে বলা হয় ব্রহ্মভূতঃ। সম্ভবতঃ আপনি এই শব্দটি শুনেছেন--ব্রহ্ম । যোগী চিন্তা করেন, "অহং ব্রহ্মাস্মি  আমি এই দেহ নই; আমি এই মন নই; আমি বুদ্ধি নই: আমি আত্মা।" এই হচ্ছে অপ্রাকৃত স্তর ।


আমরা অপ্রাকৃত ধ্যান সম্বন্ধে আলোচনা করছি। অতএব, দেহাত্মবোধের স্তর অতিক্রম করে, মনোগত স্তর অতিক্রম করে, বৌদ্ধিক ধারণার স্তর অতিক্রম করে আপনি পরিশেষে অপ্রাকৃত স্তরে, চিন্ময় স্তরে উপনীত হন, যাকে বলা হয় ব্রহ্মভূত সবকিছুরই স্তর । 

 

আপনি কখনই কতকগুলো শব্দ উচ্চারণ করতে পারেন না--"এখন আমি ব্রহ্ম উপলব্ধি করেছি।" এগুলো কথার কথামাত্র নয়, তার লক্ষণ রয়েছে। আর কেউ ব্রহ্ম উপলব্ধি করেছেন কিনা আপনি কেমন করে তা জানতে পারবেন, ভগবদ্গীতায় (১৮/৫৪) তা ব্যাখ্যা করা হয়েছে  ব্রহ্মভূত প্রসন্নাত্মা । 

 

কেউ যখন চিন্ময় স্তরে ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হন, তখন তার লক্ষণ এই যে, তিনি সর্বদাই আনন্দিত, প্রসন্ন। কোন বিষণ্নতা নেই। আর এই প্রসন্ন শব্দের দ্বারা কী বোঝায়? সেটিও ব্যাখ্যা করা হয়েছে : ন শোচতি ন কাঙ্ক্ষতি । যিনি ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হয়েছেন তিনি কোনকিছুর জন্য শোক করেন না, কিছু আকাঙ্ক্ষাও করেন না। 

 

জড় জাগতিক স্তরে স্থিত অবস্থায় আমাদের দুটি লক্ষণ থাকে আকাঙ্ক্ষা ও শোক আমাদের যা নেই আমরা তা লাভের আকাঙ্ক্ষা করি, আমরা যা হারিয়েছি তার জন্য শোক করি। দেহ চেতনায় আবিষ্ট থাকার এগুলো হচ্ছে লক্ষণ।

 

এই সমগ্র জড়জগত যৌনসুখের জন্য আকাঙ্ক্ষিত কামই হচ্ছে আকাঙ্ক্ষার মূল ভিত্তি। পুংসঃ স্ত্রীয়া মিথুনী ভাবমেতম্। মিথুনীভাবম্-এর অর্থ হচ্ছে মৈথুন, যৌনপরিতৃপ্তি। আপনি মানব সমাজে দেখুন অথবা পশু সমাজে, কিংবা পাখিদের মধ্যে বা কীটপতঙ্গের মধ্যে, সর্বত্রই আপনি দেখবেন যে, মৈথুন আকাঙ্ক্ষা অত্যন্ত প্রবল । 

 

একটি ছেলে একটি মেয়ের সঙ্গলাভের আকাঙ্ক্ষা করছে, একটি মেয়ে কোন ছেলের সঙ্গলাভের আকাঙ্ক্ষা করছে, একজন নারী পুরুষের সঙ্গ আকাঙ্ক্ষা করছে। সেটিই চলছে ।


আর যখনই পুরুষ ও নারী মিলিত হয়, তাদের হৃদয়গ্রন্থি শক্তভাবে বাঁধা পড়ে । তয়োমিথো হৃদয়-গ্রন্থিমাহুঃ। তারা মনে করে, “আমি জড় পদার্থ, এই জড় দেহ। এই দেহটি আমার এই নারী, বা পুরুষটি আমার। এই দেশ আমার। এই পৃথিবী আমার।” এই হচ্ছে হৃদয়গ্রন্থি। 

 

এই দেহগত চেতনা অতিক্রম করার পরিবর্তে, তারা আরো বেশি করে দেহ চেতনায় আবিষ্ট হয়ে পড়ে। তখন পরিস্থিতি অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে । সেজন্য শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় উপদেশ দেন যে, আপনি যদি যোগ ও ধ্যান অনুশীলনে আদৌ আগ্রহী হন, চিন্ময় স্তরে উন্নীত হওয়ার চেষ্টা করেন, তাহলে । আপনাকে অবশ্যই মেথুন হতে বিরত হতে হবে। কিন্তু বর্তমান যুগে সেটি সম্ভব নয়।

 

 অতএব, আমাদের এই পন্থায় কৃষ্ণভাবনা পন্থায়, আমরা বলি না, “যৌন সংসর্গ বন্ধ করো।" আমরা বলি, “অবৈধ যৌনসঙ্গ করো না। অবশ্য, অবৈধ যৌনসঙ্গ বর্জন না করলে মানুষ সভ্য জীবনেই আসতে পারেনা, অপ্রাকৃত, চিন্ময় জীবনের কথা তো বলাই বাহুল্য। প্রত্যেক সভ্য সমাজে বিবাহ প্রথা রয়েছে, আর বিবাহ বহির্ভূত যে যৌনকর্ম, সেটিকে বলা হয় অবৈধ যৌনতা। 

 

কোন সভ্য সমাজেই মানুষকে অবৈধ যৌনতার অনুমোদন দেওয়া হয় না, অতএব যারা পারমার্থিক জীবন লাভের চেষ্টা করছেন তাদের কথা কি বলার আছে । অপ্রাকৃত, পারমার্থিক জীবন অবশ্যই সমস্ত ধরনের মানসিক ও দেহগত চেতনা থেকে বিমুক্ত, পরিশুদ্ধ হতে হবে ।


কিন্তু কলিযুগে, যেখানে প্রত্যেকেই উপদ্রুত, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায়, আয়ু অত্যন্ত স্বল্প, সেখানে মানুষ সাধারণতঃ কোন পারমার্থিক বিষয়ে আগ্রহী নয়। তারা কেবল দেহগত ব্যাপারে আগ্রহী। কেউ যখন এত সমস্ত উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় বিব্রত, তখন কিভাবে সে ব্রহ্ম উপলব্ধির অপ্রাকৃত স্তরে উপনীত হতে পারে? 

 

এই যুগে এটি অত্যন্ত কষ্টসাধ্য, দুরূহ । এমনকি পাঁচ হাজার বছর আগেও এটি কষ্টসাধ্য ছিল, যখন অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নিকট থেকে এই ধ্যানযোগ সম্বন্ধে উপদেশ গ্রহণ করেন, ভগবদ্গীতায়   অর্জুন ছিলেন একজন রাজপুত্র; তিনি অনেক দিক থেকেই সাধারণ মানুষের থেকে উন্নত ছিলেন। 

 

তবুও তিনি কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধক্ষেত্রে বলেছিলেন, “প্রিয় কৃষ্ণ, আমার পক্ষে এই ধ্যানযোগ অভ্যাস করা সম্ভব নয়। আমি একজন গৃহস্থ; আমার রাজনৈতিক স্বার্থের কারণে আমি এখানে যুদ্ধ করতে এসেছি। কিভাবে আমি যোগ অভ্যাস করতে পারি, যেখানে আমাকে একটি নির্জন স্থানে যেতে হবে, বসতে হবে, তারপর আমাকে কাম থেকে বিরত হতে হবে? এটি সম্ভব নয়।” আমাদের চেয়েও অর্জুন অনেক বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন ছিলেন, তবুও এই ধ্যান পন্থা অভ্যাস করতে অস্বীকার করেন।


সুতরাং, এই যোগে হঠযোগ বা ধ্যানযোগের মাধ্যমে অপ্রাকৃত স্তরে ব্রহ্মভূত স্তরে উপনীত হওয়া সম্ভব নয়। আর কেউ যদি তথাকথিত ধ্যান অভ্যাস করার চেষ্টা করে, প্রকৃতপক্ষে সে ধ্যানযোগ অভ্যাস করছে না। আপনি কোন জনাকীর্ণ শহরে এই ধ্যানযোগ অভ্যাস করতে পারেন না। 

 

সেটি সম্ভব নয়। ভগবদ্গীতায় সেটি সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু আপনি একটি জনবহুল শহরে বাস করছেন, আপনি আপনার পরিবারের সঙ্গে বাস করছেন, আপনি আপনার বন্ধুদের সঙ্গে বাস করছেন । সুতরাং, আপনার পক্ষে বনে যাওয়া এবং একটি জনশূন্য স্থানে ধ্যান অভ্যাসের চেষ্টা করা সম্ভব নয়। কিন্তু শ্রীকৃষ্ণ বলছেন যে, এই ধ্যানযোগ অভ্যাস করতে হলে আপনাকে এগুলো করতেই হবে।

 

অতএব, এখন, এই যুগে, আপনি যদি চিন্ময় ব্রহ্মভূত স্তরে অধিষ্ঠিত হতে চান, তাহলে আপনাকে অবশ্যই বৈদিক শাস্ত্রের উপদেশ গ্রহণ করতে হবে  কলৌ তত্ত্বরিকীর্তনাৎ। এই যুগে কেবল ভগবানের দিব্যনাম কীর্তনের মাধ্যমে একজন সকল ধরনের যোগসিদ্ধি লাভ করতে পারে। আমরা আমাদের মানসিক জল্পনা কল্পনা উদ্ভাবন করে এই যোগপন্থা প্রবর্তন করছি না-—সবকিছুকে সহজ করার জন্য। না, এটি আমাদের স্বকপোলকল্পিত নয়।


শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পাঁচশ বছর পূর্বে এই ধ্যানপন্থা প্রবর্তন করেন। বৈদিক শাস্ত্রেও এটি উপদিষ্ট হয়েছে, এবং এটি বাস্তবসম্মত। আপনারা দেখেছেন যে, আমার শিষ্যবৃন্দ, এই সমস্ত ছেলে-মেয়েরা যখনই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন শুরু করে তৎক্ষণাৎ তারা এক ধরনের অপ্রাকৃত অনুভূতি লাভ করতে থাকে।

 

আপনারা যদি অনুশীলন করেন আপনারাও দেখবেন কিভাবে আপনারা এই চিন্ময় স্তরে উন্নীত হচ্ছেন। সুতরাং, হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে, হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে কীর্তন হচ্ছে সর্বাপেক্ষা সহজ যোগপন্থা।


এই অপ্রাকৃত শব্দতরঙ্গ আপনাকে অচিরেই চিন্ময় স্তরে উন্নীত করবে; বিশেষতঃ আপনি যদি এমনভাবে ওই শব্দ শ্রবণের চেষ্টা করেন যাতে আপনার মন সম্পূর্ণভাবে এই শব্দে নিবিষ্ট থাকে। এই হরেকৃষ্ণ শব্দতরঙ্গ শ্রীকৃষ্ণ থেকে অভিন্ন, কেননা শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন পরম তত্ত্ব। 

 

যেহেতু, ভগবান হচ্ছেন পরম সেজন্য ভগবান স্বয়ং এবং ভগবানের নামের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। এই জড়জগতে প্রকৃত জল এবং জল শব্দটির পার্থক্য রয়েছে, একটি ফুল এবং ফুল শব্দের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। কিন্তু চিন্ময় জগতে, পরম জগতে এরকম কোন পার্থক্য নেই। সেজন্য, যখনই আপনি হরেকৃষ্ণ হরেকৃষ্ণ ধ্বনিত করেন, আপনি তৎক্ষণাৎ পরমেশ্বর ভগবানের এবং তাঁর শক্তির সঙ্গ করেন।


হরে শব্দটি পরমেশ্বর ভগবানের শক্তিকে নির্দেশ করছে। সবকিছুই পরমেশ্বর ভগবানের শক্তির দ্বারা সম্পাদিত হয়। পরস্য ব্রহ্মণঃ শক্তিঃ এই গ্রহগুলো যেমন সূর্যের শক্তির একটি সৃষ্টি, তেমনই সমস্ত জড় ও চিন্ময় জগত প্রকাশ পরমেশ্বর ভগবানের শক্তির সৃষ্টি। 

 

অতএব, আমরা যখন হরেকৃষ্ণ কীর্তন করি, আমরা তখন পরমেশ্বর ভগবান স্বয়ং এবং পরমেশ্বর ভগবানের শক্তির নিকট প্রার্থনা করছি “কৃপা করে আমাকে উদ্ধার করুন।  আমি দেহ চেতনায় আবিষ্ট। আমি জড় জগতের জড় অস্তিত্বে বদ্ধ হয়ে পড়েছি। আমি দুর্দশা ভোগ করছি । আমাকে কৃপা করে চিন্ময় স্তরে উন্নীত করুন যাতে আমি প্রসন্ন হতে পারি, সুখী হতে পারি।” 

 

আপনাকে আপনার বর্তমান অবস্থার কোন পরিবর্তন করতে হবে না। আপনি যদি একজন ছাত্র হন, তাহলে ছাত্রই থাকুন। আপনি যদি ব্যবসায়ী হন, তাহলে ব্যবসায়ী থাকুন স্ত্রী, পুরুষ, কৃষ্ণাঙ্গ, শ্বেতাঙ্গ--যে কেউ হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করতে পারে। 

 

এটি একটি সরল পন্থা, এবং এরজন্য কোন অর্থ ব্যয় করতে হয় না। আমরা বলছি না, "আমাদের এক ডলার দিন, তাহলে আমরা আপনাকে হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র দেব। না, আমরা এটি প্রকাশ্যে বিতরণ করছি। আপনাকে কেবল এটি গ্রহণ করতে হবে, এবং পরে অভ্যাস করতে হবে। 

 

আপনি অতি দ্রুত চিন্ময় স্তরে উন্নীত হবেন। আপনি যখন কীর্তন শ্রবণ করেন, সেটি একটি অপ্রাকৃত ধ্যান । সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রে এই পন্থাটি উপদিষ্ট হয়েছে, শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু এই পন্থায় শিক্ষা দিয়েছেন এবং তাঁর অনুগামীগণ শিষ্য পরম্পরাক্রমে গত পাঁচশ বছর এটি অনুসরণ করছেন, এবং আজও মানুষ এর সফলতা লাভ করছেন, কেবল ভারতে নয়, এখানেও।

 

আপনারা যদি এই কৃষ্ণভাবনামৃত আন্দোলন উপলব্ধি করার চেষ্টা করেন, আপনারা তাহলে বুঝতে পারবেন যে, এখনও ধ্যানানুশীলন সম্ভব। আমরা ভাবপ্রবণ, ভাববাদী নই; আমাদের অনেক গ্রন্থ রয়েছে : শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ, শ্রীমদ্ভাগবত, চৈতন্য মহাপ্রভুর শিক্ষা, ঈশোপনিষদ ।

 

 আর আমাদের নিজস্ব পত্রিকা রয়েছে, ভগবৎ-দর্শন। এমন নয় যে, আমরা ভাবপ্রবণ আমাদের উচ্চ দার্শনিক তত্ত্বের সমর্থন রয়েছে। কিন্তু এই সমস্ত দার্শনিক শাস্ত্রগ্রন্থ পাঠ না করেও আপনারা যদি এই সরল পন্থাটি গ্রহণ করেন--এই মহামন্ত্র হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে/ হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে কীর্তন--তাহলে আপনারা তৎক্ষণাৎ অপ্রাকৃত, চিন্ময় স্তরে উন্নীত হবেন। 

 

এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র বর্তমান যুগের বদ্ধজীবের জন্য শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর অনবদ্য উপহার, বৈদিক শাস্ত্রের অনুমোদন অনুসারে । সুতরাং, আমাদের অনুরোধ হচ্ছে, আপনারা এটি একবার চেষ্টা করে দেখুন, কেবল কীর্তন করুন, বাড়িতে বা যেকোন জায়গায়। 

 

কোন বিধি-নিষেধ নেই “এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র এইরকম স্থান, এইরকম এইরকম পরিস্থিতিতে জপ করতে হবে"--এমন কোন বিধিনিয়ম নেই। নিয়মিতঃ স্মরণে ন কালঃ। স্থান, কাল পরিবেশের কোন সীমাবদ্ধতা নেই। যেকোন জায়গায় যেকোন সময়ে আপনি এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ কীর্তনের দ্বারা ধ্যান করতে পারেন। 

 

আপনি যখন জনাকীর্ণ রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন তখন অন্যকোন ধ্যানপন্থা অভ্যাস করা সম্ভব নয়, কিন্তু এই ধ্যান সম্ভব । আপনি আপনার হাত দিয়ে কাজ করছেন? তবুও আপনি হরেকৃষ্ণ জপ করতে পারেন । এটি এতই অপূর্ব


কৃষ্ণ হচ্ছে ভগবানের একটি পূর্ণ নাম। সংস্কৃত শব্দ কৃষ্ণ অর্থ হচ্ছে “সর্বাকর্ষক" । এবং রাম শব্দের অর্থ হচ্ছে “পরম আনন্দ"। অতএব, ভগবান যদি সর্বাকর্ষক না হন এবং পরম দিব্যানন্দে পূর্ণ না হন, তাহলে ভগবানের অর্থ কি? ভগবান অবশ্যই পরম আনন্দের উৎস হবেন; তা নাহলে আপনি কিভাবে ভগবানের সান্নিধ্যে সুখী হবেন, প্রসন্ন হবেন? 

 

আরও পড়ুন 

 

* হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র নামের মাহাত্ম্য ও প্রকৃত অর্থ কি?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন