বৌদ্ধ ধর্মে ঈশ্বর, ভগবান বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের গুপ্ত কারণ।
বৌদ্ধ ধর্ম কি? ভগবান বুদ্ধদেবের আবির্ভাব
“বৈদিক কল্পবৃক্ষের সুপরিপক্ক ফল” শ্রীমদ্ভাগবত হচ্ছে সবচেয়ে পরিপূর্ণ ও যথাযথ বৈদিক জ্ঞান। পাঁচ হাজার বছর পূর্বে মহর্ষি কৃষ্ণদ্বৈপায়ন ব্যাসদেব এই পুরাণ বা ইতিহাস সংকলন করেছিলেন অপ্রাকৃত বৈদিক জ্ঞানের সারতত্ত্ব ব্যাখ্যা করার উদ্দেশ্যে। এখানে শ্রীমদ্ভাগবতের ক্রমানুসারে শ্লোক, শব্দার্থ এবং ইসকন প্রতিষ্ঠাতা-আচার্য কৃষ্ণকৃপাশ্রীমূর্তি অভয়চরণারবিন্দ ভক্তিবেদান্ত স্বামী প্রভুপাদ কর্তৃক প্রদত্ত তাৎপর্যসহ পাঠকদের উদ্দেশ্যে উপস্থাপিত হল।
শ্রীল ব্যাসদেব বুঝতে পেরেছিলেন ভবিষ্যতে বিবেক-বর্জিত মানুষেরা বেদান্ত-সূত্রের অপব্যবহার করবে। তাই তিনি এই বেদান্ত-সূত্রের ভাষ্যরূপে ভাগবত-পুরাণ প্রণয়ণ করেছিলেন। “শ্রীমদ্ভাগবতে মহামুনিকৃতে কিং বাপরৈরীশ্বরঃ”(১/১/২)
শ্রীকৃষ্ণ হচ্ছেন সমস্ত অবতারের উৎস।
ততঃ কলৌ সম্প্রবৃত্তে সম্মোহায় সুরদ্ধিষাম্।
বুদ্ধো নাম্নাঞ্জনসুতঃ কীকটেষু ভবিষ্যতি।।২৪।।
অনুবাদঃ তারপর কলিযুগের প্রারম্ভে ভগবান ভগবদ্ধিদ্বেষী নাস্তিকদের সম্মোহিত করার জন্য বৃদ্ধদেব নামে গয়া প্রদেশে অঞ্জনার পুত্ররূপে আবির্ভূত হবেন।
তাৎপর্যঃ ভগবানের শক্ত্যাবেশ অবতার বুদ্ধদেব অঞ্জনার পুত্ররূপে গয়া প্রদেশে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তিনি অহিংসার বাণী প্রচার করেন এবং বেদ-বিহিত পশুবলিরও নিন্দা করেন। বুদ্ধদেব যখন আবির্ভূত হয়েছিলেন, তখন মানুষ অত্যন্ত নাস্তিক হয়ে গিয়েছিল। তারা মাংসাহার-প্রিয় এবং বৈদিক যজ্ঞের নামে সব জায়গাই কসাইখানাতে পরিণত হয়েছিল। তখন অবৈধভাবে অসংখ্য পশুবলি হচ্ছিল। নিরীহ পশুদের প্রতি সদয় হয়ে ভগবান তখন শ্রীবুদ্ধদেবরূপে অহিংসার বাণী প্রচার করেছিলেন। তিনি প্রচার করেছিলেন যে, তিনি বৈদিক নির্দেশ মানেন না এবং পশুহত্যার ফলে মনোবৃত্তি যে কিভাবে কলুষিত হয়ে যায়, সে কথা তিনি মানুষদের বুঝিয়েছিলেন।
ভগবতত্ত্বজ্ঞানরহিত কলিযুগের অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা তাঁর সেই তত্ত্ব অনুসরণ করেছিল এবং নীতিবোধ ও অহিংসা সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করে ভগবৎ-উপলব্ধির পথে অগ্রসর হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছিল। তিনি এইভাবে ভগবত্তত্ত্বজ্ঞানবিহীন নাস্তিকদের বিমোহিত করেছিলেন। এই সমস্ত নাস্তিকেরা, যারা তাঁকে অনুসরণ করেছিল তারা ভগবানকে মানত না, কিন্তু তারা তাঁকে পূর্ণরূপে মেনেছিল এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়েছিল, যিনি নিজেই ছিলেন ভগবানের অবতার। এইভাবে বুদ্ধরূপে তিনি অবিশ্বাসী নাস্তিকদের আস্তিকে পরিণত করেছিলেন।
বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্বে পশুবলিই ছিল সমাজের সব চাইতে লক্ষণীয় আচরণ। লোকেরা দাবি করত যে, বৈদিক নির্দেশ অনুসারে সেই সমস্ত পশু বলি হচ্ছে আদর্শ পরম্পরার মাধ্যমে বৈদিক জ্ঞান লাভ না হলে বেদের অনিয়মিত পাঠক তার আলঙ্কারিক ভাষার প্রভাবে বিপথগামী হয়। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে যে, এই ধরনের তত্ত্বজ্ঞানবিহীন তথাকথিত পন্ডিতের যারা তত্ত্বদ্রষ্টা গুরুর কাছ থেকে পরম্পরা ধারায় এই অপ্রাকৃত বাণী গ্রহণ করতে চায় না, তারা অবশ্যই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
তাদের আচার-অনুষ্ঠানগুলির উর্ধ্বে বেদের মুখ্য তত্ত্ব সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞই থেকে যায়। তাদের জ্ঞানের কোন গভীরতা নেই। ভগবদগীতায় (১৫/১৫) বলা হয়েছে, বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব দেব্যঃ-সমস্ত বৈদিক পন্থা ধীরে ধীরে পরমেশ্বর ভগবানকে জানার পথে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবত্তত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে জানা এবং তাদের মধ্যে সম্বন্ধ নিরূপণ করা। যখন এই সম্বন্ধ সম্পর্কে জানা হয়, তখন সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার শুরু হয় এবং তার ফলে অত্যন্ত সরলভাবে জীবনের পরম উদ্দেশ্য ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম হয়।
দুর্ভাগ্যবশত, বেদের অবৈধ পাঠকেরা কেবল বৈদিক সংস্কারগুলির দ্বারাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং তার ফলে তাদের স্বাভাবিক প্রগতি ব্যাহত হয়। আসুরিকভাবাপন্ন এই ধরনের বিভ্রান্ত মানুষদের কাছে বুদ্ধদেব হচ্ছেন আস্তিকতার প্রতীক। তাই তিনি সর্বপ্রথমে তাদের পশুহত্যা করা থেকে বিরত করেন।
ভগবৎ-চেতনা বিকাশের পথে পশুহত্যা হচ্ছে সব চাইতে ভয়ঙ্কর প্রতিবন্ধক। দু’রকমে পশুঘাতী রয়েছে। আত্মাকে কখনও কখনও ‘পশু’ অথবা জীব বলা হয়। দাই যারা পারমার্থিক জীবনের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা না করে আত্মঘাতী হয়, তারাও পশুঘাতী বা পশুঘ্ন। মহারাজ পরীক্ষিৎ বলেছেন যে, পশুঘাতীরা কখনও পরমেশ্বর ভগবানের দিব্য মহিমা আস্বাদন করতে পারেনা। তাই মানুষকে যদি ভগবৎ-ভক্তির পথে পরিচালিত করতে হয়, তাহলে সর্বপ্রথম তাদের পশুহত্যা থেকে বিরত করতে হবে। যারা বলে যে পশুহত্যার সঙ্গে পারমার্থিক প্রগতির কোন সম্বন্ধ নেই, তারা এক একটি মূর্খ। এই ভয়ঙ্কর মতবাদের প্রভাবে কলির চেলা কয়েকজন তথাকথিত সন্ন্যাসী বেদের নাম করে পশুহত্যায় লিপ্ত হচ্ছে এবং অন্যদের সেই কাজে উদ্বুদ্ধ করছে। এই সম্বন্ধে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে চাঁদ কাজীর আলোচনার কথা পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে। বেদে যে পশুবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সঙ্গে কসাইখানায় অবিধিপূর্বক যে পশুহত্যা হচ্ছে তার পার্থক্য অনেক। অসুরেরা অথবা তথাকথিত বেদজ্ঞরা বেদে পশুবলির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে, কিন্তু সেই পশুবলি যে প্রকৃতপক্ষে কি তা তাদের জানা নেই।
তাই বুদ্ধদেব আপাতভাবে বেদকে অস্বীকার করেছিলেন। পশুহত্যাজনিত প্রচন্ড পাপ থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য এবং যে সমস্ত মানুষ মুখে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য এবং স্বাধীনতার বাণী আউড়ে কাজের বেলায় নৃশংসভাবে নিরীহ পশুদের হত্যা করে, তাদের হাত থেকে পশুদের রক্ষা করার জন্য বুদ্ধদেব এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। যেখানে পশুহত্যা হয়, সেখানে ন্যায় নীতির কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। বুদ্ধদেব সর্বতোভাবে এই পশুহত্যা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁর এই অহিংসার বাণী প্রচারিত হয়েছিল।
আরও পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা ও কৃষ্ণ লীলা কাহিনী।
বুদ্ধদেবের দর্শনকে ব্যবহারিক পরিভাষায় ‘প্রচ্ছন্ন নাস্তিক্যবাদ’ বলে বর্ণনা করা হয়। কেন না এই মতবাদে পরমেশ্বর ভগবানকে স্বীকার করা হয়নি এবং বেদের প্রমাণিকত্ব স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু আসলে তা হচ্ছে নাস্তিকদের বিমোহিত করে ভগবন্মুখী করার একটি ব্যবস্থা। বুদ্ধদেব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের অবতার। প্রকৃতপক্ষে তিনিই হচ্ছেন বৈদিক জ্ঞানের আদি প্রবর্তক। তাই তিনি বৈদিক তত্ত্বদর্শন কখনই অস্বীকার করতে পারেন না। বাহ্যিকভাবে তিনি তা অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু ‘সুর-দ্বিষ’ বা অসুরদের জন্য, যারা সব সময় ভগবদ্বিদ্বেষী এবং যারা বেদের অজুহাত দেখিয়ে গো-হত্যা অথবা পশুহত্যা সমর্থন করতে চায়, তাদের সেই জঘন্য কার্যকলাপ রোধ করবার জন্য বুদ্ধদেবকে সর্বতোভাবে বেদের প্রামাণিতকতা অস্বীকার করতে হয়েছিল। তাঁর কার্য-সিদ্ধির জন্যে কেবল তিনি এটি করেছিলেন।
তা না হলে তাঁকে ভগবানের অবতার বলে স্বীকার করা হতো না; তা না হলে জয়দেব আদি বৈষ্ণব আচার্যরা তার অপ্রাকৃত মহিমা কীর্তন করতেন না। বুদ্ধদেব বেদের যথার্থ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য এইভাবে ভগবৎ-বিশ্বাসের পথ প্রশস্ত করে গিয়েছিলেন এবং বৈষ্ণব আচার্যরা, বিশেষ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পূর্ণরূপে ভগবৎ-চেতনা বিকাশের পথে মানুষকে পরিচালিত করেছিলেন।
আরও পড়ুনঃ * হিন্দু ধর্মে স্বর্গ ও নরক, নরক কত প্রকার ও কি কি?
মানুষ যে বুদ্ধদেবের অহিংসা আন্দোলনের প্রতি উৎসাহ প্রদর্শন করছে, তা দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হচ্ছি। কিন্তু তারা কি এই বিষয়টি যথার্থ ঐকান্তিকতা সহকারে গ্রহণ করবে এবং সমস্ত কসাইখানাগুলি বন্ধ করবে? তা যদি না হয়, তা হলে অহিংসার বাণীর কোন অর্থ হয় না। শ্রীমদ্ভাগবত রচনা হয়েছিল কলিযুগ আরম্ভ হওয়ার ঠিক পূর্বে (আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে। এবং বুদ্ধদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে। এই শ্রীমদ্ভাগবতে বুদ্ধদেবের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল।
ভগবতত্ত্বজ্ঞানরহিত কলিযুগের অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা তাঁর সেই তত্ত্ব অনুসরণ করেছিল এবং নীতিবোধ ও অহিংসা সম্বন্ধে শিক্ষালাভ করে ভগবৎ-উপলব্ধির পথে অগ্রসর হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতা অর্জন করেছিল। তিনি এইভাবে ভগবত্তত্ত্বজ্ঞানবিহীন নাস্তিকদের বিমোহিত করেছিলেন। এই সমস্ত নাস্তিকেরা, যারা তাঁকে অনুসরণ করেছিল তারা ভগবানকে মানত না, কিন্তু তারা তাঁকে পূর্ণরূপে মেনেছিল এবং তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাযুক্ত হয়েছিল, যিনি নিজেই ছিলেন ভগবানের অবতার। এইভাবে বুদ্ধরূপে তিনি অবিশ্বাসী নাস্তিকদের আস্তিকে পরিণত করেছিলেন।
বুদ্ধদেবের আবির্ভাবের পূর্বে পশুবলিই ছিল সমাজের সব চাইতে লক্ষণীয় আচরণ। লোকেরা দাবি করত যে, বৈদিক নির্দেশ অনুসারে সেই সমস্ত পশু বলি হচ্ছে আদর্শ পরম্পরার মাধ্যমে বৈদিক জ্ঞান লাভ না হলে বেদের অনিয়মিত পাঠক তার আলঙ্কারিক ভাষার প্রভাবে বিপথগামী হয়। ভগবদগীতায় বলা হয়েছে যে, এই ধরনের তত্ত্বজ্ঞানবিহীন তথাকথিত পন্ডিতের যারা তত্ত্বদ্রষ্টা গুরুর কাছ থেকে পরম্পরা ধারায় এই অপ্রাকৃত বাণী গ্রহণ করতে চায় না, তারা অবশ্যই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
তাদের আচার-অনুষ্ঠানগুলির উর্ধ্বে বেদের মুখ্য তত্ত্ব সম্বন্ধে তারা সম্পূর্ণভাবে অজ্ঞই থেকে যায়। তাদের জ্ঞানের কোন গভীরতা নেই। ভগবদগীতায় (১৫/১৫) বলা হয়েছে, বেদৈশ্চ সর্বৈরহমেব দেব্যঃ-সমস্ত বৈদিক পন্থা ধীরে ধীরে পরমেশ্বর ভগবানকে জানার পথে জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। সমস্ত বৈদিক শাস্ত্রের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে ভগবত্তত্ত্ব, জীবতত্ত্ব, সৃষ্টিতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে জানা এবং তাদের মধ্যে সম্বন্ধ নিরূপণ করা। যখন এই সম্বন্ধ সম্পর্কে জানা হয়, তখন সম্বন্ধ প্রতিষ্ঠার শুরু হয় এবং তার ফলে অত্যন্ত সরলভাবে জীবনের পরম উদ্দেশ্য ভগবদ্ধামে ফিরে যাওয়ার পথ সুগম হয়।
দুর্ভাগ্যবশত, বেদের অবৈধ পাঠকেরা কেবল বৈদিক সংস্কারগুলির দ্বারাই মোহাচ্ছন্ন হয়ে পড়ে এবং তার ফলে তাদের স্বাভাবিক প্রগতি ব্যাহত হয়। আসুরিকভাবাপন্ন এই ধরনের বিভ্রান্ত মানুষদের কাছে বুদ্ধদেব হচ্ছেন আস্তিকতার প্রতীক। তাই তিনি সর্বপ্রথমে তাদের পশুহত্যা করা থেকে বিরত করেন।
ভগবৎ-চেতনা বিকাশের পথে পশুহত্যা হচ্ছে সব চাইতে ভয়ঙ্কর প্রতিবন্ধক। দু’রকমে পশুঘাতী রয়েছে। আত্মাকে কখনও কখনও ‘পশু’ অথবা জীব বলা হয়। দাই যারা পারমার্থিক জীবনের পথে অগ্রসর হওয়ার প্রচেষ্টা না করে আত্মঘাতী হয়, তারাও পশুঘাতী বা পশুঘ্ন। মহারাজ পরীক্ষিৎ বলেছেন যে, পশুঘাতীরা কখনও পরমেশ্বর ভগবানের দিব্য মহিমা আস্বাদন করতে পারেনা। তাই মানুষকে যদি ভগবৎ-ভক্তির পথে পরিচালিত করতে হয়, তাহলে সর্বপ্রথম তাদের পশুহত্যা থেকে বিরত করতে হবে। যারা বলে যে পশুহত্যার সঙ্গে পারমার্থিক প্রগতির কোন সম্বন্ধ নেই, তারা এক একটি মূর্খ। এই ভয়ঙ্কর মতবাদের প্রভাবে কলির চেলা কয়েকজন তথাকথিত সন্ন্যাসী বেদের নাম করে পশুহত্যায় লিপ্ত হচ্ছে এবং অন্যদের সেই কাজে উদ্বুদ্ধ করছে। এই সম্বন্ধে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর সঙ্গে চাঁদ কাজীর আলোচনার কথা পূর্বেই বর্ণনা করা হয়েছে। বেদে যে পশুবলির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, তার সঙ্গে কসাইখানায় অবিধিপূর্বক যে পশুহত্যা হচ্ছে তার পার্থক্য অনেক। অসুরেরা অথবা তথাকথিত বেদজ্ঞরা বেদে পশুবলির দৃষ্টান্ত উল্লেখ করে, কিন্তু সেই পশুবলি যে প্রকৃতপক্ষে কি তা তাদের জানা নেই।
তাই বুদ্ধদেব আপাতভাবে বেদকে অস্বীকার করেছিলেন। পশুহত্যাজনিত প্রচন্ড পাপ থেকে মানুষকে উদ্ধার করার জন্য এবং যে সমস্ত মানুষ মুখে বিশ্ব-ভ্রাতৃত্ব, শান্তি, সাম্য এবং স্বাধীনতার বাণী আউড়ে কাজের বেলায় নৃশংসভাবে নিরীহ পশুদের হত্যা করে, তাদের হাত থেকে পশুদের রক্ষা করার জন্য বুদ্ধদেব এই পন্থা অবলম্বন করেছিলেন। যেখানে পশুহত্যা হয়, সেখানে ন্যায় নীতির কোনও প্রশ্ন থাকতে পারে না। বুদ্ধদেব সর্বতোভাবে এই পশুহত্যা বন্ধ করতে চেয়েছিলেন। তাই তাঁর এই অহিংসার বাণী প্রচারিত হয়েছিল।
আরও পড়ুনঃ শ্রীকৃষ্ণের জন্মলীলা ও কৃষ্ণ লীলা কাহিনী।
বুদ্ধদেবের দর্শনকে ব্যবহারিক পরিভাষায় ‘প্রচ্ছন্ন নাস্তিক্যবাদ’ বলে বর্ণনা করা হয়। কেন না এই মতবাদে পরমেশ্বর ভগবানকে স্বীকার করা হয়নি এবং বেদের প্রমাণিকত্ব স্বীকার করা হয়নি। কিন্তু আসলে তা হচ্ছে নাস্তিকদের বিমোহিত করে ভগবন্মুখী করার একটি ব্যবস্থা। বুদ্ধদেব হচ্ছেন পরমেশ্বর ভগবানের অবতার। প্রকৃতপক্ষে তিনিই হচ্ছেন বৈদিক জ্ঞানের আদি প্রবর্তক। তাই তিনি বৈদিক তত্ত্বদর্শন কখনই অস্বীকার করতে পারেন না। বাহ্যিকভাবে তিনি তা অস্বীকার করেছিলেন। কিন্তু ‘সুর-দ্বিষ’ বা অসুরদের জন্য, যারা সব সময় ভগবদ্বিদ্বেষী এবং যারা বেদের অজুহাত দেখিয়ে গো-হত্যা অথবা পশুহত্যা সমর্থন করতে চায়, তাদের সেই জঘন্য কার্যকলাপ রোধ করবার জন্য বুদ্ধদেবকে সর্বতোভাবে বেদের প্রামাণিতকতা অস্বীকার করতে হয়েছিল। তাঁর কার্য-সিদ্ধির জন্যে কেবল তিনি এটি করেছিলেন।
তা না হলে তাঁকে ভগবানের অবতার বলে স্বীকার করা হতো না; তা না হলে জয়দেব আদি বৈষ্ণব আচার্যরা তার অপ্রাকৃত মহিমা কীর্তন করতেন না। বুদ্ধদেব বেদের যথার্থ তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করার জন্য এইভাবে ভগবৎ-বিশ্বাসের পথ প্রশস্ত করে গিয়েছিলেন এবং বৈষ্ণব আচার্যরা, বিশেষ করে শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভু পূর্ণরূপে ভগবৎ-চেতনা বিকাশের পথে মানুষকে পরিচালিত করেছিলেন।
আরও পড়ুনঃ * হিন্দু ধর্মে স্বর্গ ও নরক, নরক কত প্রকার ও কি কি?
মানুষ যে বুদ্ধদেবের অহিংসা আন্দোলনের প্রতি উৎসাহ প্রদর্শন করছে, তা দেখে আমরা অত্যন্ত আনন্দিত হচ্ছি। কিন্তু তারা কি এই বিষয়টি যথার্থ ঐকান্তিকতা সহকারে গ্রহণ করবে এবং সমস্ত কসাইখানাগুলি বন্ধ করবে? তা যদি না হয়, তা হলে অহিংসার বাণীর কোন অর্থ হয় না। শ্রীমদ্ভাগবত রচনা হয়েছিল কলিযুগ আরম্ভ হওয়ার ঠিক পূর্বে (আজ থেকে প্রায় ৫০০০ বছর আগে। এবং বুদ্ধদেব আবির্ভূত হয়েছিলেন আজ থেকে প্রায় ২৬০০ বছর আগে। এই শ্রীমদ্ভাগবতে বুদ্ধদেবের আগমনের ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছিল।