মহারাজ ভরতের চরিত্রকথা

ভরত মহারাজের কাহিনী

 মহারাজ ভরতের কাহিনী


শ্রী শুকদেব গোস্বামী মহারাজ পরীক্ষিৎকে বললেন—“হে রাজন, মহারাজ ভরত ছিলেন মহাভাগবত। তিনি তাঁর পিতার সংকল্প অনুসারে, রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হয়ে পৃথিবী শাসন করতে শুরু করেছিলে।

 

তিনি তাঁর পিতার আদেশ অনুসারে, বিশ্বরূপের কন্যা পঞ্চজনীকে বিবাহ করেন। অহঙ্কার থেকে যেমন পঞ্চতন্মাত্রের উৎপত্তি হয়, তেমনই মহারাজ ভরত তাঁর পত্নী পঞ্চজনীর গর্ভে পাঁচটি পুত্র উৎপাদন করেছিলেন। 

 

তাঁর সেই পুত্রদের নাম ছিল সুমতি, রাষ্ট্রভূত, সুদর্শন, আবরণ এবং ধূম্রকেতু। পূর্বে এই বর্ষের নাম ছিল অজনাভ, কিন্তু মহারাজ ভরতের রাজত্বকাল থেকে তা ভারতবর্ষ নামে পরিচিত হয়।  

 

মহাজ্ঞানী মহারাজ ভরত সারা পৃথিবীর অধিপতি ছিলেন। স্বীয় কর্তব্য কর্মে পূর্ণরূপে রত থেকে তিনি অত্যন্ত সুন্দরভাবে প্রজাপালন করেছিলেন। তিনি তাঁর পিতা এবং পিতামহের মতো প্রজাবৎসল ছিলেন।

 

প্রজাদের স্ব-স্ব ধর্মে নিযুক্ত রেখে তিনি পৃথিবী শাসন করছিলেন। মহারাজ ভরত গভীর শ্রদ্ধা সহকারে বিভিন্ন প্রকার যজ্ঞ অনুষ্ঠান করেছিলেন। তিনি অগ্নিহোত্র, দর্শ, পূর্ণমাস, চাতুর্মাস্য, পশুযজ্ঞ (যে যজ্ঞে অশ্ব বলি দেওয়া হয়) এবং সোমযজ্ঞ (যেই যজ্ঞে সোমরস নিবেদন করা হয়) অনুষ্ঠান করেছিলেন।

 

কখনও কখনও এই সমস্ত যজ্ঞ পূর্ণরূপে এবং কখনও আংশিক রূপে সম্পাদন করা হয়েছিল। সমস্ত যজ্ঞই তিনি চাতুহোত্র বিধির দ্বারা নিষ্ঠা সহকারে সম্পাদন করেছিলেন। এইভাবে ভরত মহারাজ পরমেশ্বর ভগবানের আরাধনা করেছিলেন। 

 

বিভিন্ন যজ্ঞের প্রারম্ভিক কার্য সম্পাদন করার পর, মহারাজ ভরত তা ধর্মের নামে বাসুদেবকে নিবেদন করেছিলেন। অর্থাৎ, তিনি সমস্ত যজ্ঞ বাসুদেব শ্রীকৃষ্ণের প্রসন্নতা বিধানের জন্য অনুষ্ঠান করেছিলেন।

 

মহারাজ ভরত বিচার করেছিলেন যে, যেহেতু দেবতারা হচ্ছেন বাসুদেবের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ, তাই বৈদিক মন্ত্রে যে সমস্ত দেবতাদের বর্ণনা করা হয়েছে, তিনি তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন। 

 

এইভাবে চিন্তা করার ফলে মহারাজ ভরত কাম, ক্রোধ, লোভ আদি সমস্ত জড় কলুষ থেকে মুক্ত হয়েছিলেন। পুরোহিতেরা যখন যজ্ঞাগ্নিতে আহুতি প্রদান করার জন্য হবি গ্রহণ করতেন, তখন মহারাজ ভরত অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে হৃদয়ঙ্গম করতেন কিভাবে বিভিন্ন দেবতাদের উদ্দেশ্যে অর্পিত সেই সমস্ত আহুতি ভগবানের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে নিবেদন করা হচ্ছে। 

 

যেমন, ইন্দ্ৰ হচ্ছেন ভগবানের বাহু এবং সূর্য হচ্ছে তাঁর চক্ষু। এইভাবে মহারাজ ভরত জানতেন যে, বিভিন্ন দেবতাকে নিবেদিত আহুতি প্রকৃতপক্ষে ভগবান বাসুদেবের বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে নিবেদন করা হচ্ছে।”


“এইভাবে যজ্ঞ অনুষ্ঠানের দ্বারা পবিত্র হয়ে, মহারাজ ভরতের হৃদয় সম্পূর্ণরূপে নির্মল হয়েছিল। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর ভক্তি দিন দিন বর্ধিত হয়েছিল। বসুদেব-তনয় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ পরমাত্মারূপে এবং নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপে প্রকাশিত হন।  

 

যোগীরা তাঁদের হৃদয়াকাশে পরমাত্মারূপে তাঁর ধ্যান করেন, জ্ঞানীরা নির্বিশেষ ব্রহ্মরূপে তাঁর পূজা করেন এবং ভক্তরা পরমেশ্বর ভগবানরূপে তাঁর ভজনা করেন, যাঁর চিন্ময় রূপের বর্ণনা শাস্ত্রে করা হয়েছে। 

 

তাঁর শ্রীঅঙ্গ শ্রীবৎস, কৌস্তুভ মণি এবং বনমালায় ভূষিত এবং তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র, গদা এবং পদ্ম শোভা পায়। নারদাদি ভক্তরা সর্বদা তাঁদের হৃদয়ে তাঁর ধ্যান করেন।”


“নিয়তি মহারাজ ভরতের জড় ঐশ্বর্য ভোগের কাল এক কোটি বছর পর্যন্ত নির্ধারণ করেছিল। সেই নির্দিষ্ট সময় গত হলে, তিনি তাঁর পিতৃ-পিতামহের ধনসম্পদ তাঁর পুত্রদের মধ্যে ভাগ করে দিয়ে, সমস্ত ঐশ্বর্যের আগার স্বরূপ তাঁর পৈতৃক গৃহ পরিত্যাগ করে হরিদ্বারে, 

 

যেখানে শালগ্রাম শিলা পাওয়া যায়, সেই পুলহাশ্রমে গমন করেছিলেন। সেই পুলহাশ্রমে ভগবান শ্রীহরি আজও তাঁর ভক্তবাৎসল্যবশত তাঁর ভক্তদের গোচরীভূত হন এবং তাঁদের বাসনা পূর্ণ করেন। পুলহ আশ্রমে সর্বশ্রেষ্ঠ নদী গণ্ডকী প্রবাহিত। 

 

সেই নদীতে শালগ্রাম শিলা সেই সমস্ত স্থানকে পবিত্র করে। সেই শিলার প্রত্যেকের উপরে এবং নিম্নভাগে নাভিসদৃশ চিহ্ন বর্তমান। পুলহ আশ্রমের উপবনে মহারাজ ভরত একাকী বাস করে বিবিধ কুসুম, কিশলয়, তুলসী, গণ্ডকী নদীর জল, কন্দমূল, ফল প্রভৃতি বিবিধ নৈবেদ্যের দ্বারা ভগবান বাসুদেবের অর্চনা করতে লাগলেন। 

 

তার ফলে তাঁর হৃদয় সম্পূর্ণরূপে নির্মল হয়েছিল এবং তিনি জড় সুখভোগের বাসনা থেকে সম্পূর্ণরূপে মুক্ত হয়েছিলেন। সেই অবিচলিত অবস্থায় তিনি পরম সন্তোষ এবং পরাভক্তি লাভ করেছিলেন।”


“মহাভাগবত ভরত এইভাবে নিরন্তর ভগবানের সেবায় রত হয়েছিলেন। শ্রীকৃষ্ণের প্রতি তাঁর স্বাভাবিক প্রেম বর্ধিত হয়ে তাঁর হৃদয়কে দ্রবীভূত করেছিল। তার ফলে তাঁর আর নিত্যকৃত্যাদিতে উৎসাহ ছিল না।

 

তাঁর দেহে রোমাঞ্চ, পুলক প্রভৃতি প্রেমের লক্ষণসমূহ প্রকাশিত হতে লাগল। আনন্দাশ্রুর উদ্‌গমে তাঁর নয়নদ্বয়ের দৃষ্টি নিরুদ্ধ হয়েছিল। এইভাবে তিনি নিরন্তর ভগবানের অরুণ বর্ণ শ্রীপাদপদ্মের ধ্যান করতে লাগলেন। 

 

তখন তাঁর হৃদয়রূপ হ্রদ আনন্দরূপ জলে পূর্ণ হয়েছিল। তাঁর মন সেই আনন্দ হ্রদে নিমগ্ন হওয়ায়, তিনি যে ভগবানের সেবা করছেন, তা পর্যন্ত তিনি বিস্মৃত হয়েছিলেন। মহারাজ ভরত মৃগচর্মের বসন ধারণ করে, ত্রিসন্ধ্যা স্নান করার ফলে সিক্ত কুটিল জটা-কলাপে সুশোভিত হয়ে, সূর্যমণ্ডলে হিরণ্ময় নারায়ণকে ঋক্ মন্ত্রে আরাধনা করতেন এবং সূর্যের উদয়ের সময় নিম্নলিখিত শ্লোকের দ্বারা তাঁর বন্দনা করতেন।”


“পরমেশ্বর ভগবান শুদ্ধ সত্ত্বে অবস্থিত। তিনি সমগ্র ব্রহ্মাণ্ডকে আলোকিত করেন এবং ভক্তদের সমস্ত বাসনা পূর্ণ করেন। ভগবান তাঁর চিৎ-শক্তির দ্বারা এই ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন। 

 

ভগবান তাঁর বাসনা অনুসারে পরমাত্মা রূপে এই ব্রহ্মাণ্ডে প্রবেশ করেছেন এবং তাঁর বিভিন্ন শক্তির দ্বারা তিনি জড় সুখভোগের আকাঙ্ক্ষী সমস্ত জীবদের পালন করেন। বুদ্ধিবৃত্তি প্রদানকারী সেই ভগবানকে আমি আমার সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি।”

 

আরও পড়ুনঃ


* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব


* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা 


* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন 


* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার


* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?


* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়


* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য) 

 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url