মন কি? মনকে নিয়ন্ত্রণ করার কৌশল।
মন কি ও মনের প্রকৃতি
মন কি (যা সূক্ষ্ম শরীরের অংশ) জীবকে জড় জগতে বন্ধ রাখতে প্রধান ভূমিকা নেয়। সুতরাং, মনের গতি প্রকৃতি সম্পর্কে জানাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ যাতে কিভাবে মন কাজ করে, তার আচরণ এবং নিয়ন্ত্রণ করার পদ্ধতি জেনে তার যথার্থ উপযােগ করা যায়।
চঞ্চল বানর (যে সবসময় লাফালাফি করে)
কখনাে কখনাে মনকে একটি বানরের সঙ্গে তুলনা করা হয়, যে সব সময় এক ডাল থেকে অন্য ডালে লাফিয়ে বেড়াচ্ছে।
মন কখনাে এক বিষয়ের মধ্যে স্থির থাকে না। কোন এক সময় তার একটি বিষয় নিয়ে চিন্তা করে পরক্ষণেই অন্য চিন্তা করার একটি প্রকৃতি আছে।
মনকে কখনাে কখনাে একটি শিশুর সঙ্গেও তুলনা করা হয় যে সবসময় চঞ্চল ও সমস্যার সৃষ্টি করে। প্রায় সকলেই সবসময় মনের বিভিন্ন চাহিদা পূরণ করতে ব্যস্ত।
কিন্তু মনকে কখনােই তৃপ্ত করা যায় না, কেননা মনের অসংখ্য চাহিদার কতগুলাে পূরণ করা সম্ভব? মন একটি অসতী নারী বা বেশ্যার মতাে যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রঙের পােশাক পরিধান করে, বিভিন্ন ধরনের লােককে আকৃষ্ট করার জন্য। অনুরূপভাবে অনিয়ন্ত্রিত মন একজন মানুষকে সহজেই অধঃপতিত করে।
এমনকি অর্জুনের মত মহান ব্যক্তিত্ব অর্জুনও অকপটে স্বীকার করেছেন যে মনকে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই কঠিন। ভগবদ্গীতায় (ভঃ গীঃ ৬/৩৪) বলা হয়েছেঃ
চঞ্চলং হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাধি বলব
তস্যাহং নিগ্রহং মন্যে বায়ােরিব সুদুষ্রম।
হে কৃষ্ণ! মন অত্যন্ত চঞ্চল, শরীর ও ইন্দ্রিয়ানি বিক্ষেপ উৎপাদক,দুর্দমনীয় এবং অত্যন্ত বলবান, তাই তাকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভূত করার থেকেও অধিকতর কঠিন বলে আমি মনে করি।”
অর্জুন এরকম একজন মহান যােদ্ধা ছিলেন যে তিনি মনে করেছিলেন যে তার কাছে অস্ত্র দ্বারা বায়ুকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হতে পারে। কিন্তু, মনকে দমন করার কোনাে আশাই তিনি অনুভব করেননি।
অনিয়ন্ত্রিত মন ও আপনার কি ক্ষতি করতে পারে?
একজন ব্যক্তি যার মন এবং ইন্দ্রিয়সমূহ অনিয়ন্ত্রিত অচিরেই তাকে করুণ অবস্থায় পড়তে হয়। একদিকে জিহ্বা সুস্বাদু খাবারের জন্য তাকে টানতে থাকে,
তারপর তৃষ্ণা প্রয়োজনীয় পানীয়ের ব্যবস্থা করতে বলে, সাথে উপস্থ (ইন্দ্রিয়) যৌন-তৃপ্তির জন্য লালায়িত হয় এবং একই সে কোমল অনুভূতি সুখস্পর্শ পেতে চায়।
উদর অতৃপ্ত থাকে যতক্ষণ না তার পুর্তি হয়, কান দাবী করে মধুর শব্দ শোনার, নাসিকাও সুগন্ধের জন্য উৎকষ্ঠিত আর চোখ জগতের সৌন্দর্যকে ভােগ করতে চায়।
এইভাবে ইন্দ্রিয়সমূহ সন্তোষ বা তৃপ্তির আশায় জীবকে বিভিন্ন দিকে টানতে থাকে।
অনিয়ন্ত্রিত মনের জন্যই এই সমস্ত ইন্দ্রিয়গুলি পথভ্রষ্ট হয়ে সব দিক থেকে বিভ্রান্তির মধ্যে পড়ে।
মূর্খ মানুষ জানে না কিভাবে এর সমাধান করতে হয়। যখন জীবনে কোনাে বিপদ আসে, সে তখন হতাশায় ধুমপান, মদ্যপান অথবা আত্মহত্যা করে বসে ঐ যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য।
কিন্তু পরিণতিস্বরূপ পূর্বাপেক্ষা আরাে যন্ত্রণাকে সে আহ্বান করে। আধুনিককালে আমরা ব্যবহারিকভাবে দেখতে পাই মানুষের মানসিকভাবে চাপগ্রস্থ অবস্থা, বিশ্বস্ততার অভাব, দৃঢ়তার অভাব ইত্যাদি সবই অনিয়ন্ত্রিত মনের জন্যই হয়ে থাকে।
সমস্ত বিশ্বকে প্রাপ্ত হয়েও যদি কেউ নিজের আত্মাকেই হারিয়ে ফেলে তাহলে কি লাভ নিশ্চিতরূপে এটা অনুভূতির প্রশ্ন। অনেক অর্থ, প্রতিপত্তি, দৈহিক সৌন্দর্য বা শক্তি থাকা সত্ত্বেও সুখ নেই।
সুখলাভের প্রকৃত রহস্য হচ্ছে নিয়ন্ত্রিত মন, যা ক্রমে ক্রমে ভগবদ্ভাবনাময় জীবন ধারার মাধ্যমে অর্জিত হয় ।
মন কি করে বন্ধু হতে পারে?
ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন
বন্ধুরাত্মাত্ম্রনস্তস্য যেনাত্মৈবত্মনা জিতঃ।
অনাত্মন্তু শত্রুত্বে বর্তেতাত্বৈব শত্রুবৎ।।(ভঃ গীঃ ৬/৬)
“যিনি তার মনকে জয় করেছেন, তাঁর মন তাঁর পরম বন্ধু, কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম, তার মনই তার পরম শত্রু।”
এইভাবে মনের প্রবৃত্তি সুখ বা দুঃখের কারণ হয়। মনকে একটা ধারালাে ছুরির সঙ্গেও তুলনা করা যেতে পারে।
দুবৃত্তরা ধারালাে ছুরি দিয়ে কাউকে হত্যা করতে বা কারাে অনিষ্ট সাধনে ব্যবহার করে, আবার একজন সুদক্ষ চিকিৎসক সে চুরি কারাে জীবন রক্ষা করতে ব্যবহার করেন।
সেক্ষেত্রে ছুরিটির কোনাে দোষ বা গুণ নেই। কারো মন যখন নিয়ন্ত্রিত থাকে তখন তার সাহায্যে জীবনের সর্বোত্তম পূর্ণতা লাভ করা যায়। তিনি স্বেচ্ছায় পরমেশ্বর ভগবানের (যিনি হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজমান) নির্দেশ মেনে চলেন।
এরূপ ব্যক্তি সুখ-দুঃখ, শীত-গ্রীষ্ম আদি জড় অস্তিত্বের দ্বৈত ভাবের দ্বারা বিচলিত হন না। এই অবস্থাই হলাে ব্যবহারিক সমাধি অথবা সর্বদা পরমেশ্বরের চিন্তায় মগ্ন থাকা।
ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অনিয়ন্ত্রিত মনের গতি-প্রকৃতি। সম্পর্কেও বর্ণনা করেছেন। ঐ প্রকার মন সবসময়ই বিভিন্ন প্রকার ইন্দ্রিয় তৃপ্তির পরিকল্পনা করে।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেন "ইন্দ্রিয়ের বিষয় সমূহ সম্বন্ধে. চিন্তা করতে করতে মানুষের তাতে আসক্তি জন্মায়, আসক্তি থেকে কাম উৎপন্ন হয় এবং কামনা থেকে ক্রোধ উৎপন্ন হয়। ক্রোধ থেকে সম্মােহ, সম্মােহ থেকে স্মৃতিবিভ্রম, স্মৃতিবিভ্রম থেকে বুদ্ধিনাশ এবং বুদ্ধিনাশ হওয়ার ফলে সর্বনাশ হয়। অর্থাৎ মানুষ পুনরায় জড়জগতের অন্ধকূপে অধঃপতিত হয়। (ভ গীঃ ২/৬২-৬৩)।
এইভাবে অসংযত মনই আমাদের এই জড় জগতে থাকাকালীন যাবতীয় দুর্দশার কারণ। যদি মন সংযত হয় তাহলে ইন্দ্রিয়গুলি আর আমাদের বিপদে ফেলতে পারে ।
বুদ্ধিকে অবশ্যই শক্তিশালী হতে হবে, যাতে মন তার (বুদ্ধি) নিয়ন্ত্রণে থাকে। আর তখন ইন্দ্রিয়গুলাে স্বাভাবিকভাবে সংযত হয়ে যাবে এবং তাকে (বুদ্ধি) অনুসরণ করবে।
রথের সারথীকে অবশ্যই দক্ষতার সঙ্গে চিৎকার করে, শক্তি প্রয়ােগ করে লাগামকে ধরে রাখতে হবে, যাতে ঘােড়াগুলি নিয়ন্ত্রণে থাকে। উৰ্দ্ধতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ নিয়মিতভাবে শ্রবণ করে বুদ্ধিকে যথেষ্ট শক্তিশালী করে তুলতে হবে।
ভগবদগীতায় ভগবান । শ্রীকৃষ্ণ বলেনঃ
তদবিদ্ধিপ্রনিপাতেন পরিপ্রশ্নেন সেবয়া।
উপদেক্ষ্যান্তি তে জ্ঞানং জ্ঞানিনস্ত্বদর্শিনঃ।(ভঃ গীঃ ৪/৩৪)
সদগুরুর শরাণাগত হয়ে তত্ত্বজ্ঞান লাভ করার চেষ্টা কর । বিনম্রচিত্তে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা কর এবং অকৃত্রিম সেবার দ্বারা তাঁকে সম্ভুষ্ট কর। তা হলে সেই তত্ত্বদ্রষ্টা পুরুষেরা তােমাকে জ্ঞান উপদেশ দান করবেন।
এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে বুদ্ধি আরাে শক্তিশালী হবে এবং অসংযত মন অচিরেই শান্ত হবে। পারমার্থিক শাস্ত্র নির্দেশ সমূহ বুদ্ধির খাদ্য স্বরূপ ।
ঐ সকল বুদ্ধি বৃত্তিকে বিকশিত করে এবং মনকে পবিত্র করে তােলে। যখন বুদ্ধি (চালক) দক্ষ ও শক্তিশালী হয়, তখন সে মনকে (লাগাম) দৃঢ়ভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, ফলে আত্মা (আরােহী) শান্তিপূর্ণভাবে ভ্রমণ করতে পারবে।
কিন্তু যতক্ষণ বুদ্ধি মনের থেকে দুর্বল থাকে, ততক্ষণে আমাদের জীবনে সুখ বা শান্তি কোনােটাই সম্ভব নয়।
মন্ত্র-ধ্যানের মাধ্যমে মনকে নিয়ন্ত্রন করার কচ্ছপের কৌশল
সদগুণাবলীর বিকাশ এবং জীবনে প্রকৃতই সুখী হতে হলে মনকে অবশ্যই সংযত করতে হবে। এ বিষয়ে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন -
যদা সংহরতে চায়ং কর্মোহঙ্গনীব সর্বশঃ
ইন্দ্রিয়ানীন্দ্রিয়াৰ্থেভ্যস্তস্য প্রজ্ঞা প্রতিষ্ঠিতা। (ভঃ গীঃ ২/৫৮)
“কূর্ম (কচ্ছপ) যেমন তার অঙ্গ সমূহ তার কঠিন বহিরাবরণের মধ্যে সঙ্কুচিত করে, তেমনই যে ব্যক্তি তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে ইন্দ্রিয়ের বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে নিতে পারেন, তাঁর চেতনা চিন্ময় জ্ঞানে প্রতিষ্ঠিত।"
ইন্দ্রিয়গুলিকে বিষধর সর্পের সঙ্গেও তুলনা করা হয়। তারা কোনাে নিয়ন্ত্রন ছাড়াই থাকতে চায়। কিন্তু আমাদের দক্ষ সাপুড়ের মতাে যথেষ্ট শক্তিশালী হওয়া দরকার যাতে ঐ সর্পগুলি (ইন্দ্রিয় সমূহ) ছােবল মারতে না পারে।
শাস্ত্রে অনেক উপদেশ দেওয়া হয়েছে। তার মধ্যে কতগুলি বিধি (করণীয়) এবং কতকগুলি নিষেধ (অকরণীয়)। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ প্রদত্ত কচ্ছপের দৃষ্টান্তটি এক্ষেত্রে খুবই উপযুক্ত।
কচ্ছপ যে কোন সময় নিজের ইন্দ্রিয়গুলিকে খােলসের মধ্যে গুটিয়ে নিতে পারে আবার পুনরায় প্রয়ােজনে বিশেষ উদ্দেশ্যে তা প্রকাশ করে।
জীবনে বিধিনিয়ম পালনেই প্রকৃত স্বাধীনতা
আমাদের অবশ্যই এই প্রকার কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকা উচিত যা মনকে চেতনাকে কলুষিত করে তােলে। প্রাথমিকভাবে সেগুলি হল-আমিষাহার, জুয়াখেলা, মাদকগ্রহণ বা নেশা ও অবৈধ যৌনক্রিয়া।
এই কার্যকলাপগুলি অবশ্যই কঠোরভাবে বর্জন করা উচিত। বেশির ভাগ লোকই বলে, “কেন আমি যা চাই তা থেকে আমাকে বিরত হতে বলছেন? আমি সম্পূর্ণরূপে স্বাধীন থাকতে চাই এবং আমি যা পছন্দ করি তা করতে চায়।"
প্রকৃতপক্ষে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই বিধিনিষেধ সমূহকে "স্বাধীনতার প্রধান নিয়ামক হিসেবে বর্ণনা করেছেন। কেউ প্রশ্ন করতে পারে, "কি ধরনের স্বাধীনতা এটা? সীমাবদ্ধতা অর্থাৎ বিধিনিষেধ পালন মানে স্বাধীন নয়।
" তারা বােঝেন না খারাপ অভ্যাসগুলি অনুশীলন করলে তাদের ইন্দ্রিয়ের অধীন হয়ে যেতে হবে। উদাহরণ স্বরূপ একজন ধূমপায়ী বলতে পারে, "আমি ধূমপান করি, কারণ আমি এটা পছন্দ করি, যা আমাকে আমার কাজে মনসংযােগ করতে সাহায্য করে, খুশীর আমেজ প্রদান করে।
যখন দেখব খারাপ লাগছে তখন ছেড়ে দেব।” তারা এটা বলে শুধুমাত্র অহঙ্কারে স্ফীত হয়ে। প্রকৃতপক্ষে এই ধরনের লােকেরা তাদের অভ্যাসের দাস হয়ে পড়ে এবং জীবনে ছাড়তে পারে না।
পাশ্চাত্যদেশের লােকেরা 'স্বাধীনতা নামে, অবাধ যৌনজীবন, মদ্যপান ইত্যাদিতে লিপ্ত হয় এবং ঐসব কার্যকলাপে অত্যধিক আসক্ত হয়ে পড়ে।
তাদের মন কখনােই পরিতৃপ্ত হয় না এবং তাদেরকে উৎপীড়িত ও উত্তেজিত করে এসব পাপময় কার্যকলাপে নিয়োজিত করে। পাশাপাশি তারা ভয়ঙ্কর সব রােগে যেমন এইডস্, ক্যান্সার ইত্যাদিতে আক্রান্ত হয়। অবশেষে এই সমস্ত পাপ কর্মের ফলে তাদের নরকের পথ প্রশস্ত হয়।
অলস মন শয়তানের কারখানা
কেউ প্রশ্ন করতে পারে, আপনি আমাকে কতকিছু কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকতে বলছেন, তাহলে আমার কি করা উচিত? আমি অলস নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকতে পারি না।
"আমাকে অবশ্যই কিছু না কিছু করতে হবে!!!” এটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যে ইন্দ্রিয়গুলিকে শ্রেষ্ঠ পারমার্থিক কার্যকলাপে নিয়ােজিত করা।
ইন্দ্রিয়সমূহ এতই বলবান এবং ক্ষোভকারী যে তারা অতি যত্নশীল বিবেকসম্পন্ন পুরুষের মনকেও বলপূর্বক বিষয়াভিমুখে আকর্ষণ করে (ভঃ গীঃ ২/৬০)।
তাই মন এবং ইন্দ্রিয় সমূহকে যদি কৃষ্ণভাবনাময় আদর্শ কার্যকলাপে নিয়ােজিত করা হয়, তাহলে তারা সহজেই জড় ইন্দ্রিয় তৃপ্তির দিকে টেনে নিয়ে যাবে।
অনেক ঋষি, মুনি, দার্শনিক ও অধ্যাত্মবাদী আছেন, যারা ইন্দ্রিয়গুলােকে দমন করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু ঐকান্তিক চেষ্টা সত্ত্বেও, এমনকি তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠগণেরও, উত্তেজিত মনের কারণে সংযমের বাঁধ ভেঙ্গে যায়।
মহর্ষি বিশ্বামিত্রের মতাে যােগী,যিনি তার মন ও ইন্দ্রিয়কে সংযত করবার জন্য গভীর নিষ্ঠার সঙ্গে কঠোর তপস্যায় রত ছিলেন, তিনি স্বর্গের অপ্সরা মেনকার রূপে মুগ্ধ হয়ে কামান্ধ হয়ে অধঃপতিত হন।
পৃথিবীর ইতিহাসে এইরকম উল্লেখ পাওয়া যায়। এর থেকে বােঝা যায়, কৃষ্ণভক্তি ছাড়া মন ও ইন্দ্রিয়কে সংযত করা অত্যন্ত কঠিন। মনকে শ্রীকৃষ্ণের ভাবনায় নিয়ােজিত না করে, কেউই জাগতিক কার্যকলাপ থেকে বিরত হতে পারে না।
দুটি বিষয়ের মাধ্যমে মনকে বসে আনা যায়
ইন্দ্রিয় সমূহকে জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার ও তাদের ভগবানের সেবায় নিয়োগ।
মহর্ষি বিশ্বামিত্রের ঠিক বিপরীত ঘটনা আমরা দেখতে পাই শ্রীল হরিদাস ঠাকুরের জীবনে। হরিদাস ঠাকুর সম্পূর্ণরূপে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্যনাম জপে নিমগ্ন ছিলেন।
হরিদাস ঠাকুরের কাহিনী
তিনি প্রত্যহ তিনলক্ষ নাম জপ করতেন। এই অসাধারণ সাধুটির দেহ নাম জপের দিব্য শক্তি দ্বারা পরিচালিত হত; তিনি সবসময় সমাধিমগ্ন থাকতেন। তাছাড়া তিনি কদাচিৎ ঘুমাতেন। হরিদাস ঠাকুরের দিব্য মহিমায় শত শত লােক তাকে শ্রদ্ধা ও সম্মান জানাত।
কিন্তু রামচন্দ্র খান নামে সাধুবিদ্বেষী এক জমিদার হরিদাস ঠাকুরের দিব্য মহিমায় ঈর্ষান্বিত হয়ে তাঁকে অপদস্তের মানসে এক পরিকল্পনা করল।
সে এক সুন্দরী কে গভীর রাত্রে হরিদাস ঠাকুরকে প্রলুদ্ধ করার জন পাঠালাে। বেশ্যাটি মনােমুগ্ধকর ভাবে সজ্জিত হওয়ার পর হরিদাস ঠাকুরের কুড়ে ঘরে গমন করে।
হরিদাসকে বিচলিত করবার জন্য সেই বেশ্যা নানা প্রকার অঙ্গ ভঙ্গি করতে লাগল এবং নিজ বক্ষস্থলের কাপড় সরিয়ে কুটীরের দুয়ারে বসে মধুর স্বরে বলতে লাগল-“ঠাকুর, তুমি পরম সুন্দর, এবং তােমার সুন্দর যৌবন, তােমাকে দেখে কোন নারী স্থির থাকতে পারে?
তােমার সঙ্গ সুখ উপভােগ করার জন্য আমার অন্তর লালায়িত হয়েছে। তােমাকে না পেলে আমি আমার প্রাণ ধারণ করতে পারব না।
বেশ্যাকে হরিদাস ঠাকুর উত্তর দিলেন-“নিশ্চয় তােমাকে আলিঙ্গন করব, তবে সংখ্যাপূর্বক আমার নাম গ্রহণ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত তুমি বসে আমার নামকীর্তন শ্রবণ কর;
তারপর নাম সমাপ্ত হলে আমি তােমার মনােবাসনা পূর্ণ করব।" কিন্তু রাত্রি শেষ হয়ে এলে বেশ্যাটি বিচলিত হয়ে পড়ল, তখন হরিদাস ঠাকুর বললেন,
আমি একমাসে এক কোটি নাম জপ গ্রহণ করার সংকল্প করেছি যজ্ঞ প্রায় শেষ হয়ে এলাে। কিন্তু সারারাত জপ করেও কোটি নাম গ্রহণ সমাপ্ত হল না।
কাল অবশ্যই সেই ব্রত সমাপ্ত হবে এবং তখন স্বচ্ছন্দে আমি তােমার সঙ্গ উপভােগ করব।” বেশ্যাটি তখন চলে গেল এবং পরের দিন সন্ধ্যা হতে না হতেই হরিদাস ঠাকুরের কাছে গেল,
সারারাত ধরে হরিদাস ঠাকুর "হরেকৃষ্ণ" মহামন্ত্র জপ কীর্তন করলেন, এবং এইভাবে রাত্রি ভাের হল। ইতিমধ্যে (এইভাবে তিনদিন পর) হরিদাস ঠাকুরের সঙ্গ প্রভাবে বেশ্যার মন সম্পূর্ণরূপে পরিবর্তিত হয়ে গেল ।
সেই বেশ্যা নির্মল হৃদয়ে হরিদাস ঠাকুরের পাদপদ্মে পতিত হয়ে ক্রন্দন করে বলতে লাগল, "দয়া করে বলুন কিভাবে আমি এই জড় জাগতিক দুঃখ দুর্দশা থেকে মুক্ত হতে পারি।”
হরিদাস ঠাকুর তখন তাকে বললেন- “তুমি নিয়মিত ভাবে “হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন কর এবং তুলসীকে জলদান ও প্রার্থনা নিবেদন করার মাধ্যমে তুলসী সেবা কর, অচিরেই তুমি ভক্তি লাভ করবে।”
হরিদাস ঠাকুর বেশ্যার দ্বারা বিন্দুমাত্র বিচলিত হননি, অপরপক্ষে সেই বেশ্যা এক মহান ভক্তে পরিণত হলেন। যখন কেউ ভক্তিমূলক সেবায় (কৃষ্ণভাবনাময় জীবনে) নিয়ােজিত হন, তখন জড় আসক্তি দূর হয়ে যায়।
শ্রীকৃষ্ণ গীতায় বর্ণনা করেছেন-কিভাবে পাপ পরিত্যাগ করার পাশাপাশি ইন্দ্রিয় মনকে তার সেবায় নিয়ােজিত করার মাধ্যমে আমাদের চেতনাকে কৃষ্ণভাবনাময় রাখা যায়। ভগবদগীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন
“যিনি সম্পূর্ণরূপে সংযত চিত্তে আমার প্রতি ভক্তিপরায়ন হয়ে তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে সম্পূর্ণরূপে বশীভূত করেছেন, তিনি স্থিতপ্রজ্ঞ।"
আমাদের মন ইন্দ্রিয়সমূহকে অনুকূল পারমার্থিক কার্যকলাপে নিয়ােজিত করার মাধ্যমে মনকে নিয়ন্ত্রণ করার নিশ্চিত সহজ হয়।
বৈদিক যুগে ধর্মপরায়ণ রাজারা প্রজাদের নিকট কর আদায় করে তা কৃষ্ণভাবনা মন্দির নির্মাণ করতেন যা বৈদিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিশ্ববিদ্যালয়ের ন্যায়।
নগরের কেন্দ্রস্থলে বিরাট মন্দির নির্মিত হত যেখানে অনেক লােক একত্রে সমবেত হয়ে পারমার্থিক শিক্ষা লাভ করতে পারতেন।
এই সমস্ত রাজারা কেবলমাত্র বিশ্বজুড়ে কৃষ্ণভাবনা প্রসারে সাহায্যেই করতেন না, তাঁরা নিজেরাও অত্যন্ত কঠোরভাবে নিজেদের জীবনে ভক্তি অনুশীলন করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করতেন যাতে তা অনুসরণ করে সাধারণ মানুষও পারমার্থিক অগ্রগতি লাভ করে ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার পথ প্রশস্ত করতে পারে।
এইরকম একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলেন মহানভক্ত অম্বরীষ মহারাজ। তিনি নিজের সমস্ত ইন্দ্রিয়কে ভগবানের সেবায় নিয়ােজিত করে কামনা বাসনাকে জয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন, যা শ্রীমদ্ভাগবতে (৯/৪/১৮- ২০) উল্লেখ আছে।
সমস্ত সমস্যার সমাধান
যখন আমরা আমাদের প্রধান কর্তব্য ভগবানের সেবা করা।কিন্তু আমরা ভুলে যাই, তখন জোর পূর্বক আমাদের হৃদয়ে কাম, ক্রোধ আদির সেবা করতে হয় যা পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে।
এখন আমরা ভগবানের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক ভুলে গিয়েছি এবং বৈদিক সাহিত্যে যােগ-পদ্ধতির বর্ণনা করা হয়েছে যার সাহায্যে পরমেশ্বর ভগবানের সঙ্গে। আমাদের প্রেমময়ী সম্পর্কের পুনর্জাগরণ ঘঠাতে পারি।
ভগবানকে লাভ করার বিভিন্ন যােগ প্রণালী রয়েছে। কিন্তু বর্তমান এই কলহ ও প্রতারণার কলিযুগে একমাত্র প্রণালী ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন করা। বৃহন্নারদীয় পুরাণে অত্যন্ত জোর দিয়ে বলা হয়েছেঃ
হরেনাম হরেনাম হরেনামৈব কেবলম্। কলৌ নাস্তৈব্য নাস্তৈব্য নাস্তৈব্য গতিরন্যথা।
"এই কলিযুগে ভগবানের দিব্য হরিনাম কীর্তন করা ছাড়া আর অন্য কোন গতি নেই, আর অন্য কোন গতি নেই, আর অন্য কোন গতি নেই।"
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র ও মনের মহা পরিত্রাতা।
মন্ত্র' কথাটির অর্থ যা মনকে ত্রাণ করে। মহামন্ত্র অর্থাৎ মনের সর্বশ্রেষ্ঠ পরিত্রাতা। ভগবানের দিব্যনাম কীর্তন ছাড়া আর কোনাে কৃত্রিম পন্থা নেই যা আমাদের ভগবৎ চেতনায় পুনর্জাগরন ঘটাতে পারে।
জপধ্যান হচ্ছে অনুমোদিত ভগবৎ নামের পুনঃ পুনঃ অনুশীলন। এই প্রকার নামজপ জপকারীর হৃদয় থেকে সমস্ত কলুষ দূর করে এবং শুদ্ধ পারমার্থিক চেতনায় উন্নীত করে।
ভগবানের শত শত নাম রয়েছে, যা পূর্ণরূপে শক্তিসম্পন্ন। কিন্তু কলিযুগের অনুশীলনীয় হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র।
নিজেকে কলিযুগের কলুষ থেকে মুক্ত রাখতে এই হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তন করার অন্য কোনো মহান পন্থা সমস্ত বৈদিক শাস্ত্র গ্রন্থে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
যখন আপনি কোনাে ঔষধের দোকানে যাবেন, যদিও সেখানে শত শত প্রকার ঔষধ পাওয়া যায়, তবুও কেবলমাত্র আপনার ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী নির্দিষ্ট ঔষধই আপনি নেবেন।
অনুরূপভাবে এই নির্দিষ্ট কলিযুগের জন্য হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্রই অনুমােদিত। এই অপ্রাকৃত শব্দ তরঙ্গ, ভগবানের দিব্য নামের প্রভাব সার্বজনীন নীতি।
যেমন পদার্থ বিদ্যার মাধ্যাকর্ষণ বা অন্য কোনো সূত্র। যিনি যত্নসহকারে নাম জপ অনুশীলন করবেন, নিঃসন্দেহে উচ্চতর সুখ এবং মনের শান্তি অনুভব করতে পারবেন।
হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ করার প্রক্রিয়া
জপমালাটি ডান হাতে নিন এবং বৃদ্ধাঙ্গুলি ও মধ্যমার মাঝখানে ধরুন (চিত্র দেখুন)। তর্জনীটিকে কলুষিত বিবেচনা করা হয়, তাই এটিকে জপমালায় ব্যবহার (বা স্পর্শ) করা হয় না।
প্রধান গুটিটির পরবর্তী গুটিটি থেকে শুরু করুন। জপ করার পূর্বে, পঞ্চতত্ত্বে মন্ত্রটি উচ্চারণ করুনঃ "জয় শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য প্রভু নিত্যানন্দ শ্রী অদ্বৈত শ্রীবাসাদি গৌর ভক্তবৃন্দ।
এখন মহামন্ত্র জপ করুনঃ
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।
তারপর পরবর্তী গুটিতে যান। এভাবে ১০৮ বার জপ করার পর, আপনি পুনরায় প্রধান গুটিতে পৌছবেন এবং তখনই একমালা পূর্ণ হবে।
এখন প্রধান গুটিটি অতিক্রম না করে মালাটি ঘুরিয়ে নিন এবং পুনরায় পঞ্চতত্ত্ব মন্ত্র উচ্চারণ করে পরবর্তী মালা শুরু করুন।
জপ করা সহজ কিন্তু সর্বোত্তম ফলের জন্য যথাযথভাবে সম্পন্ন করা উচিত। জপ অন্ততঃপক্ষে যথেষ্ট উচ্চস্বরে করা উচিত যাতে জপকারীর নিকটবর্তী লােকটি তা শুনতে পায়।
জপ করার সময়, মহামন্ত্রের প্রতিটি শব্দ শ্রবণে মনোনিবেশ করুন। এই মনােনিবেশই হল মন্ত্র-ধ্যান এবং আমাদের হৃদয়কে পরিষ্কার করতে শক্তিশালী।
যদিও মনের ইতস্তত ভ্রমণ থামানাে কঠিন কিন্তু অভ্যাসের দ্বারা তা সম্ভব। উল্লেখ্য যে, মহামন্ত্র এমনভাবে জপ করা উচিত যাতে প্রতিটি শব্দাংশে স্পষ্টভাবে শােনা যায়।
জপ করার উৎকৃষ্ট সময় হল ভাের বেলা (সূর্যোদয়ের পূর্বে, ব্রাহ্মমুহূর্তের সময়) জপ যে কোন অবস্থায় করা যায়- বাসে, ট্রেনে, কাজে যাওয়ার সময় অথবা রাস্তায় হাঁটার সময়- কিন্তু দৈনন্দিন কার্যকলাপ শুরু করার পূর্বে, প্রতিদিনের নির্দিষ্ট সংখ্যক মালাজপ সকালবেলা ভােরে পূর্ণ মনােনিবেশের সাথে সম্পন্ন করা সর্বশ্রেষ্ঠ।
হরে কৃষ্ণ হরে কৃষ্ণ কৃষ্ণ কৃষ্ণ হরে হরে।
হরে রাম হরে রাম রাম রাম হরে হরে।
আরও পড়ুনঃ
* হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপের মাহাত্ম্য
* আমাদের দুঃখ পাওয়ার প্রকৃত কারণ কি
জন্ম সার্থক হল,এই বইটি পাঠ করে।