শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাবের কারণ

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর প্রেমধর্ম, গৌরাঙ্গ মহাপ্রভুর আবির্ভাবের কারণ

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর কৃপা

হিংসা সর্বদাই প্রেমের পরিপন্থী। চৈতন্যদেবের প্রেমধর্মে তাই হিংসার স্থান নেই। ভালোবেসে কাউকে যতটা আপন করে কাছে টেনে নেয়া যায়, হিংসার মাধ্যমে তা কখনোই সম্ভব নয়। আর এ কারণেই চৈতন্যদেবের প্রেমধর্ম প্রচারকারী অন্যতম সংস্থা ইসকনের জয়জয়কার আজ বঙ্গদেশের সীমা পেরিয়ে পৃথিবীজুড়ে পরিব্যাপ্ত।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর আবির্ভাবের  সময়কাল


 ১৪৮৬ সাল। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নবদ্বীপ তখন বিদ্যাশিক্ষার পীঠস্থান। পান্ডিত্যের অহঙ্কারে বরণীয় পন্ডিতগণের চরণ যেন ভুমিস্পর্শ করে না। আবার, অধর্মের অভ্যুত্থান তখন পৃথিবীর সর্বত্র তো ছিলই, বিশেষত বঙ্গদেশে তখন ধর্মপ্রাণ, নিরীহ মানুষের প্রতি দুর্বিনীত আসুরিক প্রাণীদের যাদের রক্তবীজ এখনো জনসমাজে বিদ্যমান, যাদের আমি মানুষ বলে মানুষ নামে কলঙ্ক জড়াতে চাই না; তাদের অন্যায়-অবিচার, অত্যাচার, হিংসা, লুণ্ঠন, মিথ্যাচার, আর চুরি, ডাকাতি আদি অনাচার এবং বর্ণ-ধর্ম নিয়ে জাতপাতের ভেদাভেদাদি অধর্ম চরমে পৌঁছেছিল। 

শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দৃপ্ত বাণীর সার্থক রূপদানে, প্রায় সাড়ে পাঁচশত বছর পূর্বে, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার শ্রীধাম মায়াপুরে, ধরণীর কোল আলোকিত করে, পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অবতীর্ণ হয়েছিলেন ‘শ্রীকৃষ্ণচৈতন্য’ নাম ধরে, যাঁর নামানুসারে বাংলা সাহিত্যে এক নবযুগের সূচনা হয়, যাকে বলা হয় ‘চৈতন্যযুগ’। 

পিতা জগন্নাথ মিশ্র তাঁর নাম রাখেন বিশ্বম্ভর। সুবর্ণ বর্ণ অঙ্গকান্তির জন্য তাঁকে গৌরাঙ্গ, গৌরহরি নামেও ডাকা হয়। আবার, দিগ্বজয়ীবিজিত নিমাই পন্ডিত নামে তিনি সকলের পান্ডিত্যের অহঙ্কার বিচূর্ণ করেছিলেন। হিংসা-দ্বেষ, জাতিভেদ ভুলিয়ে, অহিংসার বাণী শুনিয়ে, সাম্প্রদায়িকতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে, সকলের হৃদয় জয় করে চৈতন্যদেব প্রচার করেছিলেন বিশ্বমানবতার ধর্ম-প্রেমধর্ম, যা বৈষ্ণবধর্ম নামে সুবিদিত। বৈদিক শাস্ত্রে নির্দেশিত, শ্রীচৈতন্যদেবের প্রদর্শিত সেই বৈষ্ণব দর্শনই আজ প্রচারিত হয়েছে বিশ্বব্যাপী, যার অপ্রতিরোধ্য ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন শ্রীচৈতন্যদেব স্বয়ং- “পৃথিবীতে আছে যত নগরাদি গ্রাম। সর্বত্র প্রচার হেইবে মোর নাম।।” 

এই বৈষ্ণবধর্ম তথা প্রকৃত সনাতন ধর্ম বিশ্বায়নে যে সংগঠনটি অর্ধশতাধিক বছর ধরে নিয়ত প্রগতিশীল, তা হলো আন্তর্জাতিক কৃষ্ণভাবনামৃত সংঘ (ইসকন) ১৯৮৬ সালে আমেরিকার নিউইয়র্ক শহরে ভারতীয় সন্ন্যাসী কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি শ্রীল অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সেই ভবিষ্যদ্বাণী এবং নিজ গুরুদেব শ্রীল ভক্তিসিদ্ধান্ত সরস্বতী ঠাকুরের আদেশ শিরোধার্য করে পৃথিবীব্যাপী ভগবানের বাণী প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এই সংস্থাটি প্রতিষ্ঠা করেন। জগদ্ব্যাপী কৃষ্ণভক্তিরূপ প্রেমধর্ম প্রচার করার মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠাই এই সংস্থার মূল লক্ষ্য।

শ্রীচৈতন্যদেবের প্রদর্শিত বৈষ্ণব দর্শনের আদর্শ কীরূপ এবং ইসকন কীভাবে তা ধারণ ও প্রসারের মাধ্যমে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা রাখছে, তারই একটি চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হলো এই প্রবন্ধে।

বাঙালির হৃদয়ের ধন চৈতন্যদেব

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু বাংলাভাষায় কোনো সাহিত্য রচনা করেননি। তথাপি তিনি এমনই এক মহান ব্যক্তিত্ব, যাঁর নামানুসারে বাংলা সাহিত্যে চৈতন্যযুগ নামে এক নবযুগের অভ্যুদ্বয় হয়। তাঁর অনিন্দ্য রূপমাধুরী, অমিয় বচন, অগাধ পান্ডিত্য এবং ধনী দরিদ্র, বিদ্ধান-মুর্খ, আর জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে অপামর জনসাধারণের প্রতি তাঁর অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং সকলকে প্রেমের শৃঙ্খলে বেঁধে মানবমুক্তির যে শান্তির পথ তিনি প্রদর্শন করেছেন- তা-ই সমগ্র বাংলার মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। তাঁকে নিয়ে নানা নামে, নানা ঢঙে রচিত হয়েছে বাংলাসাহিত্যের বিখ্যাত গ্রন্থসম্ভার- যেমন, চৈতন্যমঙ্গল, চৈতন্যভাগবত, ভক্তিরত্নাকর, অমিয় নিমাই চরিত ইত্যাদি।

সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো শ্রীল কৃষ্ণদাস কবিরাজ গোস্বামীকৃত ‘শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত’। এতে চৈতন্যদেবের অনবদ্য জীবনীর পাশাপাশি রয়েছে বিভিন্ন শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত, তত্ত্ব, ও বৈষ্ণব দর্শনের সুবিস্তৃত চমৎমার বর্ণনা। এরও পরবর্তীকালে চৈতন্যদেবের আদর্শকে কেন্দ্র করে বৈষ্ণব কবিগণ রচনা করেছেন বহু গীতি।


আজ বিশ্বব্যাপী প্রতিটি ইসকন কেন্দ্রে প্রতিদিন কয়েকবার করে গাওয়া হয় সেসকল বাংলা গীতি। সেগুলোর মর্মার্থ ও চৈতন্যমহাপ্রভুর জীবন-দর্শন উপলব্ধি করার অভিলাষে বিশ্বের বিভিন্ন ভাষাভাষী মানুষ বাংলা ভাষাকে আয়ত্ব করেছে। সুতরাং, বাঙালির বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর প্রতিটি দ্বারপ্রান্তে পৌছে দিতে যাঁর অবদান সর্বাগ্রে, তিনি আর কেউ নন, বাঙালি জাতির গর্ব শ্রীচৈতন্যদেব এবং তা সম্ভব হয়েছে ইসকন প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য শ্রীল প্রভুপাদের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায়।

বাংলা সাহিত্যে শ্রীচৈতন্যদেবের মাধ্যমেই প্রথম জীবনীসাহিত্যের প্রচলন শুরু হয়। বাংলাসাহিত্যের চৈতন্য-উত্তরযুগের বহু স্বনামধন্য সাহিত্যিক ছিলেন চৈতন্যগুণমুগ্ধ।


জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম চৈতন্যদেবের গুণ গেয়েছেন এভাবে-
বর্ণচোরা ঠাকুর এল রসের নদীয়ায়, তোরা দেখবি যদি আয়
আবার কেউ বলে তায় গৌরহরি, কেউ আবার বলে তায়।। 

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু সম্পর্কে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর ‘আমরা’ কবিতায় লিখেছেন- 
“ঘরের ছেলের চক্ষে দেখেছি বিশ্বভূপের ছায়া। 
বাঙালির হিয়া অমিয় মাথিয়া নিমাই ধরেছে কায়া।” 
অর্থাৎ, বাঙালির অমৃতময় হৃদয় মন্থন করে যে কায়া ধারণ করেছে, তা হলো নিমাই, যাঁর হৃদয় কমলের চেয়েও কোমল। 

শ্রীচৈতন্যদেব সম্পর্কে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, “আমাদের বাঙালির মধ্য হইতেই তো চৈতন্য জন্মেছিলেন, তিনি তো বিঘা কাঠার মধ্যেই বাস করিতেন না, তিনি তো সমস্ত মানবকে আপনার করিয়াছিলেন, তিনি বিস্তৃত মানবপ্রেমে বঙ্গভূমিকে জ্যোতির্ময়ী করিয়া তুলিয়াছিলেন।”

শ্রীচৈতন্যদেব প্রসঙ্গে শ্রীমৎ গৌররায় গোস্বামী তাঁর বৈদুর্য্য প্রবন্ধাবলীতে লিখেছেন- “ঊনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর প্রখ্যাত কবি ও সাহিত্যিকগণের বিপুল রচনা সম্ভারেও চৈতন্য চরিত, বৈষ্ণব দর্শন রসসাহিত্যের প্রভাব বহুলভাবে লক্ষ্য করা যায়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ, কান্তকবি রজনীকান্ত, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কবি শেখর কালিদাস রায়, বিদ্রোহী কবি নজরুল; সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র; অমর কথাশিল্পী শরৎচন্দ্র প্রভৃতির সাহিত্যকর্মে মহাপ্রভুর প্রেমধর্মের ও ভক্তিভাবের ভাবসম্মিলন লক্ষ্য করা যায় বিশেষভাবে।” বাঙালির হৃদয়ের ধন চৈতন্যদেব আজ শুধু বাঙালির নন, গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রাণপুরুষ।

বিদগ্ধজনে শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব

শ্রীচৈতন্যদেবের প্রভাব কেবল দীন-হীন, দরিদ্র মানুষের মধ্যেই পড়েছিল তা নয়। সমাজের উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরাও তাঁর আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। ঊড়িষ্যার মহারাজ প্রতাপরুদ্র, বিখ্যাত বেদান্ত-পন্ডিত শ্রী সার্বভৌম ভট্রাচার্য, দিগ্বিজয়ী পন্ডিত কেশব কাশ্মিরী, সপ্তগ্রামের জমিদার পুত্র রঘুনাথ দাস গোস্বামী, বিদ্যানগরের অধিকারী রায়রামানন্দ, গৌড়ের বাদশা হোসেন শাহ্ এর প্রধানমন্ত্রী শ্রী সনাতন গোস্বামী ও মন্ত্রী শ্রীরূপ গোস্বামী, চাঁদকাজী, হোসেন শাহের পূর্ববর্তী রাজা সুবুদ্ধি রায় প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়ে তাঁর প্রতি অনুরক্ত হন।

সকল জীবের প্রতি সম্মান দান

বৈদিক শাস্ত্র অনুসারে, পরমেশ্বর ভগবান পরমাত্মারূপে প্রতিটি জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন (সর্বভূতান্তরাত্মা-কঠোপনিষদ-২.৯-১২); আবার, প্রতিটি জীব সেই পরমাত্মারই ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশ, যে কথা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন- মমৈবাংশো জীবলোকে জীবভূত সনাতনঃ। তাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু শিক্ষা দিয়েছেন-

জীবের স্বরূপ হয় কৃষ্ণের নিত্য দাস। 
কৃষ্ণের তটস্থা শক্তি ভেদাভেদ প্রকাশ।।

আবার, যেহেতু প্রতিটি জীব ভগবানেরেই অনুসদৃশ অংশ ও তাঁর নিত্য সেবক এবং প্রত্যেকের হৃদয়ে ভগবান পরমাত্মারূপে বিরাজ করেন, তাই মহাপ্রভু প্রতিটি জীবকেই সম্মান প্রদর্শনের আদর্শ দেখিয়েছেন তাঁর দিব্য লীলাবিলাসকালে। অমানিনা মানদেন- নিজে মানশূন্য হয়ে অপরকে সম্মান দান করা। তিনি বলেন- 
জীবে সম্মান দিবে জানি কৃষ্ণ অধিষ্ঠান। 

মহাপ্রভুর এই আদর্শ অনুসরণে গৌড়ীয় বৈষ্ণবগণ তথা ইসকন ভক্তগণ মানুষ তো দূরে থাক, কখনো কোনো প্রাণকে কষ্ট দিতে চান না। তাঁরা এমনকি একটি নগণ্য পিপীলিকাকেও জেনে হত্যা করেন না। জীবন ধারণের জন্য এক জীবকে অপর জীবের ওপর নির্ভরশীল হতেই হয়, তবু রসনার লালসায় মুখে মানবতার বুলি আওড়িয়ে যেন নিরীহ প্রাণীদের হত্যা করতে না হয়, সেজন্য তাঁরা শাকাহারী। হ্যা, বৃক্ষলতারও প্রাণ আছে। কিন্তু তাদের চেতনা আচ্ছাদিত; তাই তারা অন্যান্য প্রাণীর ন্যায় তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করে না। 


তবুও, এমনকি তাদেরও হত্যা করার পাপ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বৈষ্ণবগণ সাত্ত্বিক আহার্য্য ভগবানকে নিবেদন করে, তাঁর প্রসাদরূপে গ্রহণ করেন, যা তাঁদের সত্ত্বগুণ বিকশিত করে চেতনাকে শান্ত, নির্মল ও উন্নত করে তোলে। ফলে তাঁরা সকলকেই যথাযোগ্য সম্মান দান করেন। 

প্রেমধর্মই শ্রীচৈতন্যদেবের আদর্শ 

হিংসা সর্বদাই প্রেমের পরিপন্থি। চৈতন্যদেবের প্রেমধর্মে তাই হিংসার স্থান নেই। ভালোবেসে কাউকে যতটা আপন করে কাছে টেনে নেওয়া যায়, হিংসার মাধ্যমে তা কখনোই সম্ভব নয়। আর কারণেই চৈতন্যদেবের প্রেমধর্ম প্রচারকারী অন্যতম সংস্থা ইসকনের জয়জয়কার আজ বঙ্গদেশের সীমা পেরিয়ে পৃথিবীজুড়ে পরিব্যাপ্ত। মহাপ্রভু তাঁর নামপ্রেমের দ্বারা তৎকালীন সবচেয়ে পাপীষ্ঠ, পাষন্ডী জগাই-মাধাইকেও বুকে টেনে নিয়েছিলেন। 

মহাপ্রভুর পরম ভক্ত শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুকে মাধাই কলসির কানার আঘাতে রক্তাক্ত করেছিলেন। তথাপি মহাপ্রভুর শিক্ষায় অনুপ্রাণিত নিত্যানন্দ তাকে প্রেমপূর্ণ আলিঙ্গন দান করেছিলেন। এভাবে চৈতন্যদেব নামপ্রেমের দ্বারা তাদের মুক্ত করেছিলেন পাপময় ঘৃণিত জীবনের বন্ধন থেকে, দেখিয়েছিলেন উত্তরণের পথ-প্রেমধর্ম। 

“প্রভু কহে আমি বিশ্বম্ভর নাম ধরি। 
নাম সার্থক হয় যদি প্রেমে বিশ্ব ভরি।”
(চৈ.চ. আদি ৯.৭) 

মহাপ্রভু সম্পর্কে শ্রীমৎ গৌররায় গোস্বামী লিখেছেন- “জীবেশ্বরের ও জীবের মধ্যে এই মধুরভাবের সাধনার পরিসীমাই শ্রীচৈতন্যের প্রেমধর্মে পর্যবসিত। এই ভালোবাসাই নিখিল বিশ্বের সঙ্গে বিশ্বমানবের মধ্যে প্রেম ও মৈত্রীর সেতুবন্ধন করে। তাই শ্রীদীনেশচন্দ্র সেন লিখেছিলেন, ‘প্রেম একবারই মূর্তি পরিগ্রহ করেছিল, তা এই বাংলার নদীয়ায়।’ যুগমানব হিসেবে শ্রীচৈতন্যের এখানেই সার্থকতা। আর সেই অবিস্মরণীয় প্রভাব যা দীন দরিদ্র, দলিত, অবহেলিত মানুষ থেকে সমাজের উচ্চস্তরের সমৃদ্ধ জনগণকেও ত্যাগ ও ভালোবাসার আদর্শে অনুপ্রাণিত করেছিল।” 

জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে চৈতন্যদেবের অহিংস দর্শন

বাংলায় তখন মুসলিম শাসন। চাঁদকাজী মহাপ্রভুর সংকীর্তনে বিঘ্ন সৃষ্টি করতে ভক্তদের মৃদঙ্গ ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। পরম স্রষ্টার পরম মঙ্গলময় নামোচ্চারণে বাধা দান ও তাঁর ভক্তদের প্রতি লাঞ্ছনার মতো এমন ঘৃণিত কার্যের কথা শ্রবণ করে মহাপ্রভুর তাৎক্ষণিক ক্রোধ  প্রকাশ ছিল খু্বই স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু যেহেতু চৈতন্যদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন নামপ্রেমের দ্বারা বিশ্ববাসীকে জয় করতে, তাই তিনি লক্ষ লক্ষ ভক্ত পরিবৃত হয়ে কৃষ্ণনাম-সংকীর্তন সহযোগে কাজীর বাড়িতে উপস্থিত হয়েছিলেন। তিনি কাজীর ঘরে গিয়ে অত্যন্ত শান্তভাবে তা সঙ্গে মধুর ব্যবহার করেছিলেন, শাস্ত্রযুক্তির মাধ্যমে কাজীর সঙ্গে সমঝোতা করেছিলেন। 

এত শুনি’ কাজীর দুই চক্ষে পড়ে পানি। 
প্রভুর চরণ ছুই’ বলে প্রিয় বাণী।। 

জগতে শান্তিপ্রতিষ্ঠার জন্য কৃষ্ণনাম সংকীর্তনের গুরুত্ব কাজী অনুভব করলেন। তিনি তার ভুল স্বীকার করে মহাপ্রভুর চরণকমল স্পর্শ করে তাঁর কাছে কৃপা প্রার্থনা করেছিলেন এবং প্রতিজ্ঞা করেছিলেন যে, এরপর থেকে তার বংশের কেউ যদি কখনো মহাপ্রভুর নামসংকীর্তনে বাধা দেয়, তবে সে তার বংশ থেকে চ্যুত হবে।

কাজী কহে- মোর বংশে যত উপজিবে। 
তাহাকে ‘তালাক’ দিব-কীর্তন না বাধিবে।।


আর সেই কাজীর মৃত্যুর পর মহাপ্রভু তার সমাধিতে একটি কাঠচাঁপা বৃক্ষ স্বহস্তে রোপণ করেন এবং তিনি বলেন যে, প্রতিদিন অন্তত একটি পুষ্পও কাজীর সমাধিতে পতিত হবে। পশ্চিমবঙ্গের মায়াপুরে আজো সেই বৃক্ষ কাজীর সমাধিতে পুষ্পবর্ষণ করছে। 


ধোঁপা, মুচি, ব্রহ্মণ, অহিন্দু জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলকেই চৈতন্যদেব আপন করে নিয়েছিলেন। হরিদাস ঠাকুর ছিলেন মুসলিম কুলোদ্ভুত। কিন্তু ভিন্ন জাতি হলেও একই পরমেশ্বরের সন্তানরূপে শ্রীচৈতন্যদেব যেমন তাঁকে অত্যন্ত ভালোবাসতেন, তেমনি চৈতন্যদেবও ছিলেন হরিদাসের প্রাণ। চাঁদকাজীর ঘটনাসহ এ সকল বর্ণনা শ্রীচৈতন্য চরিতামৃত গ্রন্থে বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে। 

বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠায় চৈতন্যদেবের নামপ্রেম বিতরণ 

ধর্মের গ্লানি আর অধর্মের অভ্যুত্থানে, সাধুদিগের পরিত্রাণ আর অসাধুদের সংহারণে, পরমেশ্বর ভগবান যুগে যুগে অবতীর্ণ হন ধরাধামে। কিন্তু শ্রীচৈতন্যরূপে তিনি কোনো অসুর সংহার করেন না, জীব-হৃদয়ের আসুরিক প্রবৃত্তিকে সংহার করেন। শ্রীচৈতন্যদেবের জীবনচরিতে  আমরা তার সুস্পষ্ট প্রমাণ পাই। চাপাল-গোপাল, জগাই-মাধাই-এদের সমস্ত পাপপ্রবৃত্তি থেকে তিনি মুক্ত করেছিলেন। তিনি তাঁর মধুর ব্যবহার ও নামপ্রেমের দ্বারা সকলের আসুরিক গুণাবলি নাশ করে স্বয়ং তাদের হৃদয়ে জায়গা করে নিতেন এবং সঞ্চার করতেন দিব্য প্রেমের আনন্দ। তাই তিনি অমিয় নিমাই। চৈতন্যদেব সম্পর্কে বৈষ্ণব কবি দেবকীনন্দন দাস বলেন- 

“রাম-আদি-অবতারে, ক্রোধে নানা-অস্ত্র ধরে, 
অসুরের করিল সংহার।। 
এবে অস্ত্র না ধরিল, প্রাণে কারে না মারিল, 
চিত্ত-শুদ্ধি করিল সবার।।”


শ্রীচৈতন্যদেব শুধু শানুষকেই ভালোবাসতেন তা নয়। বৃন্দাবন যাওয়ার পথে ঝারিখন্ডে মহাপ্রভুর কৃষ্ণনাম কীর্তন শ্রবণ করে ময়ুর, বাঘ, হাতি, হরিণাদি বনের সমস্ত পশুপাখি তাদের সহিংসতা ভুলে কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা হয়ে একে অপরকে আলিঙ্গন করেছিল, আনন্দে নৃত্য করেছিল প্রাণভরে, ঠিক যেমন সাপ সবচেয়ে হিংসুটে প্রাণী হওয়া সত্ত্বেও বীনের শব্দে তার হিংসাবৃত্তি ভুলে গিয়ে আনন্দে নৃত্য করে। যদি সামান্য বীনের শব্দের এত ক্ষমতা থাকে, তবে ভগবানের নামরূপ দিব্য শব্দতরঙ্গ যে তার চেয়েও অধিক কিছু করতে সক্ষম, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
 
 
 এর প্রভাব আমরা স্পষ্ট দেখতে পাই পাশ্চাত্যবাসীদের মধ্যে। মাংসাহার, নেশা, জুয়া ও অবৈধ যৌনাচার যাদের নিত্য আচার, শ্রীকৃষ্ণের দিব্য নামোচ্চারণের ফলে খুব সহজেই তাদের অন্তরের অনাচার পরিত্যাগ করে তারা মহান বৈষ্ণবে পরিণত হয়েছিলেন; এমনকি এখনো হচ্ছেন। 

অর্থাৎ, ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য নাম সমন্বিত হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র কীর্তনের দ্বারা জীবের হৃদয়ে প্রেমসঞ্চার করাই শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর মূল আদর্শ। এই  নাম উচ্চারণে ভগবানের প্রতি, এমনকি সমস্ত জীবের প্রতি প্রেম বর্ধিত করে; মানুষে মানুষে হানাহানি, হিংসা-বিদ্বেষ ভুলিয়ে সহিষ্ণু হতে শিক্ষা দেয়, গড়ে তোলে বিশ্বভ্রাতৃত্ব, বয়ে আনে বিশ্বশান্তি। 

চৈতন্যশিক্ষার সার-শ্রীশিক্ষাষ্টকম্

শ্রীচৈতন্যদেবের একমাত্র রচনা যা তিনি তাঁর শিক্ষার পরাকাষ্ঠারূপে জগৎকল্যাণের জন্য রেখে গেছেন, তা হলো শ্রীশিক্ষাষ্টকম্। সংস্কৃত ভাষায় রচিত সেই আটটি শ্লোকে নিহিত রয়েছে চৈতন্যশিক্ষার সার, যার চারটি শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের দিব্য নামের শক্তি, নাম মাহাত্ম্য, নামকারীর যোগ্যতা ও নামের নিকট প্রার্থনার কথা বলা হয়েছে এবং বাকি চারটি শ্লোকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি অহৈতুকী ভক্তিলাভ ও তাঁর প্রতি শরণাগতির শিক্ষাই প্রদান করা হয়েছে। 

শিক্ষাষ্টকের তৃতীয় শ্লোকে তিনি বলেন-তৃণাদপি সুনীচেন তুরুরেব সহিষ্ণুনা। অমানিনা মানদেন কীর্তনীয়া সদা হরি। অর্থাৎ, যিনি নিজেকে তৃণাপেক্ষা হীন মনে করেন, তরুর ন্যায় সহিষ্ণু এবং নিজে মানশূন্য হয়ে অপরকে সম্মান প্রদান করেন, তিনিই সর্বদা হরিনাম কীর্তনের অধিকারী। প্রায় প্রতিটি ইসকন মন্দিরে এই শিক্ষাষ্টক ভক্তদের নিত্যপাঠ্য। চৈতন্যদেবের এই শিক্ষাষ্টকের শিক্ষাই প্রতিটি ইসকন ভক্তের জীবনাদর্শ। যে আদর্শে সহিংসতার স্থান নেই, আছে শুধু প্রেম, ভক্তি, মৈত্রী, ভ্রাতৃত্ব, সহিষ্ণুতা, উদারতা ও বিশ্বশান্তির বার্তা- পরম বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তনম্।

পরিশেষে একটি কথা বলতে চাই, পৃথিবীতে এমন কোনো মহৎ ব্যক্তি নেই, যাঁর সম্পর্কে মিথ্যা, গুজব ও কুৎসা রটায়নি পরশ্রীকাতর কুচক্রীরা। তবে পরমপুরুষ অনিন্দ্য চৈতন্যদেব কীভাবে এর ব্যতিক্রম হবেন! পূর্ণিমার চন্দ্রকে যেরুপ কালো মেঘ স্বল্পকালই দৃষ্টিসীমার আড়াল করে রাখতে পারে, তেমনি চৈতন্যচন্দ্রের অপার মহিমারূপ অপ্রতিম প্রভা কোনো কালো মেঘই আচ্ছাদন করে রাখতে পারবে না; কোনো অপশক্তিই দামিয়ে রাখতে পারবে না চৈতন্যদেব প্রদর্শিত প্রেমধর্মরূপ বৈষ্ণবদর্শনের অমিয় বাণীর প্রচার। কেননা, বাঙালির হৃদয়ের ধন চৈতন্যদেব আজ শুধু বাঙালির নন, গোটা বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রাণপুরুষ।  (-সুদর্শন নিমাই দাস)

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url