মহাভারত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ: ধর্ম ও অধর্মের চূড়ান্ত লড়াইয়ের ইতিহাস।

 

মহাভারত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ ধর্ম ও অধর্মের চূড়ান্ত লড়াইয়ের ইতিহাস।

ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীনতম এবং সবচেয়ে মহাকাব্যিক গ্রন্থের একটি হলো মহাভারত। এই মহাকাব্য শুধু একটি যুদ্ধের বিবরণ নয়, বরং ধর্ম, ন্যায়নীতি, মানবিকতা এবং আধ্যাত্মিক দর্শনের এক অনন্য সংকলন। মহাভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও নাটকীয় অধ্যায় হলো কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ। এটি শুধু একটি রাজ্য জয়ের লড়াই নয়, এটি ছিল ধর্ম ও অধর্মের চূড়ান্ত মুখোমুখি লড়াই। এই ব্লগ পোস্টে আমরা কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের কারণ, ঘটনা, প্রধান চরিত্র, শিক্ষা এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ নিয়ে বিশদ আলোচনা করব।

 

মহাভারতের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি

মহাভারত একটি বিশাল আকারের মহাকাব্য যা প্রায় এক লক্ষ শ্লোক নিয়ে রচিত। এর রচয়িতা মহর্ষি বেদব্যাস। এই মহাকাব্য মূলত কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যে সংঘটিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। তবে এর সাথে জড়িয়ে আছে নৈতিক শিক্ষা, ধর্মীয় আদর্শ, রাজনীতি এবং মানব চরিত্রের সুক্ষ্ম বিশ্লেষণ।

 

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মূল কারণ

কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের মূল কারণ ছিল রাজ্যাধিকার এবং প্রতিহিংসা। হস্তিনাপুরের রাজা পাণ্ডু ও ধৃতরাষ্ট্র দুই ভাই। পাণ্ডুর মৃত্যুর পর তাঁর পাঁচ পুত্র — যুধিষ্ঠির, ভীম, অর্জুন, সহদেব ও নকুল বড় হতে থাকে। অপরদিকে, ধৃতরাষ্ট্রের একশো পুত্র অর্থাৎ কৌরবদের প্রধান ছিল দুর্যোধন।


যখন পাণ্ডবরা রাজ্য চায়, তখন দুর্যোধন ও তাঁর কাকা শকুনি চক্রান্ত করে তাদের বনবাসে পাঠায়। বনবাস শেষে যখন পাণ্ডবরা তাদের অধিকার দাবি করে, তখন কৌরবরা তা অস্বীকার করে। এর ফলে ধর্মের পক্ষে পাণ্ডব এবং অধর্মের পক্ষে কৌরব — এই দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে ওঠে।


  কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের প্রধান চরিত্র

১. শ্রীকৃষ্ণ: যিনি এই মহাযুদ্ধের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। তিনি ছিলেন অর্জুনের রথচালক ও উপদেষ্টা। যুদ্ধে নিজে অংশগ্রহণ না করে, তিনি কৌশলে ধর্মপক্ষে পাণ্ডবদের জয় নিশ্চিত করেন।


২. অর্জুন: যুদ্ধে পাণ্ডবদের প্রধান যোদ্ধা। তার হাতে শ্রীকৃষ্ণ গীতা উপদেশ দেন।
৩. ভীম: পাণ্ডবদের শক্তিশালী ভাই, যিনি বহু কৌরবকে যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজিত করেন।
৪. যুধিষ্ঠির: ধর্মপুত্র, পাণ্ডবদের জ্যেষ্ঠ ভাই এবং ন্যায়ের প্রতীক।
৫. দুর্যোধন: কৌরবপক্ষের প্রধান, অহংকার ও অধর্মের প্রতিচ্ছবি।
৬. কর্ণ: কৌরবপক্ষের প্রধান বীর, যিনি নিজের দানশীলতা ও বীরত্বের জন্য পরিচিত।
৭. দ্রৌপদী: পাণ্ডবদের স্ত্রী এবং এই যুদ্ধের একটি প্রধান কারণ।

যুদ্ধ শুরুর প্রেক্ষাপট

যুদ্ধের আগে শ্রীকৃষ্ণ দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধির প্রচেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু দুর্যোধন তা প্রত্যাখ্যান করে। যুদ্ধে দুই পক্ষই বিশাল সৈন্যবাহিনী, রথী, মহারথী ও অশ্বারোহী নিয়ে প্রস্তুত হয়। এই যুদ্ধ হস্তিনাপুরের কুরুক্ষেত্র ময়দানে সংঘটিত হয়।


কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ১৮ দিনের বিবরণ

এই যুদ্ধ ১৮ দিন স্থায়ী হয়েছিল। প্রতিদিনই যুদ্ধের কৌশল পাল্টেছে এবং দুই পক্ষেই বহু বীরযোদ্ধা প্রাণ হারিয়েছেন। অর্জুন, ভীম, দ্রোণ, কর্ণ, অভিমন্যু, গটোটকচ, দ্রুপদ, শল্য, অশ্বত্থামা, শকুনি প্রমুখের যুদ্ধ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।


শ্রীকৃষ্ণের গীতা উপদেশ

যুদ্ধ শুরুর আগে অর্জুন আত্মীয়স্বজন ও গুরুর বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করতে দ্বিধা বোধ করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা উপদেশ দেন। এই গীতা মানবজীবনের আদর্শ, ধর্ম, কর্ম এবং আধ্যাত্মিকতার এক অনন্য দর্শন।


যুদ্ধের ফলাফল

১৮ দিনের যুদ্ধে কৌরবপক্ষের সকল প্রধান বীর এবং সৈন্য নিহত হয়। দুর্যোধন ভীমের হাতে নিহত হন। পাণ্ডবরা বিজয়ী হন এবং যুধিষ্ঠির হস্তিনাপুরের রাজ সিংহাসনে বসেন।

ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষা

এই যুদ্ধের মাধ্যমে শ্রীকৃষ্ণ দেখিয়েছেন — অধর্ম যত শক্তিশালী হোক, শেষ পর্যন্ত ধর্মের জয়ই অনিবার্য। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ বলেন:


"যদা যদা হি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত। অভ্যুৎথানমধর্মস্য তদাত্মানং সৃজাম্যহম্॥"
অর্থাৎ, যখনই ধর্মের অবক্ষয় এবং অধর্মের অভ্যুত্থান হয়, তখনই আমি নিজেকে আবির্ভূত করি।


কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের আধুনিক প্রাসঙ্গিকতা

আজকের সমাজেও সত্য-মিথ্যা, ন্যায়-অন্যায়, ধর্ম-অধর্মের সংঘর্ষ চলছে। এই মহাভারতের কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ আমাদের শেখায় — জীবনের যেকোনো সংকটে ধর্ম, ন্যায় এবং মানবিক মূল্যবোধ রক্ষা করা উচিত।

 

উপসংহার

মহাভারত কেবল একটি যুদ্ধকাহিনি নয়, এটি নৈতিকতা, ধর্ম, আদর্শ এবং জীবনদর্শনের এক অপূর্ব দিশারি। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের ইতিহাস এবং শিক্ষাগুলো আজও মানবসমাজের জন্য পথপ্রদর্শক। সত্য ও ধর্মের পক্ষে দাঁড়িয়ে জীবন সংগ্রামে জয়ী হবার অনুপ্রেরণা দেয় এই মহাকাব্য।


আরও পড়ুনঃ

* মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী ও শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ 

* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন

 

👇আপনি আমাদের তথ্যগুলি আরও যেসব মাধ্যমে পাবেন।👇

👉Facebook পেজ ফলো করে রাখুন – এখানে ক্লিক করুন।

👉X (twitter) পেজ ফলো করে রাখুন – এখানে ক্লিক করুন।




Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url