গোত্র কী? হিন্দু ধর্মে বর্ণপ্রথা - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

রবিবার, ২৩ ফেব্রুয়ারী, ২০২০

গোত্র কী? হিন্দু ধর্মে বর্ণপ্রথা



গোত্র কী?
 

 হিন্দু ধর্মে গোত্র কয় প্রকার ও কি কি?

 
 
পূজা, যজ্ঞ কিংবা বিবাহ যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানেই পুরোহিত জিজ্ঞেস করেন, আপনার গোত্র কী? গোত্রের নামটা অবলীলায় মুখ থেকে নির্গত হলেও তা কেবল নামসর্বস্বই। এর বাইরে গোত্র সম্বন্ধে আর কোনো তথ্য খুব কম লোকই জানেন। পারিবারিক পরম্পরায় শুধু নামটিই প্রবাহিত হয়ে আসছে, কিন্তু এর উৎস সম্বন্ধে অধিকাংশই অজ্ঞ। কীভাবে আমাদের নামের সাথে এই গোত্রটি যুক্ত হয়ে গেল? কী রয়েছে এর নেপথ্যে? এই প্রবন্ধে আমরা গোত্রের এই রহস্য উদঘাটনের প্রয়াস করবো। 

গোত্রের পটভূমি

গোত্র সম্বন্ধে বিস্তারিত জানতে হলে এই ব্রহ্মান্ড সৃষ্টির সূচনালগ্ন থেকে এর ইতিহাস জানা প্রয়োজন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পুরুষাবতার গর্ভোদকশায়ী বিষ্ণুর নাভিকমল থেকে জাত হয়ে ভগবানের নির্দেশে ব্রহ্মা সৃষ্টি কার্য শুরু করলেন। ব্রহ্মা সনক, সনন্দ, সনাতন ও সনৎকুমার নামে চারজন মহর্ষিকে সৃষ্টি করেছিলেন। সৃষ্টি বিস্তারের উদ্দেশ্যে তাদের সৃষ্টি করা হলেও পরমেশ্বর ভগবান বাসুদেবের প্রতি ভক্তিপরায়ণ হওয়ার ফলে, মোক্ষনিষ্ঠ কুমারেরা সে কার্যে তাঁদের অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। 

পরমেশ্বর ভগবানের শক্তিতে আবিষ্ট ব্রহ্মা প্রজা সৃষ্টির ব্যাপারে চিন্তা করে, সন্তান-সন্ততি বিস্তার করার জন্য দশটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। মরীচি, অত্রি, অঙ্গিরা, পুলস্ত্য পুলহ, ক্রুতু, ভৃগু, বশিষ্ট, দক্ষ ও দশম পুত্র নারদ এভাবে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ব্রহ্মার শরীরের সর্বশ্রেষ্ঠ অঙ্গ ও দিব্য ভাবনা থেকে নারদের জন্ম হয়েছিল। বশিষ্ঠের জন্ম হয়েছিল তাঁর নিশ্বাস থেকে, দক্ষ তাঁর বৃদ্ধাঙ্গুষ্টি থেকে, ভৃগু তাঁর ত্বক থেকে এবং ক্রতু তাঁর হস্ত থেকে। পুলস্ত্য কান থেকে, অঙ্গিরা মুখ থেকে, অত্রি নেত্র থেকে, মরীচি মন থেকে এবং পুলহ ব্রহ্মার নাভি থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। 


মহীয়সী দেবাহুতির পতি মহর্ষি কর্দম ব্রহ্মার ছায়া থেকে উৎপন্ন হয়েছিলেন। এভাবে ব্রহ্মার শরীর অথবা মন থেকে সৃষ্টিকার্য সম্পন্ন হয়েছে। ব্রহ্মা যখন দেখলেন যে, মহাবীর্যবান ঋষিদের উপস্থিতি সত্ত্বেও জনসংখ্যা পর্যাপ্ত পরিমাণে বৃদ্ধি পাচ্ছে না, তখন তিনি গভীরভাবে চিন্তা করতে লাগলেন কীভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি করা যায়। তিনি চিন্তা করলেন, নিজের দেহ থেকে এভাবে সৃষ্টি না করে, নারী-পুরুষের মাধ্যমে সংসার সৃষ্টি হোক। তখন তাঁরা দেহ থেকে আরো দুই মূর্তি প্রকাশিত হয়েছিল, তাঁরা হলেন মনু ও শতরূপা। 

সে সময় থেকে মৈথুনের দ্বারা ধীরে ধীরে প্রজা বৃদ্ধি পেতে লাগল। মনু ও শতরূপা মিলিত হয়ে প্রিয়ব্রত ও উত্তাপনপাদ নামে দুই পুত্র এবং আকুতি, স্রসূতি ও দেবাহুতি নামে তিন কন্যার জন্ম দেন। মনু তাঁর প্রথম কন্যা আকুতিকে রুচি নামক ঋষিকে দান করেন এবং কনিষ্ঠা কন্যা প্রসূতিকে দক্ষের নিকট দান করেন। তাঁদের দ্বারাই সমগ্র জগৎ জনসংখ্যায় পূর্ণ হয়েছে। 

গোত্র কী? 

ব্রহ্মা থেকে যেসকল ঋষিদের উৎপত্তি হয়েছে, তাদের থেকেই বিভিন্ন গোত্রের প্রবর্তন হয়েছে। সেই ঋষিদের থেকে যে বংশানুক্রমিক ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে, ত-ই গোত্র নামে পরিচিত। সেসমস্ত ঋষির নামানুসারেই সেই সেই গোত্র পরিচিতি লাভ করে আসছে। পাণিণির সূত্রানুসারে (৪/১/৬২) “অপত্যং পৌত্রপ্রভৃতি গোত্রম্” অর্থাৎ, পৌত্র প্রভৃতির অপত্যগণের নাম গোত্র। গোত্র প্রসঙ্গে বৌধায়নের মত নিম্নরূপ-
বিশ্বামিত্রো জমদগ্নিভরদ্বাজোত্থ গৌতমঃ। 
অত্রিবশিষ্ঠঃ কশ্যপ ইত্যেতে সপ্তঋষয়। 
সপ্তানাং ঋষিনামগস্ত্যাষ্টমানাং যদপত্যং তদগোত্রম্।। 

অর্থাৎ, বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ, কশ্যপ ও অগস্ত্য- এই আটজন মুনির পুত্র ও পৌত্র প্রভৃতি অপত্যগণের মধ্যে যিনি ঋষি হতে পেরেছেন, তিনিই তার পূর্ববর্তী ও পরবর্তী সকলের গোত্র অর্থাৎ, তাঁর নামেই সেই বংশীয়গণের গোত্র চলে। অতএব, বিশ্বামিত্রের অপত্য দেবরাত প্রভৃতিকে বিশ্বামিত্রের গোত্র বলে এবং জমদগ্নির অপত্য মার্কন্ডেয় প্রভৃতিকে জমদগ্নির গোত্র বলে। আশ্বলায়নশ্রৌতসূত্রের নারায়ণকৃত বৃত্তিকে লিখিত আছে যে, বিশ্বামিত্র প্রভৃতি আটজন ঋষির অপত্যদের তাদের গোত্র বলে জানবে। যেমন জমদগ্নি ঋষির গোত্র বৎস প্রভৃতি, গৌতমের অরণ্যাদি, ভরদ্বাজের দক্ষ, গর্গ প্রভৃতি। (বিশ্বকোষ) 


ঋকসংহিতায় যারা ঋষি, বৌধায়নের শ্রোতগ্রন্থে তাদের নামেই গোত্র নিরূপিত হয়েছে। বৌধায়ন, আশ্বলায়ন, কাত্যায়ন, সত্যাষাঢ়, ভরদ্বাজ,লৌগাক্ষি প্রভৃতি রচিত শ্রৌতসূত্রে বিভিন্ন গোত্রের নাম পাওয়া যায়। বৌধায়নসূত্রে বিশ্বামিত্র, জমদগ্নি, ভরদ্বাজ, গৌতম, অত্রি, বশিষ্ঠ ও কশ্যপ এই সাতজন ঋষিই আদি গোত্রকার বলে নির্দিষ্ট আছেন। তাদের অপত্যদের মধ্যে যাঁরা মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষি হতে পেরছিলেন তাঁদের নামেও গোত্র প্রবর্তিত হয়। আর সেই সেই গোত্রের প্রবর্তন কারীদের সেই সেই গোত্রের প্রবর বলে। মৎসপুরাণে ১৪৫/৯৮-১১৭ শ্লোকে ৯২ জন মন্ত্রকৃৎ ঋষির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তাছাড়া, মৎসপুরাণের ১৯৫-২০২ অধ্যায় পর্যন্ত ঋষিগণের গোত্র, প্রবর ও বংশপরম্পরা বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণিত আছে। মনুরুবাচ--
ঋষিনাং নাম-গোত্রানি-বংশাবতরণং তথা। 
প্রবরাণাং তথা সাম্যসাম্যং বিস্তরাদ্বদ।। (ম.পু.১৯৫/২) 
মনু মৎসরূপী ভগবানকে জিজ্ঞেস করলেন- হে ভগবান। ঋষিগণের নাম, গোত্র, বংশ-বিবরণ ও প্রবরসমূহের সাম্য-অসাম্য ইত্যাদি বিষয়ে বিস্তারিত জানতে ইচ্ছা করি।

মনুর সেই প্রশ্নের উত্তরে ভগবান মৎসরূপে পরপর কয়েকটি অধ্যায়ে ভৃগু, অঙ্গিরা, অত্রি, বিশ্বামিত্র, কশ্যপ, বশিষ্ঠ, পরাশর ও অগস্ত্যের গোত্র ও বংশের বর্ণনা করেন। এ দীর্ঘ আলোচনা স্বল্প পরিসরে করা সম্ভব নয়। মৎস্যপুরাণের এ বর্ণনা হতে কীভাবে ব্রহ্মার সৃষ্ট ঋষিগণ হতে পরবর্তীকালে গোত্রের মাধ্যমে বৈদিক সংস্কৃতির ধারা প্রবাহিত হয়ে আসছে তার বর্ণনা পাওয়া যায়। পরবর্তীকালে এই শাখা বহু বিস্তার লাভ করে। সপ্তর্ষি হতে সৃষ্ট গোত্রের ধারা পরবর্তীকালে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বহুধারায় বিভক্ত হয়।

গোত্র ও চতুর্বর্ণ 

পূর্বের আলোচনা অনুসারে দেখা যায়, গোত্রপ্রবর্তক ঋষিগণ ব্রাহ্মণ ছিলেন। তবে ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয়, বৈশ্য ও শুদ্র- এ চারটি বর্ণ ভীভাবে বিভাজিত হলো? সেক্ষেত্রে দেখা যায় জন্মসূত্রে সকলেই ব্রাহ্মণ। কিন্তু ভগবদ্গীতার সিদ্ধান্ত অনুসারে বর্ণ বিন্যাস জন্মসূত্রে নয়, বরং গুণ অনুসারে নির্ণীত হয়। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভগবদ্গীতায় (৪/১৩) বলেন-
চাতুবর্ণং ময়া সৃষ্টং গুণকর্মবিভাগশঃ। 
তস্য কর্তারমপি মাং বিদ্ধ্যকর্তারমব্যয়ম।। 
 
“প্রকৃতির তিনটি গুণ ও কর্ম অনুসারে আমি মানবসমাজে চারটি বর্ণবিভাগ সৃষ্টি করেছি। আমি এই প্রথম স্রষ্টা হলেও আমাকে অকর্তা এবং অব্যয় বলে জানবে।” উপরের শ্লোক অনুসারে বর্ণবিভাগ যে জন্মানুসারে নয়, বরং কর্মানুসারে তা শতভাগ নিশ্চিত। তাই একই গোত্রে কর্ম ও গুণানুসারে চারটি বর্ণ থাকতে দেখা যায়। কেউ যদি শাস্ত্র অধ্যয়ন তথা বুদ্ধিবৃত্তিক কাজে পারদর্শী হন এবং সেভাবে জীবিকা অবলম্বন করে তবে সে ব্রাহ্মণ, পরিচালনায় দক্ষ হলে ক্ষত্রিয়, ব্যবসা বাণিজ্যে জীবিকা নির্বাহ করলে বৈশ্য এ সকল পেশার লোকদের সেবাকারীর কোনো বৃত্তি হলে সে শূদ্র বলে গণ্য হবে। 

সমগোত্রে বিবাহ প্রসঙ্গে

প্রায়ই শোনা যায়, একই গোত্রে বা একই বংশে কি বিবাহ করা যায়? এক্ষেত্রে শাস্ত্রে কী বলা হয়েছে? মনুসংহিতায় এ প্রসঙ্গে বলা হয়েছে- 
অসপিন্ডা চ যা মাতুরসগোত্রা চ যা পিতুঃ। 
সা প্রশস্তা দ্বিজাতীনাং দারকর্মণি মৈথুনে।। 
অর্থাৎ, যে নারী মাতার সপিন্ডা না হয়, অর্থাৎ সপ্তপুরুষ পর্যন্ত মাতামহাদি বংশজাত না হয় ও মাতামহের চতুর্দশ পুরুষ পর্যন্ত সগোত্রা না হয় এবং পিতার সগোত্রা বা সপিন্ডা না হয়, অর্থাৎ পিতৃস্বসাদিব সন্তান সম্ভব সম্বন্ধ না হয় এমন স্ত্রী-ই দ্বিজাতিদের (ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্য) বিবাহের যোগ্য বলে জানবে। (মনুসংহিতা ৩/৫-৬) বৈদিক শাস্ত্রের এই সিদ্ধান্ত আধুনিক বৈজ্ঞানিকগণও স্বীকার করছেন- 


তাঁদের মতে, নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিবাহ বিজ্ঞানসম্মত নয়। এধরনের সম্পর্কের ফলে যে সন্তান হয়, তার মধ্যে জন্মগত ত্রুটি দেখা দেওয়ার ঝুঁকি প্রবল। দ্য ল্যানসেট সাময়িকীতে প্রকাশিত এক গবেষণা নিবন্ধে বিজ্ঞানীরা এ তথ্য জানিয়েছেন। যুক্তরাজ্যের ব্র্যাডফোর্ড শহরে বসবাসকারী পাকিস্তানি বংশোদ্ভূত জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, নিকটাত্মীয়ের মধ্যে বিবাহের মাধ্যমে জন্মগ্রহণকারী সন্তানের জিনগত অস্বভাবিকতার হার সাধারণ শিশুদের তুলনায় ৩০ শতাংশ বেশি। এসব অস্বাভাবিকতার মধ্যে নবজাতকের অতিরিক্ত আঙ্গুল গজানোর মতো সমস্যা থেকে শুরু করে হৃৎপিন্ডে ছিদ্র বা মস্তিষ্কের গঠনপ্রক্রিয়ার ক্রুটি দেখা দিতে পারে। গবেষণায় নেতৃত্ব দেন ফিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এয়ারমন শেরিডান।  ২০০৭ থেকে ২০১১ সালের মধ্যে জন্মগ্রহণকারী সাড়ে ১৩ হাজার শিশুকে ওই গবেষণার আওতায় আনা হয়।

ব্র্যাডফোর্ড শহরে দক্ষিণ এশীয় অভিবাসীদের বড় একটি অংশ বসবাস করে। সেখানে পাকিস্তানি বংশোদ্ভুত জনগোষ্ঠীর মধ্যে ৩৭ শতাংশই রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করে থাকে। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে রক্তের সম্পর্কের আত্মীয়দের মধ্যে বিবাহের প্রচলন রয়েছে। সারা বিশ্বে ১০০ কোটির বেশি মানুষ এ রকম সংস্কৃতি ধারণ করে।

লিডস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকগণ যেন এই বৈদিক সত্যকেই নতুন করে উদঘাটন করে ঘোষণা দিলেন ল্যানসেট সাময়িকীতে।

তবে, মনু ও শতরূপা কি ভ্রাতা ও ভগিনীর ন্যায় ছিলো না? 

উত্তর হচ্ছে না, কেননা, মন ও শতরূপা এ জগতের সাধারণ মানুষের ন্যায় যোনিগতভাবে জন্মলাভ করেননি। তারা পতি-পত্নীরূপেই ব্রহ্মা থেকে সৃষ্টি হয়েছিল। আবার, মনু ও শতরূপা থেকে যদি মানবজাতির বিকাশ হয়, তবে তাদের থেকে যাদের সৃষ্টি হয়েছে, তাদের দ্বারা কি ভ্রাতা ভগিনীর সম্পর্কের মাধ্যমে সৃষ্টি বিস্তার হয়নি? এক্ষেত্রেও এ ধরনের কোনো সম্পর্ক হয়নি। কারণ, পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে, মনুর তিন কন্যাকে যথাক্রমে রুচি, কর্দম ও দক্ষের সাথে বিবাহ দেয়া হয়। তাই সেখানেও এ প্রশ্ন ওঠার কোনো সুযোগ নেই।

বৈষ্ণবগণ কেন অচ্যুত গোত্রীয়

সপ্তর্ষি থেকে গোত্র প্রবর্তিত হলেও পরবর্তীকালে গোত্র ও প্রবরের মাধ্যমে বহু মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণের মাধ্যমে বহু গোত্র প্রবর্তিত হয়। গোত্রের সংখ্যা নিরূপণ করতে গিয়ে বৌধায়ন নিজেই বলেছেন-
গোত্রানাং তু সহস্রাণি প্রযুতান্যর্ব্বুদানিচ। 
উনপঞ্চাশদষৈাং প্রবরাঋষিদর্শনাৎ।। 
উপর্যুক্ত শ্লোক অনুসারে, সহস্র গোত্রের কথা বলা হয়েছে। এখানে সহস্রশীর্ষা পুরুষের মতো সহস্র বলতে অসংখ্য বোঝানো হয়েছে। তাই মুখ্য কতিপয় গোত্র চিহ্নিত করা গেলেও গোত্র সর্বমোট কয়টি তা নিরূপণ করা যায় না। কারণ, পূর্বেই বলা হয়েছে- মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণ হতেই গোত্র প্রবর্তিত হতো। 

এবার আসা যাক, বৈষ্ণবদের গোত্র প্রসঙ্গে। জন্মগতভাবে ভিন্নগোত্রীয় বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কেননা, বৈষ্ণবগণ বংশগতভাবে কোনো গোত্রের উত্তরসূরী হলেও বৈষ্ণবগণকে শাস্ত্রে অচ্যুতগোত্রীয় বলে সম্বোধন করা হয়েছে। কেননা, বৈষ্ণবগণ বংশগতভাবে কোনো গোত্রের উত্তরসূরী হলেও তারা এখন সরাসরি অচ্যুত ভগবানের সাথে যুক্ত। অমল পুরাণ শ্রীমদ্ভাগবতে (৪/২১/১২) ভগবদ্ভক্ত তথা বৈষ্ণবণকে অচ্যুতগোত্র বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে- 
সর্বত্রাস্থলিতাদেশঃ সপ্তীদ্বীপৈকদগুধৃক। 
অন্যত্র ব্রাক্ষণকুলাদন্যত্র অচ্যুতগোত্রতঃ 
অর্থাৎ, “মহারাজ পৃথু ছিলেন সপ্তদীপ সমন্বিত পৃথিবীর একচ্ছত্র সম্রাট। তাঁর অপ্রতিহত আদেশ সাধু, ব্রহ্মণ ও অচ্যুত গোত্রীয় বৈষ্ণব ব্যতীত অন্য কেউ লঙ্ঘন করতে পারত না।” এই শ্লোকের টীকায় শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তী ঠাকুর লিখেছেন- “অচ্যুত গোত্রতঃ’- অচ্যুত অর্থাৎ, শ্রীভগবানই গোত্র বলিতে প্রবর্তকতুল্য যাঁদের, সেই বৈষ্ণবগণ ব্যতীত, তা বলায় শ্রীবৈষ্ণবগণের বর্ণ ও আশ্রম ধর্মের অভাবই ব্যক্ত করা হলো।” 


উক্ত শ্লোকের তাৎপর্যে শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ লিখেছেন- “জড়-জাগতিক উপাধি জাতি, বর্ণ, ধর্ম, রাষ্ট্র ইত্যাদির পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য সৃষ্টি করে। বিভিন্ন গোত্র জড় দেহের পরিপ্রেক্ষিতে পার্থক্য সৃষ্টি করে, কিন্তু কেউ যখন কৃষ্ণভক্ত হন, তিনি তখন অচ্যুত গোত্রধারী হন বা পরমেশ্বর ভগবানের বংশধর হন এবং তার ফলে তিনি জাতি, ধর্ম, বর্ণ ইত্যাদির সমস্ত বিবেচনার অতীত হন। 

প্রেমবিবর্তে জগদানন্দ পন্ডিত অচ্যুত গোত্র প্রসঙ্গে বলেন- 
শ্রী অচ্যুতগোত্র বলি’ বৈষ্ণব-নির্দেশ। 
ইহার তাৎপর্য কিবা, ইথে কি বিশেষ”।।৪৫।। 
স্বরূপ বলে, “গৃহী, ত্যাগী উভয়ে সর্বথা। 
এই গোত্রে অধিকার নাহিক অন্যথা।।৪৬।। 
শ্রীঅচ্যুতগোত্রে থাকে শুদ্ধভক্ত যত। 
স্বধর্মনিষ্ঠায় কভু নাহি হয় রত।।৪৭।।
সংসারের গোত্র ত্যজি’ কৃষ্ণগোত্র ভজে। 
সেই নিত্যগোত্র তার যেই বৈসে ব্রজে।।৪৮।।
মধ্যমাধিকারী আর উত্তমাধিকারী। 
সকলে অচ্যুতগোত্র দেখহ বিচারি””।।৪৯।।
শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর তাঁর পদে নিম্নোক্তভাবে বৈষ্ণবগণকে অচ্যুতগোত্র বলে অভিব্যক্ত করেছেন- 
মুনি দ্বিজ শূদ্র ভেদ নাহিক বৈষ্ণবে। 
বৈষ্ণবগণের বাহা কৃষ্ণ গোত্র লভে।। 
পিতৃগোত্রেন যা কন্যা স্বামীগোত্রেন গোত্রিতা। 
তথা কৃষ্ণ ভক্ত মাত্রেণ অচ্যুত গোত্র ভবেৎ নৃণাং।। 

বিবাহের পর কন্যা যেমন পিতার গোত্র থেকে স্বামীর গোত্র প্রাপ্ত হয়, তেমনি কেউ যখন কৃষ্ণ ভক্ত হন, তখন তিনি অচ্যুত গোত্রভুক্ত হন। 

‘বৈষ্ণবাচার্য মাধ্ব’ গ্রন্থের একাদশ অধ্যায়ে শ্রীসুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদ বর্ণনা করেছেন- “প্রাচীন বৃদ্ধ মনু সংহিতায় লিখিত আছে, পুরাকালে সন্ন্যাস প্রবর্তক দশজন আচার্য উদ্ভূত হয়েছিলেন। তাঁরা সকলেই অচ্যুত গোত্রীয়। কশ্যপ সন্তান পদ্মপাদ গোবর্ধন মঠে এবং ভার্গব গোত্রীয় ত্রোটক জ্যোতির্মঠে প্রতিষ্ঠিত হন। শঙ্করপ্রবর্তিত সন্ন্যাসে সকলেরই চ্যুত- গোত্রাভিমান প্রবল। কিন্তু বিষ্ণুস্বামী সম্প্রদায় সেই প্রকার চ্যুতকুল বা ব্রাহ্মণকুলকেই ব্রহ্ম-সন্ন্যাসের যোগ্য বলে মনে করেন না। স্থুল শরীর চ্যুত-গোত্র হইতে উৎপন্ন হয় সত্য, কিন্তু যজ্ঞ দীক্ষাক্রমে ত্রিজগণ সকলেই অচ্যুত গোত্রীয়।” 

উপরোল্লেখিত ভাগবতের শ্লোকে স্পষ্টভাবেই বৈষ্ণবগণের গোত্র যে অচ্যুত তা ব্যক্ত করা হয়েছে। মহাপ্রভুর একান্ত পার্ষদ জগদানন্দ পন্ডিত, শ্রীল বিশ্বনাথ চক্রবর্তীপাদ, শ্রীল নরোত্তম দাস ঠাকুর, শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ ও সুন্দরানন্দ বিদ্যাবিনোদের সিদ্ধান্ত হতে অচ্যুতগোত্রই যে বৈষ্ণবের গোত্র তা প্রতিপাদিত হয়, যা দৈহিক পরিচয়ের উর্ধ্বে সরাসরি ভগবানের সাথে সম্পৃক্ত।---হরেকৃষ্ণ---
(অক্ষয় লীলামাধব দাস)

৬টি মন্তব্য: