গীতা-২য় অধ্যায়-সাংখ্য-যোগ- Srimad bhagavad gita in bengali-Capter-2

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ

 অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ
(মূল সংস্কৃত শ্লোক ও অনুবাদ)

 


দ্বিতীয় অধ্যায়- সাংখ্য-যোগ (Bangla Gita)

সঞ্জয় উবাচ
তং তথা কৃপয়াবিষ্টমশ্রুপূর্ণাকুলেক্ষণম্।
বিষীদন্তমিদং বাক্যমুবাচ মধুসূদনঃ।।১।।
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন-অর্জুনকে এভাবে অনুতপ্ত, ব্যাকুল ও অশ্রুসিক্ত দেখে, কৃপায় আবিষ্ট হয়ে মধুসূদন বা শ্রীকৃষ্ণ এই কথাগুলি বললেন। 

শ্রীভগবানুবাচ
কুতস্ত্বা কশ্মলমিদং বিষমে সমুপস্থিতম্। 
অনার্যজুষ্টমস্বর্গ্যমকীর্তিকরমর্জুন।।২।। 
অনুবাদঃ পুরুষোত্তম শ্রীভগবান বললেন-প্রিয় অর্জুন, এই ঘোর সঙ্কটময় যুদ্ধস্থলে যারা জীবনের প্রকুত মূল্য বোঝে না, সেই সব অনার্যের মতো শোকানল তোমার হৃদয়ে কিভাবে প্রজ্বলিত হল? এই ধরনের মনোভাব তোমাকে স্বর্গলোকে উন্নীত করবে না, পক্ষান্তরে তোমার সমস্ত যশরাশি বিনষ্ট করবে। 

ক্লৈব্যং মা স্ম গমঃ পার্থ নৈতত্ত্বয্যুপপদ্যতে। 
ক্ষুদ্রং হৃদয়দৌর্বল্যং ত্যক্তোত্তিষ্ঠ পরন্তপ।।৩।। 
অনুবাদঃ হে পার্থ! এই সম্মান হানিকর। ক্লীবত্বের বশবর্তী হয়ো না। এই ধরনের আচরণ তোমার পক্ষে অনুচিত।  হে পরন্তপ!হৃদয়ের এই ক্ষুদ্র দুর্বলতা পরিত্যাগ করে তুমি উঠে দাঁড়াও। 

কথং ভীষ্মমহং সংখ্যে দ্রোণং চ মধুসূদন। 
ইষুভিঃ প্রতিযোৎস্যামি পূজার্হাবরিসূদন।।৪।।
অনুবাদঃ অর্জুন বললেন-হে অরিসূদন! হে মধুসূদন! এই যুদ্ধক্ষেত্রে ভীষ্ম ও দ্রোণের মতো পরম পূজনীয় ব্যক্তিদের কেমন করে আমি বাণের দ্বারা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করব?

 গুরুনহত্বা হি মহানুভাবান্ 
শ্রেয়ো ভোক্তুং ভৈক্ষ্যমপীহ লোকে। 
হত্বার্থকামাংস্তু গুরুনিহৈব 
ভুঞ্জীয় ভোগান্ রুধিরপ্রদিগ্ধান্।।৫।। 
অনুবাদঃ আমার মহানুভক শিক্ষাগুরুদের জীবন হানি করে এই জগৎ ভোগ করার থেকে বরং ভিক্ষা করে জীবন  ধারণ করা ভাল। তাঁরা পার্থিব বস্তুর অভিলাষী হলেও আমার গুরুজন। তাঁদের হত্যা করা হলে, যুদ্ধলব্ধ সমস্ত ভোগ্যবস্তু তাঁদের রক্তমাখা হবে। 
 
 
ন চৈতদ্ বিদ্মঃ কতরন্নো গরীয়ো 
যদ্ বা জয়েম যদি বা নো জয়েয়ুঃ। 
যানেব হত্বা ন জিজীবিষামস্
তেহবস্থিতাঃ প্রমুখে ধার্তরাষ্ট্রাঃ।।৬।।
অনুবাদঃ তাদের জয় করা শ্রেয়, না তাদের দ্বারা পরাজিত হওয়া শ্রেয়, তা আমি বুঝতে পারছি না। আমরা যদি ধৃতরাষ্ট্রের পুত্রদের হত্যা করি, তা হলে আমাদের আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করবে না। তবুও এই রণাঙ্গনে তারা  আমাদের সামনে উপস্থিত হয়েছে। 

কার্পণ্যদোষোপহতস্বভাবঃ
পৃচ্ছামি ত্বাং ধর্মসম্মুঢ়চেতাঃ। 
যচ্ছ্রেয়ঃ স্যান্নিশ্চিতং ব্রুহি তন্মে 
শিষ্যস্তেহহং শাধি মাং ত্বাং প্রপন্নম্।।৭।। 
অনুবাদঃ কার্পণ্যজনিত দুর্বলতার প্রভাবে আমি এখন কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়েছি এবং আমার কর্তব্য সম্বন্ধে বিভ্রান্ত হয়েছি। এই অবস্থায় আমি তোমাকে জিজ্ঞাসা করছি, এখন কি করা আমার পক্ষে শ্রেয়স্কর, তা আমাকে বল।এখন আমি তোমার শিষ্য এবং সর্বতোভাবে তোমার শরণাগত। দয়া করে তুমি আমাকে নির্দেশ দাও। 

ন হি প্রপশ্যামি মমাপনুদ্যাদ্ 
যচ্ছোকমুচ্ছোষণমিন্দ্রিয়াণাম্।
অবাপ্য ভুমাবসপত্নমৃদ্ধং 
রাজ্যং সুরাণামপি চাধিপত্যম্।।৮।। 
অনুবাদঃ আমার ইন্দ্রিয়গুলিকে শুকিয়ে দিচ্ছে যে শোক, তা দূর করবার কোন উপায় আমি খুঁজে পাচ্ছি না। এমন কি স্বর্গের দেবতাদের মতো আধিপত্য নিয়ে সমৃদ্ধশালী, প্রতিদ্ধন্দ্বিতাবিহীন রাজ্য এই পৃথিবীতে লাভ করলেও আমার  এই শোকের বিনাশ হবে না। 

এবমুক্ত্বা হৃষীকেশং গুড়াকেশঃ পরন্তপ। 
ন যোৎস্য ইতি গোবিন্দমুক্ত্বা তুষ্ণীং বভূব হ।।৯।। 
অনুবাদঃ সঞ্জয় বললেন-এভাবে মনোভাব ব্যক্ত করে গুড়াকেশ অর্জুন তখন হৃষীকেশকে বললেন, “হে গোবিন্দ!  আমি যুদ্ধ করব না”, এই বলে তিনি মৌন হলেন। 

তমুবাচ হৃষীকেশঃ প্রহসন্নিব ভারত। 
সেনয়োরুভয়োর্মধ্যে বিষীদন্তমিদং বচঃ।।১০।। 
অনুবাদঃ হে ভরতবংশীয় ধৃতরাষ্ট্র! সেই সময় স্মিত হেসে, শ্রীকৃষ্ণ উভয় পক্ষের সৈন্যদের মাঝখানে বিষাদগ্রস্থ অর্জুনকে এই কথা বললেন। 

শ্রীভগবানুবাচ
অশোচ্যানন্বশোচস্ত্বং প্রজ্ঞাবাদাংশ্চ ভাষসে।
গতাসূনগতাসূংশ্চ নানুশোচন্তি পন্ডিতাঃ।।১১।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-তুমি প্রাজ্ঞের মতো কথা বলছ, অথচ যে বিষয়ে শোক করা উচিত নয়, সেই বিষয়ে শোক করছ। যাঁরা যথার্থই পন্ডিত তাঁরা কখনও জীবিত অথবা মৃত কারও জন্যই শোক করেন না। 

ন ত্বেবাহং জাতু নাসং ন ত্বং নেমে জনাধিপাঃ। 
ন চৈব ন ভবিষ্যামঃ সর্বে বয়মতঃপরম্।।১২।। 
অনুুবাদঃ এমন কোন সময় ছিল না যখন আমি, তুমি ও এই সমস্ত রাজারা ছিলেন না এবং ভবিষ্যতেও কখনও আমাদের অস্তিত্ব বিনষ্ট হবে না।

দেহিনোহস্মিন্ যথা দেহে কৌমারং যৌবনং জরা। 
তথা দেহান্তরপ্রাপ্তিধীরস্তত্র ন মুহ্যতি।।১৩।।
অনুবাদঃ দেহীর দেহ যেভাবে কৌমার, যৌবন ও জরার মাধ্যমে তার রূপ পরিবর্তন করে চলে, মৃত্যুকালে তেমনই ঐ দেহী (আত্মা) এক দেহ থেকে অন্য কোন দেহে দেহান্তরিত হয়। স্থিতপ্রজ্ঞ পন্ডিতেরা কখনও এই পরিবর্তনে মুহ্যমান হন না। 

আরও পড়ুনঃ ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সকল লীলা কাহিনী-শ্রীমদ্ভাগবত 
 
মাত্রাস্পর্শাস্তু কৌন্তেয় শীতোষ্ণসুখদুঃখদাঃ।
আগমাপায়িনোহনিত্যাস্তংস্তিতিক্ষস্ব ভারত।।১৪।।
অনুবাদঃ হে কৌন্তেয়! ইন্দ্রিয়ের সঙ্গে বিষয়ের সংযোগের ফলে অনিত্য সুখ ও দুঃখের অনুভব হয়। সেগুলি ঠিক যেন শীত ও গ্রীষ্ম ঋতুর গমনাগমনের মতো। হে ভরতকুল-প্রদীপ!সেই ইন্দ্রিয়জাত অনুভুতির দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে সেগুলি সহ্য করার চেষ্টা কর। 

যং হি ন ব্যথয়ন্ত্যেতে পুরুষং পুরুষর্ষভ। 
সমদুঃখসুখং ধীরং সোহমৃতত্বায় কল্পতে।।১৫।। 
অনুবাদঃ হে পুরুষশ্রেষ্ঠ (অর্জুন)! যে জ্ঞানী ব্যক্তি সুখ ও দুঃখকে সমান জ্ঞান করেন এবং শীত ও উষ্ণ আদি দ্বন্দ্বে বিচলিত হন না, তিনিই মুক্তি লাভের প্রকৃত অধিকারী। 

নাসতো বিদ্যতে ভাবো নাভাবো বিত্যতে সতঃ
উভয়োরপি দৃষ্টোহস্ত্বনয়োস্তত্ত্বদর্শিভিঃ।।১৬।।
অনুবাদঃ যাঁরা তত্ত্বদ্রষ্ট্রা তাঁরা সিদ্ধান্ত করেছেন যে অনিত্য জড় বস্তুর স্থায়িত্ব নেই এবং নিত্য বস্তু আত্মার কখনও বিনাশ হয় না। তাঁরা উভয় প্রকৃতির যথার্থ স্বরূপ উপলব্ধি করে এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। 


 অবিনাশি তু তদ্বিদ্ধি যেন সর্বমিদং ততম্। 
বিনাশশমব্যয়স্যাস্য ন কশ্চিৎ কর্তুমর্হতি।।১৭।।
অনুবাদঃ যা সমগ্র শরীরে পরিব্যাপ্ত হয়ে রয়েছে, তাকে তুমি অবিনাশী বলে জানবে। সেই অব্যয় আত্মাকে কেউ বিনাশ করতে সক্ষম নয়। 



      অন্তবন্ত ইমে দেহা নিত্যস্যোক্তাঃ শরীরিণঃ
অনাশিনোহপ্রমেয়স্য তস্মাদ্ যুধ্যস্ব ভারত।।১৮।। 
অনুবাদঃ অবিনাশী, অপরিমেয় ও শাশ্বত আত্মার জড় দেহ নিঃসন্দেহে বিনাশশীল। অতএব হে ভারত! তুমি শাস্ত্রবিহিত স্বধর্ম পরিত্যাগ না করে যুদ্ধ কর। 

য এনং বেত্তি হন্তারং যশ্চৈনং মন্যতে হতম্।
উভৌ তৌ ন বিজানীতো নায়ং হন্তি ন হন্যতে।।১৯।। 
অনুবাদঃ যিনি জীবাত্মাকে হন্তা বলে মনে করেন কিংবা ‍যিনি একে নিহত বলে ভাবেন, তাঁরা উভয়েই আত্মার প্রকৃত স্বরূপ জানেন না। কারণ আত্মা কাউকে হত্যা করেন না এবং কারও দ্বারা নিহতও হন না। 
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্ 
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।২০।।
অনুবাদঃ আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। তিনি জন্মরহিতশাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না। 

 বেদাবিনাশিনং নিত্যং য এনমজমব্যয়ম্। 
কথং স পুরুষঃ পার্থ কং ঘাতয়তি হস্তি কম্।।২১।। 
অনুবাদঃ হে পার্থ! যিনি এই আত্মাকে অবিনাশী, শাশ্বত, জন্মরহিত ও অক্ষয় বলে জানেন, তিনি কিভাবে কাউকে  হত্যা করতে বা হত্যা করাতে পারেন? 


বাসাংসি জীর্ণানি যথা বিহায়
নবানি গৃহ্নাতি নরোহপরাণি। 
তথা শরীরাণি বিহায় জীর্ণান্য-
ন্যানি সংযাতি নবানি দেহী।।২২।। 
অনুবাদঃ মানুষ যেমন জীর্ণ বস্ত্র পরিত্যাগ করে নতুন বস্ত্র পরিধান করে, দেহীও তেমনই জীর্ণ শরীর ত্যাগ  করে নতুন দেহ ধারণ করেন। 


নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ । 
ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।২৩।।
অনুবাদঃ আত্মাকে অস্ত্রের দ্বারা কাটা যায় না, আগুনে পোড়ানো যায় না, জলে ভেজানো যায় না, অথবা  হাওয়াতে শুকানো যায় না। 


অচ্ছেদ্যোহয়মদাহ্যোহয়মক্লেদ্যোহশোয্য এব চ। 
নিত্যঃ সর্কগতঃ স্থাণুরচলোহয়ং সনাতনঃ।।২৪।।
অনুবাদঃ এই আত্মা অচ্ছেদ্য, অদাহ্য, অক্লেদ্য ও অশোয্য। তিনি চিরস্থায়ী, সর্বব্যাপ্ত, অপরিবর্তনীয়, অচল ও সনাতন। 


অব্যক্তোহয়মচিন্ত্যোহয়মবিকার্যোহয়মুচ্যতে। 
তস্মাদেবং বিদিত্বৈনং নানুশোচিতুমর্হসি।।২৫।। 
অনুবাদঃ এই আত্মা অব্যক্ত, অচিন্ত্য ও অবিকারী বলে শাস্ত্রে উক্ত হয়েছে। অতএব এই সনাতন স্বরূপ অবগত হয়ে  দেহের জন্য তোমার শোক করা উচিত নয়। 


অথ চৈনং নিত্যজাতং নিত্যং বা মন্যসে মৃতম্।
তথাপি ত্বং মহাবাহো নৈনং শোচিতুমর্হসি।।২৬।।
অনুবাদঃ হে মহাবাহো! আর যদি তুমি মনে কর যে, আত্মার বারবার জন্ম হয় এবং মৃত্যু হয়, তা হলেও  তোমার শোক করার কোন কারণ নেই।


জাতস্য হি ধ্রুবো মৃত্যুর্ধ্রুবং জন্ম মৃতস্য চ। 
তস্মাদপরিহার্যেহর্থে ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।২৭।। 
অনুবাদঃ যার জন্ম হয়েছে তার মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী এবং যার মৃত্যু হয়েছে তার জন্মও অবশ্যম্ভাবী। অতেএব অপরিহার্য কর্তব্য সম্পাদন করার সময় তোমার শোক করা উচিত নয়। 


অব্যক্তাদীনি ভুতানি ব্যক্তমধ্যানি ভারত। 
অব্যক্তনিধনান্যেব তত্র কা পরিদেবনা।।২৮।।
অনুবাদঃ হে ভারত! সমস্ত সৃষ্ট জীব উৎপন্ন হওয়ার আগে অপ্রকাশিত ছিল, তাদের স্থিতিকালে প্রকাশিত থাকে এবং বিনাশের পর আবার অপ্রকাশিত হয়ে যায়। সুতরাং, সেই জন্য শোক করার কি কারণ? 

আশ্চর্যবৎ পশ্যতি কশ্চিদেনম্
আশ্চর্যবদ্ বদতি তথৈব চান্যঃ। 
আশ্চার্যবচ্চৈনমন্যঃ শৃণোতি 
শ্রুত্বাপ্যেনং বেদ ন চৈব কশ্চিৎ।।২৯।।
অনুবাদঃ কেউ এই আত্মাকে আশ্চর্যবৎ দর্শন করেন, কেউ আশ্চর্যভাবে বর্ণনা করেন এবং কেউ আশ্চর্য জ্ঞানে শ্রবণ করেন, আর কেউ শুনেও তাকে বুঝতে পারেন না। 

দেহী নিত্যমবধ্যোহয়ং দেহে সর্বস্য ভারত। 
তস্মাৎ সর্বাণি ভূতানি ন ত্বং শোচিতুমর্হসি।।৩০।। 
অনুবাদঃ হে ভারত! প্রাণীদের দেহে অবস্থিত আত্মা সর্বদাই অবধ্য। অতএব কোন জীবের জন্য তোমার শোক  করা উচিত নয়। 

স্বধর্মমপি চাবেক্ষ্য ন বিকম্পিতুমর্হসি। 
ধর্ম্যাদ্ধি যুদ্ধাচ্ছ্রেয়োহন্যৎ ক্ষত্রিয়স্য ন বিদ্যতে।।৩১।।
অনুবাদঃ ক্ষত্রিয়রূপে তোমার স্বধর্ম বিবেচনা করে তোমার জানা উচিত যে, ধর্ম রক্ষার্থে যুদ্ধ করার থেকে ক্ষত্রিয়ের  পক্ষে মঙ্গলকর আর কিছুই নেই। তাই, তোমার দ্বিধাগ্রস্থ হওয়া উচিত নয়। 

যদৃচ্ছয়া চোপপন্নং স্বর্গদ্বারমপাবৃতম্। 
সুখিনঃ ক্ষত্রিয়াঃ পার্থ লভন্তে যুদ্ধমীদৃশম্।।৩২।। 
অনুবাদঃ হে পার্থ! স্বর্গদ্বার উন্মোচনকারী এই প্রকার ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার সুযোগ না চাইতেই যে সব ক্ষত্রিয়ের কাছে আসে, তাঁরা সুখী হন। 

অথ চেত্ত্বমিমং ধর্ম্যাং সংগ্রামং ন করিষ্যসি। 
ততঃ স্বধর্মং কীর্তিং চ হিত্বা পাপমবাস্প্যসি।।৩৩।।
অনুবাদঃ কিন্তু, তুমি যদি এই ধর্মযুদ্ধ না কর, তা হলে তোমার স্বীয় ধর্ম এবং কীর্তি ভ্রষ্ট হয়ে পাপ ভোগ করবে। 

অকীর্তিং চাপি ভূতানি কথয়িষ্যন্তি তেহব্যয়াম্।
সম্ভাবিতস্য চাকীর্তিমরণাদতিরিচ্যতে।।৩৪।।
অনুবাদঃ সমস্ত লোক তোমার কীর্তিহীনতার কথা বলবে এবং যে-কোন মর্যাদাবান লোকের পক্ষেই এই অসম্মান  মৃত্যু অপেক্ষাও অধিকতর মন্দ। 

ভয়াদ্ রণাদুপরতং মংস্যস্তে ত্বাং মহারথাঃ। 
যেষাং চ ত্বং বহুমতো ভুত্বা যাস্যসি লাঘবম্।।৩৫।।
অনুবাদঃ সমস্ত মহারথীরা মনে করবেন যে, তুমি ভয় পেয়ে যুদ্ধক্ষেত্র পরিত্যাগ করেছ এবং তুমি যাদের  কাছে সম্মানিত ছিলে, তারাই তোমাকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য জ্ঞান করবে। 

অবাচ্যবাদাংশ্চ বহুন্ বদিষ্যন্তি তবাহিতাঃ। 
নিন্দস্তস্তব সামর্থ্যং ততো দুঃখতরং নু কিম।।৩৬।।
অনুবাদঃ তোমার শত্রুরা তোমার সামর্থ্যের নিন্দা করে বহু অকথ্য কথা বলবে। তার চেয়ে অধিকতর দুঃখদায়ক তোমার পক্ষে আর কি হতে পারে? 

হতো বা প্রাপ্স্যসি স্বর্গং জিত্বা বা ভোক্ষ্যসে মহীম্। 
তস্মাদুত্তিষ্ঠ কৌন্তেয় যুদ্ধায় কুতনিশ্চয়ঃ।।৩৭।।
অনুবাদঃ হে কুন্তীপুত্র! এই যদ্ধে নিহত হলে তুমি স্বর্গ লাভ করবে, আর জয়ী হলে পৃথিবী ভোগ করবে। অতএব   ‍যুদ্ধের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প হয়ে উত্থিদ হও। 

সুখদুঃখে সমে কৃত্বা লাভালাভ্যে জয়াজয়ৌ। 
ততো যুদ্ধায় যুজ্যস্ব নৈবং পাপমবাপ্স্যসি।।৩৮।।
অনুবাদঃ সুখ-দুঃখ, লাভ-ক্ষতি ও জয়-পরাজয়কে সমান জ্ঞান করে তুমি যুদ্ধের নিমিত্ত যুদ্ধ কর, তা হলে তোমাকে পাপভাগী হতে হবে না। 

এষা তেহভিহিতা সাংখ্যে বুদ্ধির্যোগে ত্বিমাং শৃণু। 
বুদ্ধা যুক্তো যয়া পার্থ কর্মবন্ধং প্রহাস্যসি।।৩৯।।
অনুবাদঃ হে পার্থ! আমি তোমাকে সাংখ্য -যোগের কথা বললাম। এখন ভক্তিযোগ সম্বন্ধিনী বুদ্ধির কথা শ্রবণ কর, যার দ্বারা তুমি কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারবে। 

নেহাভিত্রুমনাশোহস্তি প্রত্যবায়ো ন বিদ্যতে।
স্বল্পমপ্যস্য ধর্মস্য ত্রায়তে মহতো ভয়াৎ।।৪০।।
অনুবাদঃ ভক্তিযোগের অনুশীলন কখনও ব্যর্থ হয় না এবং তার কোনও ক্ষয় নেই। তার স্বল্প অনুষ্ঠানও অনুষ্ঠাতাকে সংসাররূপ মহাভয় থেকে পরিত্রাণ করে।

ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিরেকেহ কুরুনন্দন। 
বহুশাখা হ্যনন্তাশ্চ বুদ্ধয়োহব্যবসায়িনাম্।।৪১।।
অনুবাদঃ যারা এই পথ অবলম্বন করেছে তাদের নিশ্চয়াত্মিকা বুদ্ধি একনিষ্ঠ। হে কুরুনন্দন, অস্থিরচিত্ত সকাম ব্যক্তিদের বুদ্ধি বহু শাখাবিশিষ্ট ও বহিুমুখী। 

যামিমাং পুষ্পিতাং বাচং প্রবদন্ত্যবিপশ্চিতঃ
বেদবাদরাতাঃ পার্থ নান্যদন্তীতি বাদিনঃ।।৪২।।
কামাত্মানঃ স্বর্গপরা জন্মকর্মফলপ্রদাম্।
ক্রিয়াবিশেষবহুলাং ভোগৈশ্বর্যগতিং প্রতি।।৪৩।।
অনুবাদঃ বিবেকবর্জিত লোকেরাই বেদের পুষ্পিত বাক্যে আসক্ত হয়ে স্বর্গসুখ ভোগ,উচ্চকুলে জন্ম, ক্ষমতা লাভ আদিসকাম কর্মকেই জীবনের চরম উদ্দেশ্য বলে মনে করে। ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ ও ঐশ্বর্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে তারা বলে যে, তার ঊর্ধ্বে আর কিছুই নেই। 

ভোগৈশ্বর্যপ্রসক্তানাং তয়াপহৃতচেতসাম্। 
ব্যবসায়াত্মিকা বুদ্ধিঃ সমাধৌ ন বিধীয়তে।।৪৪।।
অনুবাদঃ যারা ভোগ ও ঐশ্বর্যসুখে একান্ত আসক্ত, সেই সমস্ত বিবেকবর্জিত মুঢ় ব্যক্তিদের বুদ্ধি সমাধি অর্থাৎ ভগবানে একনিষ্ঠতা লাভ হয় না। 

ত্রৈগুণ্যবিষয়া বেদা নিস্ত্রৈগুণ্যো ভবার্জুন। 
নির্দ্বনেন্দ্বা নিত্যসত্ত্বস্থো নির্যোগক্ষেম আত্মবান্।।৪৫।।
অনুবাদঃ বেদে প্রধানত জড়া প্রকৃতির তিনটি গুণ সম্বন্ধেই আলোচনা করা হয়েছে। হে অর্জুন! তুমি সেই গুণগুলিকে অতিক্রম করে নির্গুণ স্তরে অধিষ্ঠিত হও। সমস্ত দ্বন্দ্ব থেকে মুক্ত হও এবং লাভ-ক্ষতি ও আত্মরক্ষার দুশ্চিন্তা থেকে মুক্ত হয়ে অধ্যাত্ম চেতনায় অধিষ্ঠিত হও। 

 যবানর্থ উদপানে সর্বতঃ সংপ্লতোদকে। 
ভবান্ সর্বেষু বেদেষু ব্রাক্ষণস্য বিজানতঃ।।৪৬।।
অনুবাদঃ ক্ষুদ্র জলাশয়ে যে সমস্ত প্রয়োজন সাধিত হয়, সেগুলি বৃহৎ জলাশয় থেকে আপনা হতেই সাধিত হয়ে যায়। তেমনই, ভগবানের উপাসনার মাধ্যমে যিনি পরব্রক্ষের জ্ঞান লাভ করে সব কিছুর উদ্দেশ্য উপলব্ধি করেছেন, তাঁরা কাছে সমস্ত বেদের উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। 


       কর্কণ্যেবাধিকারস্তে মা ফলেষু কদাচন। 
মা কর্মফলহেতুর্ভূর্মা তে সঙ্গোহস্ত্বাকর্মণি।।৪৭।।
অনুবাদঃ স্বধর্ম বিহিত কর্মে তোমার অধিকার আছে, কিন্তু কোন কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। কখনও নিজেকে কর্মফলের হেতু বলে মনে করো না, এবং কখনও স্বধর্ম আচরণ না করার প্রতিও আসক্ত হয়ো না। 


     যোগস্থঃ কুরু কর্মাণি সঙ্গং ত্যক্তা ধনঞ্জয়। 
সিদ্ধ্যাসিদ্ধ্যোং সমো ভূত্বা সমত্বং যোগ উচ্যতে।।৪৮।।
অনুবাদঃ হে অর্জুন! ফলভোগের কামনা পরিত্যাগ করে ভক্তিযোগস্থ হয়ে স্বধর্ম-বিহিত কর্ম আচরণ কর। কর্মের সিদ্ধি ও অসিদ্ধি সম্বন্ধে যে সমবুদ্ধি, তাকেই যোগ বলা হয়। 

দূরেণ হ্যবরং কর্ম বুদ্ধিযোগান্ধনঞ্জয়। 
বুদ্ধৌ শরণমন্বিচ্ছ কৃপণাঃ ফলহেতবঃ।।৪৯।।
অনুবাদঃ হে ধনঞ্জয়! বুদ্ধিযোগ দ্বারা ভক্তির অনুশীলন করে সকাম কর্ম থেকে দূরে থাক এবং সেই চেতনায় অধিষ্ঠিত হয়ে ভগবানের শরণাগত হও। যারা তাদের কর্মের ফল ভোগ করতে চায়, তারা কৃপণ। 

বুদ্ধিযুক্তো জহাতীহ উভে সুকৃতদুষ্কৃতে। 
তষ্মাদ্ যোগায় যুজ্যস্ব যোগঃ কর্মসু কৌশলম্।।৫০।। 
অনুবাদঃ ‍যিনি ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করেন, তিনি এই জীবনেই পাপ ও পুণ্য উভয় থেকেই মুক্ত হন। অতএব, তুমি নিষ্কাম কর্মযোগের অনুষ্ঠান কর। সেটিই হচ্ছে সর্বঙ্গীণ কর্মকৌশল। 

কর্মজং বুদ্ধিযুক্তো হি ফলং ত্যক্ত্বা হি ফলং ত্যক্ত্বা মনীষিণঃ। 
জন্মবন্ধবিনির্মুক্তাঃ পদং গচ্ছন্ত্যনাময়ম্।।৫১।।
অনুবাদঃ মনীষিগণ ভগবানের সেবায় যুক্ত হয়ে কর্মজাত ফল ত্যাগ করে জন্ম-মৃত্যুর বন্ধন থেকে মুক্ত হন। এভাবে তাঁরা সমস্ত দুঃখ-দুর্দশার অতীত অবস্থা লাভ করেন। 

যদা তে মোহকলিলং বুদ্ধির্ব্যতিতরিষ্যতি।
তদা গন্তাসি নির্বেদং শ্রোতব্যস্য শ্রুতস্য চ।।৫২।।
অনুবাদঃ এভাবে পরমেশ্বর ভগবানে অর্পিত নিষ্কাম কর্ম অভ্যাস করতে করতে যখন তোমার বুদ্ধি মোহরূপ গভীর অরণ্যকে সম্পূর্ণরূপে অতিক্রম করবে,তখন তুমি যা কিছু শুনেছ এবং যা কিছু শ্রবণীয়, সেই সবের প্রতি সম্পূর্ণরুপে নিরপেক্ষ হতে পারবে। 

শ্রুতিবিপ্রতিপন্না তে যদা স্থাস্যতি নিশ্চলা। 
সমাধাবচলা বুদ্ধিস্তদা যোগমবাস্প্যসি।।৫৩।।
অনুবাদঃ তোমার বুদ্ধি যখন বেদের বিচিত্র ভাষার দ্বারা আর বিচলিত হবে না এবং আত্ম-উপলব্ধির সমাধিতে স্থির হবে, তখন তুমি দিব্যজ্ঞান লাভ করে ভক্তিযোগে অধিষ্ঠিত হবে। 

অর্জুন উবাচ
স্থিতিপ্রজ্ঞস্য কা ভাষা সমাধিস্থস্য কেশব। 
স্থিতধীঃ কিং প্রভাষেত কিমাসীত ব্রজেত কিম্।।৫৪।।
অনুবাদঃ অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন- কেশব! স্থিতপ্রজ্ঞ অর্থাৎ অচলা বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের লক্ষণ কি? তিনি কিভাবে কথা বলেন, কিভাবে অবস্থান করেন এবং কিভাবেই বা তিনি বিচরণ করেন? 

প্রজহাতি যদা কামান্ সর্বান্ পার্থ মেনোগতান্। 
আত্মন্যেবাত্মনা তুষ্টঃ স্থিতপ্রজ্ঞস্তদোচ্যতে।।৫৫।।
অনুবাদঃ পরমেশ্বর ভগবান বললেন-হে পার্থ! জীব যখন মানসিক জল্পনা-কল্পনা থেকে উদ্ভুত সমস্ত মনোগত কাম পরিত্যাগ করে এবং তার মন যখন এভাবে পবিত্র হয়ে আত্মাতেই পূর্ণ পরিতৃপ্তি লাভ করে, তখনই তাকে স্থিতপ্রজ্ঞ  বলা হয়। 


         দুঃখেষ্বনুদ্বিগ্নমনাঃ সুখেষু বিগতস্পৃহঃ।
বীতরাগভয়ক্রোধঃ স্থিতধীর্মুনিরুচ্যতে।।৫৬।।
অনুবাদঃ ত্রিতাপ দুঃখ উপস্থিত হলেও যাঁর মন উদ্ভিগ্ন হয় না, সুখ উপস্থিত হলেও যাঁর স্পৃহা হয় না এবং যিনি রাগ, ভয় ও ক্রোধ থেকে মুক্ত, তিনিই স্থিতধী অর্থাৎ স্থিতপ্রজ্ঞ। 


        য সর্বত্রানভিস্নেহস্তত্তৎ প্রাপ্য শুভাশুভম্।
নাভিনন্দতি ন দ্বেষ্টি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৫৭।।
অনুবাদঃ জড় জগতে ‍যিনি সমস্ত জড় বিষয়ে আসক্তি রহিত, যিনি প্রিয় বস্তু লাভে আনন্দিত হন না এবং অপ্রিয় বিষয় উপস্থিত হলে দ্বেষ করেন না, তিনি পূর্ণ জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। 
       যদা সংহরতে চায়ং কূর্মোহঙ্গানীব সর্বশঃ।
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্টিতা।।৫৮।।
অনুবাদঃ কুর্ম যেমন তার অঙ্গসমূহ তার কঠিন বহিরাবরণের মধ্যে সঙ্কুচিত করে, তেমনই যে ব্যক্তি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, তাঁর চেতনা চিন্ময় জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত। 


        বিষয়া বিনিবর্তস্তে নিরাহারস্য দেহিনঃ।
রসবর্জং রসোহপস্য পরং দৃষ্ট্বা নিবর্ততে।।৫৯।।
অনুবাদঃ দেহবিশিষ্ট জীব ইন্দ্রিয়সুখ ভোগ থেকে নিবৃত্ত হতে পারে, কিন্তু তবুও ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের আসক্তি থেকে যায়। কিন্তু উচ্চতর স্বাদ আস্বাদন করার ফলে তিনি সেই বিষয়তৃষ্ণা থেকে চিরতরে নিবৃত্ত হন। 


        যততো হ্যপি কৌন্তেয় পুরুষস্য বিপশ্চিতঃ। 
   ইন্দ্রিয়াণি প্রমাথীনি হরন্তি প্রসভং মনঃ।।৬০।।
অনুবাদঃ হে কোন্তেয়! ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান এবং ক্ষোভকারী যে, তারা অতি যত্মশীল বিবেকসম্পন্ন পুরুষের মনকেও বলপূর্বক বিষয়াভিমুখে আকর্ষণ করে। 


      তানি সর্বাণি সংযম্য যুক্ত আসীত মৎপরঃ। 
বশে হি যস্যেন্দ্রিয়াণি তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬১।।
অনুবাদঃ যিনি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরুপে সংযত করে আমার প্রতি উত্তমা ভক্তিপরায়ণ হয়ে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরুপে বশীভুত করেছেন, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। 


     ধ্যায়তো বিষয়ান্ পুংসঃ সঙ্গস্তেষূপজায়তে। 
সঙ্গাৎ সঞ্জায়তে কামঃ কামাৎ ক্রোধোহভিজায়তে।।৬২।।
ক্রোধাদ্ ভবতি সম্মোহঃ সম্মোহাৎ স্মৃতিবিভ্রমঃ।
স্মৃতিভ্রংশাদ্ বুদ্ধিনাশো বুদ্ধিনাশাৎ প্রণশ্যতি।।৬৩।।
অনুবাদঃ ইন্দ্রিয়ের বিষয়সমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। ক্রোধ থেকে সম্মোহ, সম্মোহ থেকে স্মৃুতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। অর্থাৎ, মানুষ পুনরায় জড় জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়।         
       রাগদ্বেষবিমুক্তৈস্তু বিষয়ানিন্দ্রিয়ৈশ্চরন্। 
আত্মবশ্যৈর্বিধেয়াত্মা প্রসাদমধিগচ্ছতি।।৬৪।।
অনুবাদঃ সংযতচিত্ত মানুষ প্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক আসক্তি এবং অপ্রিয় বস্তুতে স্বাভাবিক বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হয়ে, তাঁর বশীভূত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা ভগবদ্ভক্তির অনুশীলন করে ভগবানের কৃপা লাভ করেন। 


      প্রসাদে সর্বদুঃখানাং হানিরস্যোপজায়তে। 
প্রসন্নচেতসো হ্যাশু বুদ্ধিঃ পর্যবতিষ্ঠতে।।৬৫।।
অনুবাদঃ চিন্ময় চেতনায় অধিষ্ঠিত হওয়ার ফলে তখন আর জড় জগতের ত্রিতাপ দুঃখ থাকে না; এভাবে প্রসন্নতা লাভ করা ফলে বুদ্ধি শীঘ্রই স্থির হয়। 


        নাস্তি বুদ্ধিরযুক্তস্য ন চাযুক্তস্য ভাবনা। 
ন চাভাবয়তঃ শান্তিরশান্তস্য কুতঃ সুখম্।।৬৬।।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি কৃষ্ণভাবনায় যুক্ত নয়, তার চিত্ত সংযত নয় এবং তার পারমার্থিক বুদ্ধি থাকতে পারে না। আর পরমার্থ চিন্তাশূন্য ব্যক্তির শান্তি লাভের কোন সম্ভাবনা নেই। এই রকম শান্তিহীন ব্যক্তির প্রকুত সুখ কোথায়?


      ইন্দ্রিয়াণাং হি চরতাং যন্মনোহনুবিধীয়তে। 
তদস্য হরতি প্রজ্ঞাং বায়ুর্নাবমিবাম্ভসি।।৬৭।।
অনুবাদঃ প্রতিকূল বায়ু নৌকাকে যেমন অস্থির করে, তেমনই সদা বিচরণকারী যে কোন একটি মাত্র ইন্দ্রিয়ের আকর্ষণেও মন অসংযত ব্যক্তির প্রজ্ঞাকে হরণ করতে পারে।


    তস্মাদ্ যস্য মহাবাহো নিগৃহীতানি সর্বশঃ। 
ইন্দ্রিয়াণীন্দ্রিয়ার্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা।।৬৮।।
অনুবাদঃ সুতরাং, হে মহাবাহো! যাঁর ইন্দ্রিয়গুলি ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে সর্বপ্রকারে নিবৃত্ত হয়েছে, তিনিই স্থিতপ্রজ্ঞ। 


     যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্তি সংযমী। 
যস্যাং জাগ্রতি ভুতানি সা নিশা পশ্যতো মুনেঃ।।৬৯।।
অনুবাদঃ সমস্ত জীবের পক্ষে যা রাত্রিস্বরূপ, স্থিতপ্রজ্ঞ সেই রাত্রিতে জাগরিত থেকে আত্ম-বুদ্ধিনিষ্ঠ আনন্দকে সাক্ষাৎ অনুভব করেন। আর যখন সমস্ত জীবেরা জেগে থাকে, তখন তত্ত্বাদর্শী মুনির নিকট তা রাত্রিস্বরূপ। 

আপূর্যমাণমচলপ্রতিষ্ঠং
সমুদ্রমাপঃ প্রবিশন্তি যদ্ধৎ। 
তদ্বৎ কামা যং প্রবিশন্তি সর্বে 
স শান্তিমাপ্নোতি ন কামকামী।।৭০।।
অনুবাদঃ বিষয়কামী ব্যক্তি কখনও শান্তি লাভ করে না। জলরাশি যেমন সদা পুরপূর্ণ এবং স্থির সমু্দ্রে প্রবেশ করেও তাকে ক্ষোভিত করতে পারে না, কামসমূহও তেমন স্থিতপ্রজ্ঞ ব্যক্তিতে প্রবিষ্ট হয়েও তাঁকে বিক্ষুব্ধ করতে পারে না, অতএব তিনিই শান্তি লাভ করেন। 

বিহায় কামান্ যঃ সর্বান পুমাংশ্চরতি নিঃস্পৃহঃ। 
নির্মমো নিরহঙ্কারঃ স শান্তিমধিগচ্ছতি।।৭১।।
অনুবাদঃ যে ব্যক্তি সমস্ত কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করে জড় বিষয়ের প্রতি নিষ্পৃহ, নিরহঙ্কার ও মমত্ববোধ রহিত হয়ে বিচরণ করেন, তিনিই প্রকৃত শান্তি লাভ করেন। 

এষা ব্রাক্ষী স্থিতিঃ পার্থ নৈনাং প্রাপ্য বিমুহ্যতি। 
স্থিত্বাস্যামন্তকালেহপি ব্রক্ষনির্বাণমৃচ্ছতি।।৭২।।
অনুবাদঃ এই প্রকার স্থিতিকেই ব্রাক্ষীস্থিতি বলে। হে পার্থ! যিনি এই স্থিতি লাভ করেন, তিনি মোহপ্রাপ্ত হন না। জীবনের অন্তিম সময়ে এই স্থিতি লাভ করে, তিনি এই জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে ভগবৎ-ধামে প্রবেশ করেন। 
 সমাপ্ত
-------------

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার সকল অধ্যায় সমূহ

 *মঙ্গলাচরণ

 *গীতা-মাহাত্ম্য

 ১. গীতা-প্রথম অধ্যায় অর্জুন বিষাদ-যোগ

৩. গীতা-৩য় অধ্যায়-কর্মযোগ

৪. গীতা-৪র্থ অধ্যায়-জ্ঞান যোগ

৫. গীতা-৫ম অধ্যায়-কর্মসন্ন্যাস-যোগ

৬. গীতা-ষষ্ঠ-অধ্যায়-ধ্যানযোগ

৭. গীতা-সপ্তম-অধ্যায়-বিজ্ঞান-যোগ

৮. গীতা-অষ্টম-অধ্যায়-অক্ষরব্রহ্ম-যোগ

৯. গীতা-নবম-অধ্যায়-রাজগুহ্য-যোগ

১০. গীতা-দশম-অধ্যায়-বিভূতি-যোগ

১১. গীতা-একাদশ-অধ্যায়-বিশ্বরূপ-দর্শন-যোগ

১২. গীতা-দ্বাদশ অধ্যায়-ভক্তিযোগ

১৩. গীতা-ত্রয়োদশ অধ্যায়-প্রকৃতি-পুরুষ-বিবেকযোগ

 ১৪. গীতা-চতুর্দশ অধ্যায়-গুণত্রয়-বিভাগ-যোগ

১৫. গীতা-পঞ্চদশ অধ্যায়-পুরুষোত্তম-যোগ

১৬. গীতা-ষোড়শ অধ্যায়-দৈবাসুর-সম্পদ-বিভাগযোগ

১৭. গীতা-সপ্তদশ অধ্যায়-শ্রদ্ধাত্রয়-বিভাগ-যোগ

১৮. গীতা-অষ্টাদশ অধ্যায়-মোক্ষযোগ


 

Next Post Previous Post
7 Comments
  • Unknown
    Unknown ৬ এপ্রিল, ২০২০ এ ২:২৫ AM

    আমি খুবই উপকৃত হয়েছি।
    নমস্কার গ্রহন করবেন।
    ধন্যবাদ।

    • Krishna Das
      Krishna Das ১০ এপ্রিল, ২০২০ এ ১১:০৭ PM

      আপনাকেউ ধন্যবাদ,,,হরে কৃষ্ণ

  • Sahityomela
    Sahityomela ২৩ জুন, ২০২০ এ ৪:১৩ PM

    kichu spelling mistech achea. aktu dhekhe neben.

  • Unknown
    Unknown ১৬ জানুয়ারী, ২০২১ এ ৫:৩৯ PM

    খুবই চমকপ্রদ

  • Unknown
    Unknown ২৫ মার্চ, ২০২১ এ ১০:৪২ AM

    আমি অত্যন্ত উপকৃত হয়েছি এবং গীতার বাণী প্রচারও করছি।
    ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই।

  • Unknown
    Unknown ২৬ আগস্ট, ২০২১ এ ১২:৪৩ PM

    This is very useful for me. Though I don't have the book but here as all the 18 chapters are given, When I am writing it is very easy for me to collect the information. the main is is that the site is not hanging and creating problems on my laptop. Very good. I like it. Keep it up.

  • Unknown
    Unknown ২৮ ফেব্রুয়ারী, ২০২২ এ ১২:২৫ PM

    বাংলা গীতার অধ্যায় গুলো দিলে ভালো হয়

Add Comment
comment url