প্রকৃত বন্ধু কে
বিপদের বন্ধুই প্রকৃত বন্ধু
শ্রীমদ্ভবদ্গীতায় (৫/২৯) ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, তিনি সমস্ত জীবের সুহৃদ- সহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি। যদি আমরা জীবনকে শান্তিময় ও আনন্দময় করতে চাই, তাহলে শ্রীকৃষ্ণকে পরম বন্ধুরূপে গ্রহণ করা উচিত।
‘বন্ধু’ বলতে আমরা কী বুঝি? যিনি আমাদের শুভাকাঙ্ক্ষী, যিনি সর্বস্ব দিয়ে সেবা করতে চান, যার ফলে আমাদের সমস্ত কিছু কল্যাণময় হয়, আমরা উপকৃত হই এবং সুখী হই।
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় আমরা দেখতে পাই, কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধভূমিতে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সঠিক দিক নির্দেশনা প্রদান করার মাধ্যমে অর্জুনের পরম বন্ধুর ভূমিকা পালন করেন।
মহাভারতে দেখি, ভীম অত্যন্ত শক্তিশালী ছিলেন। কিন্তু এত শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সহযোগিতা ছাড়া জরাসন্ধকে পরাজিত করা তার পক্ষে সম্ভবপর হয়ে ওঠেনি। কারণ, সামর্থে ও যুদ্ধের কৌশলে দুজনই ছিলেন সমপর্যায়ভুক্ত। যুদ্ধ চলছে ভীম ও জরাসন্ধের মধ্যে; ক্রমেই উত্তেজনা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। এক পর্যায় ভীম পরাজয়ের দিকে যাচ্ছিল।
এমতাবস্থায়, শ্রীকৃষ্ণ একটি তৃণ হাতে নিলেন এবং একে দুভগে বিভক্ত করে দুদিকে ছুড়ে মারলেন। যার দ্বারা কৃষ্ণ ইঙ্গিত করলেন, জরাসন্ধের দুর্বলতা হলো তাকে দুভাগে বিভক্ত করে দুদিকে ফেলতে হবে। ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র ভীম জরাসন্ধকে দুভাগে বিভক্ত করে দুদিকে ছুড়ে ফেলে দিলেন এবং জরাসন্ধ পরাজিত হলো।
ভীম কৃষ্ণের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলেন। এভাবে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ ভীমের সেবা করার মাধ্যমে প্রকৃত বন্ধুর ভূমিকা পালন করলেন।
শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠির মহারাজেরও পরম বন্ধু ছিলেন। যুধিষ্ঠির মহারাজ যখনই কোনো বিপদের সম্মুখীন হয়েছেন, তখনই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাকে সহায়তা করেছেন। কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ যখন শেষ হলো, তখন যুধিষ্ঠির মহারাজ প্রচন্ডভাবে বিষাদগ্রস্থ হন এবং কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন।
তিনি ভাবছিলেন, “শুধু আমাকে রাজা করার জন্য এত বড় যুদ্ধ হলো, আমার আত্মীয় স্বজনের মৃত্যু হলো, এই ভয়াবহ যুদ্ধে কোটি কোটি সৈন্য নিহত হয়েছে। এজন্য আমিই দায়ী।” ব্যাসদেব প্রমুখ মহর্ষিগণ এবং অদ্ভূদকর্মা শ্রীকৃষ্ণ শাস্ত্রসমূহের প্রমাণ উল্লেখসহ উপদেশ দেওয়া সত্ত্বেও শোকসন্তপ্ত মহারাজ যুধিষ্ঠির শান্তি পেলেন না।
তখন শ্রীকৃষ্ণ যুধিষ্ঠির মহারাজ ভীষ্মদেবের নিকট যান। ভীষ্মদেব তখন যুধিষ্ঠির মহারাজকে বিভিন্ন উপদেশ প্রদান করেন। ফলে মহারাজ যুধিষ্টির শান্ত হন এবং রাজা হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে সম্মত হন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকেও বারবার সহায়তা করেছেন।
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধ সমাপ্ত হলো, যুধিষ্ঠির মহারাজ রাজা হলেন এবং শ্রীকৃষ্ণ দ্বারকায় প্রত্যাগমন করলেন। এর কিছুদিন পর অর্জুন দ্বারকায় গেলেন শ্রীকৃষ্ণের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য। সাক্ষাৎ শেষে অর্জুন যখন হস্তিনাপুর ফিরে আসছিলেন, তখনই তিনি বুঝতে পারছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরাধাম থেকে স্বধামে গমন করেছেন। কারণ অর্জুন শক্তিহীন হয়ে গিয়েছিলেন।
তিনি হস্তিনাপুর ফিরে এলে যুধিষ্ঠির মহারাজ তাকে জিজ্ঞেস করলেন- তোমাকে এত বিষন্ন দেখাচ্ছে কেন? এর কারণ কী? সব ঠিক আছে তো? তখন অর্জুন মহাশয় উত্তর দিলেন- বঞ্চিতোহহং মহারাজ হরিণা বন্ধুরূপিণা (শ্রীমদ্ভাগবত ১/১৫/৫)- আমি বঞ্চিত হলাম। কৃষ্ণ আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, আমার পরম বন্ধুর সঙ্গ হতে আমি আজ বঞ্চিত হলাম।
তিনি আজ আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। আমার যে বিপুল তেজ যা দেবতাদেরও বিষ্ময় উৎপাদন করতো তা আজ অপহৃত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণ এই জগৎ থেকে অপ্রকট হওয়া মাত্রই অর্জুনের সেই বিপুল তেজ, শক্তি, দক্ষতা, সবকিছু অপহৃত হয়েছিল। কারণ, কারো শক্তিশালী হওয়া বা শক্তিহীন হওয়া ভগবানের কৃপার ওপর নির্ভর করে। কৃষ্ণ আমাদের শক্তি প্রদান করেন, কৃষ্ণই আমাদের শক্তি অপহৃত করেন। আমরা ভগবানের হাতের ক্রীড়ানক মাত্র।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের বিশেষত অর্জুনকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করেছেন।
সারথ্যপারণদসেবনসখ্যদৌত্যবীরাসনানুগমনন্তবনপ্রণামান।
স্নিগ্ধেষু পান্ডুষু জগৎপ্রণতিং চবিষ্ণোর্ভক্তি করোতি নুপতিশ্চরণারবিন্দে।।
(শ্রীমদ্ভাগবত ১/১৬/১৬)
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পান্ডবদের সর্বদা বন্ধুরূপে সেবা করেছেন। শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন তাদের সারথি, সখা, সেবক, বার্তাবহ দূতম সুরক্ষাকারী। কিন্তু আজ তিনি তাঁর লীলা সংবরণ করেছেন, তাই অর্জুন পুনরায় অনুধাবন করেছেন, কৃষ্ণ কীভাবে তাঁর রথের সারথি হয়েছিলেন, কখনো রথের দিকনির্দেশনা দিতে গিয়ে তিনি শ্রীকৃষ্ণকে পদাঘাত করেছেন। আর সেই সারথির পদ শ্রীকৃষ্ণ স্বেচ্ছায় গ্রহণ করেছিলেন। কারণ, কৃষ্ণ চেয়েছেন এই যুদ্ধের নায়ক হবে অর্জুন, অর্জুন জয়ী হোক। সকলে অর্জুনের প্রশংসা করুক।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণের অনন্ত গুণের মধ্যে সর্বাধিক আকর্ষণীয় গুণ হচ্ছে তিনি তাঁর ভক্তদের প্রশংসা প্রদান করতে ভালোবাসেন। রামায়ণ এবং শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা- উভয় ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে, রামচন্দ্র হনুমানকে প্রশংসিত করেছেন এবং কৃষ্ণ অর্জুনকে প্রশংসিত করেছেন। সুতরাং, কৃষ্ণের জীবন চরিত সত্যিই খুব চমৎকার এবং প্রশংসিত।
তিনি কোনো স্বার্থ ছাড়াই আমাদের হৃদয়ের শুদ্ধ ভালোবাসা পরখ করার জন্য আমাদের সাহায্য করেন। প্রত্যেকেই এমন একজন নির্ভরযোগ্য বন্ধু চায়, যার সঙ্গে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক স্থাপন করতে পারে। যখন কৃষ্ণ রুক্মিণীকে অপহরণ করেন, তার পূর্বে কৃষ্ণ রুক্মিণীর নিকট হতে একটি চিঠি পান। চিঠিটা পড়ে কৃষ্ণ অবাক হয়ে যান এবং চিন্তা করতে থাকেন- কীভাবে এই রাজকন্যা আমার পরিচয় জানেন!
আমাকে কেন একজন অবিবাহিত রাজকন্যা এমন করে লিখেছেন? রুক্মিণী বলেছেন, “হে কৃষ্ণ, আমি তোমার কথা শুনেছি। নারদমুনি আমাদের রাজ্যে এসে আপনার কথা বলতেন- ভুবন সুন্দরাং শৃন্বতাংতে। আর তাঁর কাছ থেকে আপনার গুণ মহিমা শ্রবণ করে আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে আপনি এ জগতের সবচেয় সুন্দর পুরুষ।”
স্বভাবতই কেউ যখন শ্রীকৃষ্ণের গুণমহিমা শ্রবণ করেন, তখন তার সমস্ত কলুষতা, কষ্ট দূর হয়ে যায়। এজগতে সকলেই সৌন্দর্যের পেছনে ছুটছে। যার দৃষ্টিতে যাকে সুন্দর বলে মনে হয়, সে তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়তে চায়।
রুক্মিণী উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন যে, কৃষ্ণের রূপ, গুণ, সৌন্দর্য, বিদ্যা, যশ এবং ক্ষমতার সমতুল্য এ জগতে আর কেউ নেই। সেজন্য লজ্জাত্যাগ করে রুক্মিণী কৃষ্ণের কাছে প্রার্থনা করেছেন। রুক্মিণী বলেছেন “লোকে আমাকে অপবাদ দিতে পারে, অপমান করতে পারে- কেমন নির্লজ্জ কন্যা তুমি? একজন অবিবাহিত পুরুষকে এভাবে প্রেম নিবেদন করেছো?
কারণ এ কার্যটি সামাজিক রীতিনীতিন বিরোধী। কিন্তু এ অপবাদ শুধু আমরই নয়, আপনারও। কেননা আপনার সৌন্দর্যের দ্বারা এ জগতের প্রত্যেক জীবকে আপনি আকর্ষণ করেন, মুগ্ধ করেন। তাই আপনিও এই কার্যের জন্য দায়ী।”
রুক্মিণী দেবী বললেন, “কা ত্বা মুকুন্দ মহ্রতী কুলশীশরূপে (১০/৫২/৩৮-ভা.)- আপনি আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু, কারণ আপনি মুকুন্দ, যিনি এই জগতের সবরকম দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্তি প্রদান করেন এবং নিত্য আনন্দ প্রদান করেন। আপনি নব যৌবনসম্পন্ন, শতসহস্র লক্ষ্মীদেবী তাদের সমস্ত যোগ্যতা দিয়ে সর্বদা আপনার পদ সেবা করার চেষ্টা করেন।
সমস্ত রমণী আপনাকে পতি হিসেবে প্রার্থনা করেন। হে নরসিংহ, আপনি সকল মানবের মনোভিরাম। আপনি সকলকে আকর্ষণ করেন। আমি আমার সমস্ত স্বাধীনতা আপনার কাছে হারিয়েছি। যদি আপনি মনে করেন যে, আপনি রুক্মিণীকে বিবাহ করতে চান, তা সম্পূর্ণ আপনারই ইচ্ছা।”
কৃষ্ণ রুক্মিণীদেবীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন এবং রুক্মিণীর ভ্রাতা রুক্মি অপেক্ষা করছিল শিশুপাল কখন আসবে আর রুক্মিণীকে বিবাহ করবে। কিন্তু ঠিক তখনিই কৃষ্ণ এসে রুক্মিণীদেবীকে রথে করে হরণ করলেন এবং দ্বারকা থেকে বলরামের সঙ্গে আসা সৈন্যদের সহযোগিতায় সেখান থেকে প্রত্যাগমন করলেন। কিন্তু রুক্মিনীর ভ্রাতা রুক্মি, জরাসন্ধ ও শিশুপালের সমস্ত সৈন্য তাদের ঘিরে ফেলেছিল এবং রুক্মিণী ভয় পাচ্ছিলেন। তখন কৃষ্ণ বললেন, “প্রহস্য ভগবানহ..(১০/৫৪/৫ভা.)- হে সুনয়না রুক্মিণী, তুমি এই সৈন্যদের ভয় পেওনা।
এই সমস্ত সৈন্য তোমার সৈন্যদের দ্বারা ধ্বংস হবে। যদি আমরা ৪০ বছর ধরে অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে কোনো কোম্পানির উন্নয়ন করি এবং এমনকি যদি আমরা কোনো বড় কোম্পানির মালিক বা অংশীদারও হই, কিন্তু আমাদের অবসরের সময় সেই কোম্পানির অংশ আমাদের কেউ দিতে চাইবে না। কিন্তু কৃষ্ণ সর্বদা সকল জীবকে তাঁর চিন্ময় ধামে ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য আমন্ত্রণ জানাচ্ছেন।
যদি আমরা তাঁর জন্য কিঞ্চিৎ পরিমাণ সেবাও করে থাকি, তাঁর প্রতিদান তিনি অবশ্যই আমাদের দেবেন। সেজন্য তিনি রুক্মিণীদেবীর দিকে তাকিয়ে বললেন “তাবকৈঃ শাতবং বলম”- এই সমস্ত সৈন্য এখন তোমার সৈন্য, তোমার সৈন্যরাই রুক্মি ও শিশুপালের সৈন্যদের পরাজিত করবে। এভাবে কৃষ্ণ সর্বদাই তাঁর সমস্ত কিছু সকল জীবদের প্রদান করার জন্য প্রস্তুত।
যখন সুদামা কৃষ্ণের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্য দ্বারকা এলেন, সমস্ত দ্বারকাবাসী অবাক হয়ে দেখতে লাগলেন কৃষ্ণ খালি পায়ে পাথরের উপর দিয়ে দৌড়ে এসে সুদামাকে আলিঙ্গন করছেন, তাকে প্রসাদে নিয়ে এসে তাঁর চরণ সম্বাহন করছেন, তাকে প্রাসাদে নিয়ে এসে তাঁর চরণ সম্বাহন করছেন, চরণ ধৌত করে দিচ্ছেন।
রুক্মিণীদেবী নিজের হাতে সুদামাকে চামর ব্যজন করছেন। তখন দ্বারকাবাসীরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করতে শুরু করলেন “কুটলং মালনং...“কে এই ব্যক্তি, তিনি পূর্ব জীবনে কী এমন ভালো কাজ করেছিলেন, যার ফলে তিনি কৃষ্ণের দর্শন লাভ করেছেন এবং কৃষ্ণের নিকট হতে এত আতিথেয়তা লাভ করেছেন?”
বাহ্যিকভাবে সুদামাকে দেখে দুর্ভাগা মনে হতে পারেম কিন্তু তিনি প্রকৃত সৌভাগ্যবান। কারণ কৃষ্ণের প্রতি তার ভালোবাসা এবং তার প্রতি কৃষ্ণের ভালোবাসা ও অনুগ্রহ সত্যিই সকলকে বিস্মিত করেছিল। এভাবে সুদামা কৃষ্ণের আতিথেয়তায় অনেক আনন্দ লাভ করেছিলেন। যদিও তিনি কৃষ্ণের নিকট থেকে কোনো আর্থিক সাহায্য লাভ করেননি, তবুও তার কোনো দুঃখ ছিল না। তিনি দ্বারকা থেকে ফিরে আসার সময় পথে হাঁটতে হাঁটতে চিন্তা করেছিলেন, কৃষ্ণ আমাকে এমনভাবে সেবা করলেন, যেভাবে দেবতারা কৃষ্ণের সেবা করেন।
এমন আতিথেয়তার জন্য কৃষ্ণের নিকট আমি কৃতজ্ঞ। এরূপ চিন্তা করতে করতে সুদামা বাড়ি ফিরছিলেন। দুটো বিষয় সুদামাকে খুবই তৃপ্ত ও আর্শীবাদপুষ্ট করেছিল। অনেক সময় আমরা চিন্তা করি টাকা আমাকে সুখী করবে, পদমর্যাদা আমাকে সুখী করবে, ঐশ্বর্য, সম্পদ আমাকে সুখী করবে, কিন্তু সুদামা বিপ্র পরম সুখী হওয়ার অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলেন, যদিও তার এসব কিছুই ছিল না। কৃষ্ণের সঙ্গে তার বন্ধুত ছিল খাঁটি এবং দৃঢ়।
খাঁটি বন্ধুত দুটো বিশেষ বৈশিষ্ট্যের দ্বারা চিহ্নিত করা যায়। আমাদের বন্ধুতের মধ্যেও যদি এই দুটো বৈশিষ্ট্য থাকে তাহলে সেই সম্পর্ক মধুর ও আনন্দপূর্ণ হবে। প্রথমত কৃষ্ণ সুদামাকে যথার্থ সম্মান প্রদান করেছিলেন; দ্বিতীয়ত, কৃষ্ণ সুদামা বিপ্রকে অত্যন্ত প্রীতির সাথে সেবা করেছিলেন। তাই সম্পর্কের মধ্যে যখন যথার্থ সম্মান এবং সেবা থাকে, তখন সেই দুটো মিলে একটি সুদৃঢ় বন্ধন তৈরি করে।
সত্যতার অভাবে, যোগাযোগের অভাবে এবং স্বচ্ছতার অভাবে পরিচিতদের মধ্যেও সম্পর্ক ধীরে ধীরে বাধা প্রাপ্ত হয় এবং পরিশেষে সম্পর্ক ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। যখন হৃদয়ে প্রকৃত সম্মান এবং সেবা মনোভাব উৎপন্ন হয়, তখন তা অন্যের হৃদয়কে দ্রবীভূত করে।
শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ১৫ মিলিয়ন মানুষের অ্যালকোহলের সমস্যা সমাধানের জন্য ২০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়। সারাবিশ্বে প্রতিজন ব্যক্তি বছরে ৬.৪ লিটার অ্যালকোহল গ্রহণ করে। সবচেয়ে বেশি গ্রহণ করে ইউরোপের ব্যক্তিরা- জনপ্রতি ১৫ লিটার।
আমরা দেখতে পাচ্ছি দিনে দিনে মাদকাসক্তের মাত্রা বেড়েই চলছে। এই সমস্যা দূর করার জন্য সকলের সহায়তা প্রয়োজন। তাদের প্রয়োজন প্রকৃত বন্ধুর। সেই প্রকৃত বন্ধু আমাদের খু্ব কাছেই আছেন। অ্যালকোহল গ্রহণ করার ফলে প্রতিবছর প্রায় ২.৪ মিলিয়ন লোক মৃত্যুবরণ করে। অন্যধরনের মাদক যেমন তামাক বা সিগারেট মানুষ গ্রহণ করে বিশেষত একাকীত্ব বোধের কারণে।
১৯০০-২০০০ সাল এই ১০০ বছরের মধ্যে মিলিয়ন লোকের মৃত্যু ঘটেছে ধুমপানের কারণে। অনুমান করা হচ্ছে, ২০০০-২১০০ সালের মধ্যে ১ বিলিয়ন লোকের মৃত্যু ঘটবে। ধূমপান করে প্রতিবছর ৭-৮ মিলিয়ন লোক মারা যাচ্ছে, যা বিশ্লেষণ করে দখা যায় প্রতি ৫ সেকেন্ডে ১ জন করে মারা যায়। ধূমপান হার্টের সমস্যার জন্য ২৫% দায়ী এবং ফুসফুসের সমস্যার জন্য ৭৫% দায়ী। একটি সিগারেট গ্রহণের ফলে জীবন থেকে ৫-১১ মিনিট আয়ক্ষয় হয়।
এসব নেশার কারণ সংস্কারের অভাব, তাদের একাকীত্ব ও ভালোবাসার অভাব, প্রকৃত বন্ধুর অভাব। আমাদের উচিত উপযুক্ত সংস্কার করা, সকলকে প্রকৃত বন্ধুর সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত করা। কৃষ্ণ আমাদের পরম বন্ধু, যিনি সর্বদা আমাদের হৃদয়েই বাস করেন। সকলেরই তাঁর সঙ্গে যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এই হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন। মানুষ বিষন্নতায় ভুগছে তার কারণ হিংসা। সকল প্রকার অর্থনৈতিক উন্নয়ন, প্রযুক্তিগত উন্নতি এবং আধুনিক যন্ত্রপাতি যা আমরা অর্জন করেছি তা দ্বারা প্রকৃতপক্ষে আমরা কতটুকু অগ্রগতি অর্জন করতে পেরেছি। আমরা কী আদৌ মানুষের বসবাসের জন্য উপযুক্ত সমাজ বা গোষ্ঠী গড়ে তুলেছি? নাকি সমাজটাকে আরো বেশি কঠিন করে তুলেছি।
তািই আমাদের জানা উচিত, আত্মা প্রকৃতিগতভাবে আনন্দের সন্দান করে। আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার চিরন্তন সম্পর্ক রয়েছে। যিনি আত্মাকে অপ্রাকৃত আনন্দ সমুদ্রে অবগাহন করাতে পারেন, তিনিই জীবের শ্রেষ্ঠ বন্ধু, পরম বন্ধু, তিনি হলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণ, ভগবান রাম। কিন্তু তাঁর পরিবর্তে আমরা সম্পর্ক তৈরি করছি ইন্টারনেটের সঙ্গে।
২০০০ সালে সারাবিশ্বে ৪১৩ মিলিয়ন লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করতো, আর বর্তমানে সারাবিশ্বে ৪.৬ বিলিয়ন লোক ইন্টারনেট ব্যবহার করছে। ৬.৪ লক্ষ লোক প্রতিদিন প্রথমবারে মতো অনলাইন ব্যবহার শুরু করছে। কমপক্ষে ২৫% যুবক রয়েছে যারা এর দ্বারা প্রভাবিত। এতে করে পারিবারিক সমস্যা বন্ধু বান্ধব আত্মীয় স্বজনের সাথে সময় কাটানোর মায়া অনেক কমে গেছে। গড়ে সপ্তাহে ১ জন লোক ১০ ঘন্টা ইন্টারনেটের পেছনে সময় ব্যয় করছে। ইন্টারনেট প্রবেশকারী ৩১% মানুষ পর্নোপ্রাফি সাইটগুলোতে প্রবেশ করে এবং সারাবিশ্বে ২,০০০ লোক প্রতি সেকেন্ডে পর্নোগ্রাফী সাইটে প্রবেশ করে। এই পর্নোগ্রাফির জন্য ৩০০০ মার্কিন ডলার ব্যয় করা হয় প্রতি সেকেন্ডে। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে প্রতিদিন ৩৭টি করে নতুন পর্নোগ্রাফ ভিডিও তৈরি করা হয় এবং ২.৫ বিলিয়ন ই-মেইল বিনিময় করা হয়, যার মধ্যে অশ্লীল বিষয়বস্তু থঅকে।
এর দ্বারা আমরা কী বুঝি? আমরা বুঝি, একটি গোষ্ঠী চরমভাবে অতৃপ্ত, ধ্বংস উন্মুখী, যারা কোথাও আনন্দের সন্ধান করছে এবং জীবনের প্রকৃত অর্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে। বর্তমানে ডিভোর্স সংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে। ৬৫% ডিভোর্স হয়ে থাকে এই অশ্লীলতা জনিত সমস্যার কারণে।
তাই, আধুনিক সভ্যতার পাশাপাশি আমাদের কিছু প্রকৃত বন্ধু অনুসন্ধান করা প্রয়োজন। এই বন্ধুত্ব কেবল ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জারে লাইক, লাভ বা হাহা রিয়েক্টের জন্য নয়, জীবনের প্রকৃত উদ্দেশ্য লাভে যিনি অনেকটা ওয়ান স্টপ সল্যুশন এর মতো যিনি আমাদের সকল প্রত্যাশা পূর্ণ করতে পারেন।
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার পঞ্চম অধ্যায়ে বর্ণনা করেছেন, “সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি।” তার সঙ্গে নিত্যসম্বন্ধ স্থাপনের মাধ্যমে আমরা পরম শান্তি লাভ করতে পারি।--হরে কৃষ্ণ--
আরও পড়ুন
* আত্মা ও দেহের পার্থক্য এবং এবং আমাদের দুঃখের প্রকৃত কি?* সুখ অর্থে নয় সন্তুষ্টিতে
* মহাজন উপদেশ-শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ
*মহাজন উপদেশ-শ্রী যমরাজ
* জীবনে সাফল্য পেতে চান! তাহলে মেনে চলুন এই দশটি টিপস
* চানক্য পন্ডিতের অমূল্য বাণী যা আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে
* মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী
* মহাজন উপদেশ-শ্রীপ্রহ্লাদ মহারাজ
*মহাজন উপদেশ-শ্রী যমরাজ
* জীবনে সাফল্য পেতে চান! তাহলে মেনে চলুন এই দশটি টিপস
* চানক্য পন্ডিতের অমূল্য বাণী যা আমাদের জীবনকে পরিবর্তন করে দিতে পারে
* মহাভারতের ভগবান শ্রীকৃষ্ণের বাণী