বিশ্ব সৃষ্টির রহস্য-অমল পূরান শ্রীমদ্ভাগবত
সৃষ্টির রহস্য
শ্রীসুত গোস্বামী বললেন- -“শুকদেব গোস্বামীর আত্মতত্ত্ব নির্ণায়ক বাণী শ্রবণ করে উত্তরানন্দন পরীক্ষিৎ নিষ্ঠা সহকারে তাঁর মনকে ভগবান শ্রীকৃষ্ণে একাগ্র করেছিলেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি সর্বান্তঃকরণে আকৃষ্ট হওয়ার ফলে মহারাজ পরীক্ষিৎ তাঁর দেহ, জায়া, পুত্র, প্রাসাদ, হাতি, ঘোড়া ইত্যাদি পশু, রাজকোষ, বন্ধু-বান্ধব এবং আত্মীয়-স্বজনদের প্রতি দৃঢ় আসক্তি চিরকালের জন্য ত্যাগ করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
হে মহর্ষিগণ! মহাত্মা মহারাজ পরীক্ষিৎ নিরন্তর শ্রীকৃষ্ণের ভাবনায় মগ্ন হয়ে, তাঁর মৃত্যু আসন্ন জেনে ধর্মানুষ্ঠান আদি সবরকম সকামকর্ম, অর্থনৈতিক উন্নতি এবং ইন্দ্রিয় তৃপ্তি সাধন সর্বতোভাবে পরিত্যাগ করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক প্রেমকে আরও দৃঢ়ভাবে নিযুক্ত করেছিলেন এবং আপনারা যেভাবে আমাকে প্রশ্ন করছেন ঠিক সেই সমস্ত এ জিজ্ঞাসা করেছিলেন "
মহারাজ পরীক্ষিৎ বললেন – “হে বিদ্বান ব্রাহ্মণ! আপনি সবকিছুই জানেন, কেননা আপনি সবরকম জড় কলুষ থেকে মুক্ত। তাই আপনি আমাকে যা কিছু বলেছেন তা যথার্থই বলে প্রতীত হচ্ছে।
আপনার বাণী ধীরে ধীরে আমার অজ্ঞানের অন্ধকার দূর করছে, কেননা আপনি পরমেশ্বর ভগবানের কথা বর্ণনা করছেন। আমি আপনার কাছে জানতে চাই পরমেশ্বর ভগবান কিভাবে তাঁর আত্মমায়ার দ্বারা এই বিশ্ব সৃষ্টি করেন, যা মহান্ দেবতাদের পক্ষেও দুর্বোধ্য।
দয়া করে আপনি বলুন সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান ক্রীড়াচ্ছলে তাঁর বিভিন্ন শক্তি এবং বিভিন্ন অংশদের কেমনভাবে এই জগতের পালন কার্যে এবং সংহার কার্যে নিযুক্ত করেন।
"হে বিদ্বান ব্রাহ্মণ, পরমেশ্বর ভগবানের অপ্রাকৃত কার্যকলাপ অত্যন্ত আশ্চর্যজনক, এবং তা অচিন্ত্য বলে মনে হয়, কেননা মহান পণ্ডিতদের মহতী প্রচেষ্টাও তা বোঝার জন্য পর্যাপ্ত নয়।
পরমেশ্বর ভগবান এক, তা তিনি একলাই প্রকৃতির গুণের দ্বারা কার্য করুন, অথবা যুগপৎ বছরূপে নিজেকে বিস্তার করুন অথবা প্রকৃতির গুণসমূহ পরিচালনা করার জন্য ক্রমশ নিজেকে বিস্তার করুন।
দয়া করে আপনি আমার সমস্ত সন্দেহের নিরসন করুন। আপনি কেবল বৈদিক শাস্ত্রে গভীর জ্ঞানসম্পন্ন এবং আত্মতত্ত্ববেত্তাই নন, আপনি ভগবান শ্রীকৃষ্ণের একজন মহান ভক্ত এবং তাই আপনি ভগবানেরই সমান।”
শ্রীসুত গোস্বামী বললেন—“রাজা কর্তৃক এইভাবে ভগবানের সৃজনাত্মক শক্তি বর্ণনা করতে প্রার্থিত হয়ে শুকদেব গোস্বামী সর্বোন্দ্রিয় পতি ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে স্মরণ করে প্রত্যুত্তর দিতে শুরু করলেন।”
শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন – “আমি সেই ভগবানকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি, যিনি জড় জগতের সৃষ্টির জন্য প্রকৃতির তিনটি গুণ অঙ্গীকার করেন। তিনি প্রতিটি জীবের শরীরে বিরাজমান পরমপূর্ণ এবং তাঁর কার্যকলাপ অচিন্ত্য।
আমি পুনরায় পূর্ণ অস্তিত্ব এবং অধ্যাত্ম রূপ সমন্বিত পরমেশ্বর ভগবানকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি, যিনি পুণ্যবান ভক্তদের সমস্ত সংকট থেকে উদ্ধার করেন এবং অভক্ত অসুরদের নাস্তিক মনোবৃত্তি বৃদ্ধিতে বাধা দেন।
পারমার্থিক সিদ্ধির সর্বোচ্চ স্তরে অধিষ্ঠিত পরমহংসদের তিনি বিশিষ্টপদ দান করেন। যদুবংশীয়দের পার্ষদ এবং অভক্তদের যিনি সর্বদা সমস্যার সৃষ্টি করেন তাঁকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি।
তিনি জড় এবং চেতন উভয় জগতেরই পরম ভোক্তা, তথাপি তিনি চিদাকাশে তাঁর লীলাবিলাস করেন। কেউই তাঁর সমকক্ষ নয়, কেননা তাঁর অপ্রাকৃত ঐশ্বর্য অনন্ত এবং অসীম। আমি সেই সর্বমঙ্গলময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করি,
ধার যশগাথা কীর্তন, স্মরণ, দর্শন, বন্দন, শ্রবণ এবং পূজনের ফলে সমস্ত পাপরাশি অচিরেই ধৌত হয়। আমি সর্বমঙ্গল ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বারংবার আমার প্রণতি নিবেদন করি। তাঁর চরণকমলের শরণ গ্রহণ করার ফলে পরম বুদ্ধিমান ব্যক্তিরা বর্তমান এবং ভবিষ্যতের সমস্ত জড় আসক্তি থেকে মুক্ত হন এবং অনায়াসে চিন্ময় জগতের প্রতি অগ্রসর হন।
আমি সর্বমঙ্গলময় ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে বারংবার আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি, কেননা তপস্যা পরায়ণ মহান ঋষিগণ, দানশীল কর্মীগণ, প্রতিষ্ঠাবান যশস্বীগণ, মনস্বী বা যোগীগণ, বেদজ্ঞ যন্ত্র উচ্চারণকারীগণ অথবা সদাচারী পুরুষগণ কেউই সেই সমস্ত মহান গুণের দ্বারা ভগবানের সেবা না করে মঙ্গল লাভ করতে সমর্থ হন না।
কিরাত, ণ, আন্ধ, পুলিন্দ, পুষ্পশ, আভীর, গুপ্ত, যবন, বস তথ্য অন্যান্য সমস্ত জাতির পাপাসক্ত মানুষেরা যার ভক্তদের শরণ গ্রহণ করার ফলে শুদ্ধ হতে পারে, আমি সেই পরম শক্তিশালী পরমেশ্বর ভগবানকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।
তিনি আত্মতত্ত্ববেত্তা পুরুষদের পরমাধ্যা এবং পরমেশ্বর। তিনি বেদ, ধর্মশাস্ত্র এবং তপস্যার মূর্তিমান প্রকাশ। তিনি ব্রহ্মা, শিব এবং কপটতা রহিত সমস্ত ব্যক্তিদের দ্বারা পূজিত।
এই প্রকার শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমের আস্পদ পরমেশ্বর ভগবান আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। সমস্ত ভক্তদের আরাধ্য ভগবান, অন্ধক, বৃষ্ণি প্রমুখ যদুবংশীয় রাজাদের পালক এবং গৌরব ও সৌভাগ্যের অধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীদেবীর পতি,
সমস্ত যজ্ঞের নির্দেশক এবং সেই সূত্রে সমস্ত জীবের নায়ক, সমস্ত বুদ্ধিমত্তার নিয়ন্তা, জড় এবং চেতন সমস্ত লোকসমূহের অধীশ্বর এবং পৃথিবীর পরম অবতার (সর্বেসর্বা) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ আমার প্রতি প্রসন্ন হোন।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন মুক্তিদাতা। মহাত্মাদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে প্রতিক্ষণ তাঁর চরণকমলের চিন্তা করার ফলে ভগবদ্ভক্তেরা সমাধিতে সেই পরম সত্যকে দর্শন করতে পারেন। কিন্তু মনোধর্মী জ্ঞানীরা তাদের কল্পনা অনুসারে তাঁকে অনুমান করতে চেষ্টা করে।
সেই পরমেশ্বর ভগবান আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। যিনি সৃষ্টির প্রারম্ভে ব্রহ্মার হৃদয়ে শক্তিশালী জ্ঞান বিকশিত করেছিলেন এবং সৃষ্টি ও তাঁর নিজের সম্বন্ধে পূর্ণ জ্ঞান প্রদান করে অনুপ্রাণিত করেছিলেন, এবং সেই বেদরূপা সরস্বতী ব্রহ্মার মুখ থেকে প্রকাশিতা হয়েছিলেন।
সমস্ত জ্ঞানদাতা ঋষিদের মধ্যে যিনি সর্বশ্রেষ্ঠ সেই পরমেশ্বর ভগবান আমার প্রতি প্রসন্ন হোন। যে পরমেশ্বর ভগবান ব্রহ্মাণ্ডের অভ্যন্তরে শয়ন করে প্রকৃতির উপাদান থেকে সৃষ্ট সমস্ত শরীরকে উজ্জীবিত করেন, এবং পুরুষাবতাররূপে জীবকে তার জড় শরীরের জনক ষোলটি গুণের (একাদশ ইন্দ্রিয় এবং পঞ্চ মহাভূত) অধীনস্থ করেন,
সেই ভগবান যেন আমার প্রতি প্রসন্ন হয়ে আমার বাণীকে অলংকৃত করেন। আমি বৈদিক শাস্ত্রের সঙ্কলনকর্তা, বাসুদেবের অবতার শ্রীল ব্যাসদেবকে আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। শুদ্ধ ভক্তেরা ভগবানের মুখারবিন্দ থেকে নিঃসৃত অমৃতময় দিব্যজ্ঞান পান করেন।”
“হে রাজন্ প্রথম জন্মা, জন্ম থেকেই যাঁর মধ্যে বৈদিক জ্ঞানের সঞ্চার হয়েছিল, তাঁর সেই পুত্র ব্রহ্মাকে ভগবান নিজ মুখে যে জ্ঞান দান করেছিলেন, ব্রহ্মাও নারদ কর্তৃক জিজ্ঞাসিত হয়ে তাঁকে সেই কথাই বলেছিলেন।”
আরও পড়ুনঃ
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?
* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়