বৈষ্ণব সঙ্গ লাভের উপকার
বৈষ্ণব সঙ্গ লাভের ফল
বহু সৌভাগ্যের ফলে ভগবানের কৃপায় জীবের সংসার বাসনা দুর্বল হয়ে পড়ে; তখন ভাবেই সাধুসঙ্গের প্রতি স্পৃহা জন্মে। সাধুসঙ্গে কৃষ্ণকথা শ্রবণ হতে শ্রদ্ধার উদয় হয়।
তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্য হচ্ছে বৈষ্ণবদের শ্রীমুখ থেকে কৃষ্ণকথা শ্রবণ। ভগবদ্ভক্তির নয়টি বিধির মধ্যে শ্রবণ হল প্রথম পদ্ধতি। শ্রীল প্রভুপাদ এই শ্রবণের বিশেষ গুরুত্ব দিতেন, তাই পৃথিবীর প্রত্যেকটি কৃষ্ণভাবনাময় মন্দিরে সকালে এবং সন্ধ্যায় গীতা ও ভাগবত পাঠের ব্যবস্থা করেছেন।
এই কৃষ্ণভাবনাময় আন্দোলনে আমরা বহু নিষ্ঠাবান, সমর্পিত প্রাণ এবং ভগবদ্ভক্তি অনুশীলনরত বৈষ্ণবদের বিপুল আশীর্বাদ পেয়ে থাকি।
তাঁরা শুদ্ধভাবে ভগবদ্ভক্তি সম্পাদনের চেষ্টা করে চলছেন। শ্রীল রূপ গোস্বামীও উপদেশামৃত গন্থে বলেছেন যে, ভগবদ্ভক্তের সান্নিধ্য অর্জন করা কৃষ্ণভাবনায় অগ্রসর হওয়ার পথে ষড়বিধ পন্থার অন্যতম। এই সান্নিধ্যের সুযোগ আমাদের গ্রহণ করা দরকার।
গীতা, শ্রীমদ্ভাগবত এবং কৃষ্ণাভাবনা সম্পর্কে বৈষ্ণবেরা যেসব প্রবচন এবং সারগর্ভ আলোচনা করে থাকেন, সেগুলি নিয়মিত শুনতে হবে।
ঠিক যেমন অবৈষ্ণবদের সাথে দেখা-সাক্ষাৎ করতেও নিষেধ করা হয়ে থাকে, তেমনই বৈষ্ণবদের কথা শুনতেও পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে।
যখনই আমি শুনতে পাই, আমার গুরুভ্রাতারা তাঁদের প্রবচন সভায় নানা উপলব্ধির কথা বুঝিয়ে বলছেন, তা শুনে সব সময়েই আমরা আত্মদর্শন প্রসারিত হয়ে উঠে।
কৃষ্ণভাবনা অনুশীলনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে এবং নতুন পরিমন্ডল বা নতুন অন্তর্দৃষ্টি এনে দেয় আমাদের মাঝে, যা হয়ত আমি খেয়াল করিনি বিংবা একই দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তা লক্ষ্য করতে পারিনি।
তাছাড়া এতে পরিশুদ্ধিও লাভ হয়। অতএব এই বিষয়টি নিয়ে আমার সমস্ত অনুগামীদের বিশেষ মনোযোগ আকর্ষণ করতে চাই যে, বৈষ্ণবদের কাছ থেকে, বিশেষ করে যাঁরা কৃষ্ণভাবনায় অনেক অগ্রণী হয়ে রয়েছেন, তাদের কাছ থেকে কিছু শোনার প্রয়োজন আছে।
ভগবদ্ভক্ত শ্রীকৃষ্ণের বড় প্রিয়, আর শ্রীকৃ্ষ্ণও ভক্তদের পরম প্রিয়। ভক্ত র্সবদাই শ্রীকৃষ্ণের সেবা করছেন আর শ্রীকৃষ্ণও সেবা করছেন ভক্তের।
শ্রীমদ্ভাগবতের নমব স্কন্ধের চতুর্থ অধ্যায়ে ৬৩ থেকে ৬৮ শ্লোকে পরমেশ্বর শ্রীবিষ্ণু দুর্বাসা মুনিকে বলেছেন, কিভাবে তাঁর নিজের সাথে তাঁর ভক্তদের অন্তরঙ্গ সম্পর্ক রয়েছে।
পরমেশ্বর ভগবানের কাছে ভক্ত এমনই প্রিয় যে, ভগবান এই কথা বারে বারে শাস্ত্রাদিতে ঘোষণা করছেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের ভক্তগণ বিশ্বব্রহ্মান্ডকে পারমার্থিক জ্যোতিতে উদ্ভাসিত করে রেখেছেন।
ঠিক যেমন সূর্য তার বিচ্ছুরিত কিরণালোকের মাধ্যমে বিশ্বব্রহ্মান্ডকে জ্যোতির্ময় করে রেখেছে। এই কথা শ্রীমদ্ভাগবতে (১১/১৬/৩৪) শ্রীকৃষ্ণ উদ্বব সংবাদে উল্লেখ করা হয়েছে-
আমরার ভক্তরা দিব্য চক্ষু দান করে, যেক্ষেত্রে সূর্য শুধুই বহিরঙ্গা দৃষ্টিক্ষমতা এনে দেয়, আর তাও যখন সে আকাশে উঠে।
আমার ভক্তবৃন্দ মানুষের প্রকৃত আরাধ্য দেবমন্ডলী আর প্রকৃত পরিবার গোষ্ঠী; তারাই মানুষের স্বরূপাত্মা, শেষ পর্যন্ত তারাই আমার থেকে অভিন্ন।
তাই বৈষ্ণবদের কাছ থেকে আমরা শ্রীকৃষ্ণভাবনার অন্তরঙ্গা জ্ঞানালোক লাভ করতে পারে! ভক্ত সান্নিধ্য লাভের মূল্যায়ন কে করতে পারে।
বৈষ্ণবদের কাছ থেকে শ্রবণ করা এবং এবং বৈষ্ণবদের সেবা করার এমনই মাহাত্ম্য। যখন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং তাঁর ভক্তদের সেবা করে থাকেন, তাহলে কোন উৎসাহী ভক্তের কথা আর কী বলার আছে।
বৈষ্ণব ভক্তদের সেবা করা কতেই না জরুরী। ভগবান শ্রীবিষ্ণু আগেই বলেছেন, ‘ভক্তেরও ভক্ত, তারাও আমার অধিক প্রিয়।’
শ্রীল প্রভুপাদ বারে বারেই নরোত্তম দাস ঠাকুরের ভক্তিগীতিটি তুলে ধরতেন, যেখানে তিনি গেয়েছেন, ‘ছাড়িয়া বৈষ্ণব সেবা নিস্তার পেয়েছে কেবা- ভক্তের ভক্ত না হতে পারলে কখনও জড় জগতের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়া যায় না।
শ্রীমদ্ভাগবত ৯/৪/৬৩ তাৎপর্য
বাস্তবিকই, পদ্ম পুরাণে পরিস্কার ভাবেই বলা আছে, পরমেশ্বর ভগবানের ভক্তরূপে তাকে গণ্য করা হবে না, যে ভগবানের শুদ্ধ বৈষ্ণব ভক্তদের আরাধনা পরিত্যাগ করেছে,
এমনকি যদি সে সরাসরি গোবিন্দের ভজনাও করে থাকে। তেমন মানুষকে বৃথা অহংকারী এবং উদ্ভত বলেই জানতে হবে। অতেএব অতি সযত্নে ও মনোযোগ সহকারে মানুষকে নিয়ত বৈষ্ণবগণের আরাধনা করতে হবে।
পদ্মপুরাণ, উত্তর খন্ড
প্রহ্লাদ মহারাজ তাঁর পিতা হিরণ্যকশিপুকে বলেছেন- “যে সব মানুষের জড়জাগতিক জীবনের প্রতি অত্যধিক প্রবণতা রয়েছে, তারা যদি জড় কলুষ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত কোনও বৈষ্ণবের চরণকমলরেণু তাদের সর্বাঙ্গে লেপন করতে না পারে, তা হলে অসাধারণ কার্যকলাপের মহিমামন্ডিত সেই পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি তারা আসক্ত হতে পারবে না।
শুধুমাত্র শ্রীকৃষ্ণভাবনায় মগ্ন হয়ে এই ভাবে পরশেশ্বর ভগবানের পাদপদদ্মে আশ্রয় গ্রহণ করেই মানুষ জড় কলুষতা থেকে মুক্ত হতে পারে।”
উন্নত বৈষ্ণব ভগবদ্ভক্তের কাছ থেকে শ্রবণ করা এবং তাঁদের সেবা করার মাধ্যমেই বিশেষ পরিশুদ্ধি এবং কৃপালাভের সুযোগ ঘটে।
----শ্রীমৎ জয়পতাকা স্বামী মহারাজ