কীভাবে ভগবানকে জানা যায়?

 
কীভাবে ভগবানকে জানা যায়

বৈদিক প্রথায় গুরু-শিষ্য পরম্পরা

বৈদিক প্রথায় পারমার্থিক দীক্ষাগুরুগণ সর্বদা প্রামাণিক পূর্বতন আচার্যবর্গের কাছ থেকে জ্ঞান পরিবেশন করেন। তাঁরা কখনোই ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে উপদেশ দেন না। কারণ ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা ইন্দ্রিয়নির্ভর এবং সীমিত।

প্রত্যক্ষ জ্ঞান বনাম শ্রুতি

যে জ্ঞান আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা বা ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অর্জন করি, তাকে বলা হয় প্রত্যক্ষ জ্ঞান। কিন্তু বৈদিক পদ্ধতিতে জ্ঞান আহরণ সম্পূর্ণ ভিন্ন। এখানে জ্ঞান লাভের পদ্ধতিকে বলা হয় শ্রুতি—অর্থাৎ প্রমাণ্য সূত্র থেকে শ্রবণের মাধ্যমে জ্ঞান সংগ্রহ।

অসম্পূর্ণ ইন্দ্রিয়ের সীমাবদ্ধতা

আমাদের ইন্দ্রিয়সমূহ সীমিত ও অসম্পূর্ণ। তাই পরীক্ষামূলক প্রচেষ্টায় পরম সত্যকে জানা সম্ভব নয়।   

যেমন—কে আপনার প্রকৃত পিতা, তা পরীক্ষার মাধ্যমে নয়, বরং আপনার মা-ই নিশ্চিতভাবে বলতে পারেন। যদি জড় পিতাকেই পরীক্ষার মাধ্যমে জানা সম্ভব না হয়, তবে পরম পিতা শ্রীকৃষ্ণকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা দিয়ে কীভাবে জানা সম্ভব?

আধুনিক ভ্রান্ত ধারণা

অনেকে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর ভগবানকে পরীক্ষামূলক পদ্ধতিতে না পেয়ে বলেন—“ভগবান নেই” অথবা “আমিই ভগবান”। কিন্তু ঈশোপনিষদে বলা আছে—ভগবানকে জানতে চাইলে তাঁকে শ্রুতির মাধ্যমে উপলব্ধি করতে হবে, পরীক্ষামূলক প্রক্রিয়ায় নয়।

কাদের কাছে শ্রবণ করতে হবে

তাহলে প্রশ্ন আসে—শ্রবণ করবেন কার কাছ থেকে? উত্তর হলো—ধীর ব্যক্তিদের কাছ থেকে, যারা ইন্দ্রিয়বেগ দমন করতে সক্ষম। ধীর মানে সেই ব্যক্তি যিনি ক্রোধ, জিহ্বার লালসা বা কামপ্রবৃত্তির মতো উত্তেজনায় সহজে প্রভাবিত হন না।

জিহ্বা ও ইন্দ্রিয়সংযম

আমরা জিহ্বার সুখের জন্য পশুহত্যা করি, অথচ শ্রীকৃষ্ণ আমাদের জন্য শস্য, ফল, শাকসবজি ও দুধের মতো বিশুদ্ধ খাদ্য দিয়েছেন। গাভীর অতিরিক্ত দুধ মানুষের জন্যই ভগবানের দান। কিন্তু আমরা সেটিকে অবহেলা করে কসাইখানা চালাই।
সংযমী ধীর ব্যক্তিরা এসব ইন্দ্রিয়বেগ জয় করে ভক্তি ও তত্ত্ব প্রচার করেন। তাদের কাছ থেকেই আমাদের জ্ঞান শ্রবণ করা উচিত।

ধীর ব্যক্তির উদাহরণ

দেবাদিদেব শিব কিংবা শ্রীকৃষ্ণ নিজেই প্রকৃত ধীর ব্যক্তিত্ব। বহু গোপীদের সঙ্গে নৃত্য করলেও শ্রীকৃষ্ণ কখনো লালসাপরায়ণ হননি। এ কারণেই বলা হয়—সংযমী গুরু ও আচার্যের কাছ থেকে জ্ঞান গ্রহণ করতে হবে। অসংযমীদের কাছ থেকে শোনা সবই ব্যর্থ।

উপনিষদ ও বৈদিক জ্ঞান

ঈশোপনিষদে উল্লেখ আছে—গুরু কেবল সেই জ্ঞানই শিষ্যকে দেন, যা তিনি প্রমাণ্য সূত্র থেকে শ্রবণ করেছেন। এজন্য আলাদা গবেষণা করার প্রয়োজন হয় না।
বেদশাস্ত্রকে বলা হয় শ্রুতি—অর্থাৎ, শোনা জ্ঞান। এটি মানুষের সীমিত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা উদ্ভাবিত নয়, বরং পরম্পরাগতভাবে প্রাপ্ত শাশ্বত সত্য।

ভ্রান্ত ভাষ্যকারদের প্রতারণা

আজকাল অনেকে ভগবদ্গীতা না বুঝে নিজের মতে ভাষ্য লিখে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে। অথচ শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট বলেছেন—শুধু তাঁর ভক্তরাই গীতার মর্ম বুঝতে সক্ষম। তাই এ ধরনের পণ্ডিতদের থেকে দূরে থাকা উচিত।

উপসংহার

অতএব, যথার্থ পারমার্থিক জ্ঞান অর্জনের জন্য একজন সত্যিকারের সদগুরুর শরণাপন্ন হওয়া অপরিহার্য। শুধুমাত্র ধীর, সংযমী ও ভক্ত আচার্যের কাছ থেকে শ্রুতি-প্রমাণের ভিত্তিতে জ্ঞান আহরণ করলেই আমরা শ্রীকৃষ্ণের নিকটবর্তী হতে পারি। আর সেটিই বৈদিক জ্ঞান অর্জনের সঠিক পথ।

 আরও পড়ুন 

* হরিনামই কলি যুগের একমাত্র উদ্ধার পথ 

* সকল ভয় থেকে পরিত্রাণের উপায় 


Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url