জড় ভরত কে ছিলেন ও তার মহৎ চরিত্রের বর্ণনা
জড় ভরতের পরম মহৎ চরিত্র
শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন—“হে রাজন্, মহারাজ ভরত মৃগশরীর ত্যাগ করার পর এক অতি বিশুদ্ধ ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। আঙ্গিরস গোত্রে এক ব্রাহ্মণ ছিলেন। তিনি সমস্ত ব্রাহ্মণোচিত গুণাবলীতে পূর্ণরূপে গুণান্বিত ছিলেন।
তিনি তাঁর মন এবং ইন্দ্রিয় সংযত করেছিলেন এবং বৈদিক শাস্ত্রসমূহ অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি দান, সন্তোষ, সহিষ্ণুতা, বিনয়, বিদ্যা, অনসূয়া আদি সমস্ত গুণে গুণান্বিত ছিলেন। তিনি ছিলেন আত্মজ্ঞানী এবং ভগবানের সেবায় যুক্ত।
তিনি সর্বদা ভগবানের চিন্তায় সমাহিত থাকতেন। তাঁর জ্যেষ্ঠা পত্নীর গর্ভে তাঁরই মতো গুণসম্পন্ন নয়টি পুত্রের জন্ম হয়েছিল এবং তাঁর কনিষ্ঠা পত্নীর গর্ভে একটি যমজ পুত্র ও কন্যা জন্মগ্রহণ করেছিল।
তাদের মধ্যে পুত্রটি হচ্ছে পরম ভাগবত রাজর্ষিশ্রেষ্ঠ মহারাজ ভরত—যিনি মৃগশরীর পরিত্যাগ করে চরমে ব্রাহ্মণত্ব প্রাপ্ত হয়েছিলেন।”
“ভগবানের বিশেষ কৃপার ফলে, ভরত মহারাজ তাঁর পূর্বজন্মের কথা স্মরণ করতে পেরেছিলেন। ব্রাহ্মণের শরীর পাওয়া সত্ত্বেও, তিনি ভগবদ্বিমুখ আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের ভয়ে অত্যন্ত ভীত ছিলেন। তাদের সঙ্গপ্রভাবে পুনরায় অধঃপতন হতে পারে, এই আশঙ্কায় তিনি সর্বদা শঙ্কিত ছিলেন।
তার ফলে তিনি জনসাধারণের কাছে নিজেকে উন্মাদ, জড়, অন্ধ এবং বধিরের মতো প্রদর্শন করতেন, যাতে তারা তাঁর সাথে কথা বলার চেষ্টা না করে। এইভাবে তিনি অসৎসঙ্গ থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন।
অন্তরে তিনি সর্বদা ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের কথা চিন্তা করতেন এবং নিরস্তর ভগবানের মহিমা কীর্তন করতেন; তার ফলে তিনি কর্মবন্ধন থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। এইভাবে তিনি অসৎসঙ্গের প্রভাব থেকে নিজেকে রক্ষা করেছিলেন।”
“ব্রাহ্মণ পিতার মন সর্বদা তাঁর পুত্র জড় ভরতের প্রতি (ভরত মহারাজের প্রতি) স্নেহে পূর্ণ ছিল। তাই তিনি তাঁর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। জড় ভরত যেহেতু গৃহস্থ-আশ্রমে প্রবেশ করার অযোগ্য ছিলেন, তাই ব্রহ্মচর্য-আশ্রমের সমাপ্তি পর্যন্তই কেবল তাঁর সংস্কার সম্পাদন করা হয়েছিল।
জড় ভরতের অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর পিতা তাঁকে শৌচ, আচমন আদি কর্মের নিয়মসমূহ বিশেষভাবে শিক্ষা দিয়েছিলেন। তাঁর পিতা তাঁকে বৈদিক জ্ঞান সম্বন্ধে যথেষ্ট শিক্ষা দিলেও, জড় ভরত তাঁর সমক্ষে মূর্খের মতো আচরণ করতেন।
তিনি এইভাবে আচরণ করতেন, যাতে তাঁর পিতা তাঁকে শিক্ষা লাভের অযোগ্য মনে করে, তাঁকে শিক্ষা দিতে চেষ্টা না করেন। তিনি সম্পূর্ণ বিপরীতভাবে আচরণ করতেন। তাঁর পিতা তাঁকে মল ত্যাগের পর হাত ধোয়ার শিক্ষা দিলে, তিনি মলত্যাগের পূর্বে হাত ধুতেন।
কিন্তু তা সত্ত্বেও তাঁর পিতা তাঁকে বেদ অধ্যয়ন করাবার ইচ্ছা করে, বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতুতে প্রণব ও ব্যাহৃতি-সহ ত্রিপদী গায়ত্রী শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ঐ চার মাসেও তিনি তাঁকে তা শেখাতে পারলেন না।
জড় ভরতের ব্রাহ্মণ- পিতা তাঁকে তাঁর প্রাণতুল্য প্রিয় বলে মনে করে, তাঁর প্রতি অত্যন্ত আসক্ত ছিলেন। তিনি তাঁকে সুশিক্ষিত করার বাসনায় তাঁকে ব্রহ্মচর্য, ব্রত, শৌচ, বেদ অধ্যয়ন, নিয়ম, গুরুদেবের সেবা এবং অগ্নিযজ্ঞ করার বিধি শিক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন।
কিন্তু তাঁর সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছিল। তিনি হৃদয়ে যে আশা পোষণ করেছিলেন তা পূর্ণ হল না। অন্য সকলের মতো সেই ব্রাহ্মণও তাঁর গৃহের প্রতি আসক্ত ছিলেন এবং তাঁর স্মরণ ছিল না যে, একদিন তাঁকে মৃত্যুবরণ করতে হবে।
কিন্তু মৃত্যুর কখনও বিস্মৃতি হয় না। মৃত্যু যথা সময়ে আগমন দ্বারা আচ্ছাদিত থাকে। তাঁর কটিদেশে ছিল একটি অত্যন্ত মলিন বস্ত্র এবং অত্যন্ত মলিন হওয়ার ফলে, তাঁর যজ্ঞোপবীত ছিল কাল। ব্রাহ্মণ-কুলোদ্ভূত বলে তাঁকে বুঝতে পেরে, মানুষেরা তাঁকে ব্রহ্মবন্ধু আদি নামে সম্বোধন করত।
এইভাবে বিষয়াসক্ত ব্যক্তিদের দ্বারা অপমানিত এবং উপেক্ষিত হয়ে তিনি ইতস্তত বিচরণ করতেন। জড় ভরত কেবল আহারের জন্য কাজ করতেন। তাঁর বৈমাত্রেয় ভায়েরাও সেই সুযোগ নিয়ে, কেবল আহারের বিনিময়ে তাঁকে ক্ষেত্রের কাজে নিযুক্ত করেছিল।
কিন্তু শস্যক্ষেত্রে যে কিভাবে কাজ করতে হয় তা তিনি ভালভাবে জানতেন না। তিনি জানতেন না কোথায় মাটি ঢালতে হবে অথবা কোথায় ভূমি সমতল করতে হবে। তাঁর ভায়েরা তাঁকে খুদ, খইল, তুষ, গোকায় খাওয়া শস্য এবং রন্ধনপাত্রে লেগে থাকা গোড়া অন্ন খেতে দিত, কিন্তু তিনি কারও প্রতি কোন রকম বিদ্বেষভাব পোষণ না করে, তাই-ই অমৃতের মতো ভোজন করতেন।”
“সেই সময়, এক শূদ্রকুলোদ্ভূত দস্যুসর্দার পুত্র কামনায় ভদ্রকালীর কাছে নরপশু বলি দেওয়ার উদ্যোগ করেছিল। সেই দস্যুপতি বলি দেওয়ার জন্য একটি নরপশুকে ধরেছিল কিন্তু সে দৈবক্রমে বন্ধনমুক্ত হয়ে পলায়ন করে।
তখন সেই দস্যুপতি তার অনুগামীদের তাকে ধরে আনতে আদেশ দেয়। তারা সকলে চতুর্দিকে ধাবিত হয় কিন্তু কোথায়ও তাকে খুঁজে পায়নি। ভ্রমণ করতে করতে ঘোর অন্ধকারাচ্ছন্ন মধ্য রাত্রে তারা অকস্মাৎ শস্যক্ষেত্রে উপস্থিত হয়ে আঙ্গিরস কুলোদ্ভূত ব্রাহ্মণ-তনয় জড় ভরতকে একটি ঊর্ধ্ব আসনে উপবেশন করে মৃগ, বরাহ ইত্যাদি পশুদের থেকে শস্যক্ষেত্র রক্ষা করতে দেখতে পায়।
দস্যুপতির অনুচরেরা জড় ভরতকে সমস্ত লক্ষণযুক্ত নরপশু বলে বিবেচনা করে, সর্বতোভাবে বলির উপযুক্ত বলে মনে করে, তাঁকে দড়ি দিয়ে বেঁধে হর্ষোৎফুল্ল সহাস্য বদনে কালীর মন্দিরে নিয়ে গিয়েছিল। তারপর সেই সমস্ত দস্যুরা তাদের নরপশু বলি দেওয়ার কল্পিত বিধি অনুসারে জড় ভরতকে স্নান করিয়ে, নতুন বস্ত্র পরিয়ে, তাঁকে পশুযজ্ঞ অলঙ্কার, গন্ধতেল, তিলক, চন্দন এবং মালার দ্বারা বিভূষিত করেছিল।
তারা তাঁকে ভোজন করিয়ে কালীর সম্মুখে নিয়ে এসে ধূপ, দীপ মালা, লাজ, নবপল্লব, দুর্বাঙ্কুর, ফল এবং ফুল দিয়ে কালীর পূজা করেছিল। এইভাবে নরপশুকে বলি দেওয়ার পূর্বে তারা উচ্চ গীত, স্তুতি এবং মৃদঙ্গ, পণব ইত্যাদির উচ্চ নির্ঘোষের সঙ্গে প্রতিমার পূজা করেছিল।
এবং তারপর জড় ভরতকে প্রতিমার সামনে উপবেশন করিয়েছিল। তখন দস্যুদের মধ্যে একজন প্রধান পুরোহিতের ভূমিকা অবলম্বনপূর্বক জড় ভরতকে নরপশুতুল্য মনে করে আসবরূপে পান করার জন্য কালীর কাছে তাঁর রক্ত নিবেদন করার বাসনায় ভদ্রকালীর মন্ত্রে পবিত্রীকৃত ভয়ঙ্কর তীক্ষ্ণধার একটি খড়্গ গ্রহণ করে, জড় ভরতকে বলি দিতে উদ্যত হয়েছিল।
যে সমস্ত দস্যু-তস্করেরা ভদ্রকালীর পূজার আয়োজন করেছিল, তারা সকলেই ছিল অত্যন্ত নীচ প্রকৃতির এবং রজ ও তমোগুণের দ্বারা আচ্ছন্ন। তারা বহু ধনসম্পদ লাভের বাসনায় উন্মত্ত হয়ে, বৈদিক বিধান লঙ্ঘন করে ব্রাহ্মণ- কুলোদ্ভূত আত্ম-তত্ত্ববেত্তা জড় ভরতকে বলি দিতে উদ্যত হয়েছিল।
এইপ্রকার মানুষেরা সর্বদাই হিংসাত্মক আচরণে প্রবৃত্ত থাকে এবং তাই তারা জড় ভরতকে বলি দিতে চেষ্টা করার সাহস করেছিল। জড় ভরত ছিলেন সমস্ত জীবের পরম সুহৃৎ। তাঁর কোন শত্রু ছিল না এবং তিনি সর্বদা ভগবানের চিন্তায় মগ্ন ছিলেন।
তিনি সৎ ব্রাহ্মণ পিতার পুত্ররূপে জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং তিনি শত্রু হলেও অথবা আক্রমণকারী হলেও, তাঁকে হত্যা করা শাস্ত্রের বিধান অনুসারে নিষিদ্ধ। কোন অবস্থাতেই জড় ভরতকে হত্যা করার কোন কারণ ছিল না।
তাই ভদ্রকালী তা সহ্য করতে পারেননি। সেই সমস্ত পাপাচারী দস্যুরা পরম ভাগবত জড় ভরতকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছে দেখে, দেবী ভদ্রকালী সহসা প্রতিমা বিদীর্ণ করে স্বয়ং প্রকাশিতা হলেন। তাঁর শরীর প্রচণ্ড অসহ্য তেজে জ্বলছিল।
সেই অপরাধ সহ্য করতে অসহিষ্ণু হয়ে, ক্রোধাবেশে ভদ্রকালীর ভ্রূকুটি বেগে সঞ্চালিত হয়েছিল, তাঁর ভয়ঙ্কর কুটিল দাঁত বহির্গত হয়েছিল এবং তাঁর আরক্ত লোচন বিঘূর্ণিত হয়েছিল। এইভাবে তিনি তাঁর ভয়ঙ্কর রূপ প্রদর্শন করেছিলেন।
তিনি যেন সমগ্র জগৎ সংহার করার জন্য সেই প্রচণ্ড মূর্তি ধারণ করেছিলেন। বেদি থেকে লাফ দিয়ে নেমে এসে যে খড়গের দ্বারা সেই দস্যুরা জড় ভরতকে হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, সেই খড়গের দ্বারাই তিনি সেই সমস্ত দস্যু এবং তস্করদের মস্তক ছেদন করতে লাগলেন ।
তারপর তাদের গলদেশ থেকে রক্তরূপ যে অতি উষ্ণ মদ নির্গত হতে লাগল, তিনি ডাকিনী, যোগিনী ইত্যাদি তাঁর সহচরদের সঙ্গে তা পান করতে লাগলেন। অত্যধিক রক্তপানে উন্মত্ত হয়ে দেবী তখন তাঁর পার্ষদদের সঙ্গে উচ্চস্বরে গান এবং নৃত্য করতে শুরু করলেন এবং সেই সমস্ত দস্যুদের ছিন্ন মস্তকগুলি নিয়ে কন্দুক-ক্রীড়া করতে লাগলেন।
মহাপুরুষের প্রতি হিংসারূপ অপরাধের ফলে, অনিষ্টকারীকে উপরোক্তভাবে সর্বদা দণ্ডভোগ করতে হয়।”শ্রীল শুকদেব গোস্বামী তখন মহারাজ পরীক্ষিৎকে বললেন—“হে বিষ্ণুদত্ত, যাঁরা জানেন যে আত্মা দেহ থেকে ভিন্ন, যাঁরা হৃদয়গ্রন্থি থেকে মুক্ত, যাঁরা সর্বদা সমস্ত জীবের মঙ্গল সাধনে রত এবং যাঁরা কখনও কারোর অনিষ্ট চিন্তা করেন না, তাঁরা সর্বদাই সুদর্শন চক্রধারী পরমেশ্বর ভগবানের দ্বারা রক্ষিত হন।
মহাকালরূপে তিনি অসুরদের সংহার করেন এবং ভক্তদের রক্ষা করেন। ভক্তেরা সর্বদাই ভগবানের শ্রীপাদপদ্মের আশ্রয় গ্রহণ করেন। তাই সর্ব অবস্থাতেই, এমনকি শিরশ্ছেদন কাল উপস্থিত হলেও, তাঁরা অবিচলিত থাকেন। তাঁদের পক্ষে তা মোটেই আশ্চর্যজনক নয়।”
আরও পড়ুনঃ
* মহারাজ ভরতের চরিত্রকথা- শ্রীমদ্ভাগবত
* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব
* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা
* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন
* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার
* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?
* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়