সমুদ্র মন্থনে দেবতা এবং অসুরদের সন্ধি

 

 দেবতা এবং অসুরদের সন্ধি


শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন-"হে মহারাজ পরীক্ষিৎ, ভগবান শ্রীহরি এইভাবে দেবতা এবং ব্রহ্মার দ্বারা তাঁদের স্তবের মাধ্যমে পূজিত হয়ে, তাঁদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তাঁর অঙ্গজ্যোতি হাজার হাজার সূর্যের উদয়ের মতো উজ্জ্বল। 

 

ভগবানের সেই  অঙ্গজ্যোতির ছটায় দেবতাদের দৃষ্টি প্রতিহত হয়েছিল। তাই তাঁরা আকাশ, দিকসমূহ, পৃথিবী, এমন কি নিজেদেরও দেখতে সমর্থ হলেন না, অতএব তাঁদের সম্মুখে উপস্থিত ভগবানকে দর্শন করবেন কি করে? 

 

শিব সহ ব্রহ্মা ভগবানের নির্মল সৌন্দর্য দর্শন করেছিলেন। তাঁর অঙ্গকান্তি মরকত মণির মতো শ্যামবর্ণ, তাঁর চক্ষু পদ্মগর্ভের মতো অরুণবর্ণ, তাঁর রেশমের বসন তপ্তকাঞ্চনের মতো পীতবর্ণ এবং তাঁর সারা শরীর অত্যন্ত সুন্দরভাবে অলঙ্কৃত। 

 

তাঁরা তাঁর প্রসন্ন ও মনোহর হাসি, সুন্দর পদ্মমুখশ্রী এবং বহু মূল্যবান মণিখচিত মুকুট দর্শন করেছিলেন। ভগবানের ভ্রূযুগল অত্যন্ত মনোহর এবং তাঁর কপোলদ্বয় কর্ণকুণ্ডলের দ্বারা বিভূষিত। ব্রহ্মা এবং শিব দেখেছিলেন ভগবানের কোমরে কাঞ্চী, হস্তে বলয়, বক্ষে হার এবং চরণে নূপুর।  

 

তিনি ফুলমালায় ভূষিত, তাঁর কণ্ঠে কৌস্তুভ মণি শোভা পাচ্ছে এবং তিনি বক্ষঃস্থলে লক্ষ্মীদেবীকে ধারণ করেছেন। তিনি সুদর্শন চক্র, গদা আদি স্বীয় অস্ত্রে সজ্জিত। শিব এবং অন্যান্য দেবতাগণ সহ ব্রহ্মা এইভাবে ভগবানকে দর্শনপূর্বক তাঁদের সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করে তখন ভূমিতে নিপতিত হয়েছিলেন।"


শ্রীব্রহ্মা বললেন-“আপনি যদিও অজ তবুও অবতাররূপে আপনার আবির্ভাব এবং তিরোভাবের কখনও নিবৃত্তি হয় না। আপনি সর্বদাই জড়া প্রকৃতির গুণ থেকে মুক্ত এবং আপনি চিন্ময় আনন্দের সমুদ্র সদৃশ। আপনার অপ্রাকৃত শাশ্বত রূপ সূক্ষ্মতম থেকেও সূক্ষ্মতর। সেই অচিন্ত্য আপনাকে আমরা আমাদের সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করি। হে পুরুষশ্রেষ্ঠ বিধাতা,


শ্রেয়ষ্কামী ব্যক্তিরা বৈদিক তন্ত্র অনুসারে সর্বদা আপনার এই মূর্তির পূজা করেন। হে প্রভু, আমরা আপনার মধ্যে সমগ্র ত্রিভুবন দর্শন করতে পারি। হে ভগবান, আপনি পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র। আপনার থেকে এই জড় জগৎ প্রকাশিত হয়েছে, আপনাকে আশ্রয় করেই তা বিরাজ করে এবং চরমে তা আপনাতেই লীন হয়ে যায়। 

 

আপনিই সব কিছুর আদি, মধ্য এবং অন্ত, ঠিক যেমন মাটি হচ্ছে ঘটের কারণ ও আশ্রয় এবং অবশেষে সেই ঘট ভেঙ্গে গেলে তা আবার মাটিতেই মিশে যায়। হে ভগবান, আপনি আপনাতে সম্পূর্ণরূপে স্বতন্ত্র এবং আপনি অন্য কারও সাহায্য গ্রহণ করেন না। 

 

আপনার নিজের শক্তির দ্বারা আপনি এই জড় জগৎ সৃষ্টি করেছেন এবং তাতে প্রবেশ করেছেন। যাঁরা কৃষ্ণভাবনামৃতের • উন্নত জ্ঞানসম্পন্ন, যাঁরা পূর্ণরূপে শাস্ত্রতত্ত্ব অবগত এবং যাঁরা ভক্তিযোগের অনুশীলনের দ্বারা সমস্ত জড় কলুষ থেকে নির্মল হয়েছেন, 

 

তাঁরা তাঁদের শুদ্ধ অন্তঃকরণে দর্শন করতে পারেন যে, যদিও আপনি জড় গুণের রূপান্তরের ভিতর অবস্থান করেন, তবুও আপনি জড়া প্রকৃতির স্পর্শরহিত। 

 

যেভাবে কাষ্ঠ থেকে অগ্নি, গাভী থেকে দুগ্ধ, ভূমি থেকে অন্ন ও জল এবং উদ্যোগ থেকে জীবিকা প্রাপ্ত হয়, তেমনই ভক্তিযোগের অনুশীলনের দ্বারা এই জড় জগতেও আপনার অনুগ্রহ লাভ করা যায় অথবা বুদ্ধির দ্বারা আপনাকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। পুণ্যাত্মা ব্যক্তিগণ সেই কথা বলে গেছেন। 

 

দাবাগ্নি পীড়িত হস্তীগণ যেমন গঙ্গার জল প্রাপ্ত হয়ে অত্যন্ত সুখী হয়, তেমনই, হে পদ্মনাভ ভগবান, যেহেতু এখন আপনি আমাদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়েছেন, তাই আমরা দিব্য আনন্দ অনুভব করছি।

 

 আমরা দীর্ঘকাল ধরে আপনার দর্শনের আকাঙক্ষী ছিলাম, কিন্তু এখন আপনাকে দর্শন করে আমাদের জীবনের চরম উদ্দেশ্য সাধিত হয়েছে। হে ভগবান, আমরা এই ব্রহ্মাণ্ডের লোকপাল সমস্ত দেবতাগণ আপনার শ্রীপাদপদ্মে উপস্থিত হয়েছি। 

 

যে অষ্টম স্ব উদ্দেশ্য সাধনের জন্য আমরা এখানে এসেছি, তা আপনি এ দয়া করে চরিতার্থ করুন। আপনি অন্তরে এবং বাইরে ত সব কিছুর সাক্ষী। আপনার অজ্ঞাত কিছুই নেই এবং ভ তাই আপনাকে পুনরায় বলার কোন প্রয়োজন নেই। 

 

আমি (ব্রহ্মা), শিব এবং অন্যান্য দেবতাগণ ও দক্ষ আদি প্রজাপতিগণ অগ্নির স্ফুলিঙ্গের মতো আপনার থেকে প্রকাশিত। যেহেতু আমরা আপনার অংশ, তাই আমাদের মঙ্গল সম্বন্ধে আমরা কি বুঝতে পারি? হে ভগবান, দয়া করে ব্রাহ্মণ এবং দেবতাদের উপযুক্ত মুক্তির উপায় আপনি আমাদের প্রদান করুন।"


শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন-"ব্রহ্মা আদি দেবতারা যখন এইভাবে ভগবানের স্তব করলেন, তখন ভগবান তাঁদের অভিপ্রায় জানতে পেরেছিলেন। তাই তিনি মেঘগম্ভীর বাক্যে বদ্ধাঞ্জলি এবং সংযত-ইন্দ্রিয় দেবতাদের বললেন। 

 

যদিও দেবতাদের ঈশ্বর ভগবান একাই দেবতাদের কার্যকলাপ সম্পন্ন করতে সমর্থ ছিলেন, তবুও, সমুদ্রমন্থন লীলা উপভোগ করার ইচ্ছা করে তিনি তাঁদের বলেছিলেন, 'হে ব্রহ্মা, হে শিব, হে দেবতাগণ, গভীর মনোযোগ সহকারে আমার বাক্য শ্রবণ কর, কারণ আমি যা বলছি তার ফলে তোমাদের শ্রেয় লাভ হবে। 

 

যতক্ষণ তোমাদের সমৃদ্ধি না হয়, ততক্ষণ তোমরা কালের দ্বারা অনুগৃহীত দৈত্য এবং দানবদের সঙ্গে সন্ধি স্থাপন কর। হে দেবতাগণ, নিজের হিতসাধন করা এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, সেই জন্য শত্রুর সঙ্গেও সন্ধি স্থাপন করতে হয়। 

 

নিজের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য সর্প-মূষিক ন্যায় অনুসারে কার্য করতে হয়। এখনই তোমরা অমৃত উৎপাদনের চেষ্টা কর, যা পান করলে মৃত্যুগ্রস্ত জীবও অমর হয়। হে দেবতাগণ, ক্ষীরসমুদ্রে সর্বপ্রকার গুল্ম, তৃণ, লতা ও ওষধী নিক্ষেপ করে মন্দার পর্বতকে মন্থনদণ্ড এবং বাসুকিকে মন্থনরজ্জু করে, আমার সাহায্যে তোমরা একাগ্রচিত্তে ক্ষীরসমুদ্র মন্থন কর।  

 

তার ফলে দৈত্যরা ক্লেশভাগী হবে, কিন্তু তোমরা দেবতারা ফলভাগী হয়ে সমুদ্রোত্থিত অমৃত লাভ করবে। হে দেবগণ, ধৈর্য এবং শান্তির দ্বারা সব কিছুই সিদ্ধ হয়, কিন্তু ক্রোধের দ্বারা হয় না। অতএব, অসুরেরা যা চাইবে, তোমরা তাই অনুমোদন করো। সমুদ্র থেকে কালকূট নামক বিষ উৎপন্ন হবে, কিন্তু তোমরা সেই বিষকে ভয় করো না


এবং সমুদ্র মন্থনের ফলে যখন বিভিন্ন বস্তু উৎপন্ন হবে, তখন সেগুলি লাভ করার জন্য লালায়িত হয়ো না এবং ক্রুদ্ধ হয়ো না।'”


শ্রীল শুকদেব গোস্বামী বললেন-"হে মহারাজ পরীক্ষিৎ! দেবতাদের এইভাবে উপদেশ দিয়ে, স্বচ্ছন্দগতি পুরুষোত্তম ভগবান তাঁদের সমক্ষেই অন্তর্হিত হলেন। তারপর ব্রহ্মা এবং শিব ভগবানকে তাঁদের সশ্রদ্ধ প্রণতি নিবেদন করে তাঁদের ধামে প্রত্যাবর্তন করেছিলেন। 

 

সমস্ত দেবতারা তখন বলি মহারাজের কাছে গিয়েছিলেন। দৈত্যদের অত্যন্ত মহান রাজা বলি কখন সন্ধি স্থাপন করতে হয় এবং কখন যুদ্ধ করতে হয়, সেই কথা খুব ভালভাবে জানতেন। তাই যদিও তাঁর সেনা নায়কেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে দেবতাদের হত্যা করতে উদ্যত হয়েছিল, কিন্তু মহারাজ বলি দেবতাদের যুদ্ধে অনুদ্যত দেখে, তাঁর সেনানায়কদের নিষেধ করেছিলেন। 

 

দেবতারা বিরোচনের পুত্র বলি মহারাজের সমীপে উপবেশন করেছিলেন। বলি মহারাজ তাঁর অসুর সেনাপতিদের দ্বারা সুরক্ষিত ছিলেন এবং ত্রিলোক বিজয় করার ফলে পরম ঐশ্বর্যশালী ছিলেন। মৃদু বাক্যের দ্বারা বলি মহারাজের প্রসন্নতা বিধান করে, মহামতি দেবরাজ ইন্দ্র ভগবান শ্রীবিষ্ণুর কাছ থেকে শিক্ষাপ্রাপ্ত সমস্ত প্রস্তাব অত্যন্ত বিনীতভাবে নিবেদন করেছিলেন। 

 

দেবরাজ ইন্দ্রের সেই প্রস্তাব বলি মহারাজ এবং তাঁর পার্ষদ শম্বর, অরিষ্টনেমি আদি ত্রিপুরবাসী সমস্ত অসুরদের রুচিকর হওয়ায়, তারা তৎক্ষণাৎ সেই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল।"


"হে শত্রুদমনকারী মহারাজ পরীক্ষিৎ, তারপর দেবতা এবং অসুরেরা পরস্পরের মধ্যে সৌহার্দ্য স্থাপন করেছিলেন। তারপর মহা উদ্যোগে তাঁরা ইন্দ্রের প্রস্তাব অনুসারে অমৃত উৎপাদনের আয়োজন করেছিলেন। 

 

তারপর অত্যন্ত শক্তিশালী অর্গলবাহু দেবতা এবং দানবেরা বলপূর্বক মন্দর পর্বত উৎপাটন করে সিংহনাদ করতে করতে ক্ষীরসমুদ্রে নিয়ে চলল। বহু দূর থেকে - সেই বিশাল পর্বত বহন করার ফলে, দেবরাজ ইন্দ্র, - মহারাজ বলি প্রভৃতি দেবতা এবং অসুরেরা অত্যন্ত  পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন। সেই পর্বত বহন করতে  অক্ষম এবং অবশ হয়ে তাঁরা তা পথিমধ্যে পরিত্যাগ  করেছিলেন। 

 

সেই মন্দর পর্বত স্বর্ণময় হওয়ার ফলে অত্যন্ত ভারী ছিল এবং তা পতিত হয়ে বহু দেবতা এবং দানবদের চূর্ণ করেছিল। দেবতা এবং দানবেরা তখন ভগ্নমনোরথ হয়েছিলেন এবং তাদের বাহু, ঊরু ও স্কন্ধ ভগ্ন হয়েছিল। 

 

তাই সর্বজ্ঞ ভগবান তখন গরুড়ে আরোহণ করে সেখানে আবির্ভূত হয়েছিলেন। পর্বতের পতনের ফলে অধিকাংশ দেবতা এবং দানবকে নিষ্পিষ্ট দর্শন করে ভগবান তাঁর দৃষ্টিপাতের দ্বারা তাদের পুনর্জীবিত করেছিলেন। এইভাবে তারা শোকমুক্ত


হয়েছিল এবং তাদের দেহ অক্ষত হয়েছিল। ভগবান তখন তাঁর এক হাতের দ্বারা অনায়াসে মন্দর পর্বত উত্তোলন করে গরুড়ের পিঠে স্থাপন করেছিলেন। তারপর তিনি নিজে তার উপর আরোহণ করে, দেবতা এবং দানবগণ পরিবৃত হয়ে ক্ষীরসমুদ্রে গমন করেছিলেন। তারপর, পক্ষীশ্রেষ্ঠ গরুড় মন্দর পর্বতকে জলের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন। তারপর ভগবানের আদেশ অনুসারে তিনি সেই স্থান ত্যাগ করেছিলেন।"

আরও পড়ুনঃ



* শ্রীমদ্ভাগবত বক্তা- শুকদেব গোস্বামীর আবির্ভাব


* মহাভারতের মহারাজ পরীক্ষিতের জন্ম কথা 


* কিভাবে পরীক্ষিৎ মহারাজ কলিযুগের সম্মুখীন হয়েছিলেন 


* পৃথিবীতে কলি যুগের শুরুর সময়-কলির দন্ড ও পুরুষ্কার


* আমাদের হৃদয়ে ভগবান কোথায় থাকেন?


* শুদ্ধ ভক্তি কি? কোন দেবতার পূজা করলে কি লাভ করা যায়


* বিষ্ণুর অবতার সমূহ (বিশিষ্ট কার্য সম্পাদনের জন্য) 

 


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url