আমরা যখন রাস্তা দিয়ে যাতায়াত করি তখন আমরা অনেক গাড়ি বা সি এন জি দেখি যেগুলো অনেক সময় ধরে ফিলিং স্টেশনে দারিয়ে থাক।
আচ্ছা বলুন তো এ দাঁড়িয়ে থাকা কি তাদের জন্য এক বিশাল সময়ের অপচয় নয় কি? এ সময়কে কাজে লাগিয়ে অনেক অর্থ উপার্জন করা যেত।
কিন্তু সত্য এই যে, যেকোন লোক সে যদি তত বুদ্ধিমান ও না হয় এক বাক্যে স্বীকার করবে, না এটি অপচয় নয়। দীর্ঘ লাইনে ধরে গ্যাস অথবা তেল নেয়া পরবর্তী সময়গুলোতে যথার্থরূপে কাজ করার জন্য এক বিনিয়োগ।
কেন বলছি এ কথা? হ্যাঁ ঠিক তেমনই আমরা যখন হরিনাম জপ করি তখন একটি কথা প্রায়শই আমাদের নিকট বহু জন প্রশ্ন করে এভাবে বলে ব্যয় করছেন ততক্ষণে আপনি অন্য কোন কাজে সময় দিলে আরও লাভবান হতেন।
এটি একটি সময়ের অপচয় ছাড়া আর কিছু নয়। সুতরাং এটি খুবই স্পষ্ট হচ্ছে মস্তিস্কের কার্যক্ষমতা বাড়ানোর ফলে ভবিষ্যতে ভাল ফল প্রাপ্ত হওয়ার জন্য মন্ত্র মেডিটেশনের জন্য অতিবাহিত সময় কোন অপচয় নয় বরং এক বিশাল বিনিয়োগ।
চলুন একটি দৃষ্টান্তমূলক গল্প দিয়ে তা আরেকটু পরিষ্কার করিঃ একদা এক বনে দুইজন ব্যক্তি প্রতিদিন কাঠ কাঁটতে যেত। যার অন্যজন যথেষ্ট বৃদ্ধ এবং আরেকজন সতেজ যুবক। একদিন তারা সিদ্ধান্ত নিল প্রতিদিন একই কাজ তাদের মধ্যে একঘেয়েমির সৃষ্টি করছে,
তাই তারা তা কাটানোর জন্য একদিন প্রতিযোগিতা করে কাঠ কাঁটতে চাই এতে তাদের কাজও হবে আর আনন্দও হবে। যথারীতি খুব ভোরে তারা গহীন বনে প্রতিযোগিতা শুরু করল।
তরুণ যুবক শুরু থেকেই খুব তৎপর ছিল। আর বৃদ্ধ যথারীতি গতিতে কাঠ কাটতে লাগল এবং কিছুক্ষণ পর পর কাজে বিরতি নিত।
দিন শেষে যখন ফলাফল হিসেব করা হল তখন বৃদ্ধই জয়ী হল। তরুণ সে জয় মেনে নিতে পারল না এবং প্রতারণার অভিযোগ করল আর দুইজনই বিবাদে জড়িয়ে পড়ল।
তাদের ঝগড়া বাড়তে বাড়তে এক পর্যায়ে রাজদরবারে বিচার মন্ডলে পৌছাল। রাজাকে তাদের বিস্তারিত বিবরণ জানানো হলে রাজাও অবাক হয়ে বৃদ্ধের কাছে জয়ের কারণ জানতে চাইল।
বৃদ্ধ বলল, “হে মহারাজ, একথা সত্য যে, তরুণ যুবক প্রথম থেকেই খুবই তৎপর ছিল কিন্তু সে এত বেশি তৎপর ছিল যে, সে কুড়ালে ধার দিতে ভুলে গিয়েছিল এবং একটানা কাজ করতে গিয়ে সে হাঁপিয়ে পড়েছিল।
আর আমি কিছুক্ষণ পরপর বিশ্রাম নিতাম আমার কর্মক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আর সে সুযোগে কুড়ালটিকে ভাল করে শান দিয়ে নিতাম।
এতে করে কম সময়ে আমি খুব ভাল ফল পেলাম। বিশ্রাম নেয়া আমার জন্য সময়ের অপচয় নয় বরং শ্রেষ্ট বিনিয়োগ। মনীষিরা প্রায়ই বলেছেন আমাদের মস্তিস্ক একটি ধারালো ছুড়ির মত একে যত ধার দেয়া যাবে তত তা তীক্ষ্ন হবে। সুতরাং হরিনাম মহামন্ত্র জপ হচ্ছে মস্তিস্কের জন্য সর্বোৎকৃষ্ট ধার দেওয়া।
হরেকৃষ্ণ মহামন্ত্র ভগবানকেও আকর্ষণ করে
এই হরে কৃষ্ণ মহামন্ত্র জপ আমাদের শুধু জাগতিক ভাবেই সাহায্য প্রদান করে না, পারমার্থিক ভাবেও তা কার্যকর। শাস্ত্রে বলা হয়েছে জপ ভগবানকে আকর্ষণ করে। ভগবান তা পদ্মপুরাণে বলেছেন-
ন অহম তিষ্ঠামি বৈকুন্ঠে যোগিনাং হৃদয়েষু বা।
মদ্ভক্তাঃ যত্র গায়ন্তি তত্র তিষ্ঠামি নারদ।।
“হে নারদ, আমি বৈকুণ্ঠেও থাকি না, যোগীদের হৃদয়েও থাকি না। আমার ভক্ত যেখানে আমার নাম কীর্তন করেন আমি সেখানেই অবস্থান করি।”
এই উদ্ধৃতি দিতে গিয়ে একটি সত্য ঘটনা মেন পড়ে গেল। একদা সম্রাট আকবর তাঁর সেনাপতি সহ প্রাতঃভ্রমণে বের হয়ে তার রাজ প্রাসাদের নিকটস্থ এক মন্দিরে প্রবেশ করলেন। প্রবেশ করেই তিনি দেখতে পেলেন সাধুগণ হরিনামে নিমগ্ন।
তাঁরা এতটাই নিমগ্ন যে তারা সম্রাটকে স্বাগতম ও সম্ভাষণ জানাতে ভুলে গেল। আর এ ভেবে সম্রাট প্রচুর ক্রোধিত হয়ে সেনাপতিকে ডেকে আদেশ জারি করলেন যে এ রাজ্যে আর কোনভাবেই হরিনাম করা যাবে না।
যে হরিনাম করবে তাকে কঠোর শাস্তির আওতায় আনা হবে। এ সিদ্ধান্তের পর সকলেই খুবই চিন্তাগ্রস্থ হয়ে পড়লেন। কি করা যায়?
তাঁরা খুব দ্রুত এক জরুরী সভার আয়োজন করলেন। অনেক রকমের প্রস্তাব আসলেও তারা কেউ একমত হতে পারছিল না। তখন এক সাধু প্রস্তাব করলেন যে চলুন আগামীকাল থেকেই সবাই আকবর নাম জপ করি।
তাঁর কথা শুনে সবাই হাস্যরস করতে করতে বলতে লাগল পাগল হয়ে গেছ নাকি? তখন সাধু বললেন, একবার তাঁর প্রস্তাবটি ভেবে দেখার জন্য। পরবর্তীতে আর কোন উপায়ান্ত না দেখে তাঁর প্রস্তাব সবাই মেনে নিল। যে কথা সে কাজ। পরদিন খুব ভোর বেলা থেকে শুরু হল উচ্চস্বরে আকবর নাম জপ।
যথারীতি বেলা বাড়তে লাগল আর জপের ধ্বনিও জোড়ালো হতে লাগল। সম্রাট শয্যা ত্যাগের সময় সে শব্দ শুনতে পেলেন তথাপি কর্ণপাত করলেন না।
কিন্তু যত সময় অতিবাহিত হচ্ছে আকবর নামে ধ্বনি তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। তখন আকবর কৌতুহলী হয়ে রাজকীয় পোশাক, মূকুট বিহীন এবং অগোছালো চুলে মন্দিরে গিয়ে সবাইকে বলতে লাগলেন “ হে আমার প্রিয় প্রজাগণ, আপনাদের কি প্রয়োজন আমাকে কৃপা করে বলুন, আমি আপনাদের সেবা করতে চাই।
তখন সেই সভার মধ্যে এক সাধু বলে উঠল “হে সম্রাট, দেখুন কি অদ্ভুত বিষয় মাত্র কিছুক্ষণ আপনার নাম উচ্চারণ করাতে আপনি আপনার রাজসিংহাসনে স্থির থাকতে পারলেন না। একবার ভেবে দেখুন অনন্ত কোটি বিশ্ব ব্রহ্মান্ডের এত নিরীহ জীব প্রতিটি মুহূর্ত সেই ভগবানকে তাদের হৃদস্থিত প্রেম দিয়ে মুহুর্মুহু ডেকেই যাচ্ছে।
তিনি কিভাবে গোলক বৃন্দাবনে বসে থাকতে পারে বলুন। তিনিও আপনার মত ছুটতে ছুটতে ভক্তের মনোভিলাষ পূর্ণ করার জন্য অবতরণ করেন।” তখন সম্রাট লজ্জিত হলেন আর হরিনামে পূর্ণ স্বাধীনতা প্রদান করলেন।
এই হচ্ছে হরিনামের বাস্তবিক একটি প্রমাণ যাকে বিজ্ঞান বললে অতি উক্তি হবে না। কারণ একদিকে তা প্রমাণসিদ্ধ এবং প্রয়োগিককৃতভাবে বাস্তবিক ফল প্রদানকারী।
হরিনাম জপকারীকে সুরক্ষা প্রদান করে
আমরা সবাই মহাভারত সম্পর্কে জানি। এটি কোন পৌরাণিক কাহিনি নয়। এটি বাস্তব ইতিহাস। পঞ্চপান্ডবকে যখন ছল করে পাশা খেলায় হারিয়ে দ্রৌপদীকে দুষ্ট কৌরবরা জয় করে নিয়ে দুঃশাসন চুলের মুঠি ধরে টানতে টানতে নিচে নিয়ে এসে তাঁর বস্ত্র অপসারণ করছিল তখন দ্রৌপদী সেই শক্তিশালী দুঃশাসনের হাত থেকে রক্ষা পেতে নিজে চেষ্টা করছিলেন।
কিন্তু তথাপি নিরাশ হয়ে তিনি এক হাত দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করছিলেন আর আরেক হাত তুলে ভগবানের কাছে সাহায্য চাইছিলেন, তারপরও শেষ রক্ষা যখন হচ্ছিল না তিনি তখন তাঁর সমস্ত সম্রম দুঃশাসনের হাতে দিয়ে দুই হাত তুলে ভগবানের কাছে তাঁর পরম পবিত্র নাম ধরে উচ্চারণ করলে ভগবান অনন্ত বস্ত্র প্রদান করলেন।
আর সকলেই অবাক হয়ে দেখলেন হরিনাম কিভাবে জপকারী বা হরিনামে আশ্রয় গ্রহণকারীকে সুরক্ষা প্রদান করে।
সুতরাং এ থেকে আমরা এই শিক্ষা নিতে পারি যে, হরিনামকারী সর্বতোভাবে ভগবানের সুরক্ষায় থাকে।
বিশ্বাসের মাত্রার উপর হরিনাম সাড়া দেয়
গীতার (৯/৩) একটি শ্লোক কয়েকদিন ধরে আমার হৃদয়কে খুব নাড়া দিয়েছিল সেখানে ভগবান বলছিলেন-
অশ্রদ্দধানাঃ পুরুষা ধর্মস্যাস্য পরন্তপ।
অপ্রাপ্য মাং নিবর্তন্তে মৃত্যসংসারবর্ত্মনি
হে পরন্তপ! এই ভগবদ্ভক্তিতে যাদের শ্রদ্ধা উদিত হয়নি তারা আমাকে লাভ করতে পারে না। তাই, তারা এই জড় জগতে জন্ম-মৃত্যুর পথে ফিরে আসে।
দ্রৌপদী উপরোক্ত ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়ার পর পঞ্চপান্ডবের উপর অভিমান করে নিজ ঘরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দিলেন, ফলে কেউ তাঁর সাথে যোগাযোগ করতে পারছিলেন না।
পান্ডবরা উপায়ন্তর না দেখে কৃষ্ণকে খবর দিলেন। যথারীতি কৃষ্ণ এলেন কিন্তু দ্রৌপদী তাকেও প্রত্যাখান করেন ও কথা বলতে অস্বীকার করলেন কৃষ্ণ তাকে সান্তনা দিয়ে অভিমান দূর করলেন।
দ্রৌপদী জিজ্ঞাসা করলেন, “তুমি আমাকে কথা দিয়েছিলে আমি স্মরণ করলেই তুমি যেকোন পরিস্থিতিতে আমাকে রক্ষা করবে।
কিন্তু তুমি কেন এত দেরী করলে? আরেকটু হলে আমার সম্ভ্রম হানি হত”। তখন কৃষ্ণ মৃদু হেসে বললেন, “দেখ প্রথমবার তুমি নিজে রক্ষা করার চেষ্টা করছিলে আর তাতে শরণাগতি ছিল না।
দ্বিতীয়বারে তুমি একহাত দিয়ে আমাকে স্মরণ করলেও আমার প্রতি তোমার শতভাগ আস্থা ছিল না। কিন্তু তৃতীয়বারে যখন তুমি সম্পূর্ণ দায়িত্বভার আমাকে অর্পণ করে পূর্ণ শরণাগতি দিয়ে আমার দিব্যনাম উচ্চারণ করলে, তখন আমি তোমাকে সর্বোচ্চ সুরক্ষা প্রদান করেছিলাম।
আর তুমি আমাকে গোলকবিহারী মাধব নামে না ডেকে যদি হৃদয়বিহারী মাধব বলে ডাকতে তবে আমি আরও দ্রুত আসতে পারতাম।
গোলক তো অনেক দূর তাই আসতে দেরী হল। যদি হৃদয়বিহারী বলতে তবে স্বয়ং তোমার হৃদয় থেকে প্রকটিত হতাম।” এতটুকু বিশ্বাস তাই ভগবানের নামে আমাদের থাকা উচিত।
যড়ঙ্গ শরণাগতি হইবে যাঁহার।
তাঁহার প্রার্থনা শুনে শ্রীনন্দকুমার।।
হরিনাম হৃদয় পরিশুদ্ধকারী
মহাপ্রভু বলেছেন-“শ্রীকৃষ্ণ এ কলিযুগে নাম রূপে আবির্ভূত হয়েছেন।” তিনি আমাদের তেমন কোন বিশেষ শাস্ত্র দিয়ে না গেলেও আটটি মন্ত্র আমাদের নির্দেশনামূলক ভাবে প্রদান করেছেন যা শ্রীশ্রী শিক্ষাষ্টক্ নামে পরিচিত। যার প্রথম দুইটি শ্লোক আমাদের জন্য প্রাথমিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রথম শ্লোকে বলেছেন-
চেতোদর্পণমার্জনং ভবমহাদাবাগ্নি-নির্বাপণম্
শ্রেয়ঃকৈরব-চন্দ্রিকা বিতরণম বিদ্যাবধূজীবনম
আনন্দাম্বুধিবর্ধনং প্রতিপদং পূর্ণামৃতাস্বাদনং
সর্বাত্মস্নপণং পরং বিজয়তে শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তনম্ ।।
চিত্তরূপ দর্পণের মার্জনকারী, ভবরূপ মহাদাবাগ্নি নির্বাপণকারী, জীবের মঙ্গলস্বরূপ কৈরবচন্দ্রিকা বিতরণকারী, বিদ্যাবধূর জীবনস্বরূপ, আনন্দ সমুদ্রের বর্ধনকারী, পদে পদে পূর্ণামৃত আস্বাদন স্বরূপ এবং সর্বরূপের শীতলকারী শ্রীকৃষ্ণ সংকীর্তন বিশেষরূপে জয়যুক্ত হোন।
এর পর তিনি দ্বিতীয় শ্লোকে বলেছেন-
হে ভগবান! তোমার নামই জীবের সর্বমঙ্গল বিধান করেন। এইজন্য তোমার ‘কৃষ্ণ’ গোবিন্দ-আদি বহুবিধ নাম তুমি বিস্তার করেছ। সেই নামে তুমি তোমার সর্বশক্তি অর্পণ করেছ এবং সেই নাম স্মরণের কালাদিনিয়ম করনি।
হে প্রভু! এইভাবে কৃপা করে জীবের পক্ষে তুমি তোমার নামকে সুলভ করেছ, তবুও আমার নামপরাধরূপ দুর্দৈব যে তোমার সুলভ নামেও আমার অনুরাগ জন্মাতে দেয় না।
আজ যে বিষয়ে হালকা আলোকপাত করার চেষ্টা করলাম তা আমাদের জড়বিজ্ঞানের ধারণার অতীত এক অতি উন্নত অধ্যাত্ম বিজ্ঞান। যা সকল জল্পনা কল্পনার অতীত এক স্নিগ্ধ বিজ্ঞান, নির্ভুল এবং পরম সত্য।
হরিনাম হচ্ছে ৩০০ বছর ধরে আলো না জ্বলা একটি কক্ষে আলো জ্বালানোর মত। সুরাং নিজের হৃদয়ে হরিনামচন্দ্র রূপ আলো প্রজ্বলিত করুন।