প্রহ্লাদ মাতৃগর্ভে কি শিখেছিল - শ্রীমদ্ভগবদ গীতা যথাযথ বাংলা

নতুন পোষ্ট

Add

শুক্রবার, ১৯ মে, ২০২৩

প্রহ্লাদ মাতৃগর্ভে কি শিখেছিল

 
প্রহ্লাদ মাতৃগর্ভে কি শিখেছিল

প্রহ্লাদ মাতৃগর্ভে কিভাবে হরি ভক্তি শিখেছিল


নারদ মুনি বললেন—“প্রহ্লাদ মহারাজ যদিও অসুরকুলে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তবুও তিনি সমস্ত ভক্তদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। 

 

তাঁর সহপাঠী অসুর-বালকদের দ্বারা এইভাবে জিজ্ঞাসিত হয়ে, তিনি আমার কথিত উপদেশসমূহ হেসে তাদের বলেছিলেন—আমাদের পিতা হিরণ্যকশিপু যখন তপস্যা করার জন্য মন্দর পর্বতে গিয়েছিলেন,

 

তখন তাঁর অনুপস্থিতিতে ইন্দ্ৰ আদি দেবতারা দানবদের দমন করার জন্য এক ভীষণ যুদ্ধের আয়োজন করেছিলেন। ‘আহা! পিপীলিকা যেমন সর্পকে ভক্ষণ করে, তেমনই সর্বদা সকলের সন্তাপ প্রদানকারী হিরণ্যকশিপুও তার পাপকর্মের ফলে বিনষ্ট হয়েছে।' 

 

এই বলে ইন্দ্র আদি দেবতারা দৈত্যদের সঙ্গে যুদ্ধের আয়োজন করেছিলেন। অসুর যূথপতিরা যখন যুদ্ধে একে একে দেবতাদের হস্তে নিহত হতে লাগল, তখন অন্য অসুরেরা নানাদিকে পলায়ন করতে শুরু করল। 

 

তাদের প্রাণ রক্ষার জন্য তারা এতই ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল যে, তারা তাদের গৃহ, স্ত্রী, পুত্র, পশু এবং গৃহের উপকরণের প্রতি দৃষ্টিপাতও করতে পারেনি। বিজয়ী দেবতারা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর প্রাসাদ লুণ্ঠন করেছিলেন এবং সেখানকার সব কিছু বিনষ্ট করেছিলেন।


তারপর দেবরাজ ইন্দ্র আমার মাতা দৈত্য-রাজমহিষীকে বন্দী করেছিলেন। শকুনের কবলগ্রস্ত কুররী পক্ষীর মতো ক্রন্দন-পরায়ণা আমার মাকে যখন তাঁরা নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ঘটনাক্রমে নারদ মুনি সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। এবং সেই অবস্থায় আমার মাকে দর্শন করেছিলেন।”


নারদ মুনি বললেন—“হে দেবরাজ ইন্দ্র, এই নিষ্পাপ রমণীকে এই রকম নিষ্ঠুরভাবে নিয়ে যাওয়া তোমার উচিত নয়। হে মহাভাগ্যবান, এই সতী অন্যের স্ত্রী, একে তুমি এখনই মুক্ত কর, মুক্ত কর।”


দেবরাজ ইন্দ্র বললেন—“এই দানবপত্নীর গর্ভে সেই মহাদৈত্য হিরণ্যকশিপুর বীজ রয়েছে। তাই যতদিন না প্রসব হয়, ততদিন আমি একে আমার তত্ত্বাবধানে রাখব, তারপর পুত্রের জন্ম হলে একে মুক্ত করব।”


নারদ মুনি উত্তর দিলেন — “এই রমণীর গর্ভস্থ শিশুটি নির্দোষ এবং নিষ্পাপ। প্রকৃতপক্ষে সে একজন মহাভাগবত, ভগবানের এক মহা প্রভাবসম্পন্ন অনুচর। তাই তুমি একে বধ করতে পারবে না।”


“দেবর্ষি নারদ এইভাবে বললে, দেবরাজ ইন্দ্র তাঁর বাক্য অনুসারে তৎক্ষণাৎ আমার মাতাকে মুক্ত করেছিলেন। আমি ভগবানের ভক্ত বলে সমস্ত দেবতারা তখন আমার মাকে প্রদক্ষিণ করেছিলেন এবং তারপর তাঁরা স্বর্গলোকে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন।”


প্রহ্লাদ মহারাজ বললেন—“দেবর্ষি নারদ আমার মাতাকে তাঁর আশ্রমে নিয়ে এসেছিলেন এবং তাঁকে সর্বতোভাবে রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে বলেছিলেন, 'হে বৎসে, তোমার পতি ফিরে না আসা পর্যন্ত তুমি আমার আশ্রমে থাক।' 

 

দেবর্ষি নারদের উপদেশ অঙ্গীকার করে আমার মাতা সর্বতোভাবে ভয়মুক্ত হয়ে, আমার পিতা দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপু তাঁর কঠোর তপস্যা থেকে নিবৃত্ত হয়ে ফিরে না আসা পর্যন্ত, তাঁর আশ্রয়ে ছিলেন। 

 

গর্ভবতী সতী আমার মাতা তাঁর গর্ভের মঙ্গল কামনা করে তাঁর পতির আগমনের পর প্রসব করার বাসনা করেছিলেন। এইভাবে তিনি পরম ভক্তি সহকারে নারদ মুনির সেবা করে তাঁর আশ্রমে অবস্থান করেছিলেন। 

 

নারদ মুনি গর্ভস্থ আমি এবং পরিচর্যারত আমার মাতা উভয়কেই তত্ত্বজ্ঞান উপদেশ দিয়েছিলেন। যেহেতু তিনি স্বভাবতই অধঃপতিত জীবদের প্রতি অত্যন্ত দয়ালু, তাই তাঁর চিন্ময় স্থিতিতে অবস্থিত হয়ে তিনি ধর্মতত্ত্ব এবং দিব্য জ্ঞান প্রদান করেছিলেন। 

 

সেই উপদেশ সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত ছিল। দীর্ঘকাল গত হওয়ায় এবং স্ত্রীজাতি বলে আমার মা সেই সমস্ত উপদেশ বিস্মৃত হয়েছেন; কিন্তু দেবর্ষি নারদের অনুগ্রহে আমি তা ভুলিনি।”


“হে বন্ধুগণ, তোমরা যদি আমার বাক্যে শ্রদ্ধাবান হও, তা হলে কেবল সেই শ্রদ্ধার ফলে তোমরাও ছোট্ট বালক হওয়া সত্ত্বেও, আমার মতো এই দিব্যজ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে। তেমনই, স্ত্রীলোকেরাও এই জ্ঞান হৃদয়ঙ্গম করে জানতে পারবেন আত্মা কি এবং জড় পদার্থ কি। 

 

বৃক্ষের ফল এবং ফুলের যেমন কালবশত ছয় প্রকার বিকার (জন্ম, স্থিতি, বৃদ্ধি, রূপান্তর, ক্ষয় এবং মৃত্যু) হয়, তেমনই জীবাত্মার বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রাপ্ত জড় দেহেরও এই প্রকার পরিবর্তন হয়। কিন্তু আত্মার কোন পরিবর্তন হয় না। 

 

‘আত্মা’ শব্দে ভগবান অথবা জীবকে বোঝায়। তাঁরা উভয়েই চিন্ময়, জন্ম-মৃত্যু রহিত, অব্যয়, জড় কলুষ থেকে মুক্ত, স্বতন্ত্র, ক্ষেত্রজ্ঞ, সব কিছুর আশ্রয়, বিকারশূন্য, আত্মদর্শী, সর্বকারণ, সর্বব্যাপ্ত, জড় দেহের উপর নির্ভরশীল নয় এবং তাই সর্বদা অনাবৃত। 

 

যে ব্যক্তি আত্মার এই বারোটি গুণ সম্বন্ধে অবগত, তিনি যথার্থ বিদ্বান্ এবং তাঁর কর্তব্য ‘এই জড় শরীরটি আমি এবং এই শরীরের সঙ্গে সম্পর্কিত সব কিছু আমার' মোহজনিত এই ভ্রান্ত ধারণা ত্যাগ করা। 

 

দক্ষ ভূতত্ত্ববিদ্, যেমন বুঝতে পারেন কোথায় সোনা রয়েছে এবং বিভিন্ন পন্থার দ্বারা স্বর্ণবিশিষ্ট প্রস্তর থেকে স্বর্ণ সংগ্রহ করতে পারেন, 

 

তেমনই অভিজ্ঞ অধ্যাত্মবিদ বুঝতে পারেন কিভাবে জড় দেহের মধ্যে চিন্ময় আত্মা রয়েছে এবং এইভাবে আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অনুশীলনের দ্বারা তিনি আধ্যাত্মিক সিদ্ধি লাভ করতে পারেন। 

 

কিন্তু, অনভিজ্ঞ ব্যক্তি যেমন বুঝতে পারে না কোথায় সোনা রয়েছে, তেমনই যে ব্যক্তি আধ্যাত্মিক জ্ঞানের অনুশীলন করেনি সে কখনই বুঝতে পারে না কিভাবে দেহের ভিতর আত্মা রয়েছে। 

 

ভগবানের আটটি ভিন্ন জড় শক্তি, তিনটি গুণ এবং ষোড়শ বিকার (একাদশ ইন্দ্রিয় এবং মাটি, জল আদি পঞ্চ মহাভূত)—এই সবের মধ্যে এক আত্মা সাক্ষীরূপে বিরাজমান। তাই সমস্ত মহান আচার্যেরা উল্লেখ করেছেন যে, আত্মা এই সমস্ত জড় উপাদানের দ্বারা আবদ্ধ। 

 

প্রতিটি জীবের দুই প্রকার শরীর রয়েছে— পঞ্চ ভূতাত্মক স্থূল শরীর এবং মন, বুদ্ধি ও অহঙ্কারের দ্বারা রচিত সূক্ষ্ম শরীর। 

 

এই শরীরের মধ্যে রয়েছে চিন্ময় আত্মা। মানুষের কর্তব্য “এটি নয়, এটি নয়,” এইভাবে বিচার করে আত্মার অনুসন্ধান করা এবং  এইভাবে চিন্ময় আত্মা ও জড় পদার্থের মধ্যে পার্থক্য স নিরূপণ করা। 

 

ধীর এবং দক্ষ ব্যক্তিদের কর্তব্য,  বিশ্লেষণের দ্বারা পবিত্র মনের সাহায্যে সৃষ্টি, স্থিতি এবং বিনাশধৰ্মী সমস্ত বস্তুর সঙ্গে আত্মার সম্পর্ক এবং পার্থক্য নিরূপণ করা। বুদ্ধির তিনটি বৃত্তি—জাগ্রত, স্বপ্ন এবং সুষুপ্তি। 

 

যিনি এই তিনটি বৃত্তিকেই অনুভব করেন, তিনিই আদি নিয়ন্তা, পরম পুরুষ, পরমেশ্বর ভগবান। সৌরভের দ্বারা যেমন বায়ুর উপস্থিতি অনুভব করা যায়, তেমনই ভগবানের পরিচালনায় বুদ্ধির এই তিন বিভাগের দ্বারা আত্মাকে হৃদয়ঙ্গম করা যায়। 

 

এই তিনটি বিভাগ কিন্তু আত্মা নয়; সেগুলি তিন গুণ সমন্বিত এবং ক্রিয়া থেকে উৎপন্ন। কলুষিত বুদ্ধির ফলে মানুষ জড়া প্রকৃতির গুণের বশীভূত হয় এবং তার ফলে সে জড় জগতের বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে পড়ে। 

 

 স্বপ্নে যেমন মানুষ অলীক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করে, তেমনই অজ্ঞানজনিত সংসার অবাঞ্ছিত এবং নশ্বর। অতএব, হে বন্ধু দৈত্যবালকগণ, তোমাদের কর্তব্য কৃষ্ণভক্তির পন্থা অবলম্বন করা, 

 

যার ফলে জড়া প্রকৃতির প্রভাবে কৃত্রিমভাবে উৎপন্ন সকাম কর্মের বীজ দগ্ধ হবে এবং জাগ্রত, স্বপ্ন ও সুষুপ্তি অবস্থায় বুদ্ধির প্রবাহ নিবৃত্ত হবে। অর্থাৎ, কেউ যখন কৃষ্ণভক্তির পন্থা অবলম্বন করেন, তখন তাঁর অজ্ঞান সঙ্গে সঙ্গে দূর হয়ে যায়।”  


“ভব-বন্ধন থেকে মুক্ত হওয়ার যে সমস্ত উপায় রয়েছে, তার মধ্যে স্বয়ং ভগবান প্রদত্ত পন্থাটি সর্বশ্রেষ্ঠ বলে জানতে হবে। সেই পন্থাটি হচ্ছে ভগবৎ প্রেম বিকশিত করার কর্তব্য কর্মের অনুষ্ঠান। 

 

মানুষের কর্তব্য সদ্গুরু গ্রহণ করে গভীর শ্রদ্ধা এবং ভক্তি সহকারে তাঁর সেবা করা। নিজের যা কিছু রয়েছে তা সবই শ্রীগুরুদেবকে নিবেদন করা উচিত এবং সাধু ও ভক্তদের সঙ্গে ভগবানের আরাধনা করা, 

 

শ্রদ্ধা সহকারে ভগবানের মহিমা শ্রবণ করা, ভগবানের দিব্য গুণাবলী এবং কার্যকলাপের মহিমা কীর্তন করা, সর্বদা ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের ধ্যান করা এবং শাস্ত্র ও গুরুর নির্দেশ অনুসারে গভীর নিষ্ঠা সহকারে ভগবানের শ্রীবিগ্রহের আরাধনা করা উচিত। 

 

প্রতিটি জীবের হৃদয়ে পরমাত্মারূপে বিরাজমান ভগবানকে সর্বদা স্মরণ করা উচিত। এইভাবে প্রতিটি জীবকে তার স্থিতি অনুসারে সম্মান করা উচিত। 

 

এই সমস্ত কার্যকলাপের দ্বারা মানুষ কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ এবং মাৎসর্য—এই ষড়রিপুকে জয় করে ভগবদ্ভক্তি সম্পাদন করতে সক্ষম হন। এইভাবে তিনি নিশ্চিতরূপে ভগবানের প্রেমময়ী সেবার স্তর প্রাপ্ত হন। 

 

যে ব্যক্তি ভগবদ্ভক্তির স্তর প্রাপ্ত হয়েছেন, তিনি অবশ্যই তাঁর ইন্দ্রিয়গুলিকে বশীভূত করেছেন এবং তার ফলে তিনি মুক্ত পুরুষ। এই প্রকার মুক্ত পুরুষ, বা শুদ্ধ ভগবদ্ভক্ত যখন লীলাবিলাস পরায়ণ ভগবানের বিবিধ অবতারের দিব্য গুণাবলী এবং অসাধারণ বীর্যবর্তী কার্যকলাপ শ্রবণ করেন, 

 

অত্যন্ত আনন্দবশত তাঁর শরীর রোমাঞ্চিত হয়, চোখ থেকে অশ্রু ঝরে পড়ে এবং কণ্ঠ রুদ্ধ হয়। কখনও কখনও তিনি মুক্ত কণ্ঠে গান করেন, নৃত্য করেন এবং কখনও কখনও তিনি ক্রন্দন করেন। এইভাবে তিনি তাঁর দিব্য আনন্দ প্রকাশ করেন। 

 

ভক্ত যখন গ্রহগ্রস্ত ব্যক্তির মতো হয়ে যান, তখন তিনি হাসেন, উচ্চস্বরে ভগবানের গুণাবলী কীর্তন করেন, কখনও তিনি ধ্যান করেন, প্রতিটি জীবকে ভগবানের সেবায় যুক্ত বলে মনে করে তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন, 

 

নিরন্তর দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন, সামাজিক শিষ্টাচার গ্রাহ্য না করে পাগলের মতো উচ্চস্বরে “হরেকৃষ্ণ, হরেকৃষ্ণ! হে ভগবান, হে জগৎপতে!” এইভাবে বলতে থাকেন। 

 

নিরন্তর ভগবানের লীলা স্মরণ করার ফলে, ভক্তের মন এবং শরীর তখন সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে চিন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয়। তাঁর ঐকান্তিক ভক্তির ফলে তাঁর অজ্ঞান, জড় চেতনা এবং সর্বপ্রকার জড় বাসনা ভস্মীভূত হয়ে যায়। 

 

এই স্তরে মানুষ ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় লাভ করতে পারে। জীবনের প্রকৃত সমস্যা হচ্ছে জন্ম-মৃত্যুর চক্র। কিন্তু জীব যখন ভগবানের সংস্পর্শে আসে, তখন এই চক্রের গতি সম্পূর্ণরূপে স্তব্ধ হয়।

 

 অর্থাৎ, ভগবদ্ভক্তিতে নিরন্তর মগ্ন থাকার ফলে যে দিব্য আনন্দ আস্বাদন হয়, তার ফলে জীব এই সংসার থেকে পূর্ণরূপে মুক্ত হয়ে যায়। সমস্ত বিজ্ঞ ব্যক্তিরা সেই কথা জানেন। 

 

অতএব, হে বন্ধুগণ, হে দৈত্যনন্দনগণ, তোমরা তোমাদের অন্তরের অন্তস্তলে সেই অন্তর্যামী পরমেশ্বরের ধ্যান করে তাঁর আরাধনা কর।”


“হে বন্ধুগণ! হে অসুর বালকগণ! পরমাত্মারূপে ভগবান সর্বদাই সমস্ত জীবের হৃদয়ে বিরাজ করেন। প্রকৃতপক্ষে তিনি সমস্ত জীবের শুভাকাঙ্ক্ষী এবং বন্ধু এবং তাঁর উপাসনায় কোন অসুবিধা নেই। 

 

তা হলে লোকেরা কেন তাঁর প্রতি ভক্তিপরায়ণ হয় না? কেন তারা ইন্দ্রিয়সুখ ভোগের জন্য কৃত্রিম আয়োজনের চেষ্টায় অনর্থক আসক্ত হয়? 

 

মানুষের ধন, সুন্দরী স্ত্রী এবং বান্ধবী, পুত্র-কন্যা, গৃহ, ভূমি, গাভী, হস্তী, অশ্ব আদি গৃহপালিত পশু, ধনাগার, অর্থ এবং কাম, এমন কি এই সমস্ত জড় ঐশ্বর্য ভোগ করার পরমায়ু সমস্তই ক্ষণভঙ্গুর এবং অস্থির। 

 

যেহেতু মনুষ্য-জীবন অনিত্য, অতএব যে ব্যক্তি বুঝতে পেরেছেন যে তিনি নিত্য, সেই বিচক্ষণ ব্যক্তিকে কি এই সমস্ত জড় ঐশ্বর্য সুখ প্রদান করতে পারে? 

 

বৈদিক শাস্ত্র থেকে জানা যায় যে, যজ্ঞ অনুষ্ঠানের ফলে স্বর্গলোকে উন্নীত হওয়া যায় । কিন্তু, স্বর্গলোকের জীবন যদিও এই পৃথিবীর জীবন থেকে শত-সহস্রগুণ অধিক সুখকর, তবুও স্বর্গলোক শুদ্ধ (নির্মলম্) অথবা জড় অস্তিত্বের ত্রুটি থেকে মুক্ত নয়। 

 

স্বর্গলোকও অনিত্য এবং তাই সেই লোক প্রাপ্ত হওয়া জীবনের উদ্দেশ্য নয়। কিন্তু ভগবানের মধ্যে কোন প্রকার ত্রুটি কেউ কখনও দেখেনি বা শোনেনি। তাই, তোমাদের কর্তব্য তোমাদের প্রকৃত লাভের জন্য এবং আত্ম উপলব্ধির জন্য শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে পরম ভক্তি সহকারে ভগবানের আরাধনা করা। 

 

জড় বিষয়াসক্ত ব্যক্তি নিজেকে অত্যন্ত বুদ্ধিমান বলে মনে করে, নিরন্তর অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনের জন্য কর্ম করে। কিন্তু বার বার বেদবিহিত সকাম কর্মের অনুষ্ঠান করে সে ইহলোকে অথবা পরলোকে নিরাশ হয়। 

 

প্রকৃতপক্ষে, সে তার বাঞ্ছিত ফল লাভ না করে তার বিপরীত ফল লাভ করে। এই জড় জগতে সমস্ত বিষয়াসক্ত ব্যক্তিরা সুখ লাভের এবং দুঃখ দূরীকরণের চেষ্টা করে এবং সেই উদ্দেশ্যে কর্ম করে। 

 

কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মানুষ তখনই সুখী হয়, যখন সে সুখের জন্য কোন রকম চেষ্টা করে না। মানুষ যখনই সুখের জন্য চেষ্টা করতে শুরু করে, তখনই তার দুঃখভোগ শুরু হয়। 

 

জীব তার দেহসুখ কামনা করে এবং সেই উদ্দেশ্যে বহু পরিকল্পনা করে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে দেহটি অন্যের সম্পত্তি। প্রকৃতপক্ষে, নশ্বর দেহটি জীবাত্মাকে আলিঙ্গন করে এবং তারপর তাকে ছেড়ে চলে যায়।

 

যেহেতু দেহটি চরমে বিষ্ঠা অথবা মাটিতে পরিণত হবে, তখন দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত পত্নী, গৃহ, ধন, সন্তান, আত্মীয়, ভৃত্য, বন্ধু, রাজ্য, কোষাগার, পশু, মন্ত্রী ইত্যাদির কি প্রয়োজন? 

 

সেই সবই অনিত্য। সেই সম্বন্ধে অধিক কি বলার আছে? যতক্ষণ দেহের অস্তিত্ব থাকে, ততক্ষণই এই সমস্ত বস্তু অত্যন্ত প্রিয় বলে মনে হয়, কিন্তু দেহ বিনষ্ট হয়ে যাওয়া মাত্রই দেহের সঙ্গে সম্পর্কিত এই সমস্ত বস্তুগুলির আর অস্তিত্ব থাকে না। 

 

তাই, প্রকৃতপক্ষে এগুলির কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু অবিদ্যার ফলে সেগুলি অনর্থ হলেও অর্থের মতো প্রতীত হয়। নিত্য আনন্দ-রসের সমুদ্রের তুলনায় সেগুলি অত্যন্ত তুচ্ছ। নিত্য আত্মার এই প্রকার তুচ্ছ সম্পর্কের কি প্রয়োজন ?”


“হে অসুরনন্দন বন্ধুগণ, জীব তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে বিভিন্ন প্রকার শরীর প্রাপ্ত হয়। তার ফলে গর্ভে প্রবেশ থেকে শুরু করে তার বিশেষ শরীরের সমস্ত অবস্থাতেই তাকে নানা প্রকার দুঃখকষ্ট ভোগ করতে হয়। 

 

তাই, পূর্ণরূপে বিবেচনা করে তোমরাই বল, যে সকাম কর্ম চরমে কেবল দুঃখ-দুর্দশাই প্রদান করে, তা অনুষ্ঠান করে কি লাভ? দেহধারী জীবের পূর্বকৃত কর্মের ফল এই জীবনে সমাপ্ত হতে পারে, কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে, সে জড় দেহের বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে গেছে।  

 

জীব তার পূর্বকৃত কর্ম অনুসারে এক শরীর প্রাপ্ত হয় এবং সেই শরীরের দ্বারা অনুষ্ঠিত কর্মের প্রভাবে সে আর একটি শরীর তৈরি করে। এইভাবে সে তার অজ্ঞানের ফলে, জন্ম-মৃত্যুর মাধ্যমে এক দেহ থেকে আর এক দেহে দেহান্তরিত হয়। 

 

পারমার্থিক উন্নতির চারটি বর্গ— ধর্ম, অর্থ, কাম এবং মোক্ষ পরমেশ্বর ভগবানের উপর আশ্রিত। তাই হে বন্ধুগণ, ভগবস্তুক্তের পদাঙ্ক অনুসরণ কর। কোন রকম কামনা না করে, ভগবানের উপর সর্বতোভাবে নির্ভরশীল হয়ে, ভক্তি সহকারে সেই পরম আত্মা ভগবানের আরাধনা কর। 

 

পরমেশ্বর ভগবান শ্রীহরি সমস্ত জীবের আত্মস্বরূপ এবং অন্তর্যামী। সমস্ত জীবই চিন্ময় আত্মা এবং জড় দেহের পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরই শক্তির প্রকাশ। 

 

তাই ভগবান পরম প্রিয় এবং পরম নিয়ন্তা। দেবতা, অসুর, মানুষ, যক্ষ, গন্ধর্ব অথবা এই জগতের যে কেউই যদি মুক্তিদাতা মুকুন্দের শ্রীপাদপদ্মের সেবা করেন, তা হলে তিনি ঠিক আমাদেরই মতো (প্রহ্লাদ মহারাজ আদি মহাজনদের মতো) পরম মঙ্গলময় স্থিতি লাভ করেন।”


“হে অসুরনন্দনগণ! ব্রাহ্মণত্ব, দেবত্ব, ঋষিত্ব, সদাচার এবং পাণ্ডিত্যের দ্বারা ভগবানের প্রসন্নতা বিধান করা যায় না। এই সমস্ত গুণগুলি ভগবানকে আনন্দ দান করে না। এমন কি দান, তপস্যা, যজ্ঞ, শৌচ, ব্রত ইত্যাদির দ্বারাও ভগবানের প্রসন্নতা বিধান করা যায় না। 

 

ভগবান কেবল অবিচল, ঐকান্তিক ভক্তির দ্বারাই প্রসন্ন হন। একনিষ্ঠ ভক্তি ব্যতীত অন্য সব কিছুই কেবল লোক দেখানো অভিনয় মাত্র। হে অসুরনন্দন বন্ধুগণ, যেভাবে তোমরা নিজেদের ভালবাস এবং নিজেদের দেখাশোনা কর, 

 

ঠিক সেইভাবে, সমস্ত জীবের অন্তর্যামীরূপে যিনি সর্বত্র বিরাজমান, সেই ভগবানের প্রসন্নতা বিধানের জন্য তাঁর সেবা কর। 

 

হে দৈত্যনন্দন বন্ধুগণ! যক্ষ, রাক্ষস, নির্বোধ স্ত্রী, শূদ্র, গোপ, পক্ষী, পশু এবং পাপী জীবেরাও কেবলমাত্র ভক্তিযোগের পন্থা অবলম্বন করার মাধ্যমে শাশ্বত আধ্যাত্মিক জীবন লাভ করে অমৃতত্ব প্রাপ্ত হতে পারে। 

 

এই জগতে সর্বকারণের পরম কারণ গোবিন্দের শ্রীপাদপদ্মের সেবা করা এবং সর্বত্র তাঁকে দর্শন করাই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য। এটিই মানব-জীবনের চরম লক্ষ্য, যা সমস্ত শাস্ত্রে বিশ্লেষণ করা হয়েছে।”


আরও পড়ুনঃ


* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব


* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা 


* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন 


* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার


* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?


* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়


* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য) 

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন