পৃথু মহারাজের উপদেশ-শ্রীমদ্ভাগবত
মহর্ষি মৈত্রেয় বিদুরকে বললেন-"পৃথু মহারাজ যখন তাঁর নগরীতে প্রবেশ করলেন, তখন তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্য মুক্তা, ফুলের মালা, সুন্দর বস্ত্র ও স্বর্ণ-তোরণের দ্বারা অত্যন্ত সুন্দরভাবে শহরটিকে সাজানো হয়েছিল এবং সারা নগরী সুগন্ধিত ধূপের দ্বারা সুবাসিত হয়েছিল।
নগরীর পথ ও প্রাঙ্গণসমূহ চন্দন ও অগুরু মিশ্রিত জলে সিক্ত হয়েছিল এবং ফুল, ফল, খই, বিভিন্ন প্রকার ধাতু, প্রদীপ ইত্যাদি মাঙ্গলিক সামগ্রীর দ্বারা সর্বত্র সাজান হয়েছিল।
পথের সন্ধিস্থলগুলি ফল, ফুল, কদলীস্তম্ভ, সুপারি গাছের ডাল, বৃক্ষ ও তরুপল্লবের দ্বারা অত্যন্ত সুন্দরভাবে সাজানো হয়েছিল। যখন রাজা নগরে প্রবেশ করলেন, তখন সমস্ত নাগরিকেরা দীপ, পুষ্প, দধি ইত্যাদি মাঙ্গলিক সামগ্রী নিয়ে তাঁকে স্বাগত জানিয়েছিল।
নানা প্রকার রত্নালংকারে বিভূষিতা বহু সুন্দরী কুমারীও রাজাকে স্বাগত জানিয়েছিল। তাদের পরস্পরের অঙ্গ সংলগ্ন হওয়ার ফলে, তাদের কানের দুল যেন পরস্পরকে স্পর্শ করছিল।
রাজা যখন প্রাসাদে প্রবেশ করলেন, তখন শঙ্খ ও দুন্দুভি ধ্বনিত হল, পুরোহিতেরা বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করলেন এবং স্তবকারীরা স্তব করলেন। কিন্তু তাঁকে স্বাগত জানাবার জন্য এই সমস্ত অনুষ্ঠান সত্ত্বেও, রাজা ছিলেন সম্পূর্ণ নিরহঙ্কার।
নগরীর সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিরা ও সাধারণ প্রজারা সকলেই অত্যন্ত আন্তরিকভাবে রাজাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন এবং রাজাও তাঁদের অভীষ্ট বর প্রদান করেছিলেন।
পৃথু মহারাজ ছিলেন মহত্তম মহাপুরুষ এবং তাই তিনি ছিলেন সকলেরই পূজ্য। তিনি পৃথিবী শাসন করার সময় বহু মহিমান্বিত কীর্তি স্থাপন করেছিলেন এবং তিনি ছিলেন সর্বদাই উদার।
এই প্রকার মহান সাফল্য অর্জন করার ফলে, তাঁর খ্যাতি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে বিস্তৃত হয়েছিল এবং চরমে তিনি পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্ম প্রাপ্ত হয়েছিলেন।"
সূত গোস্বামী বললেন-
"হে ঋষিদের নায়ক শৌনক। অত্যন্ত যোগ্য মহিমান্বিত ও বিশ্ববিশ্রুত • আদিরাজা পৃথুর সম্বন্ধে মৈত্রেয় ঋষির কাছ থেকে শ্রবণ - করার পর, মহাভাগবত বিদুর অত্যন্ত বিনীতভাবে মৈত্রেয় ঋষির অর্চনা করে তাঁকে নিম্নলিখিত প্রশ্নগুলি করেছিলেন।"
বিদুর বললেন-"হে ব্রাহ্মহ্মণ মৈত্রেয়! মহর্ষি ব্রাহ্মণেরা যে পৃথু মহারাজকে রাজসিংহাসনে অভিষেক - করেছিলেন, সমস্ত দেবতারা যে তাঁকে অসংখ্য উপহার - প্রদান করেছিলেন এবং তিনি যে বিষ্ণুতেজ প্রাপ্ত হয়ে সারা পৃথিবী জুড়ে তাঁর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন, সেই সমস্ত বিষয় অবগত হয়ে, আমি গভীর আনন্দ অনুভব করছি।
পৃথু মহারাজের কার্যকলাপ এতই মহান ছিল এবং তাঁর শাসন-প্রণালী এতই উদার ছিল যে, আজও সমস্ত রাজা ও বিভিন্ন গ্রহলোকের দেবতারা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন।
এমন কে আছে যে তাঁর মহিমান্বিত -কার্যকলাপ শ্রবণ করতে চাইবে না? আমি পৃথু মহারাজ সম্বন্ধে আরও শুনতে চাই কারণ তাঁর কার্যকলাপ অত্যন্ত পবিত্র ও বিশুদ্ধ।"
মহর্ষি মৈত্রেয় বিদুরকে বললেন-"হে বিদুর! পৃথু মহারাজ গঙ্গা ও যমুনার অন্তর্বর্তী ভূখণ্ডে বাস করেছিলেন। যেহেতু তিনি ছিলেন অত্যন্ত ঐশ্বর্যশালী, তাই মনে হয়েছিল, তিনি যেন তাঁর পূর্বকৃত পুণ্য ক্ষয় করার জন্য প্রারব্ধ সৌভাগ্য ভোগ করছেন।
মহারাজ পৃথু ছিলেন সপ্তদ্বীপ-সমন্বিত পৃথিবীর একচ্ছত্র সম্রাট। তাঁর অপ্রতিহত আদেশ সাধু, ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণব ব্যতীত অন্য কেউ লঙ্ঘন করতে পারত না।
এক সময় পৃথু মহারাজ এক মহাযজ্ঞে দীক্ষিত হয়েছিলেন। সেই যজ্ঞে দেবতা, ব্রহ্মহ্মর্ষি ও রাজর্ষিরা সকলে সমবেত হয়েছিলেন। সেই মহান সভায় মহারাজ পৃথু সর্ব প্রথমে সমস্ত পূজনীয় অতিথিদের যথাযথভাবে পূজা করেছিলেন এবং তার পর তিনি সেই সভায় তারকা পরিবৃত চন্দ্রের মতো উত্থিত হয়েছিলেন।
মহারাজ পৃথুর দেহ উন্নত ও বলিষ্ঠ,তাঁর অঙ্গকান্তি গৌরবর্ণ, তাঁর বাহুযুগল দীর্ঘ ও স্কুল, তাঁর নেত্রযুগল প্রভাতকালীন সূর্যের মতো উজ্জ্বল, তাঁর নাসিকা উন্নত, মুখমণ্ডল অত্যন্ত সুন্দর এবং ব্যক্তিত্ব সৌম্য।
তাঁর স্মিত হাস্যযুক্ত মুখমণ্ডলে সুন্দর দন্তরাজি শোভা পাচ্ছিল। পৃথু মহারাজের বক্ষস্থল বিস্তৃত, কটিদেশ স্কুল, উদর ত্রিবলী রেখায় সুশোভিত এবং অশ্বখ পত্রের মতো ঊর্ধ্বভাগে বিস্তৃত ও অধোভাগে সংকুচিত।
তাঁর নাভিদেশ আবর্তের মতো গভীর, উরুদ্বয় সুবর্ণের মতো উজ্জ্বল এবং পায়ের পাতার মধ্যভাগ উন্নত। তাঁর কেশকলাপ সূক্ষ্ম, কুঞ্চিত, কৃষ্ণবর্ণ ও চিক্কণ; গলদেশ শঙ্খের মতো রেখাযুক্ত।
তিনি একটি অতি মূল্যবান ধুতি পরেছিলেন এবং তাঁর দেহের উপরিভাগে ছিল এক অতি সুন্দর উত্তরীয়। যজ্ঞে দীক্ষিত হওয়ার সময় পৃথু মহারাজ তাঁর মূল্যবান বস্ত্র ত্যাগ করেছিলেন এবং তার ফলে তাঁর দেহের স্বাভাবিক সৌন্দর্য দৃষ্টিগোচর হয়েছিল।
তিনি যখন কৃষ্ণাজিন পরিধান করেছিলেন এবং আঙ্গুলে কুশাঙ্গরীয় ধারণ করেছিলেন, তখন তাঁকে আরও সুন্দর দেখাচ্ছিল, কারণ তার ফলে তাঁর দেহের স্বাভাবিক সৌন্দর্য বর্ধিত হয়েছিল।
যজ্ঞ অনুষ্ঠানের পূর্বে পৃথু মহারাজ সমস্ত বিধি-নিষেধগুলি পালন করেছিলেন। সভাস্থ সকলকে অনুপ্রাণিত করার জন্য এবং তাঁদের আনন্দ বর্ধন করার জন্য পৃথু মহারাজ শিশির-স্নিগ্ধ তারকার মতো চক্ষুর দ্বারা তাঁদের উপর দৃষ্টিপাত করেছিলেন এবং তার পর তিনি গম্ভীর স্বরে তাঁদের বলেছিলেন।
পৃথু মহারাজের সেই বাণী ছিল অত্যন্ত মনোহর, বিচিত্র পদবিশিষ্ট, স্পষ্টভাবে বোধগম্য, শ্রবণ-মধুর, গম্ভীর ও শুদ্ধ। তিনি যেন উপস্থিত সকলের মঙ্গলের জন্য তাঁর ব্যক্তিগত উপলব্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তা বলেছিলেন।"
পৃথু মহারাজ বললেন-"হে সভায় উপস্থিত সদস্যগণ! আপনাদের মঙ্গল হোক। আপনারা, সমস্ত মহাত্মারা, যাঁরা এই সভায় উপস্থিত হয়েছেন, দয়া করে আমার প্রার্থনা মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করুন।
পৃথু মহারাহের উপদেশ
যে-ব্যক্তি প্রকৃতপক্ষে জিজ্ঞাসু, ধর্মজিজ্ঞাসু ব্যক্তিদের কাছে তাঁর মনের অভিলাষ ব্যক্ত করা উচিত। পরমেশ্বর ভগবানের কৃপায় আমি এই লোকের রাজারূপে নিযুক্ত হয়েছি এবং প্রজাদের শাসনের জন্য, বিপদ থেকে তাদের
রক্ষা করার জন্য এবং বৈদিক নির্দেশে স্থাপিত বর্ণাশ্রম ব্যবস্থা অনুসারে তাদের জীবিকা প্রদানের জন্য আমি এই রাজদণ্ড ধারণ করেছি। আমি মনে করি যে, রাজারূপে আমি যদি আমার কর্তব্য সম্পাদন করি, তা হলে আমি বেদজ্ঞদের দ্বারা বর্ণিত ঈপ্সিত বস্তু লাভ করতে পারব।
সমস্ত নিয়তির দ্রষ্টা পরমেশ্বর ভগবানের প্রসন্নতা বিধানের ফলে, সেই গন্তব্যস্থল নিশ্চিতভাবে লাভ করা যায়। যে রাজা তাঁর প্রজাদের বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুসারে তাদের কর্তব্য সম্পাদন করার শিক্ষা না দিয়ে, কেবল তাদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করেন, তাঁকে প্রজাদের পাপকর্মের ফল ভোগ করতে হয় এবং তাঁর সমস্ত ঐশ্বর্য বিনষ্ট হয়।"
"অতএব হে প্রজাবৃন্দ। তোমাদের রাজার পারলৌকিক কল্যাণ সাধনের জন্য, বর্ণাশ্রম ধর্ম অনুসারে তোমাদের কর্তব্যকর্ম যথাযথভাবে সম্পাদন কর এবং সর্বদা তোমাদের হৃদয়ে ভগবানের কথা চিন্তা কর।
তা করলে তোমাদের নিজেদের হিতসাধন হবে এবং তোমাদের রাজারও পারলৌকিক মঙ্গলসাধন করে তোমরা তাঁর প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করবে।
আমি সমস্ত নির্মল-হৃদয় দেবতা, পিতৃ ও ঋষিদের অনুরোধ করছি যে, আপনারা আমার প্রস্তাব সমর্থন করুন, কারণ মৃত্যুর পর কর্মের ফল কর্মকর্তা, আদেশকর্তা ও সমর্থককে সমানভাবে ভোগ করতে হয়।
হে পূজ্যতমগণ! প্রামাণিক শাস্ত্রের মতে, একজন পরম পুরুষ নিশ্চয়ই রয়েছেন, যিনি আমাদের কর্মের ফল প্রদান করছেন। তা না হলে কেন এমন কোন কোন ব্যক্তিদের দেখা যায়, যাঁরা ইহলোকে ও পরলোকে অসাধারণ সৌন্দর্য ও শক্তিসম্পন্ন হন?
তা কেবল বৈদিক প্রমাণের দ্বারাই প্রতিপন্ন হয়নি, মনু, উত্তানপাদ, ধ্রুব, প্রিয়ব্রত, আমার পিতামহ অঙ্গ প্রভৃতি বহু মহাপুরুষের দ্বারা এবং প্রহ্লাদ মহারাজ, বলি প্রমুখ মহাজনদের দ্বারা তা প্রতিপন্ন হয়েছে এবং তাঁরা সকলেই ছিলেন গদাধারী পরমেশ্বর ভগবানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী আস্তিক।
আমার পিতা এবং মূর্তিমান মৃত্যুর পৌত্র বেণ প্রমুখ নিন্দনীয় ব্যক্তিরা ধর্মের পথে মোহগ্রস্ত হলেও, পূর্বোল্লিখিত মহাপুরুষেরা স্বীকার করেছেন যে, এই জগতে ধর্ম, অর্থ, কাম ও মোক্ষ অথবা স্বর্গলোকে উন্নতির আশীর্বাদ একমাত্র পরমেশ্বর ভগবানই প্রদান করতে পারেন।
ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের সেবার অভিরুচির ফলে, দুর্দশাক্লিষ্ট মানুষ অন্তহীন জন্ম-জন্মান্তরের সঞ্চিত কলুষ থেকে তৎক্ষণাৎ মুক্ত হয়।
ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের অঙ্গুষ্ঠ থেকে উদ্ভুত গঙ্গার জলের মতো এই পন্থা তৎক্ষণাৎ মনকে নির্মল করে এবং তার ফলে তার পারমার্থিক চেতনা বা কৃষ্ণভক্তি ধীরে ধীরে বর্ধিত হয়।
ভগবদ্ভক্ত যখন পরমেশ্বর ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করেন, তখন তিনি সম্পূর্ণরূপে সমস্ত ভ্রান্ত ধারণা অথবা মনোধর্মের কলুষ থেকে মুক্ত হন এবং তাঁর মধ্যে বৈরাগ্যের উদয় হয়।
ভক্তিযোগের অনুশীলনের প্রভাবে বীর্যবান হওয়ার ফলেই কেবল তা সম্ভব হয়। একবার ভগবানের শ্রীপাদপদ্মমূলের আশ্রয় গ্রহণ করলে, সেই ভক্তকে আর কখনও ত্রিতাপ দুঃখ-সমন্বিত এই জড় জগতে ফিরে আসতে হয় না।"
পৃথু মহারাজ তাঁর প্রজাদের উপদেশ দিলেন-"তোমাদের কায়মনোবাক্য এবং তোমাদের বৃত্তিগত কর্মের ফল অর্পণ করার দ্বারা সর্বদা উদার চিত্তে ভগবানের সেবা কর।
তোমাদের যোগ্যতা ও বৃত্তি অনুসারে পূর্ণ বিশ্বাস সহকারে, নিষ্কপটে ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের সেবায় নিযুক্ত হও। তা হলে তোমাদের জীবনের চরম উদ্দেশ্যসাধনে তোমরা সফল হবে। পরমেশ্বর ভগবান চিন্ময় এবং তিনি জড় জগতের দ্বারা কলুষিত নন।
যদিও তিনি হচ্ছেন জড় বৈচিত্র্যবিহীন ঘনীভূত আত্মা, তবুও তিনি বিবিধ দ্রব্য, গুণ, ক্রিয়া, মন্ত্র, অর্থ, সংকল্প, দ্রব্যশক্তি ও নাম দ্বারা অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রকার যজ্ঞ বদ্ধ জীবদের মঙ্গলের জন্য স্বীকার করেন।
পরমেশ্বর ভগবান সর্বব্যাপ্ত, কিন্তু জড়া প্রকৃতি, কাল, বাসনা ও বৃত্তিগত ধর্মের সমন্বয়ে উৎপন্ন বিভিন্ন প্রকার শরীরেও তিনি প্রকাশিত। একই
অগ্নি যেমন বিভিন্ন আকার ও আয়তনের কাষ্ঠখণ্ডে বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হয়, তেমনই বিভিন্ন প্রকার চেতনার বিকাশ হয়।
পরমেশ্বর ভগবান সমস্ত যজ্ঞফলের ঈশ্বর এবং ভোক্তা। তিনি পরম গুরুও। এই ভূমণ্ডলে সমস্ত প্রজারা যাঁরা আমার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত এবং যাঁরা স্বধর্মের দ্বারা ভগবানের পূজা করছেন, তাঁরা আমার প্রতি পরম অনুগ্রহ প্রদান করছেন। অতএব, হে প্রজাগণ! আপনাদের ধন্যবাদ।
ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবেরা তাঁদের সহিষ্ণুতা, তপস্যা, জ্ঞান ও বিদ্যার বলে মহিমান্বিত হন। এই সমস্ত দিব্য সম্পদের প্রভাবে বৈষ্ণবেরা রাজকুল থেকেও শ্রেষ্ঠ।
তাই উপদেশ দেওয়া হয়েছে যে, রাজকুল যেন কখনও ব্রাহ্মাণ ও বৈষ্ণবদের উপর তাদের বিক্রম প্রদর্শন না করে এবং কখনও তাঁদের চরণে অপরাধ না করে।
পুরাতন, শাশ্বত ও সমস্ত মহা-পুরুষদের অগ্রণী পরমেশ্বর ভগবান ভুবন-পাবন যশরূপী ঐশ্বর্য লাভ করেছেন ব্রাহ্মহ্মণ ও বৈষ্ণবদের শ্রীপাদপদ্মের উপাসনার দ্বারা।
সকলের হৃদয়ে বিরাজ করা সত্ত্বেও, সর্বতোভাবে স্বাধীন পরমেশ্বর ভগবান তাঁদের প্রতি অত্যন্ত প্রসন্ন হন, যাঁরা তাঁর পদাঙ্ক অনুসরণ করেন এবং নিষ্কপটে ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের বংশধরদের সেবা করেন, কারণ ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবেরা তাঁর অত্যন্ত প্রিয় এবং তিনিও তাঁদের অত্যন্ত প্রিয়।
নিয়মিতভাবে ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের সেবা করার দ্বারা হৃদয়ের কলুষ বিধৌত করে পরম শান্তি লাভকরা যায় এবং জড় আসক্তি থেকে মুক্ত হয়ে সন্তুষ্ট হওয়া যায়।
এই জগতে ব্রাহ্মণদের সেবা করার থেকে শ্রেষ্ঠ সকাম কর্ম নেই, কারণ যে-সমস্ত দেবতাদের জন্য নানা প্রকার যজ্ঞ অনুষ্ঠানের উপদেশ দেওয়া হয়েছে, সেই দেবতারা তার ফলে প্রসন্ন হন।
পরমেশ্বর ভগবান অনন্ত যদিও বিভিন্ন দেবতাদের নামে নিবেদিত যজ্ঞের আহুতির মাধ্যমে আহার করেন, তবুও যজ্ঞাগ্নির মাধ্যমে আহার করার থেকে তত্ত্বজ্ঞ ঋষি ও ভক্তদের মুখের দ্বারা আহার করে তিনি অধিক তৃপ্তি অনুভব করেন, কারণ তিনি তখন ভক্তদের সঙ্গ ত্যাগ করেন না।
ব্রহ্মণ্য সংস্কৃতিতে ব্রাহ্মণদের দিব্য স্থিতি শাশ্বতরূপে সুরক্ষিত হয়, কারণ সেই সংস্কৃতিতে শ্রদ্ধা, তপস্যা, শাস্ত্রসিদ্ধান্ত, মন ও ইন্দ্রিয়-সংযম এবং ধ্যানের দ্বারা বৈদিক নির্দেশ পালন করা হয়।
এইভাবে জীবনের বাস্তবিক উদ্দেশ্য উজ্জ্বলভাবে প্রকাশিত হয়, ঠিক যেমন স্বচ্ছ দর্পণে মুখ পূর্ণরূপে প্রতিবিম্বিত হয়।"
"এখানে উপস্থিত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিগণ! আমি আপনাদের সকলের আশীর্বাদ কামনা করি, যাতে আমার জীবনের অন্তিম সময় পর্যন্ত, এই সমস্ত ব্রাহ্মণ ও বৈষ্ণবদের শ্রীপাদপদ্মের ধূলিকণা সর্বদা আমার মুকুটে ধারণ করতে পারি।
যিনি এই প্রকার ধূলিকণা তাঁর মস্তকে ধারণ করতে পারেন, তিনি অতি শীঘ্র সমস্ত পাপ থেকে মুক্ত হন এবং সমস্ত বাঞ্ছিত সদ্গুণাবলী অর্জন করেন। যিনি ব্রাহ্মণোচিত গুণাবলী অর্জন করেছেন-
যাঁর একমাত্র সম্পদ হচ্ছে তাঁর সৎ আচরণ, যিনি কৃতজ্ঞ এবং যিনি অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের শরণাগত-তিনি পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ প্রাপ্ত হন। আমি তাই বাসনা করি যে, পরমেশ্বর ভগবান ও তাঁর পার্যদেরা যেন গাভীসহ আমার প্রতি প্রসন্ন হন।"
মহর্ষি মৈত্রেয় বললেন- "পৃথু মহারাজের সেই সুন্দর বাণী শ্রবণ করে, সেই সভায় উপস্থিত সমস্ত দেবতা, পিতৃ, ব্রাহ্মহ্মণ ও সাধু মহাত্মারা তাঁকে অভিনন্দন জানিয়ে তাঁদের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেছিলেন।
তাঁরা সকলে ঘোষণা করেছিলেন যে, পুত্রের কর্মের দ্বারা পিতা স্বর্গলোক-সমূহ জয় করতে পারেন, এই হিতবাক্য সার্থক হয়েছে; যেহেতু ব্রহ্মশাপের ফলে নিহত পাপী বেণও তার পুত্র মহারাজ পৃথুর দ্বারা অন্ধকারাচ্ছন্ন নরক থেকে নিস্তার পেল।
তেমনই, হিরণ্যকশিপু পরমেশ্বর ভগবানের শ্রেষ্ঠত্ব অস্বীকার করার পাপে নরকের গভীরতম অন্ধকার প্রদেশে প্রবিষ্ট হয়েছিল; কিন্তু তার মহান পুত্র প্রহ্লাদ মহারাজের প্রভাবে, সেও উদ্ধার লাভকরে ভগবদ্ধাম প্রাপ্ত হয়েছিল।"
সমস্ত সাধু ব্রাহ্মণেরা পৃথু মহারাজকে সম্বোধন করে বললেন-"হে বীরশ্রেষ্ঠ, হে পৃথিবীর পিতা! আপনি দীর্ঘায়ু হোন, কারণ আপনি সমগ্র জগতের পতি অচ্যুত পরমেশ্বর ভগবানের প্রতি অত্যন্ত ভক্তিপরায়ণ।"
**শ্রোতারা বললেন-
"হে মহারাজ পৃথু! আপনার কীর্তি পরম পবিত্র, কারণ ব্রাহ্মণদের প্রভু, পবিত্র কীর্তি পরমেশ্বর ভগবানের মহিমা আপনি প্রচার করছেন। - আমাদের পরম সৌভাগ্যের ফলে, আমরা আপনাকে আমাদের প্রভুরূপে প্রাপ্ত হয়েছি এবং তাই আমাদের মনে হচ্ছে, আমরা যেন প্রত্যক্ষভাবে পরমেশ্বর ভগবানের আশ্রয়ে বাস করছি।
হে প্রভু! প্রজাশাসন করাই - আপনার ধর্ম। আপনার মতো মহাপুরুষের পক্ষে তা কোন আশ্চর্যজনক কার্য নয়, কারণ আপনি অত্যন্ত দয়ালু এবং সর্বদা প্রজাদের হিতসাধনে যত্নবান।
সেটিই আপনার চরিত্রের মাহাত্ম্য।" নাগরিকেরা বললেন- "আজ আপনি আমাদের জ্ঞানচক্ষু উন্মীলিত করেছেন এবং আমাদের জানিয়েছেন - কিভাবে ভবসাগর অতিক্রম করা যায়।
আমাদের পূর্বকৃত - কর্ম ও দৈবের ব্যবস্থাপনায় আমরা সকাম কর্মের জালে আটকে পড়েছি এবং জীবনের লক্ষ্য থেকে ভ্রষ্ট হয়েছি; তার ফলে আমরা এই ব্রহ্মাণ্ডে বিভিন্ন যোনিতে ভ্রমণ করছি।
হে প্রভু! আপনি বিশুদ্ধ সত্ত্বে অবস্থিত; তাই আপনি পরমেশ্বর ভগবানের আদর্শ প্রতিনিধি। আপনি আপনার স্বীয় প্রভাবের দ্বারা মহিমান্বিত এবং এইভাবে আপনি ব্রহ্মণ্য সংস্কৃতির প্রবর্তন করার দ্বারা সমগ্র জগৎ পালন করছেন এবং ক্ষত্রিয়রূপে আপনার কর্তব্য সম্পাদন করে আপনি সকলকে রক্ষা করছেন।"
আরও পড়ুনঃ
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার