সূর্য্য দেব কিভাবে সমস্থ বিশ্ব্য আলোকিত করেন-সূর্যের গতির বর্ণনা
শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন-"হে রাজন, এইভাবে আমি প্রমাণ এবং লক্ষণ প্রদর্শনপূর্বক ব্রহ্মাণ্ডের পরিমাণ (৫০ কোটি যোজন বা ৪০০ কোটি মাইল ব্যাস) বর্ণনা করলাম।
গম আদি দ্বিদল শস্যের অধঃস্থিত দলের পরিমাণ জানা হলে যেমন উপরস্থ দলের পরিমাণ জানা যায়, তেমনই ভূগোলবেত্তা পণ্ডিতেরা বলেন যে, ব্রহ্মাণ্ডের নিম্নভাগের পরিমাপ জানা হলে ঊর্ধ্বভাগের পরিমাপ সহজেই জানা যায়।
ভূগোলক এবং স্বর্গ-গোলকের মধ্যবর্তী স্থান হচ্ছে অন্তরীক্ষ। তা ভূগোলকের ঊর্ধ্বে এবং স্বর্গ-গোলকের অধঃভাগে অবস্থিত।
সূর্য্য দেব কিভাবে সমস্থ বিশ্ব ব্রহ্মান্ড ভ্রমন করেন
সেই অন্তরীক্ষের মধ্যে থেকে চন্দ্র প্রভৃতি তাপ প্রদানকারী গ্রহদের রাজা ঐশ্বর্যশালী সূর্যদেব তাঁর তেজের প্রভাবে ব্রহ্মাণ্ডকে উত্তপ্ত করেন এবং ব্রহ্মাণ্ডের প্রকৃত স্থিতি পালন করেন।
তিনি সমস্ত জীবকে দর্শন করতে সাহায্য করার জন্য আলোকও প্রদান করেন। ভগবানের নির্দেশ অনুসারে সূর্য উত্তরায়ণ, দক্ষিণায়ন এবং বিষুবরেখার মধ্যে ভ্রমণ করার সময় সূর্যের গতি যথাক্রমে মন্দ, ক্ষিপ্র এবং সমান হয়।
তাঁর এই ত্রিবিধ গতি অনুসারে আরোহণ, অবরোহণ ও সমস্থানে মকর আদি রাশিতে ভ্রমণের ফলে, দিন ও রাত্রির হ্রস্বতা, দীর্ঘতা এবং সমানতা হয়। সূর্য যখন মেষ ও তুলা রাশিতে থাকেন, তখন দিন এবং রাত্রি সমান হয়।
যখন বৃষ আদি পঞ্চ রাশিতে বিচরণ করেন, তখন দিবাভাগ বৃদ্ধি পায় এবং প্রতি মাসে আধ ঘণ্টা করে রাত্রির মান হ্রাস পায় (কর্কট রাশি পর্যন্ত)।
তারপর দিনের মান প্রতি মাসে আধ ঘণ্টা করে কমতে কমতে অবশেষে তুলা রাশিতে দিন এবং রাত্রি সমান হয়ে যায়।
সূর্য যখন বৃশ্চিকাদি পঞ্চ রাশিতে অবস্থান করেন, তখন দিবাভাগ হ্রাস পায় এবং রাত্রি বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় (মকর রাশি পর্যন্ত)। তারপর ধীরে ধীরে মেষ রাশিতে পুনরায় দিন এবং রাত্রি সমান হয়ে যায়।
সূর্যের দক্ষিণায়ন পর্যন্ত দিবাভাগ বৃদ্ধি পেতে থাকে এবং উত্তরায়ণ পর্যন্ত রাত্রি বৃদ্ধি পেতে থাকে।"
"হে রাজন, আমি পূর্বেই বর্ণনা করেছি এবং পণ্ডিতেরা নির্ণয় করেছেন যে, সূর্য মানসোত্তর পর্বতের চতুর্দিকে মণ্ডলাকারে ৯ কোটি ৫১ লক্ষ যোজন ভ্রমণ করেন।
মানসোত্তর পর্বতে সুমেরুর পূর্বদিকে দেবধানী নামে ইন্দ্রের, দক্ষিণে সংযমনী নামে যমের, পশ্চিমে নিম্নোচনী নামে বরুণের এবং উত্তরে বিভাবরী নামে চন্দ্রের পুরী রয়েছে।
সেই সমস্ত পুরীতে কাল বিশেষে সূর্যোদয়, মধ্যাহ্ন, সূর্যাস্ত ও মধ্যরাত্রি হয়ে থাকে এবং তার ফলে সমস্ত জীব তাদের কর্মে প্রবৃত্ত হয় অথবা নিবৃত্ত হয়।
সুমেরু পর্বতবাসীরা সব সময় মধ্যহ্নের উষ্ণতা অনুভব করেন, কারণ সূর্য সর্বদা তাঁদের মাথার উপরে থেকে তাপ দান করেন।
সূর্য যদিও নক্ষত্র অভিমুখী স্বাভাবিক গতি অনুসারে সুমেরুকে বামদিকে রেখে বামাবর্তে ভ্রমণ করেন, তবুও দক্ষিণাবর্ত বায়ুর প্রভাবে সুমেরুকে দক্ষিণে রেখেও কখনও কখনও ভ্রমণ করেন।
যে স্থানে মানুষ সূর্যের উদয় হতে দেখছে, তার ঠিক বিপরীত স্থানে অবস্থিত দেশের মানুষেরা সেই সময়ে সূর্যাস্ত দর্শন করবে এবং যেখানে মধ্যাহ্ন তার সমসূত্রপাত স্থানে সেখানকার মানুষদের কাছে তা তখন মধ্যরাত্রি।
অতএব যে স্থানে অবস্থিত হয়ে মানুষ সূর্য অক্ত দর্শন করে, তারা তার সমসূত্রপাত স্থানে গিয়ে সূর্যকে সেই অবস্থায় দেখতে পাবে না। সূর্য যখন ইন্দ্রের পুরী দেবধানী থেকে যমপুরী সংযমনীতে গমন করেন, তখন তিনি ১৫ ঘটিকায় (৬ ঘণ্টায়) ২ কোটি ৩৭ লক্ষ ৭৫ হাজার যোজন (১৯ কোটি ২ লক্ষ মাইল) পথ অতিক্রম করেন।
যমরাজের পুরী থেকে সূর্য বরুণের পুরী নিম্নোচনীতে যান, সেখান থেকে চন্দ্রের পুরী বিভাবরীতে যান এবং সেখান থেকে পুনরায় ইন্দ্রের পুরীতে ফিরে আসেন।
ঠিক এইভাবে চন্দ্র অন্যান্য গ্রহ ও নক্ষত্রগণসহ জ্যোতিশ্চক্রে উদিত হন এবং অস্তে গমন করেন। এইভাবে সূর্যদেবের রথ যা ত্রয়ীময়, অর্থাৎ ওঁ ভূর্ভুবঃ স্বঃ আদি গায়ত্রী মন্ত্রের দ্বারা উপাসিত হয়, তা
এক মুহূর্তে ৩৪ লক্ষ ৮ শত যোজন (২ কোটি ৭২ লক্ষ ৬ হাজার ৪০০ মাইল) বেগে সেই চারটি পুরীর চতুর্দিকে ভ্রমণ করে। সূর্যদেবের রথে সংবৎসর নামক একটি চক্র রয়েছে।
বারোটি মাস তার বারোটি অর, ছয় ঋতু তার নেমি এবং তিনটি চাতুর্মাস্য তার তিনটি নাভি। তার অক্ষের এক প্রান্ত সুমেরুর শিখরে এবং অপর প্রান্ত মানসোত্তর পর্বতে অবস্থিত।
রথচক্র এই অক্ষে গ্রথিত হয়ে তেল নিষ্কাশন যন্ত্রের চক্রের মতো মানসোত্তর পর্বতের উপরে অহরহ পরিভ্রমণ করছে।
তৈল নিষ্কাশন যন্ত্রের অক্ষের মতো প্রথম অক্ষটি দ্বিতীয় অক্ষের সঙ্গে যুক্ত, যার দৈর্ঘ্য প্রথম অক্ষরটির এক-চতুর্থাংশ (৩৯ লক্ষ ৩৭ হাজার ৫০০ যোজন বা ৩ কোটি ১৫ লক্ষ মাইল)।
এই দ্বিতীয় অক্ষের উপরিভাগ একটি বায়ুর রজ্জুর দ্বারা ধ্রুবলোকের সঙ্গে সংযুক্ত। হে রাজন, সূর্যদেবের রথ ৩৬ লক্ষ যোজন দীর্ঘ (২ কোটি ৮৮ লক্ষ মাইল) এবং তার এক-চতুর্থাংশ পরিমাণ (৯ লক্ষ যোজন বা ৭২ লক্ষ মাইল) বিস্তৃত।
রথের অশ্বগুলির নামকরণ হয়েছে গায়ত্রী আদি বৈদিক ছন্দের নাম অনুসারে। অরুণদেব সেই অশ্বদের ৯ লক্ষ যোজন দীর্ঘ রথের জোয়ালের সঙ্গে যুক্ত করেছেন।
সেই রথ নিরন্তর সূর্যদেবকে বহন করে। অরুণদেব যদিও সূর্যদেবের সামনে অবস্থিত হয়ে রথের অশ্ব পরিচালনারূপ সারথির কার্যে নিযুক্ত, তবুও তিনি পিছনে সূর্যদেবের দিকে তাকিয়ে রয়েছেন।
অঙ্গুষ্ঠ পরিমিত ষাট হাজার বালিখিল্য ঋষি সূর্যদেবের সম্মুখে স্তুতিবাক্যে তাঁর স্তব করছেন। তেমনই অন্য চোদ্দজন-ঋষি, গন্ধর্ব, অপ্সরা, নাগ, যক্ষ, রাক্ষস এবং দেবতা দুজন করে সাত ভাগে বিভক্ত হয়ে, প্রতি মাসে পৃথক পৃথক নাম ধারণ করে বিভিন্ন কর্মের দ্বারা বিভিন্ন নামধারী সূর্যদেবরূপী ভগবানের আরাধনা করেন।
হে রাজন, ভূমণ্ডলে সূর্যদেব তাঁর কক্ষপথে ৯ কোটি ৫১ লক্ষ যোজন (৭৬ কোটি ৮ লক্ষ মাইল) পথ প্রতিক্ষণে দুই হাজার যোজন এবং দুই ক্রোশ (১৬ হাজার ৪ মাইল) বেগে অতিক্রম করেন।"
আরও পড়ুনঃ
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?