আদর্শ সমাজ গঠন কিভাবে সম্ভম

 

আদর্শ সমাজ গঠনে চতুরাশ্রাম


আদর্শ সমাজ গঠন সম্ভন্ধে নারদ মুনি বললেন-“বিদ্যার্থীর কর্তব্য পূর্ণরূপে ইন্দ্রিয়-সংযম করার অভ্যাস করা। তার কর্তব্য বিনীতভাবে শ্রীগুরুদেবের প্রতি শ্রদ্ধা সহকারে সৌহার্দ্য পরায়ণ হওয়া এবং দাসবৎ আচরণ করা। 

 

এইভাবে মহান ব্রত সহকারে, কেবলমাত্র শ্রীগুরুদেবের হিতসাধনের জন্য ব্রহ্মচারীর গুরুকুলে বাস করা উচিত। প্রাতঃকালে এবং সায়ংকালে, উভয় সন্ধ্যায় সমাহিত চিত্তে মৌন হয়ে গায়ত্রী মন্ত্র জপ করে গুরু, অগ্নি, সূর্য এবং ভগবান শ্রীবিষ্ণুর উপাসনা করা ব্রহ্মচারীর কর্তব্য। 

 

শ্রীগুরুদেব আহ্বান করলে, তাঁর কাছ থেকে নিয়মিত বৈদিক মন্ত্র অধ্যয়ন করা উচিত এবং প্রতিদিন অধ্যয়নের প্রারম্ভে ও শেষে শ্রীগুরুদেবকে সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করা শিষ্যের কর্তব্য। 

 

ব্রহ্মচারীর কর্তব্য হস্তে কুশঘাস ধারণ করে শাস্ত্রের নির্দেশ অনুসারে মেখলা, মৃগচর্মের বসন, জটা, দণ্ড, কমণ্ডলু এবং উপবীত ধারণ করা। ব্রহ্মচারীর কর্তব্য সকালে ও সন্ধ্যায় ভিক্ষা সংগ্রহ করা এবং ভিক্ষালব্ধ সমস্ত বস্তু শ্রীগুরুদেবকে দান করা। 

 

গুরুদেব যদি আদেশ দেন, তা হলেই কেবল তার আহার করা উচিত; শ্রীগুরুদেব যদি তাকে আদেশ না দেন, তা হলে কখনও বা তার উপবাস করা উচিত।  

 

ব্রহ্মচারীর কর্তব্য সুশীল এবং নম্র হওয়া, পরিমিত আহার করা, অনলস এবং দক্ষ হওয়া, শ্রীগুরুদেব ও শাস্ত্রের নির্দেশে পূর্ণ শ্রদ্ধাপরায়ণ হওয়া, জিতেন্দ্রিয় হওয়া এবং স্ত্রী ও স্ত্রৈণদের সঙ্গে যতটুকু প্রয়োজন ততটুকুই ব্যবহার করা।


ব্রহ্মচারী অথবা যারা গৃহস্থ-আশ্রম গ্রহণ করেননি, তাঁদের কর্তব্য অত্যন্ত দৃঢ়তাপূর্বক স্ত্রীলোকদের সঙ্গে কথোপকথন অথবা স্ত্রীলোকদের বিষয়ে কথোপকথন পরিত্যাগ করা, কারণ ইন্দ্রিয়গুলি এতই বলবান যে, তা সন্ন্যাসীর মনকেও বিচলিত করে। 

 

গুরুপত্নী যদি যুবতী হন, তা হলে যুবক ব্রহ্মচারী তাঁর দ্বারা আপনার কেশ প্রসাধন, গাত্র মর্দন, স্নান এবং তৈল মর্দন আদি কার্য করাবে না। যুবতী স্ত্রী অগ্নির মতো এবং পুরুষ ঘৃতকুম্ভের মতো। তাই নিজের কন্যার সঙ্গেও নির্জনে অবস্থান করা উচিত নয়। 

 

তেমনই, অনির্জন স্থানে অন্য সময়ে যতটুকু প্রয়োজন কেবল ততটুকুই তাদের সাথে সঙ্গ করা উচিত। জীব যতক্ষণ পর্যন্ত পূর্ণরূপে তার স্বরূপ উপলব্ধি না করে-যতক্ষণ পর্যন্ত তার দেহাত্মবুদ্ধির যে ভ্রান্ত ধারণা, যা তার মূল শরীর এবং ইন্দ্রিয়ের প্রতিবিম্ব মাত্র, তা থেকে মুক্ত না হয়-ততক্ষণ পর্যন্ত স্ত্রী এবং পুরুষরূপে যে দ্বৈতভাব প্রতিভাত হয়, তা থেকে সে মুক্ত হতে পারে না। 

 

এইভাবে তার বুদ্ধি মোহগ্রস্ত হওয়ার ফলে অধঃপতনের সমূহ সম্ভাবনা থাকে। সমস্ত বিধি-বিধানগুলি গৃহস্থ এবং সন্ন্যাসী উভয়েরই পালনীয়। তবে, গৃহস্থের পক্ষে সন্তান উৎপাদনের জন্য অনুকূল সময়ে গুরুদেব মৈথুনকার্যে লিপ্ত হওয়ার অনুমতি দেন। 

 

উপরোক্ত বর্ণনা অনুসারে ব্রহ্মচর্য-ব্রত ধারণকারী ব্রহ্মচারী অথবা গৃহস্থদের অঞ্জন, তৈললেপন, গাত্রমর্দন, স্ত্রীদর্শন, স্ত্রীলোকের চিত্র অঙ্কন, আমিষ আহার, সুরাপান, পুষ্পমাল্যের দ্বারা দেহসজ্জা, গন্ধ অনুলেপন অথবা অলঙ্কার ধারণ ত্যাগ করা উচিত। 

 

দ্বিজ অর্থাৎ ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় অথবা বৈশ্যের কর্তব্য পূর্বোক্ত নিয়ম অনুসারে গুরুকুলে বাস করে বেদাঙ্গ এবং উপনিষদ সহ বৈদিক শাস্ত্রসমূহ যথাশক্তি এবং ক্ষমতা অনুসারে অধ্যয়ন করা। যদি সম্ভব হয়, তা হলে শিষ্যের কর্তব্য শ্রীগুরুদেবের ইচ্ছা অনুসারে তাঁকে দক্ষিণা দিয়ে তাঁর অনুমতি গ্রহণ করে, নিজের বাসনা অনুসারে গৃহস্থ, বানপ্রস্থ অথবা সন্ন্যাস আশ্রম গ্রহণ করা। 

 

মানুষের কর্তব্য অগ্নি, গুরুদেব, আত্মা এবং সমস্ত জীবে সর্ব অবস্থাতেই অধোক্ষজ ভগবান শ্রীবিষ্ণুকে যুগপৎ প্রবিষ্ট এবং অপ্রবিষ্টরূপে দর্শন করা। তিনি সব কিছুর পূর্ণ নিয়ন্তারূপে অন্তরে এবং বাইরে অবস্থিত। 

 

এইভাবে অনুশীলন করার ফলে ব্রহ্মচারী, গৃহস্থ, বানপ্রস্থ অথবা সন্ন্যাসী সর্বত্র ভগবানের উপস্থিতি উপলব্ধি করে পরম ব্রহ্মকে হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন।" “হে রাজন, আমি এখন বানপ্রস্থ-আশ্রম অবলম্বীর গুণাবলী বর্ণনা করব। 

 

নিষ্ঠা সহকারে বানপ্রস্থ-আশ্রমের এই বিধি-বিধানগুলি পালন করার ফলে, মানুষ মুনিদের উচ্চতর গ্রহলোক মহর্লোক প্রাপ্ত হয়। বানপ্রস্থ আশ্রমীর ভূমি কর্ষণের দ্বারা উৎপন্ন শস্য আহার করা উচিত নয়।

 

অকর্ষণোৎপন্ন অপক্ক শস্যও আহার করা উচিত নয়। তাঁর পক্ষে অগ্নিপক্ক শস্য গ্রহণ করা উচিত নয়। বস্তুতপক্ষে, সূর্যকিরণের দ্বারা পক্ক ফলই কেবল তাঁর আহার্য। বানপ্রস্থীর কর্তব্য জঙ্গলে স্বাভাবিকভাবে উৎপন্ন হয়েছে যে ফল এবং অন্ন, তা দিয়ে তৈরি পুরোডাশ (পিষ্টক) যজ্ঞে নিবেদন করা। 

 

নতুন নতুন অন্ন প্রাপ্ত হলে, তাঁর কর্তব্য সংগৃহীত পুরাতন অন্ন পরিত্যাগ করা। বানপ্রস্থাবলম্বীর কর্তব্য, কেবল পবিত্র অগ্নি রাখার জন্য পর্ণ কুটির অথবা পর্বত গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করা। কিন্তু তিনি স্বয়ং হিম, বায়ু, অগ্নি, বর্ষা এবং সূর্যকিরণ সহ্য করবেন। 

 

বানপ্রস্থ-আশ্রম অবলম্বীর কর্তব্য জটাধারী হয়ে কেশ, রোম, শ্মশ্রু বর্ধিত হতে দেওয়া। তাঁর শরীরের ময়লা পরিষ্কার করা উচিত নয়। তাঁর উচিত, কমণ্ডলু, মৃগচর্ম, দণ্ড, বল্কল এবং অগ্নিবর্ণ পরিচ্ছদ ধারণ করা। 

 

বানপ্রস্থ-আশ্রমের কর্তব্য অত্যন্ত মননশীল হয়ে বারো বছর, আট বছর, চার বছর, দুবছর, অথবা অন্ততপক্ষে এক বছর বনে থাকা। তাঁর এমনভাবে আচরণ করা উচিত যাতে তিনি অত্যধিক তপস্যার ফলে বিচলিত অথবা ক্লিষ্ট না হন। 

 

যখন তিনি ব্যাধি অথবা বার্ধক্যবশত আধ্যাত্মিক চেতনায় উন্নতি সাধনের জন্য নিজের কর্তব্য কর্ম অনুষ্ঠানে অথবা বেদ অধ্যয়নে অক্ষম হবেন, তখন কোন আহার গ্রহণ না করে তাঁর অনশন করা উচিত।  

 

তাঁর কর্তব্য আত্মাতে অগ্নি যথাযথভাবে স্থাপন করে, দেহাত্মবুদ্ধির কারণ দেহের মমতা পরিত্যাগপূর্বক জড় দেহকে ধীরে ধীরে পঞ্চ-মহাভুতে (মাটি, জল, আগুন, বায়ু এবং আকাশে) লীন করে দেওয়া।" 

 

"সংযত এবং পূর্ণরূপে আত্মতত্ত্ববিদ ব্যক্তির কর্তব্য, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ তাদের মূল উৎসে বিলীন করে দেওয়া। দেহের ছিদ্রগুলি আকাশ থেকে, নিঃশ্বাস বায়ু থেকে, দেহের তাপ অগ্নি থেকে, শুক্র, শোণিত ও শ্লেষ্মা জল থেকে এবং ত্বক, পেশী, অস্থি আদি কঠিন বস্তুগুলি মাটি থেকে উৎপন্ন হয়েছে। 

 

এইভাবে দেহের বিভিন্ন অবয়ব বিভিন্ন উপাদান থেকে উৎপন্ন হয়েছে এবং তাই তাদের পুনরায় সেই উপাদানগুলিতে বিলীন করে দেওয়া উচিত। তারপর, বাক্যের সঙ্গে বাক্ ইন্দ্রিয়কে (জিহ্বা) অগ্নিতে সমর্পণ করা উচিত। 

 

শিল্প সহ হস্তদ্বয় ইন্দ্রদেবকে অর্পণ করা উচিত। গতি সহ পদদ্বয় বিষ্ণুকে নিবেদন করা উচিত। রতি সহ উপস্থ প্রজাপতিকে নিবেদন করা উচিত। বিসর্গ সহ পায়ুকে মৃত্যুতে অর্পণ করা উচিত। শব্দসহ শ্রবণেন্দ্রিয়কে দিক সমূহের অধিপতি দেবতাদের নিবেদন করা উচিত। 

 

স্পর্শ সহ ত্বক ইন্দ্রিয় বায়ুকে অর্পণ করা উচিত। দৃষ্টিশক্তি সহ রূপ সূর্যকে অর্পণ করা উচিত। বরুণ সহ জিহ্বাকে জলে এবং অশ্বিনীকুমারদ্বয় সহ ঘ্রাণকে ভূমিতে অর্পণ করা উচিত। জড় বাসনা সহ মনকে চন্দ্রদেবে লীন করা উচিত। 

 

বৌধ্য বিষয় সহ বুদ্ধি ব্রহ্মাকে অর্পণ করা উচিত। দেহাত্মবুদ্ধি এবং দেহ সম্পর্কিত বস্তুতে মমতা উৎপাদনকারী অহঙ্কার সহ কর্মসমূহকে অহঙ্কারের দেবতা রুদ্রদেবে লীন করে দেওয়া উচিত। 

 

চেতনা সহ চিত্তকে ক্ষেত্রজ্ঞ জীবে লীন করে দেওয়া উচিত এবং বিকার প্রাপ্ত জীব সহ প্রকৃতির গুণের অধীন দেবতাদের পরম পুরুষে লীন করে দেওয়া উচিত। পৃথিবীকে জলে, জলকে তেজে, তেজকে বায়ুতে, বায়ুকে সমগ্র জড় শক্তি স্বরূপ আকাশে, আকাশকে অহঙ্কারে, অহঙ্কারকে মহত্তত্ত্বে, মহত্তত্ত্বকে প্রধানে এবং অবশেষে প্রধানকে পরমাত্মায় লীন করে দেওয়া উচিত। 

 

এইভাবে যখন সমস্ত জড় উপাধি তাদের জড় উপাদানে লীন হয়ে যায়, তখন পূর্ণ চিন্ময় জীব পরম পুরুষের সঙ্গে গুণগতভাবে এক হওয়ার ফলে তার জড় অস্তিত্ব থেকে বিরত হবে, ঠিক যেমন কাঠ দগ্ধ হয়ে গেলে আর তখন অগ্নিশিখা থাকে না। জড় দেহ যখন বিভিন্ন জড় উপাদানে লীন হয়ে যায়, তখন কেবল চিন্ময় আত্মাই অবশিষ্ট থাকে। এই চিন্ময় জীব হচ্ছে ব্রহ্ম এবং সে পরব্রহ্মের সঙ্গে গুণগতভাবে এক।"

আরও পড়ুনঃ


* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব


* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা 


* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন 


* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার


* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?


* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়


* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য) 
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url