পরমাণু থেকে কালের গণনার উপায় - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

শনিবার, ১৫ এপ্রিল, ২০২৩

পরমাণু থেকে কালের গণনার উপায়

 
পরমাণু থেকে কালের গণনা

পরমাণু থেকে কালের গণনা


মৈত্রেয় বললেন—“জড় জগতের যে ক্ষুদ্রতম অংশ অবিভাজ্য এবং দেহরূপে যার গঠন হয় না, তাকে বলা হয় পরমাণু। তা সর্বদা তার অদৃশ্য অস্তিত্ব নিয়ে বিদ্যমান থাকে, এমনকি প্রলয়ের পরেও। 

 

জড় দেহ এই প্রকার পরমাণুর সমন্বয়, কিন্তু সাধারণ মানুষের সেই সম্বন্ধে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। পরমাণু হচ্ছে ব্যক্ত জগতের চরম অবস্থা। যখন তারা বিভিন্ন প্রকারের শরীর নির্মাণ না করে তাদের স্বরূপে স্থিত থাকে, তখন তাদের বলা হয় পরম-মহৎ। 

 

ভৌতিক রূপে নিশ্চয়ই অনেক প্রকারের শরীর রয়েছে, কিন্তু পরমাণুর দ্বারা সমগ্র জগৎ সৃষ্টি হয়। পরমাণু-সমন্বিত শরীরের গতিবিধির মাপ অনুসারে কালের গণনা করা যায়। কাল সর্বশক্তিমান পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির শক্তি, যিনি জড় জগতের অগোচর হলেও সমস্ত পদার্থের গতিবিধি নিয়ন্ত্রণ করেন।

 

পরমাণুর আয়তনকে অতিক্রম করে যেটুকু সময়, সেই অনুসারে পারমাণবিক কালের আয়তনকে মাপা হয়। যে কাল সমগ্র পরমাণুর সামগ্রিক অব্যক্ত সমষ্টিকে আবৃত করে, তাকে বলা হয় পরম-মহৎ কাল।”


“ স্থুল কালের গণনা নিম্নলিখিতভাবে করা হয়—দুইটি পরমাণুতে একটি অণু এবং তিনটি অণুতে একটি ত্রসরেণু। গবাক্ষের মধ্য দিয়ে গৃহে প্রবিষ্ট সূর্যরশ্মির মধ্যে এই ত্রসরেণু দেখা যায়।  

 

স্পষ্টভাবে দেখা যায় যে, ত্রসরেণু ঊর্ধ্বগামী হয়ে আকাশের দিকে যাচ্ছে। তিনটি এসরেণু সংযুক্ত হতে যেটুকু সময় লাগে, তাকে বলা হয় ত্রুটি, একশত ত্রুটি পরিমিত কালকে বলা হয় বেধ। 

তিন বেধের মিলনে এক লব হয়। তিন লব পরিমিত কালে এক নিমেষ হয়, তিন নিমেষে এক ক্ষণ হয় এবং পঞ্চ ক্ষণে এক কাষ্ঠা এবং পঞ্চদশ কাষ্ঠায় এক লঘু হয়। 

 

পনের লঘুতে এক নাড়িকা হয়, যাকে এক দণ্ডও বলা হয়। দুই দণ্ডে এক মুহূর্ত হয় এবং ছয় অথবা সাত দণ্ডে মানুষের গণনা অনুসারে দিন অথবা রাত্রির এক- চতুর্থাংশ বা এক প্রহর হয়। 

 

চার মাষা পরিমিত স্বর্ণের দ্বারা নির্মিত চার অঙ্গুলি পরিমাণ শলাকার দ্বারা ছয় পল (চোদ্দ আউন্স) পরিমিত তাম্রপাত্রে একটি ছিদ্র করে সেই পাত্রটি যদি জলে রাখা হয়, তাহলে সেই পাত্রটি জলে পূর্ণ হতে যতক্ষণ সময় লাগে, সেই সময়কে বলা হয় নাড়ি অথবা দণ্ড। 

 

চার প্রহরে বা যামে মানুষদের দিন এবং চার প্রহরে রাত্রি হয়। পঞ্চদশ দিবা রাত্রে এক পক্ষ হয় এবং শুক্ল ও কৃষ্ণ এই দুই পক্ষে এক মাস হয়। দুই পক্ষের সমষ্টিতে এক মাস হয় এবং তা পিতৃলোকের এক দিন এবং রাত্রি। 

 

দুই মাসে এক ঋতু হয় এবং ছয় মাসে এক অয়ন হয়, তা দক্ষিণ ও উত্তর ভেদে দ্বিবিধ। দুই অয়নে দেবতাদের এক দিন এবং রাত্রি হয় এবং দেবতাদের সেই দিবারাত্র মানুষদের গণনায় এক বছর হয়। মানুষদের আয়ু এক শত বৎসর। 

 

প্রভাবশালী নক্ষত্র, গ্রহ, জ্যোতিষ্ক এবং পরমাণু সমগ্র বিশ্বে পরমেশ্বর ভগবানের নির্দেশনায় তার প্রতিনিধি শাশ্বত কালের প্রভাবে তাদের স্বীয় কক্ষপথে আবর্তিত হচ্ছে। আকাশে সূর্য, বৃহস্পতি, চন্দ্র, নক্ষত্র ও জ্যোতিষ্কের পাঁচটি কক্ষের বিভিন্ন নাম রয়েছে এবং তাদের প্রত্যেকের স্ব-স্ব সংবৎসর রয়েছে।”


"হে বিদুর। সূর্য তাঁর অসীম তাপ এবং আলোকের দ্বারা সমস্ত জীবেদের প্রাণবন্ত করেন। তিনি সমস্ত জীবের আয়ু ক্ষয় করেন যাতে তারা মায়ার বন্ধন থেকে মুক্ত হতে পারে এবং তিনি স্বর্গে উন্নীত হওয়ার পথ প্রশস্ত করেন। 

 

এইভাবে তিনি প্রচণ্ড গতিতে মহাকাশে পরিভ্রমণ করেন এবং তাই সকলের কর্তব্য হচ্ছে প্রতি পাঁচ বছরে একবার পূজার বহুবিধ নৈবেদ্য সহকারে তাঁকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা।"

 

বিদুর বললেন—“আমি এখন পিতৃলোকের, স্বর্গলোকের এবং মনুষ্যলোকের অধিবাসীদের আয়ুষ্কাল সম্বন্ধে অবগত হয়েছি। এখন আপনি দয়া করে সেই সমস্ত জ্ঞানী ও শ্রেষ্ঠ জীবেদের আয়ু সম্বন্ধে বলুন যারা কল্পের সীমার অতীত। হে চিন্ময় শক্তিসম্পন্ন। 

 

আপনি পরমেশ্বর ভগবানের নিয়ন্ত্রণকারীরূপ শাশ্বত কালের গতিবিধি সম্বন্ধে অবগত। আপনি যেহেতু আত্ম- তত্ত্ববেত্তা, তাই আপনি আপনার দিব্য দৃষ্টির প্রভাবে সব কিছু দর্শন করতে পারেন।"


মৈত্রেয় বললেন—“হে বিদুর! চার যুগকে বলা হয় সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর এবং কলিযুগ। এই চার যুগের সমন্বয়ে যে সময়, তা দেবতাদের বার হাজার বছর। সত্যযুগের স্থিতিকাল দেবতাদের ৪,৮০০ বছরের সমান; ত্রেতাযুগের স্থিতিকাল দেবতাদের ৩,৬০০ বছরের সমান; দ্বাপর যুগের স্থিতিকাল দেবতাদের ২,৪০০ বছরের সমান; এবং কলিযুগের স্থিতিকাল দেবতাদের ১,২০০ বছরের সমান। 

 

প্রতিটি যুগের প্রথম এবং শেষ সন্ধিক্ষণ, যা পূর্বের উল্লেখ অনুসারে কেবলমাত্র কয়েক শত বৎসর, তাকেই অভিজ্ঞ জ্যোতিষীরা যুগসন্ধ্যা বলে থাকেন। এই সন্ধিক্ষণে সমস্ত প্রকার ধর্মের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়।”


“হে বিদুর! সত্যযুগে মানুষ যথাযথ রীতি অনুসারে পূর্ণরূপে ধর্মের আচরণ করত, কিন্তু অন্য যুগে অধর্মের বৃদ্ধির ফলে এক এক পাদ করে ধর্মের হ্রাস পেতে থাকে। ত্রিলোকের (স্বর্গ, মর্ত্য এবং পাতাললোকের) বাইরে ব্রহ্মার লোকে এক হাজার চতুর্যুগে এক দিন হয়। 

 

তেমনই ব্রহ্মার রাত্রিকালও ততখানি, এবং বিশ্বের সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা সেই সময় নিদ্রা যান। ব্রহ্মার নিশান্তে যখন ব্রহ্মার দিন শুরু হয়, তখন পুনরায় ত্রিলোকের সৃষ্টি শুরু হয় এবং তারা চতুর্দশ মনুর আয়ুষ্কাল পর্যন্ত বর্তমান থাকে। 

 

প্রত্যেক মনু একাত্তর চতুর্যুগের কিছু অধিক কাল পর্যন্ত জীবন উপভোগ করেন। প্রত্যেক মনুর অবসানে, তাদের বংশধরগণ-সহ পরবর্তী মনুর আবির্ভাব হয়, যিনি বিভিন্ন গ্রহমণ্ডল শাসন করেন, কিন্তু সপ্তর্ষিগণ এবং ইন্দ্রের মতো দেবতাগণ ও গন্ধর্বদের মতো তাঁদের অনুগামীগণ সকলেই মনুর সঙ্গে যুগপৎ আবির্ভূত হন। 

 

সৃষ্টিতে ব্রহ্মার দিবাভাগে, স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল এই ত্রিলোকের আবর্তন হয় এবং সকাম কর্ম অনুসারে, সেখানকার তির্যক, মানুষ, দেব ও পিতৃগণ আদি অধিবাসীদের আবির্ভাব ও তিরোভাব হয়। 

 

প্রত্যেক মন্বন্তরে, পরমেশ্বর ভগবান মনু এবং অন্যান্য অবতাররূপে তাঁর অন্তরঙ্গা শক্তি প্রকাশ করে আবির্ভূত হন। এইভাবে তাঁর শক্তিকে অবলম্বন করে তিনি বিশ্বের পালন করেন।


দিনান্তে, তমোগুণের ক্ষুদ্র অংশের অধীনে, বিশ্বের শক্তিশালী অভিব্যক্তিও রাত্রির অন্ধকারে লীন হয়ে যায়। শাশ্বত কালের প্রভাবে অসংখ্য জীব তখন প্রলয়ে বিলীন হয়ে থাকে এবং তখন সব কিছু নীরব হয়ে যায়। 

 

ব্রহ্মার যখন রাত্রি শুরু হয়, তখন লোকত্ৰয় অদৃশ্য হয়ে যায় এবং ঠিক সাধারণ রাত্রির মতো তখন চন্দ্র ও সূর্য নিষ্প্রভ হয়ে যায়। সঙ্কর্ষণের মুখনিঃসৃত অগ্নির ফলে এই প্রলয় হয় এবং তখন মহলোকের অধিবাসী ভৃগু আদি ঋষিগণ  ত্রিলোকদগ্ধকারী প্রজ্বলিত অগ্নির তাপে পীড়িত হয়ে জনলোকে গমন করেন।

 

প্রলয়ের শুরুতে সমস্ত সমুদ্র বর্ধিত হয় এবং প্রচণ্ড বায়ুবেগে তরঙ্গসমূহ উদ্বেলিত হয়ে,  ত্রিভুবনকে পরিপ্লাবিত করে। পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি তখন মুদ্রিত নয়নে জলের উপর অনন্ত শয্যায় শয়ন   করেন এবং জনলোকের অধিবাসীরা তখন কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁর স্তব করেন। 

 

এইভাবে ব্রহ্মাসহ প্রত্যেক জীবের আয়ু ক্ষয়প্রাপ্ত হয়। বিভিন্ন লোকে কালের গতি অনুসারে  সকলেরই আয়ু একশত বৎসর। ব্রহ্মার শতবর্ষ আয়ু দুভাগে বিভক্ত। তার আয়ুর প্রথম অর্ধভাগ ইতিমধ্যেই গত হয়েছে এবং দ্বিতীয়ার্ধ এখন চলছে। 

 

ব্রহ্মার জীবনের পূর্ব পরার্ধের প্রারম্ভে ব্রাহ্ম-কল্প নামক কল্পে ব্রহ্মার  আবির্ভাব হয়েছিল। বেদের আবির্ভাব এবং ব্রহ্মার জন্ম  একসঙ্গে হয়েছিল। 

 

প্রথম ব্রাহ্ম -কল্পের পরের কল্পকে বলা হয় পাদ্ম-কল্প, কেননা সেই কল্পে ভগবান শ্রীহরির নাভি সরোবর থেকে ব্রহ্মাণ্ডরূপ কমল বিকশিত হয়েছিল। 

 

হে ভারত! ব্রহ্মার আয়ুর দ্বিতীয়ার্ধের প্রথম কল্প বরাহ- কল্প নামেও প্রসিদ্ধ, কেননা সেই কল্পে পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি বরাহরূপে অবতরণ করেছিলেন। ব্রহ্মার জীবনের  দুটি পরার্ধকাল, যা পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে, তা বিকার- এ রহিত, অনন্ত এবং সর্ব জগতের পরম কারণ পরমেশ্বর  ভগবানের এক নিমেষ মাত্র।”


“শাশ্বত কাল অবশ্যই পরমাণু থেকে শুরু করে ব্রহ্মার জীবনকাল পর্যন্ত বিভিন্ন আয়তনের নিয়ন্তা; কিন্তু তা সত্ত্বেও তা পরমেশ্বর ভগবানের নিয়ন্ত্রণাধীন। 

 

কাল কেবল তাদেরই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, যারা দেহচেতনার প দ্বারা প্রভাবিত, এমনকি সত্যলোক পর্যন্ত বা ব্রহ্মাণ্ডের ব অন্যান্য উচ্চতর লোকেও কালের এই প্রভাব বিদ্যমান। । আটটি জড় উপাদানের সমন্বয়ে ষোড়শ প্রকার বিকার থেকে প্রকাশিত এই যে ব্রহ্মাণ্ড, 

 

তার অভ্যন্তর পঞ্চাশ কোটি যোজন বিস্তৃত এবং নিম্নলিখিত আবরণের দ্বারা আবৃত। ব্রহ্মাণ্ডকে আবৃত করে যে সমস্ত তত্ত্ব, তা উত্তরোত্তর দশগুণ অধিক বিস্তৃত এবং সমস্ত ব্রহ্মাণ্ডগুলি এক বিশাল সমন্বয়ে পরমাণুর মতো প্রতিভাত হয়। 

 

তাই পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সর্বকারণের পরম কারণ বলা হয়েছে। এইভাবে বিষ্ণুর চিন্ময় ধাম নিঃসন্দেহে শাশ্বত এবং তা সমস্ত প্রকাশের মূল উৎস মহাবিষ্ণুরও ধাম।”

 

আরও পড়ুনঃ

 

* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব

 

* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা 

 

* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন 

 

* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার

* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?

* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়

* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য) 



কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন