হিরণ্যাক্ষ বধের কাহিনী
হিরণ্যাক্ষ বধ
শ্রীমৈত্রেয় বললেন—“সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মার সেই নিষ্কপট এবং অমৃতের মতো মধুর বাণী শ্রবণ করে ভগবান আন্তরিকতার সঙ্গে হেসেছিলেন এবং প্রেমপূর্ণ দৃষ্টিপাতের দ্বারা তাঁর সেই প্রার্থনা স্বীকার করেছিলেন।
ভগবান, যিনি ব্রহ্মার নাক থেকে আবির্ভূত হয়েছিলেন, তিনি লাফ দিয়ে তাঁর সম্মুখে নির্ভীকভাবে বিচরণশীল তাঁর শত্রু হিরণ্যাক্ষের চিবুক লক্ষ্য করে, তাঁর গদার দ্বারা আঘাত করলেন।
কিন্তু দৈত্যের গদার আঘাতে ভগবানের হাত থেকে তাঁর গদা বিচ্যুত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে নিম্নে পতিত হল এবং তখন তা এক অপূর্ব শোভা বিস্তার করছিল। তা অত্যন্ত আশ্চর্যজনক ছিল, কেননা ভগবানের গদাটি অদ্ভুতভাবে দীপ্তি বিস্তার করে ঝলমল করছিল।
দৈত্যটি যদিও তার নিরস্ত্র শত্রুকে আঘাত করার এক অপূর্ব সুন্দর সুযোগ পেয়েছিল, তবুও সে যুদ্ধ-ধর্মের নীতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করেছিল, তার ফলে পরমেশ্বর ভগবানের ক্রোধ উদ্দীপ্ত হয়েছিল।
ভগবানের গদা যখন ভূমিতে পড়ে গিয়েছিল, তখন যে-সমস্ত ঋষি এবং দেবতাগণ তাঁদের সেই যুদ্ধ দেখছিলেন, তাঁরা হাহাকার করে উঠেছিলেন। তখন পরমেশ্বর ভগবানের দৈত্যের ধর্ম-আচরণের প্রতি অনুরাগের প্রশংসা করে, তাঁর সুদর্শন চক্রকে স্মরণ করেছিলেন।
চক্রটি যখন ভগবানের হাতে ঘুরতে লাগল এবং দিতির অধম পুত্র হিরণ্যাক্ষরূপে জন্ম-গ্রহণকারী তাঁর প্রধান পার্ষদের সঙ্গে ভগবান যখন মুখোমুখি যুদ্ধ করছিলেন, তখন যাঁরা তাঁদের বিমান থেকে সেই যুদ্ধ দেখছিলেন, তাঁরা চতুর্দিক থেকে বিচিত্র বাক্য বলতে লাগলেন।
ভগবানের প্রকৃত পরিচয় সম্বন্ধে তাঁদের জানা ছিল না এবং তাঁরা বলেছিলেন—‘আপনার জয় হোক! কৃপা করে একে হত্যা করুন। এর সঙ্গে আর খেলা করবেন না।' সেই দৈত্যটি পদ্ম-পলাশ-লোচন পরমেশ্বর ভগবানকে সুদর্শন চক্র হাতে তার সামনে অবস্থিত দেখে, অত্যন্ত ক্রোধে বিকলেন্দ্রিয় হয়েছিল।
সে ভীষণ ক্রোধে তার দাঁতের দ্বারা অধর দংশন করে সাপের মতো দীর্ঘ-নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে শুরু করেছিল। ভয়ঙ্কর দংষ্ট্রযুক্ত ন সেই দৈত্য যেন ভগবানকে তার দৃষ্টিপাতের দ্বারা দগ্ধ করবে, সেইভাবে নিরীক্ষণ করে, ভগবানের দিকে তার গদা উত্তোলন করে লাফ দিয়ে বলল, 'তুই এখন নিহত হলি!
হে সাধো বিদুর! সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা, বরাহ- রূপধারী ভগবান শত্রুর নয়ন সমক্ষেই তাঁর বাম পায়ের দ্বারা অবলীলাক্রমে সেই গদাকে নিবারণ করলেন, যদিও তা প্রচণ্ড ঝড়ের বেগে তাঁর প্রতি নিক্ষিপ্ত হয়েছিল।”
ভগবান তখন বললেন “ “তুই যখন আমাকে জয় - করতে এতই আগ্রহী, তখন আবার অস্ত্রধারণ করে চেষ্টা কর্। এইভাবে আহুত হয়ে, সেই দৈত্য পুনরায় ভগবানকে লক্ষ্য করে গদা নিক্ষেপ করল এবং ভয়ঙ্কর গর্জন করতে লাগল।
ভগবান যখন দেখলেন যে, সেই গদা তাঁর দিকে ভীষণ বেগে আসছে, তখন তিনি সেখানেই অবিচলিতভাবে দাঁড়িয়ে থেকে অবলীলাক্রমে তা ধরে ফেললেন, ঠিক যেভাবে পক্ষীরাজ গরুড় একটি সাপকে ধরে।
এইভাবে তার পৌরুষ ব্যর্থ হওয়ায়, সেই মহা দৈত্য হত গর্ব এবং অপ্রতিভ হয়েছিল। ভগবান তার গদা প্রত্যর্পণ করতে চাইলেও, সে তা গ্রহণ করতে ইচ্ছা করল না। ঈর্ষাপরায়ণ ব্যক্তি যেমন পবিত্র ব্রাহ্মণের - অনিষ্ট সাধনের উদ্দেশ্যে তার তপস্যালব্ধ অভিচার (মারণ, উচ্চাটন আদি) প্রয়োগ করে,
তেমনই সেই দৈত্য জ্বলন্ত অগ্নির মতো জাজ্বল্যমান এক ভয়ঙ্কর ত্রিশূল সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ভগবানের উদ্দেশ্যে নিক্ষেপ করল। মহা বলবান সেই দৈত্য কর্তৃক প্রবল বেগে নিক্ষিপ্ত সেই ত্রিশূল আকাশে উজ্জ্বলভাবে প্রতিভাত হয়েছিল।
কিন্তু পরমেশ্বর ভগবান তা তাঁর তীক্ষ্ণধার সুদর্শন চক্রের দ্বারা খণ্ড খণ্ড করেছিলেন, ঠিক যেমন ইন্দ্র গরুড়ের পরিত্যক্ত একটি পক্ষ ছেদন করেছিলেন। পরমেশ্বর ভগবানের চক্রের দ্বারা তার ত্রিশূল খণ্ড খণ্ড হওয়ায়, দৈত্যটি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়েছিল।
তাই সে প্রচণ্ডভাবে গর্জন করতে করতে ভগবানের অভিমুখে ধাবিত হয়ে, শ্রীবৎসচিহ্নাঙ্কিত ভগবানের বক্ষে মুষ্টির দ্বারা কঠোরভাবে আঘাত করেছিল এবং তার পর সে অন্তর্হিত হয়েছিল।” “হে বিদুর! আদি বরাহরূপ ভগবান দৈত্যটির দ্বারা
এইভাবে আহত হলে, তার দেহের কোন অঙ্গই স্বপ্ন- মাত্রায়ও বিচলিত হল না, ঠিক যেমন ফুলের মালার দ্বারা আহত হয়ে, হস্তী কখনও বিচলিত হয় না। তারপর সেই দৈত্য যোগমায়াধীশ শ্রীহরির প্রতি নানাবিধ মায়া- জাল বিস্তার করতে লাগল।
তা দেখে সাধারণ মানুষেরা অত্যন্ত শঙ্কিত হয়েছিল এবং মনে করেছিল যে, জগতের প্রলয়-কাল সমুপস্থিত হয়েছে। চার দিক থেকে প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহিত হতে লাগল, তার ফলে ধূলি এবং শিলাবৃষ্টির দ্বারা চতুর্দিক তমসাচ্ছন্ন হয়ে পড়ল এবং সর্বত্র পাথর পতিত হতে লাগল, যেন সেইগুলি ক্ষেপণাস্ত্রের দ্বারা নিক্ষিপ্ত হচ্ছিল।
নভোমণ্ডল বিদ্যুৎ এবং বজ্র সহ মেঘের দ্বারা আচ্ছাদিত হওয়ায় নক্ষত্ররাজি বিলুপ্ত হয়েছিল এবং আকাশ থেকে পুঁজ, কেশ, রক্ত, মল, মূত্র ও অস্থি বর্ষণ হচ্ছিল। হে নিষ্পাপ বিদুর, তখন মনে হয়েছিল যেন পর্বতগুলি নানাবিধ অস্ত্র বর্ষণ করছিল এবং তার পর আলুলায়িত কেশা শূল-ধারিণী কতগুলি নগ্ন রাক্ষসী এসে উপস্থিত হয়েছিল।
পদাতিক, অশ্বারোহী, গজারোহী এবং রথারোহী বহু আততায়ী যক্ষ এবং রাক্ষস হিংসাত্মক ও নিষ্ঠুর বাক্য প্রয়োগ করতে লাগল। সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা ভগবান তখন সেই অসুর কর্তৃক প্রকাশিত মায়া বিনাশ করার জন্য তাঁর প্রিয় সুদর্শন চক্র প্রয়োগ করেছিলেন।
সেই সময় হিরণ্যাক্ষের মাতা দিতির হঠাৎ হৃৎকম্পন হয়েছিল এবং পতি কশ্যপের বাক্য তার স্মরণ হল এবং তাঁর স্তন থেকে রক্ত ক্ষরণ হতে লাগল। দৈত্যটি যখন দেখল যে, তার মায়াশক্তি প্রতিহত হয়েছে, সে তখন পুনরায় পরমেশ্বর ভগবান কেশবের সম্মুখে উপস্থিত হল এবং ক্রোধভরে তার দুই বাহুর দ্বারা তাঁকে জাপটে ধরে পেষণ করার চেষ্টা করল।
কিন্তু অত্যন্ত আশ্চর্য হয়ে সে দেখল যে, ভগবান তার বাহুদ্বয়ের বহির্দেশে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। দৈত্যটি তখন বজ্রসদৃশ কঠোর মুষ্টির দ্বারা ভগবানকে আঘাত করতে লাগল, কিন্তু ভগবান অধোক্ষজ তাঁর হস্ত দ্বারা তার কর্ণমূলে আঘাত করলেন, ঠিক যেভাবে মরুৎপতি ইন্দ্ৰ বৃত্রাসুরকে আঘাত করেছিলেন।
বিশ্বজিৎ ভগবান যদিও তা অবলীলাক্রমে সেই দৈত্যকে আঘাত করেছিলেন, তার ফলেই সেই দৈত্যের শরীর ঘূর্ণিত হতে লাগল। তার চক্ষুদ্বয় অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে এল।
তার হস্ত- পদ ভগ্ন হল, মাথার কেশ আলুলায়িত হল এবং সে প্রচণ্ড বায়ু-বেগে সমুলে উৎপাটিত বিশাল বৃক্ষের মতো মৃত অবস্থায় পতিত হল। অজ (ব্রহ্মা) এবং অন্যেরা সেখানে এসে দেখলেন যে,
সেই ভীষণ দত্ত-বিশিষ্ট দৈত্যটি তার অধর দংশন করে ধরাশায়ী হয়েছে, অথচ তার দীপ্তি মলিন হয়নি। তখন ব্রহ্মা তার প্রশংসা করে বলেছিলেন—আহা! এই প্রকার সৌভাগ্যজনক মৃত্যু কে লাভ করতে পারে ?”
ব্রহ্মা বলতে লাগলেন—“যোগীরা নির্জন স্থানে যোগ- সমাধির দ্বারা অনিত্য জড় লিঙ্গ শরীরের বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার আকাঙ্ক্ষায় যে শ্রীপাদ-পদ্মের ধ্যান করেন, সেই পায়ের দ্বারা আহত হয়ে দৈত্যশ্রেষ্ঠ তাঁর শ্রীমুখ- পদ্ম দর্শন করতে করতে তার নশ্বর শরীর ত্যাগ করেছিল।
অভিশপ্ত হওয়ার ফলে, পরমেশ্বর ভগবানের এই দুই পার্ষদকে অসুরকুলে জন্মগ্রহণ করতে হয়েছিল। এই প্রকার কয়েক জন্মের পর, তারা তাদের স্ব-স্থানে প্রত্যাবর্তন করবে।”
ভগবানের উদ্দেশ্যে দেবতারা বললেন—“হে ভগবান, আপনাকে আমরা পুনঃ পুনঃ প্রণতি নিবেদন করি! আপনি সমস্ত যজ্ঞের ভোক্তা এবং জগতের পালনের জন্য আপনি শুদ্ধ সত্ত্বে বরাহরূপ ধারণ করেছেন। জগৎ- নির্যাতনকারী এই দৈত্যটি সৌভাগ্যক্রমে আপনার দ্বারা হত হয়েছে এবং আপনার শ্রীপাদপদ্মের ভক্তিপরায়ণ আমরাও এখন আশ্বস্ত হয়েছি।”
শ্রীমৈত্রেয় বললেন—“এইভাবে অত্যন্ত ভয়ানক হিরণ্যাক্ষ দৈত্যকে সংহার করে, আদি বরাহ ভগবান শ্রীহরি তাঁর নিত্য আনন্দময় ধামে প্রত্যাবর্তন করলেন। তখন ব্ৰহ্মা প্রমুখ সমস্ত দেবতাদের দ্বারা ভগবান সংস্তুত হয়েছিলেন।
হে প্রিয় বিদুর! আমি তোমার কাছে আদি বরাহরূপে পরমেশ্বর ভগবানের অবতরণ এবং মহান যুদ্ধে অমিত বিক্রম হিরণ্যাক্ষকে ক্রীড়নকের মতো বধ করার কাহিনী বর্ণনা করলাম। আমি আমার গুরুদেবের কাছ থেকে যেভাবে তা শ্রবণ করেছিলাম, সেইভাবেই তা আমি বর্ণনা করেছি।”
শ্রীসূত গোস্বামী বলতে লাগলেন—“হে ব্রাহ্মণ ! পরম ভাগবতবত্তা (বিদুর) মহর্ষি কৌষারবের (মৈত্রেয় মুনির) কাছ থেকে পরমেশ্বর ভগবানের লীলা-বিলাসের আখ্যান শ্রবণ করে দিব্য আনন্দ লাভ করেছিলেন এবং তার ফলে তিনি অত্যন্ত প্রসন্ন হয়েছিলেন।
অমৃত-যশস্বী ভগবদ্ভক্তদের কার্যকলাপ শ্রবণ করে যখন দিব্য আনন্দ আস্বাদন করা হয়, তখন শ্রীবৎস চিহ্নাঙ্কিত স্বয়ং ভগবানের লীলা-বিলাসের কথা কি আর বলার আছে।
কুমীর কর্তৃক আক্রান্ত গজেন্দ্র যখন তাঁর শ্রীপাদপদ্মের ধ্যান করেছিলেন, তখন ভগবান তাঁকে উদ্ধার করেছিলেন। সেই সময় তাঁর সহগামিনী হস্তিনীরা কাতরভাবে আর্তনাদ করেছিল এবং ভগবান তাদের আসন্ন সংকট থেকে রক্ষা করেছিলেন।
নির্মল চিত্ত অনন্য শরণ ভক্তদের দ্বারা ভগবান সহজেই প্রসন্ন হন, কিন্তু অসাধুদের পক্ষে তিনি দুরারাধ্য। এমন কৃতজ্ঞ জীব কে আছে যে, সেই পরমেশ্বর ভগবানের মতো মহান প্রভুকে প্রেমময়ী সেবা করবে না?”
“হে ব্ৰাহ্মণগণ! পৃথিবীকে উদ্ধার করার জন্য আদি বরাহরূপে আবির্ভূত পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা হিরণ্যাক্ষ বধের এই অদ্ভুত আখ্যান যিনি শ্রবণ করেন, কীর্তন করেন অথবা তাতে আনন্দ লাভ করেন, তিনি ব্রহ্মহত্যা- জনিত মহা পাপ থেকেও মুক্তি লাভ করতে পারেন।
এই পরম পবিত্র আখ্যান মহাপুণ্য, সম্পদ, যশ, আয়ু এবং সমস্ত ‘ঈপ্সিত বস্তু প্রদান করে। যুদ্ধক্ষেত্রে তা প্রাণ এবং কর্মেন্দ্রিয়ের শক্তি বর্ধিত করে। হে শৌনক ! কেউ যদি তাঁর জীবনের অন্তিম সময়ে তা শ্রবণ করেন, তা হলে তিনি ভগবানের পরম ধাম প্রাপ্ত হন।”
আরও পড়ুনঃ
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?
* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়
* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য)