শিবের প্রতি দক্ষের অভিশাপ
শিব ও দক্ষ রাজের কাহিনী
বিদুর জিজ্ঞাসা করলেন—“দক্ষ তাঁর কন্যার প্রতি অত্যন্ত স্নেহপরায়ণ হওয়া সত্ত্বেও কেন সতীকে অবহেলা করেছিলেন এবং সুশীল ব্যক্তিদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শিবের প্রতি ঈর্ষাপরায়ণ হয়েছিলেন?
সমগ্র জগতের গুরু শিব নির্বৈরী, শান্ত এবং আত্মারাম। তিনি সমস্ত দেবতাদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। কিন্তু তা সত্ত্বেও দক্ষ কেন এই প্রকার একজন মঙ্গলময় ব্যক্তির প্রতি বৈরীভাবাপন্ন হয়েছিলেন? হে মৈত্রেয়! দেহত্যাগ করা অত্যন্ত কঠিন।
আপনি কি দয়া করে আমার কাছে বর্ণনা করবেন, কি কারণে শ্বশুর এবং জামাতা এমনই তিক্ত কলহে লিপ্ত হয়েছিলেন, যার ফলে মহাদেবী সতী দেহত্যাগ করেছিলেন ?”
মৈত্রেয় ঋষি বললেন—“পুরাকালে ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টিকার্যের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিগণ এক মহাযজ্ঞের অনুষ্ঠান করেছিলেন, যাতে সমস্ত মহর্ষিগণ, মুনিগণ, দেবতাগণ এবং অগ্নিদেবগণ তাঁদের অনুগামীগণ সহ সমবেত হয়েছিলেন।
প্রজাপতিদের অধিপতি দক্ষ যখন সেই সভায় প্রবেশ করেছিলেন, তখন সূর্যের মতো তাঁর উজ্জ্বল অঙ্গ-প্রভায় সমগ্র সভা আলোকিত হয়েছিল এবং তাঁর সামনে সভায় সমবেত সমস্ত ব্যক্তিদের নিতান্তই নগণ্য বলে মনে হয়েছিল।
ব্রহ্মা এবং শিব ব্যতীত, সমস্ত অগ্নিদেবগণ এবং সেই মহাসভায় অন্যান্য সমবেত সদস্যগণ তাঁর শরীরের জ্যোতির দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, তাঁদের আসন থেকে উঠে দাঁড়িয়েছিলেন। সেই মহান সভার সভাপতি ব্রহ্মা দক্ষকে যথাযোগ্য সম্মান প্রদর্শন করে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
ব্রহ্মাকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে দক্ষ তাঁর আসন গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু আসন গ্রহণ করার পূর্বে, তাঁকে সম্মান প্রদর্শন না করে শিবকে বসে থাকতে দেখে দক্ষ অত্যন্ত অপমানিত হয়েছিলেন। তখন দক্ষ এত ক্রুদ্ধ হয়েছিলেন যে, তাঁর চোখ দুটি জ্বলছিল।
তিনি তখন অত্যন্ত কঠোরভাবে শিবের বিরুদ্ধে বলতে শুরু করেছিলেন। উপস্থিত সমস্ত ঋষিগণ, ব্রাহ্মণগণ এবং অগ্নিদেবগণ ! দয়া করে মনোযোগ সহকারে আপনারা আমার কথা শ্রবণ করুন।
আমি অজ্ঞানতা অথবা মাৎসর্যের ফলে তা বলছি না। লোকপালদের নাম এবং যশ শিব বিনষ্ট করেছে এবং সদাচারের পন্থা কলুষিত করেছে। যেহেতু সে নির্লজ্জ, তাই সে জানে না কিভাবে আচরণ করা উচিত।
সে অগ্নি এবং ব্রাহ্মণদের সমক্ষে আমার কন্যার পাণিগ্রহণ করার ফলে, আমি তার গুরুজন। সে আমার গায়ত্রী-সদৃশ কন্যাকে বিবাহ করেছে এবং তখন সে ঠিক একজন সাধুর মতো ভান করেছিল। তার চোখ ঠিক বানরের মতো, তবুও সে আমার মৃগনয়না কন্যাকে বিবাহ করেছে।
তা সত্ত্বেও সে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে অভিবাদন করেনি এবং মিষ্ট বাক্যের দ্বারা আমাকে স্বাগত জানানো উপযুক্ত বলেও মনে করেনি। শিষ্টাচারের সমস্ত নিয়ম-ভঙ্গকারী এই ব্যক্তিটিকে আমার কন্যাদান করার কোন রকম ইচ্ছা ছিল না।
কারণ বাঞ্ছিত বিধি-নিষেধগুলি পালন না করার ফলে, সে অপবিত্র, কিন্তু শূদ্রকে বেদ পাঠ করানোর মতো আমি আমার কন্যাকে তার হস্তে সম্প্রদান করেছি। সে শ্মশানের মতো অপবিত্র স্থানে বাস করে এবং ভূত- প্রেতেরা হচ্ছে তার সহচর।
সারা শরীরে চিতাভস্ম মেখে, উন্মাদের মতো নগ্ন হয়ে, সে কখনও হাসে এবং কখনও কাঁদে। সে নিয়মিতভাবে স্নান করে না এবং তার অঙ্গের ভূষণ হচ্ছে মুণ্ডমালা এবং অস্থি। তাই সে কেবল নামেই শিব বা শুভ; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, সে সব চাইতে উন্মত্ত এবং অশুভ।
তাই সে তমোগুণাচ্ছন্ন উন্মাদ ব্যক্তিদের অত্যন্ত প্রিয় এবং তাদের অধিপতি। ব্রহ্মার অনুরোধে আমি আমার কন্যাকে তার হস্তে সম্প্রদান করেছি, যদিও সে সমস্ত প্রকার শৌচরহিত এবং তার হৃদয় জঘন্যতম নোংরায় পূর্ণ।”
মহর্ষি মৈত্রেয় বললেন – “এইভাবে শিবকে তাঁর শত্রু বলে মনে করে দক্ষ জল নিয়ে আচমন করে শিবকে অভিশাপ দিয়েছিলেন। দেবতারা যজ্ঞের নৈবেদ্য লাভের অধিকারি, কিন্তু সমস্ত দেবতার মধ্যে সব চাইতে অধম শিব যজ্ঞভাগ পাবে না।
হে বিদুর! যজ্ঞসভার সদস্যদের অনুরোধ সত্ত্বেও, দক্ষ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে শিবকে অভিশাপ দিয়েছিলেন এবং তার পর সেই সভা ত্যাগ করে তাঁর গৃহে ফিরে গিয়েছিলেন। শিবকে অভিশাপ দেওয়া হয়েছে জানতে পেরে, শিবের প্রধান পার্ষদদের অন্যতম নন্দীশ্বর অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হন।
ক্রোধে তাঁর চক্ষু লাল আরক্তিম হয়ে ওঠে এবং দক্ষ ও সেখানে উপস্থিত যে- সমস্ত ব্রাহ্মণেরা দক্ষের কর্কশ বাক্যে শিবকে অভিশাপ দেওয়া সহ্য করেছিলেন, তিনি তাঁদের সকলকেই অভিশাপ দিতে মনস্থ করেন।
যে ব্যক্তি দক্ষকে সর্বশ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে মনে করে ঈর্ষাবশত শিবকে অবহেলা করেছে, সে মূর্খ, তার এই ভেদভাবের ফলে সে দিব্য জ্ঞান থেকে বঞ্চিত হবে। 'কপট ধর্মপরায়ণ যে-গৃহস্থ-জীবনে মানুষ জড়-জাগতিক সুখের প্রতি অত্যন্ত আসক্ত হয় এবং তার ফলে বেদের আপাত ব্যাখ্যার প্রতি আকৃষ্ট হয়, তাতেই তার বুদ্ধি ভ্রষ্ট হয় এবং সে সকাম কর্মকেই জীবনের চরম লক্ষ্য বলে মনে করে তাতে লিপ্ত হয়।
দক্ষ তার দেহকেই সর্বস্ব বলে মনে করেছে। তাই যেহেতু সে বিষ্ণুপাদ বা বিষ্ণুগতির কথা ভুলে গেছে এবং কেবল স্ত্রীসম্ভোগের প্রতি আসক্ত হয়েছে, তাই অচিরেই সে একটি ছাগলের মুখ প্রাপ্ত হবে।
যারা জড় বিদ্যা এবং বুদ্ধির অনুশীলনের ফলে জড়ের মতো নির্বোধ হয়ে গেছে, তারা অজ্ঞানতাবশত সকাম কর্মে লিপ্ত হয়। তারা জেনেশুনে শিবের নিন্দা করেছে, তাই তারা জন্ম-মৃত্যুর চক্রে বার বার আবর্তিত হতে থাকুক।
যারা বেদের মোহময়ী প্রতিজ্ঞার পুষ্পময়ী ভাষায় আকৃষ্ট এবং তার ফলে জড়তে পরিণত হয়ে শিবের প্রতি বিদ্বেষভাবাপন্ন হয়েছে, তারা সর্বদা সকাম কর্মের প্রতি আসক্ত থাকুক। এই সমস্ত ব্রাহ্মণেরা কেবল তাদের দেহ ধারণের জন্য শিক্ষকতা, তপশ্চর্যা এবং ব্রত গ্রহণ করে।
তাদের ভক্ষ্যাভক্ষ্য বিচার থাকবে না। তারা কেবল দেহসুখের জন্য দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভিক্ষা করে ধন সংগ্রহ করবে। নন্দীশ্বর জাতি-ব্রাহ্মণদের এইভাবে অভিশাপ প্রদান করলে, ভৃগু মুনি তখন শিবের অনুগামীদের ভর্ৎসনা করে প্রচণ্ড ব্রহ্মশাপ দিয়েছিলেন।
যারা শিবের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য ব্রত গ্রহণ করেছে অথবা যারা এই নিয়ম পালন করে, তারা নিশ্চিতভাবে নাস্তিক হবে এবং দিব্য শাস্ত্র- নির্দেশের বিরুদ্ধ আচরণ করবে। যারা শিব-পূজার ব্রত - গ্রহণ করে, তারা এতই মূর্খ যে, তারা জটা, ভস্ম এবং অস্থি ধারণ করে তাঁর অনুকরণ করে।
তারা যখন শিবের উপাসনায় দীক্ষিত হয়, তখন তারা মদ, মাংস, এই প্রকার বস্তু গ্রহণ করে।”
ভৃগু মুনি বললেন—“যেহেতু তুমি বেদ এবং বৈদিক নির্দেশের অনুসরণকারী ব্রাহ্মণদের নিন্দা করেছ, তাই বুঝতে হবে যে, তুমি নাস্তিক মতবাদ অবলম্বন করেছ।
মানব-সভ্যতার কল্যাণের জন্য বেদ শাশ্বত বিধান প্রদান করে, যা পুরাকাল থেকে নিষ্ঠা সহকারে অনুসরণ করা হয়েছে। তার সুদৃঢ় প্রমাণ হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবান, সমস্ত জীবের শুভাকাঙক্ষী বলে যাঁকে জনার্দন বলা হয়।
সাধু ব্যক্তিদের বিশুদ্ধ এবং পরম পথরূপ বৈদিক নিয়মের নিন্দা করে, ভূত-পতি শিবের অনুগামী তোমরা সকলে নিঃসন্দেহে অধঃপতিত হয়ে পাষণ্ডীতে পরিণত হবে।”
মৈত্রেয় ঋষি বললেন—“যখন শিবের অনুচর এবং দক্ষ ও ভৃগুর পক্ষ অবলম্বনকারীদের মধ্যে শাপ-শাপান্ত হচ্ছিল, তখন ভগবান শিব অত্যন্ত বিষণ্ণ হয়েছিলেন। কিছু না বলে, তাঁর অনুগামীদের সঙ্গে সেই যজ্ঞস্থল থেকে চলে গিয়েছিলেন।
হে বিদুর! ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত প্রজাপতিরা এইভাবে সহস্র বৎসর ধরে এক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন, কারণ পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরির পূজা করার সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা হচ্ছে যজ্ঞ। হে ধনুর্বাণধারী বিদুর যজ্ঞকর্তা সমস্ত দেবতারা যজ্ঞ সমাপ্তির পর, গঙ্গা এবং যমুনার সঙ্গমে স্নান করেছিলেন।
এই স্নানকে বলা হয় অবভূথ-স্নান। এইভাবে অন্তরে পবিত্র হয়ে, তাঁরা তাঁদের স্ব-স্ব ধামে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।”
আরও পড়ুনঃ
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?
* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়
* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য)